চারদিক-মূকাভিনয়শিল্পীদের মিলনমেলায় by জাহিদ রিপন
মূকাভিনয়শিল্পীদের নিয়ে কি কারো ভাবনা আছে? আছে। আছে বলেই তো চট্টগ্রামে বসেছিল মূকাভিনেতাদের মিলনমেলা। এক যুবকের কথা বলি। এই যুবকটির স্বপ্ন ও সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় পেয়েছিলাম আগেই, যখন গত বছরের মার্চে তাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রামের মূকাভিনয় সংগঠন ‘প্যান্টোমাইম মুভমেন্ট’ আয়োজন করেছিল তিন দিনব্যাপী ‘প্রথম জাতীয় মূকাভিনয় উৎসব ও সেমিনার’-এর।
সে উৎসবে ঢাকা থেকে ‘স্বপ্নদল’ ও ‘পদাতিক নাট্য সংসদ’ এবং চট্টগ্রামের দুটি দল প্রযোজনা মঞ্চায়ন করেছিল। কিন্তু প্রথমবারের মতো এমন একটি উৎসব আয়োজন সত্ত্বেও তেমন কোনো ত্রুটি চোখে পড়েনি। ১৫ বছর ধরে একটি মূকাভিনয় সংগঠনকে সৃজন-উল্লাসে সজীব ও চলমান রাখা সহজসাধ্য নয়, সে ব্রতটি পালন করে যাচ্ছেন তিনি একনিষ্ঠভাবে। হ্যাঁ, প্যান্টোমাইম মুভমেন্টের কর্ণধার রিজোয়ান রাজনের কথাই বলছি। সম্প্রতি তাঁর উদ্যোগে দল থেকে প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশে মূকাভিনয়বিষয়ক প্রথম ও একমাত্র পত্রিকা প্যান্টোমাইম। আর এ পত্রিকার আয়োজনেই চট্টগ্রামে ৬ থেকে ৯ মে অনুষ্ঠিত হলো ‘প্রথম জাতীয় মূকাভিনয় কর্মী সম্মেলন ২০১০’।
যে দেশে মূকাভিনয়ের ব্যাপক চর্চা নেই, মূকাভিনয় শিক্ষার জন্য কোনো শিক্ষায়তন নেই, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোনো নাট্যোৎসবেই মূকাভিনয় প্রযোজনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় না, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নাট্যদলের জন্য মিলনায়তন ভাড়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য রেয়াতও মূকাভিনয় দলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না, নাট্যকর্মী-নৃত্যকর্মী-উপস্থাপনা কর্মী, মডেল যখন তাঁর নিজের শিল্পক্ষেত্রে মূকাভিনয়ের আবশ্যকতা অনুধাবনে ব্যর্থ এবং সর্বোপরি মূকাভিনয়কে কেবল মুখে ‘চুনকালি’ মাখানো শিল্প বলে মনে করা হয়, সেখানে মূকাভিনয়কর্মীদের সম্মেলন? সুতরাং টেলিফোনে রাজনের আমন্ত্রণ পেয়ে বিস্মিত হয়েছিলাম।
ঔৎসুক্য নিয়ে তাই ৭ মে ভোরে চট্টগ্রামে পৌঁছি, সঙ্গে স্বপ্নদলের ১২ জন মূকাভিনয়যোদ্ধা। অবশ্য আগের দিনই শিল্পকলা একাডেমীতে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনের উদ্বোধন করেছেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। সঙ্গে ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আফসার আহমদ প্রমুখ। জানতে পেরেছি, তাঁরা বাংলাদেশে মূকাভিনয়শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক সম্ভাবনার কথা বলেছেন।
এদিন সকালে ‘বাঙালির মূকাভিনয়, বাংলার মূকাভিনয়’ শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনার দায়িত্ব ছিল আমার। প্রবন্ধে বলা হয়েছিল, ইতিহাসে প্রাচীন রোমকে ‘প্যান্টোমাইম’ বা মূকাভিনয়ের সৃজন স্থান এবং রোমান ক্রীতদাস লিভিয়াস অ্যান্ড্রোনিকাসকে ‘মূকাভিনয়ের জনক’ বলা হলেও যেসব উৎস থেকে রোমে এ বিশিষ্ট শিল্পরীতিটি গড়ে উঠেছিল, তার অনুরূপ কিংবা তার চেয়ে বেশি উৎস প্রাচীনকাল থেকে বাংলা অঞ্চলেও ছিল। কিন্তু নানাবিধ কারণে সেসব উৎসের স্বাভাবিক বিকাশের মাধ্যমে ‘বাংলা মূকাভিনয়রীতি’ গড়ে ওঠেনি। তাই উপনিবেশ-উত্তরকালে বাংলার নানাবিধ কৃত্যমূলক অনুষ্ঠান, উপাচার, পালা-পার্বণ, লোকাচার, মেলা-উৎসব, বহুরূপী সঙ তথা রামায়ণ-মহাভারতের উপস্থাপনায় প্রচলিত ‘গ্রন্থিক-শৌভিক’-এর ধারাবাহিকতায় বাংলার নিজস্ব, স্বতন্ত্র মূকাভিনয় আঙ্গিক নির্মাণের যৌক্তিকতা, সম্ভাবনা ও সম্ভাব্য প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। নির্ধারিত আলোচক ড. আফসার আহমদ, ড. ইস্রাফিল আহমেদ, অধ্যাপক অরূপ বড়ুয়া, অধ্যাপক মসিউর রহমান আদনানসহ মূকাভিনয়কর্মীদের আলোচনা-সমালোচনা-প্রশ্নোত্তর প্রভৃতির মধ্য দিয়ে সেমিনারটি ‘একমত’, দ্বিমত’ এবং ধারাবাহিকতায় ‘সহমত’ বা ‘তৃতীয় মত’-এর যথার্থ উদাহরণ হয়ে ওঠে।
এবারের প্রথম জাতীয় মূকাভিনয় কর্মী সম্মেলনের স্লোগান ‘বদলে দেবে শতাব্দী নির্মল বাতাস, সবুজ বনানী’-এর সমান্তরালে সব আয়োজনেই জলবায়ু পরিবর্তন বা পরিবেশ বিপর্যয় সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস ছিল। সারা দেশ থেকে এখানে জমায়েত হয়েছিল ১১টি মূকাভিনয় চর্চারত দল—ঢাকার স্বপ্নদল ও মাইম আর্ট, গাজীপুরের মুক্তমঞ্চ নির্বাক দল, বরিশালের ব্রজমোহন থিয়েটার, বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের পানগুছি থিয়েটার, চট্টগ্রামের প্যান্টোমাইম মুভমেন্ট, অনাদিকল্প, ভিশন প্যান্টোমাইম, কিডস কালচারাল ইনস্টিটিউট ও বিটা। এসেছিলেন এককভাবে চর্চা করেন এমন কয়েকজন মূকাভিনয়শিল্পীও। প্রতিদিন বিকেল থেকে ছিল মূকাভিনয় পরিবেশনা। এ ছাড়া ছিল মুক্তনাটক, জীবনের গান আর আর্টক্যাম্প, যেখানে বেশ কয়েকজন চিত্রশিল্পী সার্বক্ষণিক অবস্থান করে পরিবেশ-সচেতনতামূলক চিত্রকর্ম তৈরি করেছেন।
সম্মেলনের আলোচনা থেকে উঠে আসে বাংলাদেশের মূকাভিনয়কর্মীদের একটি যৌথ প্লাটফর্ম বা মোর্চা সংগঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা এবং দীর্ঘ আলোচনা শেষে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে গঠন করা হয় বাংলাদেশ মূকাভিনয় ফেডারেশন। রিজোয়ান রাজনকে আহ্বায়ক করে আট সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটিও গঠন করা হয়। এ ছাড়া আগামী ডিসেম্বরে ঢাকায় মূকাভিনয় উৎসব, মূকাভিনয় কর্মী সম্মেলন, কর্মশালা, সেমিনার প্রভৃতি আয়োজনেরও পরিকল্পনা করা হয়।
চার দিনব্যাপী এ সম্মেলনে নানা অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে শিল্পকলার চত্বরজুড়ে চলেছে মূকাভিনয়কর্মীদের বর্ণাঢ্য আড্ডা। এতে সারা দেশের মূকাভিনয়কর্মীরা পরস্পরের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় আর মতবিনিময়ের সুযোগ পেয়েছেন। মূকাভিনয়কর্মীদের সম্মেলন এতই জমে ওঠে যে নবীন-প্রবীণ সবাই সেখানে স্বপ্ন আর অনুভূতি প্রকাশে ছিলেন সত্যিই অকৃপণ। তাই তো ব্রজমোহন থিয়েটারের তানিয়া, প্যান্টোমাইম মুভমেন্টের ফারুক, অনাদিকল্পর জুলকার নাইন অথবা স্বপ্নদলের নবীনতম সদস্য রহিমের চোখ-মুখে যে ভালো লাগার ‘আলো’ দেখি, তা আমাদের বাংলাদেশের মূকাভিনয়শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে সত্যিই আশাবাদী করে। ভনয়শিল্পীদের এ মিলনমেলা থেকে সে মুগ্ধতা আর দায়িত্ববোধ নিয়েই আমরা ফিরি ঢাকায়।
যে দেশে মূকাভিনয়ের ব্যাপক চর্চা নেই, মূকাভিনয় শিক্ষার জন্য কোনো শিক্ষায়তন নেই, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোনো নাট্যোৎসবেই মূকাভিনয় প্রযোজনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় না, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নাট্যদলের জন্য মিলনায়তন ভাড়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য রেয়াতও মূকাভিনয় দলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না, নাট্যকর্মী-নৃত্যকর্মী-উপস্থাপনা কর্মী, মডেল যখন তাঁর নিজের শিল্পক্ষেত্রে মূকাভিনয়ের আবশ্যকতা অনুধাবনে ব্যর্থ এবং সর্বোপরি মূকাভিনয়কে কেবল মুখে ‘চুনকালি’ মাখানো শিল্প বলে মনে করা হয়, সেখানে মূকাভিনয়কর্মীদের সম্মেলন? সুতরাং টেলিফোনে রাজনের আমন্ত্রণ পেয়ে বিস্মিত হয়েছিলাম।
ঔৎসুক্য নিয়ে তাই ৭ মে ভোরে চট্টগ্রামে পৌঁছি, সঙ্গে স্বপ্নদলের ১২ জন মূকাভিনয়যোদ্ধা। অবশ্য আগের দিনই শিল্পকলা একাডেমীতে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনের উদ্বোধন করেছেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। সঙ্গে ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আফসার আহমদ প্রমুখ। জানতে পেরেছি, তাঁরা বাংলাদেশে মূকাভিনয়শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক সম্ভাবনার কথা বলেছেন।
এদিন সকালে ‘বাঙালির মূকাভিনয়, বাংলার মূকাভিনয়’ শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনার দায়িত্ব ছিল আমার। প্রবন্ধে বলা হয়েছিল, ইতিহাসে প্রাচীন রোমকে ‘প্যান্টোমাইম’ বা মূকাভিনয়ের সৃজন স্থান এবং রোমান ক্রীতদাস লিভিয়াস অ্যান্ড্রোনিকাসকে ‘মূকাভিনয়ের জনক’ বলা হলেও যেসব উৎস থেকে রোমে এ বিশিষ্ট শিল্পরীতিটি গড়ে উঠেছিল, তার অনুরূপ কিংবা তার চেয়ে বেশি উৎস প্রাচীনকাল থেকে বাংলা অঞ্চলেও ছিল। কিন্তু নানাবিধ কারণে সেসব উৎসের স্বাভাবিক বিকাশের মাধ্যমে ‘বাংলা মূকাভিনয়রীতি’ গড়ে ওঠেনি। তাই উপনিবেশ-উত্তরকালে বাংলার নানাবিধ কৃত্যমূলক অনুষ্ঠান, উপাচার, পালা-পার্বণ, লোকাচার, মেলা-উৎসব, বহুরূপী সঙ তথা রামায়ণ-মহাভারতের উপস্থাপনায় প্রচলিত ‘গ্রন্থিক-শৌভিক’-এর ধারাবাহিকতায় বাংলার নিজস্ব, স্বতন্ত্র মূকাভিনয় আঙ্গিক নির্মাণের যৌক্তিকতা, সম্ভাবনা ও সম্ভাব্য প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। নির্ধারিত আলোচক ড. আফসার আহমদ, ড. ইস্রাফিল আহমেদ, অধ্যাপক অরূপ বড়ুয়া, অধ্যাপক মসিউর রহমান আদনানসহ মূকাভিনয়কর্মীদের আলোচনা-সমালোচনা-প্রশ্নোত্তর প্রভৃতির মধ্য দিয়ে সেমিনারটি ‘একমত’, দ্বিমত’ এবং ধারাবাহিকতায় ‘সহমত’ বা ‘তৃতীয় মত’-এর যথার্থ উদাহরণ হয়ে ওঠে।
এবারের প্রথম জাতীয় মূকাভিনয় কর্মী সম্মেলনের স্লোগান ‘বদলে দেবে শতাব্দী নির্মল বাতাস, সবুজ বনানী’-এর সমান্তরালে সব আয়োজনেই জলবায়ু পরিবর্তন বা পরিবেশ বিপর্যয় সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস ছিল। সারা দেশ থেকে এখানে জমায়েত হয়েছিল ১১টি মূকাভিনয় চর্চারত দল—ঢাকার স্বপ্নদল ও মাইম আর্ট, গাজীপুরের মুক্তমঞ্চ নির্বাক দল, বরিশালের ব্রজমোহন থিয়েটার, বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের পানগুছি থিয়েটার, চট্টগ্রামের প্যান্টোমাইম মুভমেন্ট, অনাদিকল্প, ভিশন প্যান্টোমাইম, কিডস কালচারাল ইনস্টিটিউট ও বিটা। এসেছিলেন এককভাবে চর্চা করেন এমন কয়েকজন মূকাভিনয়শিল্পীও। প্রতিদিন বিকেল থেকে ছিল মূকাভিনয় পরিবেশনা। এ ছাড়া ছিল মুক্তনাটক, জীবনের গান আর আর্টক্যাম্প, যেখানে বেশ কয়েকজন চিত্রশিল্পী সার্বক্ষণিক অবস্থান করে পরিবেশ-সচেতনতামূলক চিত্রকর্ম তৈরি করেছেন।
সম্মেলনের আলোচনা থেকে উঠে আসে বাংলাদেশের মূকাভিনয়কর্মীদের একটি যৌথ প্লাটফর্ম বা মোর্চা সংগঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা এবং দীর্ঘ আলোচনা শেষে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে গঠন করা হয় বাংলাদেশ মূকাভিনয় ফেডারেশন। রিজোয়ান রাজনকে আহ্বায়ক করে আট সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটিও গঠন করা হয়। এ ছাড়া আগামী ডিসেম্বরে ঢাকায় মূকাভিনয় উৎসব, মূকাভিনয় কর্মী সম্মেলন, কর্মশালা, সেমিনার প্রভৃতি আয়োজনেরও পরিকল্পনা করা হয়।
চার দিনব্যাপী এ সম্মেলনে নানা অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে শিল্পকলার চত্বরজুড়ে চলেছে মূকাভিনয়কর্মীদের বর্ণাঢ্য আড্ডা। এতে সারা দেশের মূকাভিনয়কর্মীরা পরস্পরের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় আর মতবিনিময়ের সুযোগ পেয়েছেন। মূকাভিনয়কর্মীদের সম্মেলন এতই জমে ওঠে যে নবীন-প্রবীণ সবাই সেখানে স্বপ্ন আর অনুভূতি প্রকাশে ছিলেন সত্যিই অকৃপণ। তাই তো ব্রজমোহন থিয়েটারের তানিয়া, প্যান্টোমাইম মুভমেন্টের ফারুক, অনাদিকল্পর জুলকার নাইন অথবা স্বপ্নদলের নবীনতম সদস্য রহিমের চোখ-মুখে যে ভালো লাগার ‘আলো’ দেখি, তা আমাদের বাংলাদেশের মূকাভিনয়শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে সত্যিই আশাবাদী করে। ভনয়শিল্পীদের এ মিলনমেলা থেকে সে মুগ্ধতা আর দায়িত্ববোধ নিয়েই আমরা ফিরি ঢাকায়।
No comments