দিল্লির চিঠি-শ্রীলঙ্কা বিষয়ে ভারতের নীতি by কুলদীপ নায়ার
শ্রীলঙ্কা বিষয়ে ভারতের নীতি যে কী। ভারত এখন শ্রীলঙ্কার সংখ্যালঘু তামিলদের এবং সংখ্যাগুরু সিংহলিদের মিলেমিশে থাকার কথা বলছে। অথচ অল্প কিছুদিন আগেও ফেডারেল কাঠামোর অধীনে প্রদেশগুলোর ক্ষমতা বৃদ্ধির পক্ষে ছিল ভারতের অবস্থান। পাশাপাশি বসবাস করা ছাড়া অন্য কোনো পথ দুই জনগোষ্ঠীর কারও জন্য খোলা নেই।
এত দিন তারা এভাবেই কাটিয়েছে। কিন্তু তামিলরা যাতে নিজেদের নাগরিক হিসেবে সমান মনে করার মতো আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে পারে, সে জন্য তাদের প্রতি সর্বস্তরে যে সংকীর্ণ আচরণ জারি আছে, তা আগে দূর করতে হবে।
ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণে প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের প্রতিশ্রুতিকে যথার্থ প্রমাণ করার জন্য তাঁর ওপর ভারতের চাপ প্রয়োগ করতে হবে। লিবারেশন টাইগারস অব তামিল ইলমের (এলটিটিই) বিরুদ্ধে লড়াই চলাকালেও শ্রীলঙ্কা সরকার ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলছিল।
কেউ কেউ যুক্তি দেখান যে এলটিটিইকে ধ্বংসের আগেই সেখানে ভারতের হস্তক্ষেপ করা উচিত ছিল, যাতে তামিলদের জায়গা দিতে কলম্বোকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করানোর সুযোগ থাকত। বিশ্বাসযোগ্য খবরে দেখা যাচ্ছে, এলটিটিইর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সময়টাতেও শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে ভারত। সেই সময়ে তামিলদের জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট ছাড় দিতে কলম্বোকে চাপে রাখা যেত। আর কলম্বো তখন এটা মেনে নিতে বাধ্য হতো, কারণ তারা চিরতরে এলটিটিইকে শেষ করে দিতে চাইছিল। কিন্তু তা না করে ভারত কলম্বোকে অস্ত্র দেওয়া কখনো বন্ধ করল না।
নয়াদিল্লি হয়তো এমনটা করেছে এ কারণে যে ভারত এলটিটিইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং সশস্ত্র করার আদি পাপের কথা কোনো দিনও প্রকাশ করে নিজেকে হালকা করে নিতে পারেনি। তৎকালে ভারতের নীতি ছিল, যেসব তামিল উত্তরে তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদের শিকার হচ্ছে এবং তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত, নির্দয় ব্যবহারের শিকার, তাদের সহায়তার জন্য কাজ করবে এমন একটি বাহিনী সৃষ্টি। কিন্তু এলটিটিই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনে পরিণত হয়ে যায়। তারা স্বাধীন রাষ্ট্রের উচ্চাভিলাষ লালন করতে শুরু করে।
পরবর্তী সময়ে এলটিটিই যেমন বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল, তাতে হয়তো রাজাপক্ষের পথেই এর বিনাশ ঘটা অবধারিত ছিল। এক দিক থেকে নয়াদিল্লির খুশি হওয়ারই কথা যে রাজীব গান্ধীকে যারা হত্যা করেছিল, তারা নিশ্চিহ্ন হয়েছে। কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমন হাওয়াও বইছে যে এর ফলে কলম্বোর ওপর ভারতের প্রভাব খাটানোর সুযোগ আরও কমে গেল। কিন্তু এমনটা ঘটেছে ভারতের একই অবস্থান বজায় না রাখার ফলেই। শ্রীলঙ্কার বিরাজমান পরিস্থিতির আলোকে ভারত শুধু প্রতিক্রিয়া করেছে। তামিলদের জন্য কোনো কিছু করার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য যদি নয়াদিল্লির থাকত, তাহলে তা বহু আগেই করতে পারত। এমনকি প্রেসিডেন্ট জয়াবর্ধনের সময়েই তা করা যেত। তিনি তো একবার বলেইছিলেন যে, জাহাজের নিয়ন্ত্রণ রাজীব গান্ধীর হাতে; তিনি যেমনটা নির্দেশনা দেবেন, তাঁরা তেমনই করবেন।
ভারতের বক্তব্যে প্রাদেশিক ক্ষমতা বৃদ্ধির মতো সুনির্দিষ্ট শব্দের স্থলে মিলমিশ করে নেওয়ার মতো বায়বীয় শব্দ চলে আসার কারণ, শ্রীলঙ্কায় বেইজিংয়ের বিনিয়োগ করার সাম্প্রতিক ঘোষণায় নয়াদিল্লি আতঙ্কগ্রস্ত। বেইজিং ঘোষণা দিয়েছে, তারা শ্রীলঙ্কায় বড় মাপের বিনিয়োগ করবে এবং তারা ত্রিনকোমালি বন্দর উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। নেপালেও চীন বড় ধরনের বিনিয়োগ করেছে। ভারতকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরছে চীন। এ অবস্থায় চীনকে না খেপিয়ে নয়াদিল্লি বরং শ্রীলঙ্কায় ফেডারেল কাঠামো প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় থেকে পিছু হটেছে।
শ্রীলঙ্কায় বসবাসরত তামিলদের প্রশ্নে মনমোহন সিং সরকারকে সময়সীমা বেঁধে দিতে পারতেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী কে করুণানিধি। কিন্তু দিল্লি সফরকালে তিনি টেলিযোগাযোগমন্ত্রী এ রাজাকে রক্ষাতেই ব্যস্ত থাকলেন। এমনকি তামিলদের বিষয়ে কথা বলার সময়ও করুণানিধির দায়সারাভাব ছিল স্পষ্ট।
ইত্যবসরে এলটিটিই এবং শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর সংঘাতের শেষ পর্যায়ে ক্রসফায়ারে আটকে পড়া হাজার হাজার বেসামরিক তামিলের ওপর সেনাবাহিনীর নৃশংসতার আরও অনেক কাহিনি প্রকাশিত হয়েছে। নিষ্পাপ নারী, পুরুষ আর শিশু সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে। প্রায় ২০ হাজার তামিল মারা গেছে। শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ন-ধর্ষণের মতো নৃশংসতা স্পষ্টত প্রমাণিত। তাদের এসব অপকীর্তি জেনেভা কনভেনশনের লঙ্ঘন এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
সরকারি নীতির একটি দিক এমন নৃশংসতাকে সহজ করে দিয়েছে। ১৯৭৯ সালের প্রিভেনশন অব টেররিস্ট অ্যাক্ট (পিটিএ) এলটিটিইকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিচার ও সামরিক আইনি ব্যবস্থার কিছু রক্ষাকবচকে এটি পদদলিত করেছে, যার ফলে অনেক ধরনের নৃশংসতা সহজতর হয়েছে। মৃত ব্যক্তিদের অবমাননার নজিরও পাওয়া গেছে।
ধর্ষণ, নির্যাতন, হত্যা, ‘নিখোঁজ হওয়া’ এবং খাদ্য-পানি-ওষুধের সরবরাহ বন্ধ রাখার মতো ঘটনাগুলো তামিল জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বকে হুমকিতে ফেলে। সংঘাতের সময় হোয়াইট ফসফরাস ও ক্লাসটার মিউনিশনসের মতো অবৈধ অস্ত্র এবং আর্টিলারির ব্যবহার করেছে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী; আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য আইনি মানদণ্ড সরকার মেনে চলেনি। কলম্বোর বিরুদ্ধে নৃশংসতা, জাতিগত শুদ্ধি এবং গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কোনো কারণ নেই। স্পষ্টত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ঘটেছে।
শ্রীলঙ্কা বিষয়ে গঠিত পারমানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল (পিপিটি) ইতিমধ্যে একটি তদন্ত করেছে। এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তামিলরা মর্মান্তিক অবস্থায় থাকতে বাধ্য হওয়া সত্ত্বেও এবং বারবার অনুরোধ করার পরও জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এসব নৃশংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের খোঁজে পেতে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ট্রাইব্যুনালটি জোর দিয়ে বলেছে, শ্রীলঙ্কায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে সংঘাতের সময়ে সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধ তদন্তের জন্য একটি স্বাধীন ও প্রামাণিক ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস কমিশন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
ভণ্ডুল হয়ে যাওয়া ২০০২ সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তি থেকে শুরু করে গত বছরের মে মাসে এলটিটিইর সামরিক পরাজয় পর্যন্ত বিষয়াদি নিয়ে কাজ করার জন্য কলম্বো আট সদস্যর একটি লেসনস লারন্ট অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু মানবাধিকার, সুশাসন ও জবাবদিহি-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারের কথা ও কাজের মধ্যে বিরাট ফারাক থাকায় এই কমিশনকে সন্দেহের চোখেই দেখা হচ্ছে।
রাজাপক্ষে বুঝতে পারছেন না যে তিনি শুধু এলটিটিইকে পরাভূত করেছেন, তালিমদের দুঃখ-দুর্দশার যে বোধ তাকে নয়। তাদের হূদয় জয় করার জন্য তিনি যদি কিছুই না করেন, তাহলে আবার কোনো এলটিটিইর আবির্ভাব ঘটবে। বিদেশে বসবাসরত তামিলরা ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বলতে শুরু করেছে, সিংহলি আর শ্রীলঙ্কার তামিলদের সমানভাবে বিবেচনা করার কোনো ইচ্ছা রাজাপক্ষের নেই। এতে তাঁর নিজের এবং দেশের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তির ক্ষতিসাধন হতে পারে।
অতএব, যে প্রশ্ন দিয়ে আমি লেখা শুরু করেছিলাম, সেই প্রশ্নে আবার ফিরে যাই। শ্রীলঙ্কা বিষয়ে ভারতের নীতি কী? দুই দশক ধরে একটি ফেডারেল-ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য শ্রীলঙ্কাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে নয়াদিল্লি, কিন্তু কোনো ফল হয়নি। এখন তাহলে ভারতের এজেন্ডায় কী আছে?
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণে প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের প্রতিশ্রুতিকে যথার্থ প্রমাণ করার জন্য তাঁর ওপর ভারতের চাপ প্রয়োগ করতে হবে। লিবারেশন টাইগারস অব তামিল ইলমের (এলটিটিই) বিরুদ্ধে লড়াই চলাকালেও শ্রীলঙ্কা সরকার ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলছিল।
কেউ কেউ যুক্তি দেখান যে এলটিটিইকে ধ্বংসের আগেই সেখানে ভারতের হস্তক্ষেপ করা উচিত ছিল, যাতে তামিলদের জায়গা দিতে কলম্বোকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করানোর সুযোগ থাকত। বিশ্বাসযোগ্য খবরে দেখা যাচ্ছে, এলটিটিইর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সময়টাতেও শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে ভারত। সেই সময়ে তামিলদের জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট ছাড় দিতে কলম্বোকে চাপে রাখা যেত। আর কলম্বো তখন এটা মেনে নিতে বাধ্য হতো, কারণ তারা চিরতরে এলটিটিইকে শেষ করে দিতে চাইছিল। কিন্তু তা না করে ভারত কলম্বোকে অস্ত্র দেওয়া কখনো বন্ধ করল না।
নয়াদিল্লি হয়তো এমনটা করেছে এ কারণে যে ভারত এলটিটিইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং সশস্ত্র করার আদি পাপের কথা কোনো দিনও প্রকাশ করে নিজেকে হালকা করে নিতে পারেনি। তৎকালে ভারতের নীতি ছিল, যেসব তামিল উত্তরে তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদের শিকার হচ্ছে এবং তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত, নির্দয় ব্যবহারের শিকার, তাদের সহায়তার জন্য কাজ করবে এমন একটি বাহিনী সৃষ্টি। কিন্তু এলটিটিই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনে পরিণত হয়ে যায়। তারা স্বাধীন রাষ্ট্রের উচ্চাভিলাষ লালন করতে শুরু করে।
পরবর্তী সময়ে এলটিটিই যেমন বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল, তাতে হয়তো রাজাপক্ষের পথেই এর বিনাশ ঘটা অবধারিত ছিল। এক দিক থেকে নয়াদিল্লির খুশি হওয়ারই কথা যে রাজীব গান্ধীকে যারা হত্যা করেছিল, তারা নিশ্চিহ্ন হয়েছে। কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমন হাওয়াও বইছে যে এর ফলে কলম্বোর ওপর ভারতের প্রভাব খাটানোর সুযোগ আরও কমে গেল। কিন্তু এমনটা ঘটেছে ভারতের একই অবস্থান বজায় না রাখার ফলেই। শ্রীলঙ্কার বিরাজমান পরিস্থিতির আলোকে ভারত শুধু প্রতিক্রিয়া করেছে। তামিলদের জন্য কোনো কিছু করার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য যদি নয়াদিল্লির থাকত, তাহলে তা বহু আগেই করতে পারত। এমনকি প্রেসিডেন্ট জয়াবর্ধনের সময়েই তা করা যেত। তিনি তো একবার বলেইছিলেন যে, জাহাজের নিয়ন্ত্রণ রাজীব গান্ধীর হাতে; তিনি যেমনটা নির্দেশনা দেবেন, তাঁরা তেমনই করবেন।
ভারতের বক্তব্যে প্রাদেশিক ক্ষমতা বৃদ্ধির মতো সুনির্দিষ্ট শব্দের স্থলে মিলমিশ করে নেওয়ার মতো বায়বীয় শব্দ চলে আসার কারণ, শ্রীলঙ্কায় বেইজিংয়ের বিনিয়োগ করার সাম্প্রতিক ঘোষণায় নয়াদিল্লি আতঙ্কগ্রস্ত। বেইজিং ঘোষণা দিয়েছে, তারা শ্রীলঙ্কায় বড় মাপের বিনিয়োগ করবে এবং তারা ত্রিনকোমালি বন্দর উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। নেপালেও চীন বড় ধরনের বিনিয়োগ করেছে। ভারতকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরছে চীন। এ অবস্থায় চীনকে না খেপিয়ে নয়াদিল্লি বরং শ্রীলঙ্কায় ফেডারেল কাঠামো প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় থেকে পিছু হটেছে।
শ্রীলঙ্কায় বসবাসরত তামিলদের প্রশ্নে মনমোহন সিং সরকারকে সময়সীমা বেঁধে দিতে পারতেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী কে করুণানিধি। কিন্তু দিল্লি সফরকালে তিনি টেলিযোগাযোগমন্ত্রী এ রাজাকে রক্ষাতেই ব্যস্ত থাকলেন। এমনকি তামিলদের বিষয়ে কথা বলার সময়ও করুণানিধির দায়সারাভাব ছিল স্পষ্ট।
ইত্যবসরে এলটিটিই এবং শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর সংঘাতের শেষ পর্যায়ে ক্রসফায়ারে আটকে পড়া হাজার হাজার বেসামরিক তামিলের ওপর সেনাবাহিনীর নৃশংসতার আরও অনেক কাহিনি প্রকাশিত হয়েছে। নিষ্পাপ নারী, পুরুষ আর শিশু সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে। প্রায় ২০ হাজার তামিল মারা গেছে। শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ন-ধর্ষণের মতো নৃশংসতা স্পষ্টত প্রমাণিত। তাদের এসব অপকীর্তি জেনেভা কনভেনশনের লঙ্ঘন এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
সরকারি নীতির একটি দিক এমন নৃশংসতাকে সহজ করে দিয়েছে। ১৯৭৯ সালের প্রিভেনশন অব টেররিস্ট অ্যাক্ট (পিটিএ) এলটিটিইকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিচার ও সামরিক আইনি ব্যবস্থার কিছু রক্ষাকবচকে এটি পদদলিত করেছে, যার ফলে অনেক ধরনের নৃশংসতা সহজতর হয়েছে। মৃত ব্যক্তিদের অবমাননার নজিরও পাওয়া গেছে।
ধর্ষণ, নির্যাতন, হত্যা, ‘নিখোঁজ হওয়া’ এবং খাদ্য-পানি-ওষুধের সরবরাহ বন্ধ রাখার মতো ঘটনাগুলো তামিল জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বকে হুমকিতে ফেলে। সংঘাতের সময় হোয়াইট ফসফরাস ও ক্লাসটার মিউনিশনসের মতো অবৈধ অস্ত্র এবং আর্টিলারির ব্যবহার করেছে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী; আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য আইনি মানদণ্ড সরকার মেনে চলেনি। কলম্বোর বিরুদ্ধে নৃশংসতা, জাতিগত শুদ্ধি এবং গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কোনো কারণ নেই। স্পষ্টত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ঘটেছে।
শ্রীলঙ্কা বিষয়ে গঠিত পারমানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল (পিপিটি) ইতিমধ্যে একটি তদন্ত করেছে। এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তামিলরা মর্মান্তিক অবস্থায় থাকতে বাধ্য হওয়া সত্ত্বেও এবং বারবার অনুরোধ করার পরও জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এসব নৃশংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের খোঁজে পেতে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ট্রাইব্যুনালটি জোর দিয়ে বলেছে, শ্রীলঙ্কায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে সংঘাতের সময়ে সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধ তদন্তের জন্য একটি স্বাধীন ও প্রামাণিক ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস কমিশন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
ভণ্ডুল হয়ে যাওয়া ২০০২ সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তি থেকে শুরু করে গত বছরের মে মাসে এলটিটিইর সামরিক পরাজয় পর্যন্ত বিষয়াদি নিয়ে কাজ করার জন্য কলম্বো আট সদস্যর একটি লেসনস লারন্ট অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু মানবাধিকার, সুশাসন ও জবাবদিহি-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারের কথা ও কাজের মধ্যে বিরাট ফারাক থাকায় এই কমিশনকে সন্দেহের চোখেই দেখা হচ্ছে।
রাজাপক্ষে বুঝতে পারছেন না যে তিনি শুধু এলটিটিইকে পরাভূত করেছেন, তালিমদের দুঃখ-দুর্দশার যে বোধ তাকে নয়। তাদের হূদয় জয় করার জন্য তিনি যদি কিছুই না করেন, তাহলে আবার কোনো এলটিটিইর আবির্ভাব ঘটবে। বিদেশে বসবাসরত তামিলরা ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বলতে শুরু করেছে, সিংহলি আর শ্রীলঙ্কার তামিলদের সমানভাবে বিবেচনা করার কোনো ইচ্ছা রাজাপক্ষের নেই। এতে তাঁর নিজের এবং দেশের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তির ক্ষতিসাধন হতে পারে।
অতএব, যে প্রশ্ন দিয়ে আমি লেখা শুরু করেছিলাম, সেই প্রশ্নে আবার ফিরে যাই। শ্রীলঙ্কা বিষয়ে ভারতের নীতি কী? দুই দশক ধরে একটি ফেডারেল-ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য শ্রীলঙ্কাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে নয়াদিল্লি, কিন্তু কোনো ফল হয়নি। এখন তাহলে ভারতের এজেন্ডায় কী আছে?
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
No comments