অভিমত ভিন্নমত

ফেসবুক বন্ধ নয়, আইনের কার্যকর প্রয়োগ কাম্য জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক সাময়িক বন্ধ করে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত খুবই দুঃখজনক। এতে করে সরকার মৌলবাদীদের কাছে শুধু বড় ধরনের ছাড়ই দিল না, বরং দেশের প্রচলিত আইন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীগুলোর অসহায়ত্ব প্রমাণ করল।


যেখানে বাংলাদেশে সাইবার বা ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ আইন বিদ্যমান রয়েছে, সেখানে সরকার এই আইনের উপযুক্ত ব্যবহার করতে পারত। সরকার সেই পথে না গিয়ে কেন হঠাৎ এত জনপ্রিয় একটি যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল, এটা বোধগম্য নয়।
প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে যখন সরকার কাজ শুরু করার কথা বলছে, তখন এমন একটি সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী ছাড়া কিছু নয়। নিঃসন্দেহে তরুণসমাজ এতে করে প্রযুক্তি ব্যবহারে কিছুটা হলেও তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে।
ফেসবুক বন্ধ করে দেওয়ার আগে কেন অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হলো না, এটাই এখন সবার প্রশ্ন। তাহলে কি দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধীদের শনাক্ত করতে ব্যর্থ? এ ঘটনায় দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্বলতাই কি প্রকাশ পেল না?
তথ্য ও যোগাযোগ আইন, ২০০৬-এ স্পষ্টভাবে এসব অপরাধে শাস্তির কথা উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ২৯৩ ধারাতেও এ ধরনের অপরাধে স্পষ্ট শাস্তির বিধান রয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ আইন, ২০০৬-এর ৫৭(২) ধারামতে, কোনো ব্যক্তি যদি ইন্টারনেটের মাধ্যমে অন্য কারও ছবি ব্যঙ্গ করে অথবা কারও পর্নো ছবি প্রকাশ করে, তবে এক থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার বিধান রয়েছে। উচিত ছিল এ ধরনের আইনের বিধানগুলো বেশি বেশি প্রচার করে সবাইকে অবহিত করা। তাহলেই কেবল এসব অপকর্ম থেকে মানুষ বিরত থাকত। আইনের সঠিক বাস্তবায়ন ও প্রচারই পারে অপরাধ দূর করতে; তা না করে ফেসবুক বন্ধ করে দিয়ে বরং অপরাধীদের কাছে মাথানত করাটা জাতি হিসেবে আমাদের আরও খাটো করে দেওয়া হলো।
একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে দেশের লাখো-কোটি মানুষের সঙ্গে সরকারের কাছে আমার অনুরোধ, অবিলম্বে ফেসবুক উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক, আর অপরাধীদের আইনের কাঠগড়ায় আনা হোক।
আশিকুর রহমান, আইনজীবী, ঢাকা।

২.
সামাজিক যোগাযোগের সবচেয়ে জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ফেসবুক ‘সাময়িকভাবে’ বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। খবরটি শোনার পর একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী তরুণ হিসেবে আশাহত হয়েছি। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে—এমন ব্যঙ্গচিত্র ও ছবি ফেসবুকে যাতে প্রকাশ না হতে পারে, সে চেষ্টা চালিয়ে সফল না হওয়ায় বিটিআরসি সাময়িকভাবে ওয়েবসাইটটি বন্ধ করে দিয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার ব্যঙ্গচিত্র ফেসবুকে প্রকাশ করার জন্য একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিছু মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষের অপকীর্তি বা এক যুবকের অপরাধের জন্য বাংলাদেশের নয় লাখ ফেসবুক ব্যবহারকারীকে কেন শাস্তি পেতে হবে?
ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচিত অনেকের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ রক্ষার পাশাপাশি অসংখ্য নতুন নতুন বন্ধুও পেয়েছিলাম। বিখ্যাত লেখকেরা বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের মতামত সবাইকে জানাতেন। তাঁদের পরামর্শে নিজেকে গড়ার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিলাম। এককথায় ফেসবুক হয়ে উঠেছিল আমার অস্তিত্বেরই একটি অংশ।
প্রতিটি জিনিসের ভালো-মন্দ দিক থাকে। ফেসবুকের মাধ্যমে সামাজিক বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। একে অন্যের সঙ্গে লেনদেনের ফলে বহু আশাহত মানুষ খুঁজে পেত নতুন আশা। ফেসবুকের মাধ্যমে সংবাদ পেয়ে অসহায় মানুষের পাশে মানুষ দাঁড়িয়েছে, এমন ঘটনার বহু নজির আছে। প্রতিবন্ধিতা, এইচআইভি, মাদক, নারীকে উত্ত্যক্ত করা, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তরুণ প্রজন্ম বিভিন্ন নেটওয়ার্ক তৈরি করে প্রচারণা চালানোর কারণে অনেক যুবক নৈতিক অবক্ষয় থেকে রক্ষা পাচ্ছিল। আর বিনোদনের তীব্র ঘাটতির এই শহুরে জীবনে বিনোদনের কিছুটা খোরাকও আসত ফেসবুক থেকে।
দেশে সাইবার অপরাধ দমনে আইন আছে। ফেসবুক ব্যবহার করে আইনবিরোধী কাজ করলে তার বিচার হবে, এটিই সবাই আশা করে। এ ক্ষেত্রে দরকার হলে সরকার আরও কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারত। কিন্তু ফেসবুক বন্ধ করে দেওয়া কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। তা ছাড়া ফেসবুকের মাধ্যমে ধর্মীয় প্রচারণাও চালানো হয়ে থাকে।
বর্তমান সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতাসীন হয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকারের দৃশ্যমান তৎপরতাও আছে। কিন্তু এখন বিপুলসংখ্যক তরুণ বিরাট এক ধাক্কা খেল। আশা করি, সরকার এটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফেসবুক খুলে দেবে।
আজমাল হোসেন, উত্তরা, ঢাকা।

নিজেদের হুঁশ হওয়াটাই জরুরি
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রায় দেড় বছর অতিক্রম হতে চলেছে, কিন্তু নির্বাচনী অঙ্গীকার কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে, তা ভেবে দেখার বিষয়। এ সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধের বিচার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ, সন্ত্রাস দূরীকরণ। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারে কারাগারে অবস্থানরত খুনিদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে, কিন্তু বিদেশে অবস্থানরত পলাতক খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকরের ব্যাপারে সরকারের মন্ত্রীদের উচ্চবাচ্য শোনা গেলেও এখন এ ব্যাপারে তাঁদের অবস্থান অস্পষ্ট বা খুনিদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ থিতিয়ে পড়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের অগ্রগতি কতটুকু, তাও খুব বেশি স্পষ্ট নয়। মন্ত্রীরা বিবৃতি দিচ্ছেন, এ সরকারের মেয়াদকালেই বিচারকাজ সম্পন্ন হবে। এ বিবৃতি কতটুকু বাস্তব রূপ লাভ করবে, সে ব্যাপারে শুধু সন্দেহই নয়, শঙ্কাও রয়েছে। সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধ তদন্তসংক্রান্ত কমিটিতে নিযুক্ত ব্যক্তিকে ঘিরে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়া এবং পরে তাঁকে প্রত্যাহারে সে শঙ্কা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সুতরাং এ ব্যাপারে সরকারের অবস্থান বা পদক্ষেপ আরও জোরালো ও সুদৃঢ় হওয়ার দরকার। কারণ যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা অনেক বেশি সংঘবদ্ধ ও প্রতিক্রিয়াশীল।
দুর্নীতি দমনে সরকারের পদক্ষেপ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। দাতারাও দুদককে অকার্যকর করার ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছে। এ ব্যাপারে হুঁশ হওয়াটা অধিকতর জরুরি। যত উন্নয়নের জোয়ারের কথা বলা হোক না কেন, তা কখনো বাস্তবতার মুখ দেখবে না, যদি দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা হয়।
দুদককে সংস্কারের মাধ্যমে শুধু দুর্নীতিকে উৎসাহিতই করা হয়নি, বরং সরকারি আমলাদের দুর্নীতির পথকে আরও মসৃণ করা হয়েছে। মনে রাখা দরকার, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের ভরাডুবির জন্য অবাধ দুর্নীতিই দায়ী।
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভুলে গেলে জনগণ তার জবাব ভালো করেই দিতে জানে। সন্ত্রাস দূরীকরণের যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। দিন দিন সন্ত্রাস বেড়ে চলেছে। টেন্ডার, চাঁদাবাজি, খুন, হল দখল, জমি দখল, হুমকি, পুকুরের পানি বিক্রি, বাড়ি ভাঙচুর, উচ্ছেদ—এসব কর্মকাণ্ডই ঘটিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিরা। দলীয় কোন্দল তো প্রতিদিনের খবর। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকার নির্লিপ্ত কিংবা অসহায়। ফলে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে জনগণ। বিগত সরকারগুলোর শাসনামলেও এসব ঘটনা ঘটেছিল। দল ক্ষমতায় থাকাকালে যত অন্যায়, দুর্বৃত্তপনার করার তা তাঁরা করেছেন।
আর প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব বিভিন্ন সমাবেশে দুর্বৃত্তপনার বিরুদ্ধে শুধু হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। ‘কোনো অন্যায়-অবিচার হলে আমরা ব্যবস্থা নেব। অন্যায় করলে নিজ দলের লোকদেরও ছাড়ব না’—সরকারের এমন বক্তব্য জনমনে আর কোনো স্বস্তি উৎপাদন করতে পারে না। ক্ষমতায় আসার পরদিন থেকে দলীয় লোকজন অপকর্ম করেই চলেছেন, আর বক্তৃতা দিয়ে মন্ত্রীরা জনগণকে আশ্বস্ত করছেন। বর্তমানে সরকারদলীয় সন্ত্রাস দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর অন্যতম। অবাধ তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগেও যেন দলীয় লোকদের অন্যায় এখনো যেন তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন না।
নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে গণতন্ত্রের পথে উত্তরণ হলেও এর প্রত্যাশিত সুফল জনগণ এখনো পায়নি। প্রতিটি সরকার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূরণ করেছে, আর দলীয় লোকজন সেই পাঁচ বছর এমন কোনো অপরাধ নেই, যা করেনি। আর সাধারণ জনগণ প্রতি পাঁচ বছরে পরের সরকারের ভালো কর্মকাণ্ডের স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু জনগণের স্বপ্ন প্রতিটি ক্ষেত্রে দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। জনগণ দুই দলের দুঃশাসনের কাছে জিম্মি। মনে হয়, এ দুঃশাসনের অবসান হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা তো যাচ্ছেই না, বরং বিরোধী দলের আসন্ন হরতাল বা ধ্বংসাত্মক কর্মসূচিতে দেশ যেন পুনরায় নেতিবাচক রাজনীতির দিকে যাত্রা শুরু করছে। দেশ ও সমাজের বিদ্যমান সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য দরকার ছিল হুঁশিয়ারি উচ্চারণ নয়, দুই দলের হুঁশ হওয়াটা। আদৌ হুঁশ হয় কি না, তা দেখার জন্য অপেক্ষার পরিধি বাড়ানো ছাড়া জনগণের আসলে কিছু করার আছে কি? এই ভাবনাটা আজ বড় দরকার।
মো. সোহরাব হোসেন
শ্যামবাড়িয়া, সাবগ্রাম, বগুড়া।

বিআরটিসির ১০০ বাস
যানজট আর সাধারণ মানুষের যাতায়াতের জন্য মানসম্মত পরিবহনের অপ্রতুলতায় জনজীবন যখন বিপর্যস্ত, তখন বিআরটিসির উদ্যোগে রাজধানীতে ১০০ বাস চালুর খবর নিঃসন্দেহে সুখবর। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে খবর ছাপা হয়েছে, আরও ৬০০ বাস আসছে। পর্যাপ্তসংখ্যক মানসম্মত বড় বাস, নির্দিষ্ট বিরতিতে পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকলে এবং মোটামুটি ভদ্রভাবে যাতায়াত নিশ্চিত করা গেলে শুধু নিম্নবিত্ত নয়, অনেক মধ্যবিত্ত গাড়ির মালিকও বাসে চলাচলের চেষ্টা করবে। ফলে রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কমে আসবে। রিকশার ব্যবহারও কিছুটা কমবে। ফলে যানজটও কমবে। খেয়াল রাখতে হবে, বাসগুলো যেন মানসম্মত হয়, সস্তা মানহীন বাস নামানো চলবে না। বাসগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতেরও সুব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
পর্যাপ্তসংখ্যক বড় বাসের জন্য পর্যাপ্ত সুপ্রশস্ত রাস্তা দরকার, নতুবা এই বাড়তি বাসগুলো যানজট আরও বাড়াবে। সে জন্য রাস্তাগুলোর দুই পাশের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে হবে, যত্রতত্র পার্কিং কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। অর্থাৎ যেটুকু রাস্তা আছে, তার সম্পূর্ণটা যেন ব্যবহার করা যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে এবং আরও নতুন নতুন রাস্তা তৈরি করতে হবে, যেখানে সুযোগ আছে বিদ্যমান রাস্তা প্রশস্ত করতে হবে। তৃতীয়ত আসে, ট্রাফিক আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ। জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য ট্রাফিক নিয়মকানুন-সংবলিত বিলবোর্ড বাড়ানো, অটো সিগন্যাল সিস্টেম বহাল রেখে তার কার্যকরতার সুষ্ঠু নিশ্চয়তা বিধানসহ ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীদের উচ্চ জরিমানা করার পাশাপাশি ট্রাফিক পুলিশকে সৎ ও নিষ্ঠা নিশ্চিত করতে হবে।
আমরা যারা নিত্যদিন যানবাহনের দুর্ভোগে জীবনকে তিল তিল করে ক্ষয় করে চলছি, আমরা চাই, রাজধানীর যাতায়াতব্যবস্থার এই দুর্দশার উন্নতি ঘটুক।
বন্দনা আমীর, উত্তরা, ঢাকা।

হরতালের জন্য করতালি পাবে না বিরোধী দল
দীর্ঘদিন পর আবার হরতালের ঘোষণা এল বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকে। হরতাল যে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে, তা নিয়ে কি বিরোধী দল একটুও ভাবল না? হয়তো কোনো বিরোধী দলই এটা ভাবে না। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের প্রধান হাতিয়ার হিসেবেই তারা বেছে নেয় হরতালের পথ।
দেশরক্ষা, জনস্বার্থ সংরক্ষণ, দুঃশাসন থেকে মুক্তি প্রভৃতির কথা বলে হরতাল ডাকা হয়। কিন্তু এগুলো আসলে কথার কথা। মূলত অর্থনীতির ক্ষতি ও জনসাধারণের দুর্ভোগের কারণে করা হয় হরতাল।
এমনিতেই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো নয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংগঠনগুলোর অসহিষ্ণু আচরণ, খুন-রাহাজানিসহ নানা সহিংসতায় নাগরিক জীবনে এমনিতেই অশান্তি ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। তার ওপর দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতি, উৎপাদনে শ্লথগতি, বিদেশে জনশক্তি রপ্তানিতে সমস্যা চলছে। বিপুলসংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক কাজকর্ম হারিয়ে দেশে ফিরছেন। দেশজুড়ে বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানিসংকটসহ ছোট-বড় হাজারো সমস্যা। এসব সমস্যা সমাধানে বিরোধী দলের উচিত সরকারের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ানো। এবং সেটা করলে বিরোধী দলই রাজনৈতিকভাবে উপকৃত হবে, তাদের প্রতি জনগণের শ্রদ্ধা ও সমর্থন বাড়বে।
উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জনসাধারণ চায় না, কোনো কারণে তাদের কর্মঘণ্টাও নষ্ট হোক। আমাদের দেশের মানুষেরও একই অবস্থান। কিন্তু আমাদের বিরোধী দলগুলো জনস্বার্থের কথা না ভেবে হরতাল ডেকে মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট করার কারণ ঘটায় এবং জনসাধারণের চলাফেরায় ব্যাঘাত ঘটায়, পণ্য পরিবহনে বাধা সৃষ্টি করে। এখন যদি কারণে-অকারণে ঘন ঘন হরতাল ডাকা হয়, তাহলে জনগণ বিরক্ত হয়ে পড়বে এবং শেষে আবারও এক-এগারোর মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে জনগণ তাতে সায়ও দিতে পারে; অর্থাৎ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, যা কিনা বাংলাদেশকে একই চক্রে ঘুরপাক খাওয়াবে।
বর্তমান বিরোধী দল বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের হরতালের সমালোচনা করে বলত, ‘আমরা যদি কখনো বিরোধী দলে যাই, তখনো হরতাল ডাকব না।’ নির্বাচনী ইশতেহারেও বিএনপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে তারা হরতালের মতো কর্মসূচি নেবে না। এমনকি বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে দলটির কোনো কোনো নেতা আইন করে চিরতরে হরতাল নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। বিরোধী দলে গেলেই যে সব প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে সেই চিরাচরিত পন্থায় হরতাল ডাকতে হবে, এটা কোনো যুক্তিপূর্ণ অবস্থান হলো না। দলের সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের ওপর উঠে বিএনপির নেতারা একটু ভেবে দেখুন, নিজেদের বিবেককে প্রশ্ন করুন, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে এই দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসেন কি না। তাঁদের বিবেকের উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে তাঁরা যেন ২৭ জুন ডাকা হরতাল কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেন এবং ভবিষ্যতেও এ ধরনের ক্ষতিকর কর্মসূচি নেওয়া থেকে বিরত থেকে অন্যান্য শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলনের কৌশল খুঁজে নেন।
তপু রায়হান
ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, ঝিনাইদহ।

তাঁরা রাষ্ট্রদ্রোহী
সম্প্রতি অধ্যাপক ইউসুফ আলী নামের জামায়াতের এক বুদ্ধিজীবী ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন। উক্তিটা নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। সাধারণ মানুষের মনে এক ধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টিতে যে তাঁরা পারঙ্গম, তা বিগত দিনগুলোতে তাঁরা প্রমাণ করেছেন। তাঁরা জ্ঞানপাপী। ইউসুফ আলী একবার বলেছেন, ‘একাত্তরে যা হয়েছে তা ছিল গৃহযুদ্ধ’, আবার দাবি করেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার তো অনেক আগেই সম্পন্ন হয়েছে।’ প্রশ্ন হলো, গৃহযুদ্ধের ফলে কীভাবে স্বাধীনতা এল এবং স্বাধীনতা দিবস কীভাবে ২৬ মার্চ নির্ধারিত হলো আর ১৬ ডিসেম্বরে গৃহযুদ্ধের পরিণতিতে কীভাবে বিজয় সূচিত হলো?
তাঁদের ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্যের জবাব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দেওয়ার মতো কলম ও মানুষের সংখ্যা বোধ হয় সম্প্রতি কমে গেছে। এত দিন কিছু পাওয়ার আশায় স্বাধীনতাবিরোধীদের পক্ষেও কেউ কেউ কলম ধরেছেন। আর হতাশা কিংবা বিভ্রান্তির কারণে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেরও কারও কারও হাত ও জিহ্বা আড়ষ্ট বলে মনে হচ্ছে। তা না হলে ইউসুফ আলীরা সরকারকে চোখ রাঙাতে এবং মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উপহাস করতে পারতেন না। এ অবস্থায় সোহরাব হাসানের ‘পাকিস্তানবাদের ফেরিওয়ালারা’ পড়ে আমরা কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হই, উদ্দীপ্ত হই।
একাত্তর সালের পর আমরা রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের সঠিক তালিকাও প্রণয়ন করতে পারিনি, সময় এসেছে কুলাঙ্গারদের একটা তালিকা প্রণয়নের। রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ এখন হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের রায়কে বুড়ো আঙুল দেখালেও আমাদের অবস্থান অনেকটা অসহায়ের মতো।
আজকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি বহুধাবিভক্ত। তাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। আমার বিশ্বাস, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ঢাকা ও অন্যান্য বিভাগীয় জেলা শহরে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে মিছিল বের করলে তাঁরা সাপের মতো গর্তে লুকাবে।
২৬ মার্চ ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এবং তার আদর্শের বিপক্ষে কাজ করা রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। দেশের সংবিধান অনুযায়ীই তাঁদের বিচার করতে হবে।
ড. আবুল হাশেম চৌধুরী
mhossain_wub@yahoo.com

আত্মহত্যা নয়, চাই প্রতিরোধ
কিছুদিন পর পর বিভিন্ন পত্রিকায় বখাটেদের উৎপাতে একের পর এক স্কুলছাত্রীর আত্মহননের খবর ছাপা হচ্ছে। বখাটেদের শিকার হয়ে সম্প্রতি পাবনায় কাজলী, রূপগঞ্জে সুফিয়া আত্মহত্যা করেছে। নেত্রকোনায় তিকলিমা আত্মহত্যাকালে পরিবারের প্রচেষ্টায় মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গায় ‘ইভ টিজিং’কে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের খবরও ছাপা হয়েছে। কোথাও কোথাও বখাটেপনায় বাধা দিতে গিয়ে উল্টো আক্রমণ ও হামলার শিকার হতে হয়েছে। এসব ঘটনা আমাদের উদ্বিগ্ন করে।
স্কুলগামী মেয়েদের মা-বাবাদের উদ্বেগ সবচেয়ে বেশি। বখাটেদের বিরুদ্ধে সারা দেশে চলছে মানববন্ধন, চলছে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় বিভিন্ন সভা-সমাবেশ। কিছু বখাটেকে পুলিশ আটকও করেছে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার ঘটনা কমছে না।
দেশের আনাচকানাচে, গ্রামীণ পরিমণ্ডলে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার সব খবর পত্রপত্রিকায় আসে না। বখাটেদের সংঘবদ্ধ আক্রমণের ভয়ে অনেক পরিবার থানায় নালিশ করারও সাহস পায় না। বখাটেদের পুনরায় আক্রমণ বা সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে অনেক পরিবার পুরো ঘটনা চেপে যায়। মনে প্রশ্ন জাগে, আমরা এ কোন সমাজে বাস করছি? আমাদের মেয়েরা নিরাপদে স্কুলে যেতে পারবে না কেন? কেন আমরা এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক দাবি করেও মেয়েদের চলার পথকে নিরাপদ করতে পারছি না? মেয়েদের যদি সব সময় আতঙ্কের মধ্যে চলাফেরা করতে হয়, তাহলে কীভাবে তারা সুস্থ জীবনযাপন করবে? কীভাবে তাদের স্বাভাবিক বিকাশ ঘটবে? মেয়েদের কি ঘরের বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে? তারা কি স্কুলে যাবে না? আরেকটি বিষয়, বখাটেদের লাঞ্ছনার শিকার অনেক মেয়ে নিজের পরিবার থেকেও সহানুভূতি পায় না। উল্টো অনেক অভিভাবক মেয়েটিকেই বকাঝকা করেন। ফলে মেয়েটি চরম মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। মনে হয়, লাঞ্ছনার জন্য যেন মেয়েটিই দায়ী। আবার বখাটেদের উপদ্রব এড়াতে অনেক অভিভাবক মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিতে বাধ্য হন।
শহরের বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে, স্কুলের সামনে উঠতি বয়সের তরুণদের সংঘবদ্ধভাবে আড্ডা দিতে দেখা যায়। মেয়েরা যখন একা চলাফেরা করে, তখন বখাটেরা নানা রকমের অশালীন উক্তি করে, শিস দেয়, সুযোগ বুঝে কখনো ওড়না ধরে টান দেয়। আবার কখনো নিজের মোবাইল ফোন নম্বর কাগজে লিখে রিকশারোহী কোনো মেয়ের উদ্দেশে ছুড়ে দেয়। শুধু মেয়েরা একা থাকলেই যে বখাটেরা এসব করে, তা নয়। অভিভাবক সঙ্গে থাকলেও অনেক সময় বখাটেরা সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে চরম দুঃসাহস ও ধৃষ্টতার পরিচয় দেয়। তখন মানসম্মান বাঁচানোর জন্য অভিভাবকদের নীরবে পলায়ন ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। যেসব মেয়ে একা স্কুলে যাতায়াত করে, তাদের অবস্থা আরও খারাপ।
বখাটেদের উৎপাত থেকে মেয়েদের রক্ষা করতে হলে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ পাওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকলে চলবে না। সরকার এরই মধ্যে স্কুলগুলোর সামনে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। শুধু এটাই যথেষ্ট নয়। হাজার হাজার স্কুলের সামনে পুলিশ মোতায়েন করাও সম্ভব হবে না। আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি একটা সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। পাড়ায় পাড়ায় সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠন করতে হবে ইভ টিজিং নিরোধ কমিটি। বখাটেদের পরিবারকেও এই উদ্যোগে শামিল করতে হবে।
আর আমাদের মেয়েদের বুঝতে হবে, ইভ টিজিংয়ের শিকার হওয়ার পর আত্মহত্যাই একমাত্র পথ নয়। সেটা না করে বরং পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সহযোগিতায় বখাটেদের প্রতিরোধ করতে হবে।
মো. মুজিবুর রহমান, সরকারি কলেজের শিক্ষক।
mujibur30@yahoo.com

স্বপ্নে হোঁচট
আমি সব সময় স্বপ্ন দেখি যে আমার একটা মেয়ে বুয়েটের ছাত্রী হোক। সে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। আর আমার মেয়ের জন্য স্বপ্নের ঘুড়িগুলো শুধু আঁকাবাঁকা করে ফেরে, যেন ওর ফল বুয়েটে ফরম নেওয়ার মতো হয়। অর্থাৎ ইংরেজি, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন আর গণিতে যেন অবশ্যই জিপিএ-৫ থাকে, তার পরের সংগ্রাম তো আছেই: ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভালো বিষয়ে একটা আসন পাওয়া।
কদিন খুব ভালো লাগছিল পত্রিকা দেখে—কেবল বিজয় আর উল্লাসের খবর: এভারেস্ট বিজয়ী মুসা ইব্রাহীমের সাফল্যের খবরে ভরপুর। কিন্তু ২৮ মে সকালে পত্রিকায় চোখ পড়তেই মেধাবী ছাত্র খন্দকার খানজাহান সম্রাট আর তাঁর মা-বাবার কথা ভেবে মনটা হু হু করে কেঁদে উঠল। আমরা অভিভাবকেরা কত কষ্ট করে সব অন্যায়-অসুন্দর পরিবেশ থেকে আমাদের সন্তানদের আগলে রেখে শিক্ষিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করি। আমাদের কষ্টের ধন কি একজন বাসচালকের ভুলে নিমেষে হারিয়ে যাবে চিরদিনের জন্য? যে মেধাবী ছাত্রটা মাত্র পাঁচ দিন ক্লাস করল, যে কিনা দিতে পারে দেশকে অনেক কিছু, সেই ফুল ফোটার আগেই ঝরে যাবে কেন?
দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অকালে কত প্রাণ ঝরে যাচ্ছে! কয়েক দিন পত্রিকায় লেখালেখি, আন্দোলন, তারপর আবার সব শান্ত। কেন এমন হয়?
একজন মা হিসেবে শোকাতুর পরিবারের প্রতি অন্তরের সব ভালোবাসা জ্ঞাপন করছি। চালকের সামান্য ভুলের কারণে আর কোনো স্বপ্নের মৃত্যু আমরা দেখতে চাই না।
রওশন ইসলাম
একজন অভিভাবক, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.