নারীত্বের অধিকারে রাজপথে ‘নষ্ট’ মেয়ের মিছিল

এমনও হয় কলকাতা শহরে! হয় বলেই, তার বুকে নানা পদসঞ্চার আর জনসমাগম দেখতে অভ্যস্ত মিছিল নগরী কলকাতা। ২৪ মের পড়ন্ত বিকেলে ভ্যাপসা গরম আর ক্লান্তিকে উপেক্ষা করে এক অন্য অভিজ্ঞতার সাক্ষী থাকলো এই শহর।

নারীত্বের অধিকারে রাজপথে ‘স্লাট ওয়াক কলকাতা ২০১২’ এই শিরোনামে এক মিছিল হাঁটল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকুরিয়া-গড়িয়াহাট হয়ে ট্রাঙ্গুলার পার্ক পর্যন্ত। একইসঙ্গে চরিত্র নিয়ে ছুঁৎমার্গ করা বাঙালির চিরকালীন কুটকাঁচালে লাগল বুঝি ভুবনডাঙার হুশিয়ারি!
‘স্লাট ওয়াক’ নামটা নেহাত অচেনা ঠেকছে বোধহয়! যাদের সাইবার দুনিয়ায় অবাধ যাতায়াত তারা কিছুটা হলেও এই শব্দের সঙ্গে পরিচিত। বিদেশে এমন মিছিলের ঘটনা তো প্রায়ই ঘটে বা ঘটছে। গুগুল, ফেসবুক বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সেই খবর আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়। কিন্তু কলকাতার বুকে এই রকম অভিনব মিছিল এই প্রথম। কোনো রাজনৈতিক দলের পতাকা নেই, কোনো রকম রাজনৈতিক স্লোগান নেই, নেহাতই প্রতিবাদের ভাষার সঙ্গী হয়েছিল গান কবিতা আর নানা রকমের পোস্টার । মিছিলের উৎস যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানকার কয়েকজন ছাত্রছাত্রী এই মিছিলের আয়োজক।  কিন্তু মিছিলের গভীরে ঠিক কোন কথা লুকিয়ে রয়েছে?

উদ্যোক্তাদের ব্যাখ্যা, প্রতিদিন ট্রামে বাসে ট্রেনে নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে  অছিলায় যৌন নিগ্রহের স্বীকার হয় । এই মিছিল যে কোনো লিঙ্গের এমনকি তৃতীয় লিঙ্গের ও যৌন নিগ্রহের বিরুদ্ধে কথা বলে ওঠে । পুরুষতান্ত্রিকতার ঘেরাটোপে বাঁধা সমাজে ক্রমাগত বেড়ে চলা ধর্ষণের ঘটনা আমাদের বিচলিত করছে । ধর্ষকের শাস্তির প্রসঙ্গ থেকে বড় হয়ে উঠছে ধর্ষিতার সংগ্রাম । সেখানে বিদ্বজনেরা মতামত দিচ্ছেন ধর্ষনে পুরুষের ভূমিকা যতখানি, নারীর ভূমিকা কোনও অংশে কম নয় । ধর্ষণকারী পুরুষের কামনার উদ্রেক ঘটানোর নেপথ্যে কাজ করছে নারীর খোলামেলা পোশাকের শরীরী আবেদন । এমন পোশাক পরে আমাদের সমাজে বেরনো মানে সে ‘দুশ্চরিত্র’ । এই মিছিল সেই দাবীকেই নস্যাৎ করে । এঁদের স্লোগান ছিল ‘এসো দুশ্চরিত্র পথ হাঁটো’ বা, ‘যা পরেছি বেশ পরেছি’ ।

স্লাট ওয়াক প্রথম আয়োজিত হয়েছিল কানাডার টরেন্টোতে ২০১১ এর এপ্রিলে । সেই থেকে প্রতিবাদের আগুন দেশকাল সীমানার ছড়িয়ে পায়ে পায়ে কলকাতায়। মিছিলে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গেই পা মেলান বহু বিশিষ্ট ব্যাক্তি । ছাত্র, স্কুল পড়ুয়া, স্কুল-কলেজের শিক্ষক থেকে সমস্ত পেশার মানুষ মিছিলের সমর্থনে রাস্তার দু ধারে দাঁড়িয়ে অভিবাদন দিচ্ছিলেন । মিছিল ঘিরে উন্মাদনা ও পুলিশি তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো ।


প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কিছু দিন আগেই এই বিশ্ববিদ্যালয়েই আয়োজিত হয়েছিল এক সেমিনার ‘আমার শর্ট স্কার্টে তোমার কিছু এসে যায় না’।  তারপরে এমন এক মিছিল ঘিরে উদ্দীপনায় আয়োজকরা ভীষণ খুশি। তাদের ভাষায় ‘এমন সাফল্য পাব ভাবিনি, নতুন করে আমরা কলকাতার স্পিরিটকে তুলে ধরলাম । সেমিনারে খুব বেশি হলে মাত্র ২০-২৫ জন এসেছিলেন কিন্তু এত মানুষের অভিনন্দন পেয়ে আমরা সত্যিই খুশি’।

বিশ্ববিদ্যলয়ের কয়েকজন ছাত্রনেতা অবশ্য এই সব ‘অহেতুক মাতামতি’-কে আমল দিতে নারাজ । মিছিল দেখতে আসা প্রাক্তন ছাত্রী ঈশিতা কুণ্ডু বলেন ‘ ব্যাপারটা খুব একটা স্পষ্ট নয় । স্টুডেন্ট লেভেলে এমন একটা মিছিল হচ্ছে সেটা নিঃসন্দেহে প্রসংশাযোগ্য । কিন্তু গোটা মিছিলে সব শ্রেণীর মানুষের প্রতিনিধিত্ব বেশ কম,  বিশেষ করে নিচু তলার মানুষের প্রতিনিধিত্ব বাড়লে সেটা বেশ খানিক মিছিলের উদ্দেশ্য পূরণ হতো’ । এক ছাত্র চিরঞ্জিৎ ঘোষের মন্তব্য, ‘আমাদের সমাজে চরিত্র আর পোশাক নিয়ে গণ্ডি বা ছুঁৎমার্গ যথেষ্ট । শুরু থেকেই একটা গণ্ডি টেনে দেয়া হয় যে কি কি করলে দুশ্চরিত্র প্রমাণিত হবে । আমাদের মনে মা- দিদি-পিসিদের একটা পোশাকের ছবি থাকেই। তা নতুন করে ভেঙে এগিয়ে যাওয়া বা সেটাকে আঁকড়ে ধরে থাকা কোনোটাই সমাধান হতে পারে না । সেখান থেকে এমন একটা মিছিল সেই অবস্থা পাল্টাতে না পারলেও আধুনিকতার দিকে এক পা এগিয়ে যাওয়া’ । এক শিক্ষক এর সঙ্গেই যোগ করেন “এই মিছিল মণিপুরের ‘আফস্পা’ এর বিরুদ্ধে নগ্ন মহিলাদের মিছিলের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।” সমাজবিজ্ঞানী নীলাঞ্জনা সান্যাল মনে করছেন ‘এই মিছিল থেকে চরিত্র বা দুশ্চরিত্রের গণ্ডিটা হয়ত ভাঙবে না, কিন্তু ভাঙার দিকে এক পা এগোনো যাবে সেটাই কম কি ! স্লাট শব্দের বাংলা মানে ‘বেশ্যা’ এতোগুলো মানুষ যখন বা বিশেষ করে মেয়েরা নিজেদের গায়ে যখন এমন একটা শব্দের পোশাক পড়ে শহরের রাজপথে নেমেছে সেটাই বাহবা দেয়ার মতো।’

মিছিল ট্র্যাঙ্গুলার পার্ক পৌঁছানোর পর সেখানের এক জমায়েতে স্ট্রিট প্লে আয়োজন করে ফোর্থ বেল থিয়েটার দল । আশে পাশের মানুষ সেখানে ভিড় জমান । মিছিলের শুরুতে আশার কথা ছিল ‘ঋ’-র । যাকে ঘিরে ‘ গান্ডু’ ছবির সৌজন্যে বাংলা সিনেমায় নগ্নতা বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছিল । তাকেও দেখা গেল ভিড়ের মধ্যে থেকে ছবি তুলতে এবং সবাইকে সমর্থন করতে । ঋ বলেন, “আমি এ যাবৎ যাবতীয় প্রতিবাদ বা আলোচনা আমার সিনেমার জন্যে করেছি । নারীবাদী ভাবনার আমি অন্ধ সমর্থক নই ঠিক তেমন পুরুষতান্ত্রিকতার এই ঘেরাটোপ মানতে রাজি নই । পোশাক থেকে আচরণ সব পুরুষরাই ঠিক করে দেবেন কেন ? কলকাতার এ যাবৎ সমস্ত মিছিলের আয়োজকরা একটু বয়স্ক ব্যক্তিরা করে থাকেন । এমন ভাবে ইংয় জেনারেশান এমন একটা মিছিল করছে যে, না এসে থাকতে পারলাম না। বিষয়গুলো নিয়ে প্রতিবাদ করার ছিল। এই নষ্ট সময়ে সমাজের চোখে সতী-সাবিত্রী সাজার থেকে বড় অপরাধ আর কিছু নেই।” সূত্র: ওয়েবসাইট।

No comments

Powered by Blogger.