ব্রিটেনে বিদেশি ছাত্র : অনিশ্চিত যাত্রার শেষ কোথায় by ফারুক যোশী
গত বছরের প্রথম দিকে স্রোতের মতো ছাত্রছাত্রীরা এসেছে ব্রিটেনে। বিশেষত বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল প্রভৃতি দেশ থেকে। ব্রিটেনের ইমিগ্রেশন নীতির সমালোচনা করে এ দেশের ইমিগ্রেশন ইনটেলিজেন্স ইউনিট তখন দাবি করেছিল অভিবাসন নীতির 'খোলা জানালা'র কারণেই ছাত্রদের এ স্রোত ছিল।
শুধু পয়েন্ট-নির্ভর ভিসা পদ্ধতির (স্টুডেন্টদের জন্য ঞওঊজ ৪ ভিসা পদ্ধতি) অপব্যবহারের কারণেই স্টুডেন্ট নামধারীদের ব্রিটেনে আসার জানালাটি খুলে গিয়েছিল। এ জানালাটি খোলার পদ্ধতি চালু করা হয় ২০০৯ সালের মার্চ মাসে। চলতে থাকে বিশেষত গত বছরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। যদিও ওই খোলা জানালার ছাত্রছাত্রীদের কল্যাণেই ব্রিটেন তার অর্থনৈতিক মন্দায় হাজারো মিলিয়ন পাউন্ড ব্যবসা করতে পেরেছে এসব গরিব দেশ থেকে। আর সে কারণেই এখন সয়লাব হয়ে গেছে ব্রিটেন। স্টুুডেন্টদের কারণে এবং মিডিয়া এদের উল্লেখ করছে ভুয়া স্টুুডেন্ট বোগাস স্টুুডেন্ট হিসেবে, যাদের সংখ্যা অগণন-অসংখ্য। আসলে এ কথাটি সত্যিও। কারণ কে ছাত্র, কে অছাত্র তা ওই ছাত্রদের সঙ্গে আলাপ করলে বোঝা বড় জটিল হয়ে যায়। এ কারণে আসল ছাত্রছাত্রীদের পরিচয়টুকু ঢাকা পড়েছে। মিডিয়ায় এসব উচ্চারিত হয়েছে জোরেশোরে। বাংলাদেশ থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের (ছাত্রীদের সংখ্যা নগণ্য) সঙ্গে আলাপ করলেই বোঝা যায়, আসলে দেশে এরা কতটুকুই পড়াশোনা চালিয়ে এসেছে। সত্যি কথা বলতে কি, দেশ থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের ১০ শতাংশ ও একজন ছাত্রের ক্রাইটেরিয়া মিট করতে পারবে কি না সন্দেহ আছে। যে কারণে ব্রিটেনের মূলধারার মিডিয়াগুলোতে গত বছরের মার্চ-এপ্রিলে ছাত্রদের নিয়ে নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণায় ছাত্রদের একটা নেতিবাচক ইমেজ তৈরি হতে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। আর সে কারণেই ছাত্রদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে এখানে এক বড় ধরনের প্রতিকূল অবস্থা। সর্বোচ্চ ২০ ঘণ্টা কাজের অনুমতি থাকলেও স্টুডেন্টরা কাজ পায় না। হালে যারা স্টুডেন্ট ভিসা পাচ্ছে, বিশেষত ডিগ্রি লেভেলের নিচে যারা ভর্তি হচ্ছে, তারা মাত্র ১০ ঘণ্টা কাজ করার অনুমতি পচ্ছে। মূলত ছাত্রছাত্রীরা যে ভিসায় আসছে তা ডিগ্রি লেভেলের নিচের কোর্সগুলোতেই। আর সে কারণে এমনকি ছাত্রদের একধরনের নিরাপদ চাকরির জায়গা হিসেবে খ্যাত বাংলাদেশি মালিকানাধীন রেস্টুরেন্টগুলোতেও এরা নিয়মিত কাজ পাচ্ছে না। চাকরির বাজার তাদের অনিশ্চিত, একধরনের খারাপ অবস্থা মোকাবিলা করতে হচ্ছে তাদের এখন। খুব স্বাভাবিকভাবেই ওই সব ছাত্র এখন বিপাকে। বছর শেষে এরা কলেজে নতুন সেমিস্টারের জন্য ফি জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে। কারণ নতুন সেমিস্টারের ফি বাবদ তাদের নূ্যনতম দুই হাজার ৫০০ পাউন্ড জমা দিতে হয়। একটু ভালো কলেজ হলে তো তিন-চার হাজার কিংবা তারও অধিক পর্যন্ত ফির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায়। অনিয়মিত কাজ করে বাসা-খাবার খরচ সবকিছু বাদে ওই ছাত্রদের অনেকের কাছেই এ পরিমাণ পাউন্ড থাকার কথা নয়।
আর সে কারণেই ছাত্ররা এখন সম্মুখীন হচ্ছে নতুন সমস্যায়। অসংখ্য ছাত্র বলতে গেলে অর্ধেক ছাত্রছাত্রীই দেখা গেছে, নতুন সেমিস্টারের এনরোলমেন্টকে অযথা 'ওয়েইস্ট অব মানি' (অর্থের অপচয়) হিসেবেই মনে করছে। ছাত্রদের কাজ নেই। কলেজ যেখানে, সেখানে কাজের সুবিধা না থাকায় কাজের সন্ধানে দূরে চলে যাওয়ায় অনিয়মিত ছাত্র হয়ে এদের অধিকাংশই ছাত্রত্ব হারিয়েছে। একে তো ব্রিটেনে চাকরির বাজার এমনিতেই মন্দা, অন্যদিকে ইমিগ্রেশন নীতির কড়াকড়ির কারণে অনিয়মিত ছাত্রদের কেউ কাজ দিতে চায় না। কারণ একজন অনিয়মিত ছাত্র ইউকে বোর্ডার ফোর্সের কাছে অবৈধ শ্রমিক এবং অবৈধ শ্রমিককে যে বা যারা কাজ দেয়, তাদের প্রতি আছে কঠোর হুঁশিয়ারি। কোনো প্রতিষ্ঠানে একজন অবৈধ শ্রমিক খুঁজে পেলে সর্বোচ্চ ১০ হাজার পাউন্ড জরিমানা করা হয়। ইতিমধ্যে শতাধিক বাঙালি রেস্টুুরেন্ট মালিক এ জরিমানা পরিশোধ করতে বাধ্য হয়েছেন। এমনকি উত্তর ইংল্যান্ডের একজন রেস্টুুরেন্ট ব্যবসায়ীকে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি কার্লাইল ক্রাউন কোর্ট জেলদণ্ড দিয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই এরা কাজ পাচ্ছে না। আর যদিও কাজ পায়, তা বলতে গেলে অপ্রতুল, আসল শ্রমমূল্য (পারিশ্রমিক) তারা পায় না। শোষিত হয়ে হাড়ভাঙা শ্রমের পর বছর শেষে জমানো অর্থ কিংবা বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে জোগাড় করা অর্থে শেষ পর্যন্ত কী হবে, সে এক প্রশ্ন। কারণ যেসব কলেজে তারা ভর্তি হতে চাইছে, সেখানেও তারা নিরাপদ নয়। কলেজগুলোর অবস্থা আরো খারাপ। যেসব কলেজে একসময় অনেক ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়েছিল, এখন সেসব কলেজে সেই ছাত্রছাত্রীদের অর্ধেকও পরবর্তী সেমিস্টারের জন্য নিজেদের এনরোল করছে না। ম্যানচেস্টার থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক প্রবাস বাংলায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টে লন্ডনের স্থানীয় এক কলেজের (কলেজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে) পরিসংখ্যান উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ওই কলেজে গত বছর ৯০০ মূলত বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু ক্লাসে উপস্থিত হয়নি ২০০ জনও। বলতে গেলে, নূ্যনতম ৭০০ ছাত্রছাত্রী তারা দেখেইনি। অর্থাৎ এসব ছাত্রছাত্রী পরবর্তী সেমিস্টারের জন্য আর নিজেদের এনরোল করছে না_এটাই নিশ্চিত। অর্থাৎ কলেজগুলোতে ছাত্র ভর্তির এই দৈনতা থাকলে এসব কলেজ টিকবে না, এমনিতেই এগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছাত্রছাত্রী, যারা ক্ষীণ আশা নিয়ে এখনো যুক্তরাজ্যে তাদের অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী করতে চাইছে, তারাও এসব কলেজ নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত। কারণ ভর্তি হওয়ার পরও যদি এসব কলেজ বন্ধ হয়ে যায়, এই শঙ্কা তাদের তাড়া করছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০০৯ সালে ইউকে পয়েন্ট বেইজড সিস্টেমের (টিয়ার ৪) আওতায় মোট এক হাজার ৯৮৭টি কলেজকে লাইসেন্স দেয় সরকার। এর মধ্যে প্রায় ২০০ কলেজের মালিক ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এবং এগুলোর সিংহভাগই পূর্ব লন্ডনের বিশেষত টাওয়ার হ্যামলেটস-ভিত্তিক। এর মধ্যে ইউকে বোর্ডার ফোর্স গত বছরের মধ্য জানুয়ারিতেই বাংলাদেশি মালিকানাধীন ৬৮টি কলেজের স্পন্সর লাইসেন্স বাতিল করেছে লন্ডনে। সে হিসেবে দেখা গেছে, যদি কলেজগুলো সরকারের ক্রাইটেরিয়া মিট করতে না পারে, তাহলে এসব কলেজের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। আর এভাবেই আরো অনেক বাংলাদেশি মালিকানাধীন কলেজসহ শুধু লন্ডনেই দুই শতাধিক কলেজের স্পন্সর লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছিল সে সময়। সেই থেকে বিশেষত এ সরকার অর্থাৎ টোরি লিবডেমের কোয়ালিশন আসার পর থেকে স্টুুডেন্ট ভিসাসহ অভিবাসন নীতিতে কড়াকড়ি আরোপের কারণে অনেক কলেজের মালিকই কলেজের মালিকানা ছেড়েছেন; এমনকি দেখা গেছে, ব্যবসায় কুলিয়ে উঠতে না পেরে অন্য মালিকের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন। সে জন্যই শঙ্কিত ছাত্রছাত্রীরা। যদি তারা ফি দিয়ে নতুন সেমিস্টারে কিংবা অন্য কোর্সে ভর্তিও হন এবং কলেজগুলো সরকারের নির্ধারিত নিয়মনীতি মেটাতে না পারে, তাহলে এসব কলেজও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর সে জন্যই তারা মূলধারার কলেজগুলোর প্রতি ঝুঁকতে চাইছে। কিন্তু সেই কলেজগুলোর আকাশছোঁয়া ফি তাদের এটা হতে দিচ্ছে না ।
অন্যদিকে শুধু ব্যবসার প্রয়োজনে দুই, তিন ও চার কক্ষ আর কিছু বেঞ্চ-ডেস্ক নিয়ে এমনকি ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারির (গ্রোসারি শপের) ওপরে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কলেজগুলো যেহেতু ছাত্রছাত্রীরা বিশ্বাস করতে পারছে না, সেহেতু এখন কলেজ মালিকরাও বিপাকে। হাজার হাজার এমনকি লাখ পাউন্ড বিনিয়োগ করা এই ব্যবসাটি এখন তাদের হাতছাড়া হতে যাচ্ছে। ব্যবসা বন্ধ করতে যাচ্ছেন অনেকেই। তাই তো শেষ চেষ্টা হিসেবে তাঁরাও এখন ইমিগ্রেশনের ব্যাপার নিয়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন। ইতিমধ্যে লন্ডনের তিনটি কলেজ যৌথভাবে এ সেমিনার করেছে এবং ভবিষ্যতেও তা করবে বলে জানিয়েছে।
সেমিনার-সিম্পোজিয়াম দিয়ে আশা জাগানো যায়। কিন্তু ওই সব ছাত্রছাত্রীর উপার্জনের পথ তো করে দেওয়া যায় না। এর পরও কষ্টে-সৃষ্টে উপার্জিত অর্থ দিয়ে নতুন সেমিস্টারে ভর্তির পরও যদি কলেজ বন্ধ হয়ে যায়, তখন তার অর্থাৎ ছাত্র কিংবা ছাত্রীর শেষ সম্বলটুকুর কী হবে? তাই তো এরা আর ছাত্রত্ব নিয়ে থাকছে না। ব্রিটেন ছাড়ছে ছাত্ররা। পার্শ্ববর্তী দেশ ফ্রান্সে যাচ্ছে এবং তা অবৈধ পথেই। ভিসা ছাড়া। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত দিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে। পাড়ি দিচ্ছে লন্ডনের ডোভারবন্দর থেকে ফ্রান্সের কালেবন্দর হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ইতালি, জার্মানি প্রভৃতি দেশের শহরে শহরে। সেখানে অর্থের হাতছানি না থাকলেও আছে অন্তত রাজনৈতিক আশ্রয়ের সুযোগ। ওই আশ্রয়েই থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা অন্তত কয়েকটা মাস। কিন্তু তারপর কী হবে? বন্দর থেকে বন্দরে ঘোরে এই ছাত্রছাত্রীরা তীর পাবে কবে? অনিশ্চিত এই যাত্রার শেষ কোথায়?
লেখক : লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক
faruk.joshi@gmail.com
আর সে কারণেই ছাত্ররা এখন সম্মুখীন হচ্ছে নতুন সমস্যায়। অসংখ্য ছাত্র বলতে গেলে অর্ধেক ছাত্রছাত্রীই দেখা গেছে, নতুন সেমিস্টারের এনরোলমেন্টকে অযথা 'ওয়েইস্ট অব মানি' (অর্থের অপচয়) হিসেবেই মনে করছে। ছাত্রদের কাজ নেই। কলেজ যেখানে, সেখানে কাজের সুবিধা না থাকায় কাজের সন্ধানে দূরে চলে যাওয়ায় অনিয়মিত ছাত্র হয়ে এদের অধিকাংশই ছাত্রত্ব হারিয়েছে। একে তো ব্রিটেনে চাকরির বাজার এমনিতেই মন্দা, অন্যদিকে ইমিগ্রেশন নীতির কড়াকড়ির কারণে অনিয়মিত ছাত্রদের কেউ কাজ দিতে চায় না। কারণ একজন অনিয়মিত ছাত্র ইউকে বোর্ডার ফোর্সের কাছে অবৈধ শ্রমিক এবং অবৈধ শ্রমিককে যে বা যারা কাজ দেয়, তাদের প্রতি আছে কঠোর হুঁশিয়ারি। কোনো প্রতিষ্ঠানে একজন অবৈধ শ্রমিক খুঁজে পেলে সর্বোচ্চ ১০ হাজার পাউন্ড জরিমানা করা হয়। ইতিমধ্যে শতাধিক বাঙালি রেস্টুুরেন্ট মালিক এ জরিমানা পরিশোধ করতে বাধ্য হয়েছেন। এমনকি উত্তর ইংল্যান্ডের একজন রেস্টুুরেন্ট ব্যবসায়ীকে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি কার্লাইল ক্রাউন কোর্ট জেলদণ্ড দিয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই এরা কাজ পাচ্ছে না। আর যদিও কাজ পায়, তা বলতে গেলে অপ্রতুল, আসল শ্রমমূল্য (পারিশ্রমিক) তারা পায় না। শোষিত হয়ে হাড়ভাঙা শ্রমের পর বছর শেষে জমানো অর্থ কিংবা বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে জোগাড় করা অর্থে শেষ পর্যন্ত কী হবে, সে এক প্রশ্ন। কারণ যেসব কলেজে তারা ভর্তি হতে চাইছে, সেখানেও তারা নিরাপদ নয়। কলেজগুলোর অবস্থা আরো খারাপ। যেসব কলেজে একসময় অনেক ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়েছিল, এখন সেসব কলেজে সেই ছাত্রছাত্রীদের অর্ধেকও পরবর্তী সেমিস্টারের জন্য নিজেদের এনরোল করছে না। ম্যানচেস্টার থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক প্রবাস বাংলায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টে লন্ডনের স্থানীয় এক কলেজের (কলেজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে) পরিসংখ্যান উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ওই কলেজে গত বছর ৯০০ মূলত বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু ক্লাসে উপস্থিত হয়নি ২০০ জনও। বলতে গেলে, নূ্যনতম ৭০০ ছাত্রছাত্রী তারা দেখেইনি। অর্থাৎ এসব ছাত্রছাত্রী পরবর্তী সেমিস্টারের জন্য আর নিজেদের এনরোল করছে না_এটাই নিশ্চিত। অর্থাৎ কলেজগুলোতে ছাত্র ভর্তির এই দৈনতা থাকলে এসব কলেজ টিকবে না, এমনিতেই এগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছাত্রছাত্রী, যারা ক্ষীণ আশা নিয়ে এখনো যুক্তরাজ্যে তাদের অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী করতে চাইছে, তারাও এসব কলেজ নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত। কারণ ভর্তি হওয়ার পরও যদি এসব কলেজ বন্ধ হয়ে যায়, এই শঙ্কা তাদের তাড়া করছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০০৯ সালে ইউকে পয়েন্ট বেইজড সিস্টেমের (টিয়ার ৪) আওতায় মোট এক হাজার ৯৮৭টি কলেজকে লাইসেন্স দেয় সরকার। এর মধ্যে প্রায় ২০০ কলেজের মালিক ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এবং এগুলোর সিংহভাগই পূর্ব লন্ডনের বিশেষত টাওয়ার হ্যামলেটস-ভিত্তিক। এর মধ্যে ইউকে বোর্ডার ফোর্স গত বছরের মধ্য জানুয়ারিতেই বাংলাদেশি মালিকানাধীন ৬৮টি কলেজের স্পন্সর লাইসেন্স বাতিল করেছে লন্ডনে। সে হিসেবে দেখা গেছে, যদি কলেজগুলো সরকারের ক্রাইটেরিয়া মিট করতে না পারে, তাহলে এসব কলেজের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। আর এভাবেই আরো অনেক বাংলাদেশি মালিকানাধীন কলেজসহ শুধু লন্ডনেই দুই শতাধিক কলেজের স্পন্সর লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছিল সে সময়। সেই থেকে বিশেষত এ সরকার অর্থাৎ টোরি লিবডেমের কোয়ালিশন আসার পর থেকে স্টুুডেন্ট ভিসাসহ অভিবাসন নীতিতে কড়াকড়ি আরোপের কারণে অনেক কলেজের মালিকই কলেজের মালিকানা ছেড়েছেন; এমনকি দেখা গেছে, ব্যবসায় কুলিয়ে উঠতে না পেরে অন্য মালিকের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন। সে জন্যই শঙ্কিত ছাত্রছাত্রীরা। যদি তারা ফি দিয়ে নতুন সেমিস্টারে কিংবা অন্য কোর্সে ভর্তিও হন এবং কলেজগুলো সরকারের নির্ধারিত নিয়মনীতি মেটাতে না পারে, তাহলে এসব কলেজও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর সে জন্যই তারা মূলধারার কলেজগুলোর প্রতি ঝুঁকতে চাইছে। কিন্তু সেই কলেজগুলোর আকাশছোঁয়া ফি তাদের এটা হতে দিচ্ছে না ।
অন্যদিকে শুধু ব্যবসার প্রয়োজনে দুই, তিন ও চার কক্ষ আর কিছু বেঞ্চ-ডেস্ক নিয়ে এমনকি ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারির (গ্রোসারি শপের) ওপরে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কলেজগুলো যেহেতু ছাত্রছাত্রীরা বিশ্বাস করতে পারছে না, সেহেতু এখন কলেজ মালিকরাও বিপাকে। হাজার হাজার এমনকি লাখ পাউন্ড বিনিয়োগ করা এই ব্যবসাটি এখন তাদের হাতছাড়া হতে যাচ্ছে। ব্যবসা বন্ধ করতে যাচ্ছেন অনেকেই। তাই তো শেষ চেষ্টা হিসেবে তাঁরাও এখন ইমিগ্রেশনের ব্যাপার নিয়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন। ইতিমধ্যে লন্ডনের তিনটি কলেজ যৌথভাবে এ সেমিনার করেছে এবং ভবিষ্যতেও তা করবে বলে জানিয়েছে।
সেমিনার-সিম্পোজিয়াম দিয়ে আশা জাগানো যায়। কিন্তু ওই সব ছাত্রছাত্রীর উপার্জনের পথ তো করে দেওয়া যায় না। এর পরও কষ্টে-সৃষ্টে উপার্জিত অর্থ দিয়ে নতুন সেমিস্টারে ভর্তির পরও যদি কলেজ বন্ধ হয়ে যায়, তখন তার অর্থাৎ ছাত্র কিংবা ছাত্রীর শেষ সম্বলটুকুর কী হবে? তাই তো এরা আর ছাত্রত্ব নিয়ে থাকছে না। ব্রিটেন ছাড়ছে ছাত্ররা। পার্শ্ববর্তী দেশ ফ্রান্সে যাচ্ছে এবং তা অবৈধ পথেই। ভিসা ছাড়া। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত দিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে। পাড়ি দিচ্ছে লন্ডনের ডোভারবন্দর থেকে ফ্রান্সের কালেবন্দর হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ইতালি, জার্মানি প্রভৃতি দেশের শহরে শহরে। সেখানে অর্থের হাতছানি না থাকলেও আছে অন্তত রাজনৈতিক আশ্রয়ের সুযোগ। ওই আশ্রয়েই থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা অন্তত কয়েকটা মাস। কিন্তু তারপর কী হবে? বন্দর থেকে বন্দরে ঘোরে এই ছাত্রছাত্রীরা তীর পাবে কবে? অনিশ্চিত এই যাত্রার শেষ কোথায়?
লেখক : লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক
faruk.joshi@gmail.com
No comments