জনপ্রশাসন কীভাবে রক্ষা পাবে? by মামুন ইমতিয়াজ
প্রায় ছ’মাস আগে দৈনিক নয়া দিগন্তে সোহেল মাহমুদের ‘আসুন জনপ্রশাসনকে রক্ষা করি’ নিবন্ধে প্রকাশিত বিষয়বস্তুর ওপর লেখা বা আলোচনার রেশ এখনও শেষ হয়নি; বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিকী এবং TV Talkshow-তে প্রশাসন দলীয়করণের সুফল ও কুফল নিয়ে বিতর্কের ঝড় চলছে।
‘প্রশাসন’ শব্দটি ক্ষমতা ও শাসনের ছায়া-কায়া; শাসকের প্রতিভূ হচ্ছে প্রশাসক। শাসনের অধীনে থাকা অর্থই হচ্ছে পরাধীনতা। তাই শাসনের অধীনে কেউ থাকতে চায় না, সবাই চায় স্বাধীনতা। সেই ‘প্রশাসন’ নিজেই আজ বিতর্কিত, ভঙ্গুর; যারা একে ধ্বংসের পথে নিয়ে গিয়েছিলেন তারাই রক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন।
কোনো অফিসে গিয়ে যদি দেখা যায় যে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মে নিয়োজিত না থেকে যে যার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন, বুঝতে হবে ওই অফিসে প্রশাসন অত্যন্ত দুর্বল। নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দৃশ্য অথবা অদৃশ্য কারণে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। বর্তমানে অফিস ব্যবস্থাপনার অবস্থা এতটাই করুণ যে, কর্তা কর্মের জন্য কাউকে কিছু বলার সাহস রাখেন না, বরং বছর শেষে বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদনে (ACR) ৯৯ নম্বর দিয়ে উল্টো নিজের অধস্তন কর্মকর্তার আস্থাভাজন হয়ে ধন্য হওয়ার চেষ্টা করেন। এমন একটা পরিস্থিতিতে কর্মের জন্য কর্মস্থলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাওয়া যাবে এমনটা আশা না করাই বুদ্ধিমানের কাজ। আর যদি ভাগ্যচক্রে এমন কোনো কর্মকর্তার আবির্ভাব ঘটে, যিনি অফিস ব্যবস্থাপনার করুণ দশা থেকে উত্তরণ ঘটাতে চান, তাহলে অধস্তনেরা তার বিরুদ্ধে সর্বৈব মিথ্যা, অর্ধ সত্য, বানোয়াট কাহিনী দিয়ে উপরের কর্মকর্তা বরাবর অথবা সাংবাদিকের মাধ্যমে পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ করে তাকে হেনস্তা করেন। প্রায়ই ক্ষমতাসীনদের অপছন্দনীয় রাজনৈতিক লেবেল লাগিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করা হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সবাই যখন স্বাধীন, তখন ‘শাসন’ মেনে পরাধীনতা কেউ মানতে রাজি হয়নি; প্রশাসনে রাজনৈতিক দলন শুরু হয়েছে তখন থেকেই। একজন ‘কলিমুদ্দিন’ যখন এসডিও (SDO) বাহাদুরের (তখন মহকুমা প্রশাসককে এসডিও বাহাদুর বলা হতো) সামনে স্টেনগান রেখে বাহাদুরি দেখাতো, এসডিও বাহাদুর তখন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন। স্বাধীনতার পর নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার; তারপর সেনাবাহিনী (জিয়া ও এরশাদের যুগ), সেনাবাহিনীর পর বিএনপি; বিএনপির পর আওয়ামী লীগ; আওয়ামী লীগের পর বিএনপি; আবার বিএনপি, সেনাবাহিনী, আওয়ামী লীগ সবাই সিভিল প্রশাসনকে অস্তিত্বহীন করার মিশন ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়েছে। প্রশাসনকে ধ্বংস করার অত্যন্ত সরব ও বলিষ্ঠ অংশীদার হচ্ছে জাতির Forth State হিসেবে পরিচয়দানকারী গণমাধ্যম। এ মিশনকে ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করেছেন পুলিশ, চিকিত্সক (প্রকৃচির নামে), বিচার বিভাগ, শিক্ষক, সুশীল সমাজ আরও অনেকেই; তবে প্রশাসনের সবচেয়ে বড় দলনকারী ছিল সিএসপিরা (CSP)। কিন্তু আজ সবাই নিজ ও দেশের স্বার্থে নিরপেক্ষ ও যোগ্যতর প্রশাসনকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে।
১৯৭৩ সালে দেশের প্রয়োজনেই প্রশাসনে বেশকিছু কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের মধ্যে শত মুখ রয়েছে, বাইরে রয়েছে হাজার কণ্ঠ। এ পর্যন্ত প্রশাসনকে নিয়ে কোনো লেখা চোখে পড়েনি, যেখানে ৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তাদের সুনাম করে একছত্র লেখা হয়েছে। তাদের যদি যোগ্যতার কোনো ঘাটতি থাকে তার জন্য তারা দায়ী নন; দায়ী সিএসপিরা (CSP) এবং সেনাবাহিনী। সিভিল প্রশাসনের বর্তমান অবস্থা তথা ৩৭ বছরের অযোগ্যতার দায়-দায়িত্ব এদেরই (সিএসপি ও সেনাবাহিনী) নিতে হবে।
১৯৭৩ সালে সিভিল প্রশাসনে কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগের পর তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য ও দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব ছিল মূলত সিএসপিদের (CSP)। কিন্তু ৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তাদের তারা ড়হি (নিজেদের অংশ হিসেবে স্বীকার করা) করেননি। বিদেশে তো দূরে থাক, দেশের মাটিতেই তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেননি। ৭৩ ব্যাচের একজন কর্মকর্তা ১৭ (সতের) বছর পর সাত দিনের জন্য ভূমি প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এসে আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন—‘এখন আর এনে লাভ কী? বিপরীতে উন্নয়নের জন্য শিক্ষার প্রয়োজনে দেশের দুর্যোগের সময় (১৯৭৩-৭৫) সিএসপিদের (CSP) অনেকেই উন্নয়ন অর্থনীতির (Development Economics) ওপর ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। বিদেশ থেকে এসে ‘উন্নয়নে পানি’ স্লোগানের মাধ্যমে জেনারেল জিয়াকে দিয়ে খাল কাটার বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। (যদিও আজ তাদের অনেকেই ‘পানি না টিপাইবাঁধ; টিপাই বাঁধ, টিপাই বাঁধ’ স্লোগান দেন)।
সিএসপিদের স্বপ্ন ছিল প্রশাসনিক দিগন্তে কিংবদন্তি (Legend) হয়ে থাকবেন তারা। তাদের পর আর প্রশাসন, প্রশাসক ইত্যাদি থাকবে না। জেনারেল এরশাদকে দিয়ে ‘মহকুমা প্রশাসক’ পদটি তারা বিলুপ্ত করেন। ‘জেলা প্রশাসন’ পদটি বিলুপ্ত করতে চেয়ে ৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তাদের বাধার মুখে তা করতে পারেননি তারা। অন্যদিকে এ সিএসপিরাই ব্রিগেডিয়ারকে ‘ব্রিগেডিয়ার জেনারেল’ করে দিয়ে তাদের জেনারেল সার্ভিসের অন্তর্গত করেছেন।
সিএসপি আর সেনাবাহিনী নিজেদের অতুলনীয় (Superior) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই জনপ্রশাসনের সব স্তরে ইংরেজি ব্যবহার বন্ধ করে দেয়; আজও বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদনে (ACR) ইংরেজি ব্যবহারের জন্য নম্বর কম দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। অন্যদিকে বলা হচ্ছে, সিএসপি আর সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারাই কেবল ইংরেজি জানেন, জনপ্রশাসনের বর্তমান কর্মকর্তারা ইংরেজি জানেন না।
সিএসপিরাই উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তনের নামে প্রশাসনের পীড়ামিড ভেঙে ফ্ল্যাট (flat) করে দিয়েছেন। আজ প্রশাসনের কর্মকর্তারা নিজেরাই নিজেদের শত্রু। আর এর পেছনে তাদের প্রশাসন দিগন্তে কিংবদন্তি (Administrative Legend) থাকার মানসিকতাই কাজ করেছে। ১৯৮৪ সালের ইঈঝ অফিসারদের মধ্যে যারা ঋড়ত্বরমহ ঈধফত্ব-এ যোগদান করেছেন তারা এখন অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অথবা বিভিন্ন দেশের মান্যবর রাষ্ট্রদূত। প্রশাসন ক্যাডারের অধিকাংশ কর্মকর্তা দু’ধাপ নিচে উপসচিব হিসেবে সুপারনিউমারি পদে সহকারী সচিব/সিনিয়র সহকারী সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। পুলিশ বিভাগে যারা যোগদান করেছেন কেউ কেউ অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক হিসেবে কাজ করছেন। অথচ পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশের প্রথম দু’দশকে প্রশাসন ক্যাডারের একস্তর নিচে পররাষ্ট্র ক্যাডার আর দু’তিন স্তর নিচে পুলিশ ক্যাডারের সদস্যগণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তাদের দিয়ে সিএসপিরা যত ধরনের অনৈতিক কাজ করেছেন, তার হিসা দেয়া কঠিন। সামরিক শাসনকে জিইয়ে রাখার জন্য জেনারেল এরশাদ আমলের নির্বাচনগুলোয় কাকে কত শতাংশ ভোট দেখিয়ে পাস করাতে হবে তা নির্ধারণ করেছিলেন এই সিএসপিরাই। মাঠ পর্যায়ের ৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তারা তাদের হুকুম পালন করেই রামকে পাস করিয়েছেন আর রহিমকে ফেল করিয়েছেন; অথচ আজ দায়ী করা হচ্ছে ৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তাদের, হায়রে সেলুকাস! কী বিচিত্র এ দেশ!
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আর মহকুমা প্রশাসক থেকে নামিয়ে সিএসপি ড. শেখ মোকসেদ আলীরা প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের উপজেলা নির্বাহী অফিসার করে পাঠালেন। পুলিশের যে এসপি অথবা এসডিপিও এদের পাশে বসতে পারলে ধন্য হয়ে যেত, তারা জেলা পর্যায়ে থেকে বস্ বস্ ভাব ধরলেন আর মাইক্রোসেকাপ দিয়ে যে O/C (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা)কে দেখতে হতো তিনি ইউএনওর সমকক্ষ ভাবতে শুরু করলেন। SDO-এর সঙ্গে SDPO-কে কিন্তু সিএসপিরা থানা পর্যায়ে পাঠালেন না; কারণ পুলিশ বিভাগের ক্ষতি করাটা তাদের লক্ষ্য ছিল না, ছিল প্রশাসনের ক্ষতি করাটা।
ক্যাডার আর নন-ক্যাডার সার্ভিস এক করে দিয়ে সিএসপিরা মুক্তার হাসি হেসেছেন। বিশ্বের নজিরবিহীনভাবে ত্রিশটি ক্যাডার তৈরি করে সিএসপিরা নিজেদের মধ্যে 'Bangladesh Cattle Services (BCS)' তৈরি করে দিয়েছি বলে আলোচনা করতেন। সিএসপি সচিবরা সেনাবাহিনীর একজন মেজরকে দাঁড়িয়ে যেভাবে সম্মান করতেন তার EPCS যুগ্ম সচিবকেও তারা ওই সম্মান করতেন না; এ দৃশ্য প্রশাসনের সব প্রবীণ কর্মকর্তাই দেখেছেন। আরও দেখেছেন একজন CSP SDO তার EPCS Additional SDO-র সঙ্গে আলোচনা করছেন, প্রবেশ করলেন CSP Assistant Commissioner; CSP SDO পিয়নকে দু’-CSP-র জন্য দুটি ঈড়শব আর EPCS-এর জন্য চা-য়ের আদেশ দিলেন। অবজ্ঞা, অশ্রদ্ধা, অনীহা ও অসহযোগিতার মধ্য দিয়ে কোনো বীর তৈরি হয়েছে আমার জানা নেই। তাইতো বলা হয় Brave are not born, but built। CSP-দের দলনে বাংলাদেশের প্রশাসন আতুড় ঘরেই হাত-পা হারিয়েছে, আজকালের সাংবাদিকদের কাছে এ তথ্য কতটুকু আছে তা আমার জানা নেই।
হাত-পাবিহীন কর্মকর্তারা তার পরও দেশের জন্য যে অবদান রেখেছেন তার হিসাব কেউ কখনও দেননি, এমনকি ওই কর্মকর্তারাও তা প্রকাশ-প্রচারে ব্যর্থ হয়েছেন। ’৮২ সালে উপজেলা পদ্ধতি তৈরি করে যখন সিএসপিরা ৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তাদের নির্বাসনে পাঠালেন, যখন ঘোষণা দিলেন নির্বাহী অফিসারকে তার পরিবার নিয়ে অবশ্যই নির্ধারিত কোয়ার্টারে (Earmarked Quarters) থাকতে হবে, তখন তাদের সন্তানদের শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হয়ে গেল। সঙ্গে আরও অন্যান্য অনেক বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সন্তানদের একই অবস্থা হলো। কিন্তু পুলিশ, পোস্টাল, আনসার, নিরীক্ষা, রেলওয়ে, পররাষ্ট্র, ইকোনমিক, পরিসংখ্যান, খাদ্যসহ আরও কিছু ক্যাডার কর্মকর্তাদের এ অবস্থায় পড়তে হয়নি। এ অবস্থায় উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা অন্য কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিয়ে প্রথমেই একটি করে কএ ঝপযড়ড়ষ স্থাপন করেন। নির্বাহী অফিসারের মিসেস প্রিন্সিপাল আর অন্য কর্মকর্তাদের মিসেসরা শিক্ষক হিসেবে বিনা পারিশ্রমিকে বছরের পর বছর কাজ করেছেন। স্থানীয় লোকদের সহযোগিতায় প্রতি উপজেলায় একটি করে মসজিদ, একটি করে মাদ্রাসা, একটি করে কলেজ ও একটি করে উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন এই কর্মকর্তারাই। এগুলো করতে কিন্তু সরকারি কোনো অর্থ প্রথমে দেয়া হয়নি, স্থানীয় সংগ্রহের মাধ্যমেই কর্মকর্তারা তা করেছেন আর তাদের বেশি দুর্নাম তো এ জন্যই। প্রায় ৪০০টি উপজেলায় ৪০০টি মসজিদ, ৪০০টি মাদ্রাসা, ৪০০টি কলেজ, ৪০০টি হাই স্কুল, ৪০০টি কেজি স্কুল করার কর্তৃত্ব ৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তাদের, কোনো সিএসপি বা সেনাবাহিনীর নয়।
এভাবে কাজ করে করে যখন তারা ১৭-১৮ বছর পর উপলব্ধি করল তাদের পদোন্নতি প্রয়োজন, তখন তারা দেখলেন হতাশার চিত্র। যেখানে পররাষ্ট্র ক্যাডারের একটি পদে পদোন্নতির জন্য লোক রয়েছে ০.৭৪ জন (অর্থাত্ পদ : লোক=১ : ০.৭৪), পুলিশ ১ : ১.২৫, হিসাব ও নিরীক্ষায় ১ : ০.৬৪, তখন প্রশাসনে ১ : ১৬ অর্থাত্ ১টি পদোন্নতি পদের জন্য ১৬ জন কর্মকর্তার যুদ্ধ। ৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তাদের যেখানে পদোন্নতি হচ্ছে না, সেখানে ৭৪, ৭৭, ৭৯, ৮১ ব্যাচের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির কোনো সুযোগ থাকল না। অন্যদিকে সেনাবাহিনী থেকে আত্তীকৃত (Lateral Entry), যার সংখ্যা ১২২ জন; ঈঝচ-দের এবং নবসৃষ্ট ২৫ ক্যাডারকে ২৫% পদ ছেড়ে দেয়া, পদোন্নতির সুযোগকে আরও ক্ষীণ করে দিয়েছে। হতাশা নেমে এসেছে প্রশাসনের সব স্তরে, হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠী থেকে বড় কিছু আশা করা বাতুলতা মাত্র। গত ৩৮ বছরে ঈঝচ-রা জনপ্রশাসনের জন্য ঈরারষ ঝবত্ারপব অপঃ করার চিন্তা করতে পারেননি।
প্রশাসনকে দুর্বল করার জন্য আরও একটি গোষ্ঠী প্রত্যক্ষভাবে দায়ী, তারা হচ্ছে NGO কর্ণধাররা; যাদের একজন সিএসপি আদর করে নাম দিয়েছেন সুশীল (সু-ভালো, শীল-নাপিত) সমাজ। তারা প্রচার করা শুরু করলেন যে প্রশাসনের নাপিতরা ভালোভাবে চুল কাটতে পারছে না। আমরা ভালো নাপিত, আমরাই ভালোভাবে চুল কাটি। এই সুশীলরা অর্থের বিনিময়ে সিএসপি সচিবদের ক্রয় করা শুরু করলেন। একজন সিএসপি সচিব তো নথিতে লিখলেন— আমি চাকরি শেষে এ প্রতিষ্ঠানে যোগদান করব, আমার পর্যায়ে তা নিষ্পন্ন হওয়া সমীচীন নয়, সদস্য মহোদয় সিদ্ধান্ত দেবেন; অর্থ বুঝে নিন, কীভাবে দলন করলেন সদস্য মহোদয়কে। যে সিএসপি NGO-দের নাম দিয়েছেন সুশীল সমাজ, ওই সিএসপি সাহেবই আমলাদের নাম দিয়েছেন সুশীল সেবক অর্থাত্ ভালো নাপিতদের চামচা হিসেবে কাজ করবে আমলারা; তাই করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের সেবক তারা আর থাকেননি। চাকরি শেষে আমলারা সাধারণ মানুষের কাতারে আসতে চান না। চান ওই ভালো নাপিতদের চাকর হতে; তাই চাকরির শেষ লগনে এসে সুশীলদের চাকর হওয়ার মহড়া দিতে থাকেন।
বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রে (যাকে ‘জনপ্রশাসন’ বলা হচ্ছে) সিএসপি আর সেনাবাহিনীর কালো থাবা নিয়ে হয়তো কয়েকটি বই লেখা যাবে; কিন্তু কোনো বই লেখার ইচ্ছা নিয়ে এ লেখা শুরু করা হয়নি। কোনো ক্রিয়া (Proactive) দেখানো নয় বরং প্রতিক্রিয়া (জবধপঃরাব ত্ড়ষব) দেখানোর জন্যই মূলত এ লেখা শুরু করা হয়েছিল। কারণ সোহেল মাহমুদ বর্তমান সরকারের দলীয় কালো হাতের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে তার লেখাটি শুরু এবং শেষ করেছেন। আসল কথা এখানে নয়, যেমন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী লিখেছেন—‘প্রশ্ন হতে পারে কোমর ভাঙা প্রশাসনের দিকে এই যে, আমাদের যাত্রা, এই কি নিতান্তই নির্বুদ্ধিতা বা অমনোযোগের ফল, নাকি এটা একটা সূক্ষ্ম হিসেবের ফসল?’ [উপ-সম্পাদকীয়, দৈনিক সংবাদ, ১৫ জুলাই ১৯৯০]। আমি আগেই বলেছি, এটা একটা সূক্ষ্ম হিসাব; যে হিসাবে ঈঝচরা প্রশাসনে কিংবদন্তি হয়ে থাকবেন, যে হিসাবে সেনাবাহিনী জনপ্রশাসনের সব জায়গা দখল করতে পারবে (যমুনা ব্রিজের টোল তোলা, ভোটার আইডি তৈরি, মেসিন রিডেবেল পাসপোর্ট প্রকল্প আর সুন্দর করে বেসামরিক প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সামনে কায়দা করে যানজট তৈরির জন্য নতুন রাস্তার মুখ তৈরি) যে হিসাব পুলিশ এখন সাংবিধানিক সংস্থা হতে চাচ্ছে, যে হিসাবে সুশীল সমাজ আরও জায়গা দখল করে নিতে পারবে, যে হিসেবে forth state তথ্য প্রাপ্তির স্বাধীনতায় বাজার সম্প্রসারণ করতে পারবে; আরও আরও হিসাব, এ হিসাব ২+২=৪ নয়, এ হিসাব ২+২=১০ (কখনও বা ইনফিনিটি)।
আমাদের সিএসপিরা প্রশাসনকে শুধু দিগ্ভ্রান্ত করেননি, করেছেন পুরো জাতিকে দুর্দশাগ্রস্ত। প্রশ্ন করার যথেষ্ট কারণ থাকতেই পারে যে প্রশাসনকে রক্ষা করার কথা বলতে গিয়ে সিএসপিদের বিপক্ষে এত গীত কেন গাওয়া। ফজলুর রহমানের ভাষায়—‘কে বলে সিএসপি বলে কোনো শ্রেণী নেই? শ্রেণীর ভেতরে শ্রেণীর মতো, পরতের ভেতরে পরতের মতো, খাঁজের ভেতরে খাঁজের মতো লেগে লেপ্টে আছে এই সিএসপি শ্রেণীটি। এরা সরকারের প্রায় সবকয়টি মন্ত্রণালয়ের, বিভাগের সচিব বা অনুরূপ সর্বোচ্চ স্তরের কর্মকর্তা ছিলেন। তাদের নির্দেশ এবং অভিপ্রায়ই দেশের সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। ঠিক অঙুলি হেলনে না হলেও তাদের হস্ত সঞ্চালনে দেশ পরিচালিত হয়েছে।
সিএসপিদের শেষ নেই, কবর থেকেও পুকী (জন্মগ্রহণ) দিয়ে ওঠেন তারা। গত দুই বছর সেনা-সিএসপি শাসনে দেশের যে উন্নতি (?) হয়েছে, তা দেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছে। সে আমলের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন, উপদেষ্টা ড. শওকত আলী ও মির্জা আজিজুল ইসলাম, বুদ্ধিদাতা ড. আকবর আলি খান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. সালেহ আহমেদ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. শামসুল হুদা, তারা সব সিএসপি আর সিপাইপতি মইনুদ্দিন আর তার দোসর মতিন, মাসুদ, হাসান মাসউদ, শাখাওয়াত (নির্বাচন কমিশনার) সবাই মিলে কাদের সিদ্দিকীর ভাষায়, ‘দেশটাকে পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে দিয়েছেন।’
আওয়ামী লীগ আর বিএনপি জনপ্রশাসনের জন্য মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। দেশের চেয়ে ক্ষমতা যাদের কাছে বড় তারা দূরদর্শী চিন্তা বাদ দিয়ে নিকটবর্তী চিন্তা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। গত ৩৮ বছরে অদূরদর্শী (Shortsighted) চিন্তার কারণে আজ এ জাতি (Nation State) একটি Adhoc Nation State-এ পরিণত হয়েছে।
দল দুটি প্রশাসনকে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন হিসেবে না গড়ে দলীয় (আমাদের প্রশাসন হিসেবে চিহ্নিত) প্রশাসন গড়ার দিকে মনোযোগী হয়। জনতার মঞ্চের নায়করা যারা ওই সিএসপি গোষ্ঠীর, প্রশাসনকে রাজনীতিকায়নে প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। রাজনীতিবিদদের অদূরদর্শী লক্ষ্য (Shortsighted goal) এবং সিএসপিদের কিংবদন্তি (Legend) হওয়ার দূরদর্শ।
কোনো অফিসে গিয়ে যদি দেখা যায় যে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মে নিয়োজিত না থেকে যে যার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন, বুঝতে হবে ওই অফিসে প্রশাসন অত্যন্ত দুর্বল। নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দৃশ্য অথবা অদৃশ্য কারণে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। বর্তমানে অফিস ব্যবস্থাপনার অবস্থা এতটাই করুণ যে, কর্তা কর্মের জন্য কাউকে কিছু বলার সাহস রাখেন না, বরং বছর শেষে বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদনে (ACR) ৯৯ নম্বর দিয়ে উল্টো নিজের অধস্তন কর্মকর্তার আস্থাভাজন হয়ে ধন্য হওয়ার চেষ্টা করেন। এমন একটা পরিস্থিতিতে কর্মের জন্য কর্মস্থলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাওয়া যাবে এমনটা আশা না করাই বুদ্ধিমানের কাজ। আর যদি ভাগ্যচক্রে এমন কোনো কর্মকর্তার আবির্ভাব ঘটে, যিনি অফিস ব্যবস্থাপনার করুণ দশা থেকে উত্তরণ ঘটাতে চান, তাহলে অধস্তনেরা তার বিরুদ্ধে সর্বৈব মিথ্যা, অর্ধ সত্য, বানোয়াট কাহিনী দিয়ে উপরের কর্মকর্তা বরাবর অথবা সাংবাদিকের মাধ্যমে পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ করে তাকে হেনস্তা করেন। প্রায়ই ক্ষমতাসীনদের অপছন্দনীয় রাজনৈতিক লেবেল লাগিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করা হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সবাই যখন স্বাধীন, তখন ‘শাসন’ মেনে পরাধীনতা কেউ মানতে রাজি হয়নি; প্রশাসনে রাজনৈতিক দলন শুরু হয়েছে তখন থেকেই। একজন ‘কলিমুদ্দিন’ যখন এসডিও (SDO) বাহাদুরের (তখন মহকুমা প্রশাসককে এসডিও বাহাদুর বলা হতো) সামনে স্টেনগান রেখে বাহাদুরি দেখাতো, এসডিও বাহাদুর তখন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন। স্বাধীনতার পর নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার; তারপর সেনাবাহিনী (জিয়া ও এরশাদের যুগ), সেনাবাহিনীর পর বিএনপি; বিএনপির পর আওয়ামী লীগ; আওয়ামী লীগের পর বিএনপি; আবার বিএনপি, সেনাবাহিনী, আওয়ামী লীগ সবাই সিভিল প্রশাসনকে অস্তিত্বহীন করার মিশন ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়েছে। প্রশাসনকে ধ্বংস করার অত্যন্ত সরব ও বলিষ্ঠ অংশীদার হচ্ছে জাতির Forth State হিসেবে পরিচয়দানকারী গণমাধ্যম। এ মিশনকে ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করেছেন পুলিশ, চিকিত্সক (প্রকৃচির নামে), বিচার বিভাগ, শিক্ষক, সুশীল সমাজ আরও অনেকেই; তবে প্রশাসনের সবচেয়ে বড় দলনকারী ছিল সিএসপিরা (CSP)। কিন্তু আজ সবাই নিজ ও দেশের স্বার্থে নিরপেক্ষ ও যোগ্যতর প্রশাসনকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে।
১৯৭৩ সালে দেশের প্রয়োজনেই প্রশাসনে বেশকিছু কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের মধ্যে শত মুখ রয়েছে, বাইরে রয়েছে হাজার কণ্ঠ। এ পর্যন্ত প্রশাসনকে নিয়ে কোনো লেখা চোখে পড়েনি, যেখানে ৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তাদের সুনাম করে একছত্র লেখা হয়েছে। তাদের যদি যোগ্যতার কোনো ঘাটতি থাকে তার জন্য তারা দায়ী নন; দায়ী সিএসপিরা (CSP) এবং সেনাবাহিনী। সিভিল প্রশাসনের বর্তমান অবস্থা তথা ৩৭ বছরের অযোগ্যতার দায়-দায়িত্ব এদেরই (সিএসপি ও সেনাবাহিনী) নিতে হবে।
১৯৭৩ সালে সিভিল প্রশাসনে কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগের পর তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য ও দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব ছিল মূলত সিএসপিদের (CSP)। কিন্তু ৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তাদের তারা ড়হি (নিজেদের অংশ হিসেবে স্বীকার করা) করেননি। বিদেশে তো দূরে থাক, দেশের মাটিতেই তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেননি। ৭৩ ব্যাচের একজন কর্মকর্তা ১৭ (সতের) বছর পর সাত দিনের জন্য ভূমি প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এসে আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন—‘এখন আর এনে লাভ কী? বিপরীতে উন্নয়নের জন্য শিক্ষার প্রয়োজনে দেশের দুর্যোগের সময় (১৯৭৩-৭৫) সিএসপিদের (CSP) অনেকেই উন্নয়ন অর্থনীতির (Development Economics) ওপর ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। বিদেশ থেকে এসে ‘উন্নয়নে পানি’ স্লোগানের মাধ্যমে জেনারেল জিয়াকে দিয়ে খাল কাটার বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। (যদিও আজ তাদের অনেকেই ‘পানি না টিপাইবাঁধ; টিপাই বাঁধ, টিপাই বাঁধ’ স্লোগান দেন)।
সিএসপিদের স্বপ্ন ছিল প্রশাসনিক দিগন্তে কিংবদন্তি (Legend) হয়ে থাকবেন তারা। তাদের পর আর প্রশাসন, প্রশাসক ইত্যাদি থাকবে না। জেনারেল এরশাদকে দিয়ে ‘মহকুমা প্রশাসক’ পদটি তারা বিলুপ্ত করেন। ‘জেলা প্রশাসন’ পদটি বিলুপ্ত করতে চেয়ে ৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তাদের বাধার মুখে তা করতে পারেননি তারা। অন্যদিকে এ সিএসপিরাই ব্রিগেডিয়ারকে ‘ব্রিগেডিয়ার জেনারেল’ করে দিয়ে তাদের জেনারেল সার্ভিসের অন্তর্গত করেছেন।
সিএসপি আর সেনাবাহিনী নিজেদের অতুলনীয় (Superior) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই জনপ্রশাসনের সব স্তরে ইংরেজি ব্যবহার বন্ধ করে দেয়; আজও বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদনে (ACR) ইংরেজি ব্যবহারের জন্য নম্বর কম দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। অন্যদিকে বলা হচ্ছে, সিএসপি আর সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারাই কেবল ইংরেজি জানেন, জনপ্রশাসনের বর্তমান কর্মকর্তারা ইংরেজি জানেন না।
সিএসপিরাই উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তনের নামে প্রশাসনের পীড়ামিড ভেঙে ফ্ল্যাট (flat) করে দিয়েছেন। আজ প্রশাসনের কর্মকর্তারা নিজেরাই নিজেদের শত্রু। আর এর পেছনে তাদের প্রশাসন দিগন্তে কিংবদন্তি (Administrative Legend) থাকার মানসিকতাই কাজ করেছে। ১৯৮৪ সালের ইঈঝ অফিসারদের মধ্যে যারা ঋড়ত্বরমহ ঈধফত্ব-এ যোগদান করেছেন তারা এখন অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অথবা বিভিন্ন দেশের মান্যবর রাষ্ট্রদূত। প্রশাসন ক্যাডারের অধিকাংশ কর্মকর্তা দু’ধাপ নিচে উপসচিব হিসেবে সুপারনিউমারি পদে সহকারী সচিব/সিনিয়র সহকারী সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। পুলিশ বিভাগে যারা যোগদান করেছেন কেউ কেউ অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক হিসেবে কাজ করছেন। অথচ পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশের প্রথম দু’দশকে প্রশাসন ক্যাডারের একস্তর নিচে পররাষ্ট্র ক্যাডার আর দু’তিন স্তর নিচে পুলিশ ক্যাডারের সদস্যগণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তাদের দিয়ে সিএসপিরা যত ধরনের অনৈতিক কাজ করেছেন, তার হিসা দেয়া কঠিন। সামরিক শাসনকে জিইয়ে রাখার জন্য জেনারেল এরশাদ আমলের নির্বাচনগুলোয় কাকে কত শতাংশ ভোট দেখিয়ে পাস করাতে হবে তা নির্ধারণ করেছিলেন এই সিএসপিরাই। মাঠ পর্যায়ের ৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তারা তাদের হুকুম পালন করেই রামকে পাস করিয়েছেন আর রহিমকে ফেল করিয়েছেন; অথচ আজ দায়ী করা হচ্ছে ৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তাদের, হায়রে সেলুকাস! কী বিচিত্র এ দেশ!
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আর মহকুমা প্রশাসক থেকে নামিয়ে সিএসপি ড. শেখ মোকসেদ আলীরা প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের উপজেলা নির্বাহী অফিসার করে পাঠালেন। পুলিশের যে এসপি অথবা এসডিপিও এদের পাশে বসতে পারলে ধন্য হয়ে যেত, তারা জেলা পর্যায়ে থেকে বস্ বস্ ভাব ধরলেন আর মাইক্রোসেকাপ দিয়ে যে O/C (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা)কে দেখতে হতো তিনি ইউএনওর সমকক্ষ ভাবতে শুরু করলেন। SDO-এর সঙ্গে SDPO-কে কিন্তু সিএসপিরা থানা পর্যায়ে পাঠালেন না; কারণ পুলিশ বিভাগের ক্ষতি করাটা তাদের লক্ষ্য ছিল না, ছিল প্রশাসনের ক্ষতি করাটা।
ক্যাডার আর নন-ক্যাডার সার্ভিস এক করে দিয়ে সিএসপিরা মুক্তার হাসি হেসেছেন। বিশ্বের নজিরবিহীনভাবে ত্রিশটি ক্যাডার তৈরি করে সিএসপিরা নিজেদের মধ্যে 'Bangladesh Cattle Services (BCS)' তৈরি করে দিয়েছি বলে আলোচনা করতেন। সিএসপি সচিবরা সেনাবাহিনীর একজন মেজরকে দাঁড়িয়ে যেভাবে সম্মান করতেন তার EPCS যুগ্ম সচিবকেও তারা ওই সম্মান করতেন না; এ দৃশ্য প্রশাসনের সব প্রবীণ কর্মকর্তাই দেখেছেন। আরও দেখেছেন একজন CSP SDO তার EPCS Additional SDO-র সঙ্গে আলোচনা করছেন, প্রবেশ করলেন CSP Assistant Commissioner; CSP SDO পিয়নকে দু’-CSP-র জন্য দুটি ঈড়শব আর EPCS-এর জন্য চা-য়ের আদেশ দিলেন। অবজ্ঞা, অশ্রদ্ধা, অনীহা ও অসহযোগিতার মধ্য দিয়ে কোনো বীর তৈরি হয়েছে আমার জানা নেই। তাইতো বলা হয় Brave are not born, but built। CSP-দের দলনে বাংলাদেশের প্রশাসন আতুড় ঘরেই হাত-পা হারিয়েছে, আজকালের সাংবাদিকদের কাছে এ তথ্য কতটুকু আছে তা আমার জানা নেই।
হাত-পাবিহীন কর্মকর্তারা তার পরও দেশের জন্য যে অবদান রেখেছেন তার হিসাব কেউ কখনও দেননি, এমনকি ওই কর্মকর্তারাও তা প্রকাশ-প্রচারে ব্যর্থ হয়েছেন। ’৮২ সালে উপজেলা পদ্ধতি তৈরি করে যখন সিএসপিরা ৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তাদের নির্বাসনে পাঠালেন, যখন ঘোষণা দিলেন নির্বাহী অফিসারকে তার পরিবার নিয়ে অবশ্যই নির্ধারিত কোয়ার্টারে (Earmarked Quarters) থাকতে হবে, তখন তাদের সন্তানদের শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হয়ে গেল। সঙ্গে আরও অন্যান্য অনেক বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সন্তানদের একই অবস্থা হলো। কিন্তু পুলিশ, পোস্টাল, আনসার, নিরীক্ষা, রেলওয়ে, পররাষ্ট্র, ইকোনমিক, পরিসংখ্যান, খাদ্যসহ আরও কিছু ক্যাডার কর্মকর্তাদের এ অবস্থায় পড়তে হয়নি। এ অবস্থায় উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা অন্য কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিয়ে প্রথমেই একটি করে কএ ঝপযড়ড়ষ স্থাপন করেন। নির্বাহী অফিসারের মিসেস প্রিন্সিপাল আর অন্য কর্মকর্তাদের মিসেসরা শিক্ষক হিসেবে বিনা পারিশ্রমিকে বছরের পর বছর কাজ করেছেন। স্থানীয় লোকদের সহযোগিতায় প্রতি উপজেলায় একটি করে মসজিদ, একটি করে মাদ্রাসা, একটি করে কলেজ ও একটি করে উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন এই কর্মকর্তারাই। এগুলো করতে কিন্তু সরকারি কোনো অর্থ প্রথমে দেয়া হয়নি, স্থানীয় সংগ্রহের মাধ্যমেই কর্মকর্তারা তা করেছেন আর তাদের বেশি দুর্নাম তো এ জন্যই। প্রায় ৪০০টি উপজেলায় ৪০০টি মসজিদ, ৪০০টি মাদ্রাসা, ৪০০টি কলেজ, ৪০০টি হাই স্কুল, ৪০০টি কেজি স্কুল করার কর্তৃত্ব ৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তাদের, কোনো সিএসপি বা সেনাবাহিনীর নয়।
এভাবে কাজ করে করে যখন তারা ১৭-১৮ বছর পর উপলব্ধি করল তাদের পদোন্নতি প্রয়োজন, তখন তারা দেখলেন হতাশার চিত্র। যেখানে পররাষ্ট্র ক্যাডারের একটি পদে পদোন্নতির জন্য লোক রয়েছে ০.৭৪ জন (অর্থাত্ পদ : লোক=১ : ০.৭৪), পুলিশ ১ : ১.২৫, হিসাব ও নিরীক্ষায় ১ : ০.৬৪, তখন প্রশাসনে ১ : ১৬ অর্থাত্ ১টি পদোন্নতি পদের জন্য ১৬ জন কর্মকর্তার যুদ্ধ। ৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তাদের যেখানে পদোন্নতি হচ্ছে না, সেখানে ৭৪, ৭৭, ৭৯, ৮১ ব্যাচের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির কোনো সুযোগ থাকল না। অন্যদিকে সেনাবাহিনী থেকে আত্তীকৃত (Lateral Entry), যার সংখ্যা ১২২ জন; ঈঝচ-দের এবং নবসৃষ্ট ২৫ ক্যাডারকে ২৫% পদ ছেড়ে দেয়া, পদোন্নতির সুযোগকে আরও ক্ষীণ করে দিয়েছে। হতাশা নেমে এসেছে প্রশাসনের সব স্তরে, হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠী থেকে বড় কিছু আশা করা বাতুলতা মাত্র। গত ৩৮ বছরে ঈঝচ-রা জনপ্রশাসনের জন্য ঈরারষ ঝবত্ারপব অপঃ করার চিন্তা করতে পারেননি।
প্রশাসনকে দুর্বল করার জন্য আরও একটি গোষ্ঠী প্রত্যক্ষভাবে দায়ী, তারা হচ্ছে NGO কর্ণধাররা; যাদের একজন সিএসপি আদর করে নাম দিয়েছেন সুশীল (সু-ভালো, শীল-নাপিত) সমাজ। তারা প্রচার করা শুরু করলেন যে প্রশাসনের নাপিতরা ভালোভাবে চুল কাটতে পারছে না। আমরা ভালো নাপিত, আমরাই ভালোভাবে চুল কাটি। এই সুশীলরা অর্থের বিনিময়ে সিএসপি সচিবদের ক্রয় করা শুরু করলেন। একজন সিএসপি সচিব তো নথিতে লিখলেন— আমি চাকরি শেষে এ প্রতিষ্ঠানে যোগদান করব, আমার পর্যায়ে তা নিষ্পন্ন হওয়া সমীচীন নয়, সদস্য মহোদয় সিদ্ধান্ত দেবেন; অর্থ বুঝে নিন, কীভাবে দলন করলেন সদস্য মহোদয়কে। যে সিএসপি NGO-দের নাম দিয়েছেন সুশীল সমাজ, ওই সিএসপি সাহেবই আমলাদের নাম দিয়েছেন সুশীল সেবক অর্থাত্ ভালো নাপিতদের চামচা হিসেবে কাজ করবে আমলারা; তাই করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের সেবক তারা আর থাকেননি। চাকরি শেষে আমলারা সাধারণ মানুষের কাতারে আসতে চান না। চান ওই ভালো নাপিতদের চাকর হতে; তাই চাকরির শেষ লগনে এসে সুশীলদের চাকর হওয়ার মহড়া দিতে থাকেন।
বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রে (যাকে ‘জনপ্রশাসন’ বলা হচ্ছে) সিএসপি আর সেনাবাহিনীর কালো থাবা নিয়ে হয়তো কয়েকটি বই লেখা যাবে; কিন্তু কোনো বই লেখার ইচ্ছা নিয়ে এ লেখা শুরু করা হয়নি। কোনো ক্রিয়া (Proactive) দেখানো নয় বরং প্রতিক্রিয়া (জবধপঃরাব ত্ড়ষব) দেখানোর জন্যই মূলত এ লেখা শুরু করা হয়েছিল। কারণ সোহেল মাহমুদ বর্তমান সরকারের দলীয় কালো হাতের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে তার লেখাটি শুরু এবং শেষ করেছেন। আসল কথা এখানে নয়, যেমন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী লিখেছেন—‘প্রশ্ন হতে পারে কোমর ভাঙা প্রশাসনের দিকে এই যে, আমাদের যাত্রা, এই কি নিতান্তই নির্বুদ্ধিতা বা অমনোযোগের ফল, নাকি এটা একটা সূক্ষ্ম হিসেবের ফসল?’ [উপ-সম্পাদকীয়, দৈনিক সংবাদ, ১৫ জুলাই ১৯৯০]। আমি আগেই বলেছি, এটা একটা সূক্ষ্ম হিসাব; যে হিসাবে ঈঝচরা প্রশাসনে কিংবদন্তি হয়ে থাকবেন, যে হিসাবে সেনাবাহিনী জনপ্রশাসনের সব জায়গা দখল করতে পারবে (যমুনা ব্রিজের টোল তোলা, ভোটার আইডি তৈরি, মেসিন রিডেবেল পাসপোর্ট প্রকল্প আর সুন্দর করে বেসামরিক প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সামনে কায়দা করে যানজট তৈরির জন্য নতুন রাস্তার মুখ তৈরি) যে হিসাব পুলিশ এখন সাংবিধানিক সংস্থা হতে চাচ্ছে, যে হিসাবে সুশীল সমাজ আরও জায়গা দখল করে নিতে পারবে, যে হিসেবে forth state তথ্য প্রাপ্তির স্বাধীনতায় বাজার সম্প্রসারণ করতে পারবে; আরও আরও হিসাব, এ হিসাব ২+২=৪ নয়, এ হিসাব ২+২=১০ (কখনও বা ইনফিনিটি)।
আমাদের সিএসপিরা প্রশাসনকে শুধু দিগ্ভ্রান্ত করেননি, করেছেন পুরো জাতিকে দুর্দশাগ্রস্ত। প্রশ্ন করার যথেষ্ট কারণ থাকতেই পারে যে প্রশাসনকে রক্ষা করার কথা বলতে গিয়ে সিএসপিদের বিপক্ষে এত গীত কেন গাওয়া। ফজলুর রহমানের ভাষায়—‘কে বলে সিএসপি বলে কোনো শ্রেণী নেই? শ্রেণীর ভেতরে শ্রেণীর মতো, পরতের ভেতরে পরতের মতো, খাঁজের ভেতরে খাঁজের মতো লেগে লেপ্টে আছে এই সিএসপি শ্রেণীটি। এরা সরকারের প্রায় সবকয়টি মন্ত্রণালয়ের, বিভাগের সচিব বা অনুরূপ সর্বোচ্চ স্তরের কর্মকর্তা ছিলেন। তাদের নির্দেশ এবং অভিপ্রায়ই দেশের সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। ঠিক অঙুলি হেলনে না হলেও তাদের হস্ত সঞ্চালনে দেশ পরিচালিত হয়েছে।
সিএসপিদের শেষ নেই, কবর থেকেও পুকী (জন্মগ্রহণ) দিয়ে ওঠেন তারা। গত দুই বছর সেনা-সিএসপি শাসনে দেশের যে উন্নতি (?) হয়েছে, তা দেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছে। সে আমলের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন, উপদেষ্টা ড. শওকত আলী ও মির্জা আজিজুল ইসলাম, বুদ্ধিদাতা ড. আকবর আলি খান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. সালেহ আহমেদ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. শামসুল হুদা, তারা সব সিএসপি আর সিপাইপতি মইনুদ্দিন আর তার দোসর মতিন, মাসুদ, হাসান মাসউদ, শাখাওয়াত (নির্বাচন কমিশনার) সবাই মিলে কাদের সিদ্দিকীর ভাষায়, ‘দেশটাকে পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে দিয়েছেন।’
আওয়ামী লীগ আর বিএনপি জনপ্রশাসনের জন্য মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। দেশের চেয়ে ক্ষমতা যাদের কাছে বড় তারা দূরদর্শী চিন্তা বাদ দিয়ে নিকটবর্তী চিন্তা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। গত ৩৮ বছরে অদূরদর্শী (Shortsighted) চিন্তার কারণে আজ এ জাতি (Nation State) একটি Adhoc Nation State-এ পরিণত হয়েছে।
দল দুটি প্রশাসনকে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন হিসেবে না গড়ে দলীয় (আমাদের প্রশাসন হিসেবে চিহ্নিত) প্রশাসন গড়ার দিকে মনোযোগী হয়। জনতার মঞ্চের নায়করা যারা ওই সিএসপি গোষ্ঠীর, প্রশাসনকে রাজনীতিকায়নে প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। রাজনীতিবিদদের অদূরদর্শী লক্ষ্য (Shortsighted goal) এবং সিএসপিদের কিংবদন্তি (Legend) হওয়ার দূরদর্শ।
No comments