তারুণ্যের জয়-আকাশছোঁয়া মুসা by আসিফ নজরুল

তিন-চার বছর আগের কথা। রিমি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল তাকে। ফরসা, একহারা গড়ন, শিশুতোষ চোখ, ওপরের দিকে দৃষ্টি। কিন্তু সবচেয়ে চোখে পড়ে তার ফুলে ওঠা র‌্যাকস্যাক। পিঠে এ ধরনের ভারী র‌্যাকস্যাক দেখা যায় বিমানবন্দরে, টুরিস্ট স্পটে। কিন্তু এটা বিমানবন্দর নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের করিডর।


সেখানে ছাত্রছাত্রীদের হাঁটাচলা। মাঝখানে এই র‌্যাকস্যাক পিঠের তরুণ! আমি কি সামান্য বিরক্ত হই? তড়িঘড়ি করে প্রশ্ন করি, কোথায় আছেন আপনি? সে এই প্রশ্ন শুনে হাসে। রিমি জানায় কোন পত্রিকায় কাজ করে তার বর। প্রথম আলো নয়, ডেইলি স্টার বা অন্য কোনো বড় পত্রিকায়ও নয়। আলাপ এখানেই শেষ। আমি তাঁর নামও মনে রাখি না।
চার দিন আগে ডেইলি স্টার-এর ওয়েবপেজে দেখি এক অকল্পনীয় ছবি। এভারেস্ট জয় করেছে বাংলাদেশের এক তরুণ! আনন্দে চিৎকার করে উঠি। বাংলাদেশ জয় করেছে মাউন্ট এভারেস্ট! কাঠমান্ডু থেকে ফেরার পথে বিমানের পাইলট একবার ঘোষণা করলেন, এভারেস্ট আমাদের বাঁয়ে এখন। জানলা দিয়ে দেখি, তুষারশুভ্র মৌন এক বিস্ময়! অনেক উঁচুতে মেঘ আর আকাশের সবচেয়ে কাছের পর্বতশৃঙ্গ! হিলারি আর তেনজিং এত উঁচুতে উঠেছিলেন! দূর, বিশ্বাসই হয় না আমার। ততক্ষণে বিমানের বাঁ দিকে হুড়মুড় করে উঠে এসেছে অনেকে। বিমান কি সামান্য কাত হয়ে পড়ল একদিকে! কারও কি আর্তচিৎকার শুনলাম আমি? হাসি মনে মনে। নিরাপদে এভারেস্ট দেখার জন্য এটুকু পাগলামি আমি হলেও করতাম। সেই এভারেস্টের চূড়ায় নিজের পায়ে আরোহণ করেছে মুসা ইব্রাহীম, বাংলাদেশের এক তরুণ! সত্যি সত্যিই করেছে! কই, কোনো দিন তো শুনিনি তার কথা আগে!
পরদিন প্রথম আলোতে তার ছবি, তার স্ত্রী আর শিশুপুত্রের ছবি। মূল শিরোনামের পাশে মুসাকে নিয়ে আনিসুল হকের লেখা। সেটি পড়ে বুক চিনচিন করে ওঠে আমার। আহা রে, এই লেখাটা যদি লিখতে পারতাম আমি! আনিস, মতি ভাই, সাগর ভাই, কতজন মুসাকে সাহায্য করেছেন। ওর জন্য কিছু করার সুযোগ থাকত যদি আমার! একটু যদি পরিচয়ও থাকত ওর সঙ্গে!
আনিসের নিচে সুমনা শারমিনের লেখা। মুসার পরিবারের গল্প। চমকে উঠি আমি। রিমির (উম্মে সরাবন তহুরা) বর মুসা ইব্রাহীম! রিমি আমারই ছাত্রী ছিল একসময়, এখন ময়মনসিংহের বিচারক। কয়েক বছর আগে র‌্যাকস্যাক পিঠে এক তরুণকে সে-ই নিয়ে এসেছিল আমাদের আইন বিভাগে। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল তার স্বামীকে। সেই তরুণই মুসা ইব্রাহীম! মহা স্টুপিড আমি। সেই র‌্যাকস্যাক দেখে বিরক্ত হয়েছিলাম? হালকা-পাতলা শিশুতোষ চোখের সেই ছেলেই জয় করেছে এভারেস্ট! একটু রাগ হয় রিমির ওপর। বলেনি কেন সে, মুসা একজন পর্বতারোহী? আনিসুল হকের লেখা পড়ে জানলাম, সারাক্ষণ র‌্যাকস্যাক পিঠে রাখে সে ওজন বহনের অভ্যাস করার জন্য। রিমি তো এটাও বলেনি!
বললে কী হতো? হাসি মনে মনে। আমি কি তাহলে একবারও ভাবতাম, এই ছেলে একদিন এভারেস্ট জয় করবে? একদিন ইতিহাস নির্মাণ করবে! হয়তো বরং আরও বিরক্ত হয়ে ভাবতাম, বাংলাদেশে আবার পর্বতারোহী কী? আমি সাধারণ মানুষ, আটপৌরে জীবনে আটপৌরে ভাবনা নিয়ে থাকি। মুসা অন্য কেউ, অনন্য একজন! তার উচ্চতা বোঝার শক্তিই তো ছিল না আমার!
এখন আমি বারবার মুসার ছবি দেখি, তাকে নিয়ে সব লেখা ওয়েবসাইট খুলে খুলে পড়ি। পাহাড়ের মাথায় মুসার ছবি, সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা। চোখ ভিজে যায়, বুকের ভেতর আরেক এভারেস্ট ওঠে জেগে। বাংলাদেশ পারে! চাইলেই পারে বাংলাদেশ। পারে এমনকি এভারেস্ট ছুঁতে!
মুসা ইব্রাহীম, আপনি আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম গ্রহণ করুন। স্যালুট নিন, প্রণাম নিন। দুঃখ-যন্ত্রণা ভরা এ দেশের পত্রিকার শিরোনাম কিছুদিনের জন্য হলেও পাল্টে দিয়েছেন আপনি। সারা দেশকে আনন্দে উদ্বেল করেছেন। বহু বছর পর আপনিই দেখিয়েছেন বাংলাদেশের তরুণেরা কেমন অমিত শক্তির, দৃঢ়সংকল্পের, দুর্দান্ত ইচ্ছাশক্তির।
এই তরুণেরা গোটা বাংলাদেশকে এভারেস্টের উচ্চতায় তুলতে পারবে না একদিন? নিশ্চয়ই পারবে। সব প্রতিকূলতা জয় করে বিজয়ী হতে পারবে না একদিন? অবশ্যই পারবে। হয়তো আমরা থাকব না সেদিন! কিন্তু বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই একদিন।
মুসা, আপনি ম্লান হয়ে যাওয়া আমাদের সেই বিশ্বাস কি অবলীলায় পুনর্নির্মাণ করেছেন! আপনার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.