সাদাসিধে কথা: রাজনীতি নিয়ে আমার ভাবনা—২-আওয়ামী লীগ সেই দায়িত্বটি নিতে রাজি কি না? by মুহম্মদ জাফর ইকবাল

.
এবার একটু আওয়ামী লীগের কথা বলি। গত নির্বাচনের ফলাফলের দিনটি ছিল আমাদের মতো মানুষের জন্য খুব আনন্দের একটি দিন। সেদিন এই দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে, ডিজিটাল বাংলাদেশের পক্ষে—এক কথায় একটা আধুনিক বাংলাদেশের পক্ষে রায় দিয়েছিল।


দেশের মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনা আর স্বপ্ন নিয়ে আওয়ামী লীগ তাদের যাত্রা শুরু করেছিল—(আরও একবার আওয়ামী লীগ দেশের মানুষের অনেক আশা-ভরসা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, সেটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের পর প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশে।) বাংলাদেশ মানেই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে স্বপ্ন দেখা সেই দেশ, তাই যখন বাংলাদেশকে কেউ মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে ঠিক করে দেওয়া পথ থেকে সরিয়ে অন্য পথে নেওয়ার চেষ্টা করে তখন দেশটা আর বাংলাদেশ থাকে না। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে সেই স্বপ্ন থেকে সরে এসেছে—কোনো দল জামায়াতে ইসলামীকে সহযোগী হিসেবে নিলে সেটি আর মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করতে পারে না, কাজেই বাংলাদেশকে বাংলাদেশ হিসেবে টিকিয়ে রাখার দায়িত্বটি এখন পুরোপুরি আওয়ামী লীগের ওপর।
প্রশ্ন হলো আওয়ামী লীগ সেই দায়িত্বটি নিতে রাজি কি না (আমি কিন্তু জিজ্ঞেস করিনি প্রস্তুত কি না, আমি জিজ্ঞাসা করেছি রাজি কি না!) আমরা আমাদের চারপাশে যেসব ঘটনা ঘটতে দেখছি তাতে মনে হয় তারা সেই দায়িত্বটি নিতে আর আগ্রহী নয়। একাত্তর সালে তারা দায়িত্ব নিয়েছিল, যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল। এখন আর যুদ্ধ করার সুযোগ নেই, এখন দায়িত্ব নিতে হলে ভোট পেতে হবে, ভোট পেতে হলে সম্ভাব্য ভোটারদের খুশি রাখতে হবে, আমরা সবাই দেখছি তারা হিসেব করে যে কাজগুলো করছে সেগুলো হচ্ছে ঠিক তার উল্টো। কয়েকটা উদাহরণ দিই।
শুরু করতে হবে প্রফেসর ইউনূসকে দিয়ে। প্রফেসর ইউনূস সারা পৃথিবীর মাঝে একজন অত্যন্ত সম্মানী মানুষ। তিনি শুধু যে ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তা নয়, কিছুদিন আগে তাকে স্টিভ জবস, বিল গেটস কিংবা গুগল বা ফেসবুকের প্রবর্তকদের মতো সমান কাতারের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আমি তাকে অসম্ভব পছন্দ করি (আশির দশকেই আমি একটা লেখায় তাঁর নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনার কথা বলেছিলাম) কাজেই তাঁর সম্পর্কে আমার লেখায় যুক্তিতর্ক খুঁজে লাভ নেই! কিন্তু প্রফেসর রেহমান সোবহান তাঁর লেখায় লিখেছিলেন এই মানুষটি সারা পৃথিবীর অল্প কয়েকজন মানুষের ভেতর একজন, যিনি যেকোনো সময় পৃথিবীর যেকোনো রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে টেলিফোন তুলে কথা বলার অধিকার রাখেন, কাজেই বাংলাদেশের উচিত হবে এই অসাধারণ সুযোগটি দেশের মঙ্গলের জন্য গ্রহণ করা। আওয়ামী লীগ সরকারের এই সুযোগ গ্রহণ করা তো দূরের কথা, তারা তাদের সব শক্তি নিয়োগ করেছে তাকে অপমান করার জন্য। হিলারি ক্লিনটন ঘুরে যাওয়ার পর সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রফেসর ইউনূস সম্পর্কে যে ভাষায় যে কথাগুলো বলেছেন সেগুলো পড়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে আতঙ্ক অনুভব করেছি। সম্মানী মানুষ সম্পর্কে অসম্মানজনক কথা বললে তার সম্মানের ক্ষতি হয় না, কিন্তু কথাগুলো বলে একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী তাঁর নিজের মানসিক পরিপক্বতার যে নমুনা আমাদের সামনে তুলে ধরলেন সেটা দেখে কি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের আতঙ্ক হতে পারে না?
প্রফেসর ইউনূস আসলেই রক্তচোষা মহাজন কি না আমি সেই কুতর্ক শুরু করতে চাই না, শুধু বলতে চাই এই দেশে তার তৈরি করা গ্রামীণ ব্যাংকের প্রায় এক কোটি সদস্য এবং তাদের আত্মীয়স্বজন মিলে কয়েক কোটি মানুষ আছে, যাদের সবাই ভোটার। এই দেশের প্রায় সত্তর-আশি লাখ মানুষ বিদেশে থাকে তারাও ভোটার (ভোটের সময় তারা আসলে ভোট দিতে পারেন কি না সেটি অবশ্য ভিন্ন প্রশ্ন)। এই দেশের তরুণেরা প্রায় কয়েক কোটি, তাদের একটা বড় অংশ ভোটার। আমি যে তিনটি দলের মানুষের কথা বলেছি তাদের প্রত্যেকে প্রফেসর ইউনূসকে পছন্দ করেন এবং যখন তাঁকে অসম্মান করা হয়েছে তারা সবাই খুব বিরক্ত হয়েছে। যে দল ভোটের রাজনীতি করে সেই দল এক সঙ্গে এত ভোটারকে এত দক্ষতার সঙ্গে অন্য কোনোভাবে বিরক্ত করেছে বলে আমার জানা নেই, কী কারণে সেটা করেছে তার কারণটা আমি এখনো জানি না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রফেসর ইউনূসকে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট করার প্রস্তাব দিয়েছেন, তা না করে তাঁকে যদি তাঁর অফিসে শুধু একবার চা খেতে ডাকতেন তা হলেই এ দেশের কত মানুষের বুকের ভার যে লাঘব হতো সেটা কি তাঁরা জানেন?
বাংলাদেশে প্রায় ২৫ লাখ আদিবাসী রয়েছে (মতান্তরে ৪০ লাখ)। তবে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে যে সরকার হঠাৎ করে একদিন ঠিক করেছে তাদের আর আদিবাসী বলা যাবে না, তাদের উপজাতি কিংবা ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী বা এ ধরনের আরও কঠিন এবং অসম্মানজনক কিছু বলতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকার কেন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটি এখনো আমার কাছে রহস্য। লোকমুখে শুনেছি এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সেনাবাহিনীর একটা চাপ রয়েছে, জাতিসংঘের লোভনীয় চাকরিতে সেনাবাহিনী যেতে পারবে কি পারবে না এই নামকরণের সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক রয়েছে। সরকারের মানুষদের সঙ্গে এ ব্যাপারে নিরিবিলি কথা বলার চেষ্টা করলে তাঁরা ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে তর্ক করে দেন। কিন্তু এত দিন কেন তাহলে তাদের আদিবাসী বলা হলো, হঠাৎ করে কেন আর তাদের আদিবাসী বলা যাবে না, সেটার ব্যাখ্যা দিতে পারেন না। কোনো একটা কিছু বোঝাতে যখন একটা শব্দ ব্যবহার করা রেওয়াজ হয়ে যায় তখন সেটাই যে প্রচলিত হয়ে যায় এই সোজা কথাটা কে বোঝাবে? কিছুদিন আগে আমার চোখে একটা সরকারি সার্কুলারের অনুলিপি চোখে পড়েছে, যেখানে বলা হয়েছে আগস্ট মাসকে শোকের মাস দেখিয়ে আদিবাসী দিবসকে উদ্যাপন করতে যেন সব মহলকে নিরুৎসাহিত করা হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডকে এ রকম কূটকৌশলে একটা হীন কাজে ব্যবহার করা হবে সেটি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না! যাই হোক, যে সরকারকে ভোটে জিতে আসতে হবে তাদের মনে করিয়ে দিতে হবে, চল্লিশ লাখ আদিবাসীর অন্তত বিশ লাখ ভোটার! এতগুলো ভোটারকে এত অবলীলায় ক্ষুব্ধ করে তোলার উদাহরণ আর কোথায় পাওয়া যাবে?
একসাথে দেশের অনেক মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলার আরেকটা সহজ উপায় কী হতে পারে? সেটা হচ্ছে ঈদে যেন মানুষজন তাদের বাড়িতে যেতে না পারে তার ব্যবস্থা করে দেওয়া। এই সরকারের আমলে ঠিক এই ব্যাপারটা ঘটেছিল। ঈদের আগে আগে দেখা গেল রাস্তাঘাটের অবস্থা এত খারাপ যে সেই পথে কোনো কোনো বাস যেতে পারছে না। আমরা দেখতে পাই ঢাকা শহরের ভেতর দিয়ে নানা ধরনের উড়ালসেতু, ফ্লাইওভার তৈরি হচ্ছে, একটি নয় দু-দুটি পদ্মা সেতু তৈরি নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার আলোচনা হচ্ছে (তার প্রস্তুতির জন্য নিশ্চয়ই এর মাঝে কয়েক শ কোটি টাকা খরচ পর্যন্ত হয়ে গেছে) কিন্তু সাধারণ মানুষ ঈদের ছুটিতে বাড়ি যেতে পারছে না, এর চেয়ে দুঃখের ব্যাপার আর কী হতে পারে? দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন সৈয়দ আবুল হোসেন, কাজেই রসিক বাঙালি এখন ভাঙাচোরা বেহাল রাস্তাঘাট বোঝানোর জন্য বলে আবুলি রাস্তা! ডিকশনারিতে একটা নতুন শব্দ যোগ করে আমাদের বাংলা ভাষা হয়তো একটু সমৃদ্ধ হলো কিন্তু ব্যাপারটা আওয়ামী লীগের জন্য ভালো হলো কি? বিষয়টা আরও গুরুতর হয়ে গেল যখন দেখা গেল রাস্তাঘাট ঠিক করার জন্য টাকার বরাদ্দ আছে কিন্তু সেই টাকা খরচ করে রাস্তাঘাট ঠিক করার জন্য কারও গরজ নেই। কারণটা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না, দেশের ভেতরকার রাস্তাঘাট তৈরিতে পয়সা-কড়ি নেই, বিশাল বিশাল ফ্লাইওভার, বড় বড় পদ্মা সেতুতে অনেক টাকা-পয়সা। কাজেই উৎসাহটা সেখানেই বেশি।
সৈয়দ আবুল হোসেন বেশ অনেক দিন থেকে আলোচনার মাঝে রয়েছেন। আমাদের দেশের দুর্নীতির খবর সাধারণত দেশের ভেতরেই থাকে। আমাদের এই মন্ত্রীর কারণে দুর্নীতির খবরটি মোটামুটিভাবে একটা আন্তর্জাতিক রূপ পেয়েছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং দেশের সরকারের সঙ্গে উত্তপ্ত চিঠি চালাচালি হচ্ছে, উইকিলিকস থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টির অত্যন্ত অসম্মানজনক বক্তব্য বের হয়ে আসছে, কানাডার কোর্টে মামলা হয়ে রায় বের হচ্ছে সেখানে মন্ত্রীর ফার্মের সঙ্গে যোগাযোগ খুঁজে পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে একেবারে পরিপূর্ণ লেজেগোবরে অবস্থা। পদ্মা সেতুর টাকা আটকে গেছে, যে পদ্মা সেতু দেখিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের মানুষকে তাক লাগিয়ে দিতে পারত, সেই পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারিতে এখন তাদের মুখে চুনকালি লাগানোর অবস্থা। সরকার যদিও ভাঙা রেকর্ডের মতো ‘কোনো দুর্নীতি হয়নি’ বলে যাচ্ছে কিন্তু দেশের মানুষের আসল সত্যিটি বুঝতে কোনো সমস্যা হয়নি। মন্ত্রীরও কোনো সমস্যা হয়নি, তিনি একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় থেকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে চলে গেছেন। এই বিষয়টা থেমে যাওয়ার আগেই আমাদের রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নাটক মঞ্চস্থ হলো। তদন্ত রিপোর্টে দেখা গেছে, মন্ত্রীর কোনো দোষ নেই, কিন্তু দেশের কতজন মানুষ এই রিপোর্টটিকে বিশ্বাস করে?
রাজনৈতিক নেতারা এত কিছু বোঝেন কিন্তু কেন জানি একটা অত্যন্ত সহজ জিনিস বোঝেন না—আসলে কী ঘটেছে তার থেকে অনেক অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেটা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণাটি কী। কাগজে-কলমে অনেক কিছু লিখে ফেলা যায়, অনেক কিছু প্রমাণ করা যায়, কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের কোনো পরিবর্তন হয় না। দুর্নীতির ছাপ ‘পার্মানেন্ট ইংক’-এর ছাপের মতো, একবার লেগে গেলে শতবার ঘষেও তোলা যায় না। যাদের ওপর এই ছাপ পড়েছে তাদের সরে যাওয়া ছাড়া এর কোনো বিকল্প নেই।
(তৃতীয় কিস্তি আগামীকাল)
 মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক। অধ্যাপক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.