তিস্তা নদীর পানিবণ্টন by মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞা

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা এ দেশ ত্যাগ করার আগে তিস্তা নদীতে বাঁধ দিয়ে আটকানো পানির সাহায্যে সেচের ব্যবস্থা করার একটি পরিকল্পনা নিয়েছিল। বিষয়টি র‌্যাডক্লিফ কমিশনের বিবেচনার জন্য তোলা হয়েছিল, যাতে তিস্তা নদী ও প্রস্তাবিত সেচের এলাকা অবিভাজ্য থাকে।


অবশ্য এ বিষয়ের কোনো সমাধানে না গিয়ে কমিশন তার ধ্যান-ধারণা মতো দেশ বিভাগের উদ্দেশ্যে বিভাজন লাইন টানে। সমস্যাটি যা ছিল এককালে ভারত-পাকিস্তানের, স্বভাবতই তা পরে হয় ভারত-বাংলাদেশের সমস্যা।
সেচের প্রয়োজনে ১৯৫৫ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তিস্তায় একটি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করে এবং এ সম্পর্কে ভারত সরকারকে অবহিত করে। পরবর্তী কোনো একসময়ে ভারতও তাদের এলাকায় অপর একটি বাঁধ নির্মাণের কথা জানায়। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর বেশ কিছুকাল ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ছিল যথেষ্ট উষ্ণ এবং আন্তরিক। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭২ সালে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে যেসব বিষয়ে সমঝোতা হয়, তার মধ্যে একটি ছিল উভয় দেশের নদী এবং পানি-সম্পর্কিত সমস্যাদি আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার জন্য দু-দেশের প্রতিনিধি সমন্বয়ে যৌথ নদী কমিশন নামে একটি কমিশন গঠন। এই কমিশন ১৯৭২ সালেই একটি সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়ে দু-দেশের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে এ বিষয়ে কয়েক বছর আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। এদিকে ১৯৭৭ সালে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা গঙ্গা নদীর পানিবণ্টন-সংক্রান্ত পাঁচ বছরের একটি চুক্তি ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত হয়। সে সময়ে তিস্তা সমস্যাটি আবার আলোচনায় আসে। এদিকে ১৯৭৯ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসেন। তাঁর ঢাকায় অবস্থানকালীন এমন একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে যৌথ নদী কমিশন তিস্তা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু যৌথ নদী কমিশন পরবর্তীকালে কয়েক বছরে কোনো সমঝোতায় পেঁৗছাতে পারেনি। অবশ্য ১৯৮৩ সালে পানিবণ্টন নীতির একটি রূপরেখা সম্পর্কে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কথা ছিল, উভয় দেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবরা আলোচনার মাধ্যমে এ সমঝোতাটির চূড়ান্ত রূপ দেবেন। কিন্তু রূপরেখাটি আর চুক্তিতে পরিণত করা যায়নি। এদিকে সমঝোতা ফর্মুলার মেয়াদ ১৯৮৫ সালে শেষ হয়ে যায়। এ সময়ের মধ্যে দু-দেশের পানিসম্পদ সচিব কয়েকবার বৈঠকে মিলিত হন। যতটুকু জানা যায়, একপক্ষের অনীহা বা দীর্ঘসূত্রতার কারণে সমঝোতার রূপরেখাটি আর চুক্তিতে রূপান্তর করা যায়নি।
কী ছিল উভয় দেশের সম্মতিক্রমে প্রণীত ওই পানিবণ্টনের রূপরেখায়? সেটি ছিল এমন যে মোট প্রবাহ পরিমাণের শতকরা ৩৯ ভাগ পাবে ভারত, ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ আর বাকি ২৫ ভাগ নদীর নিজস্ব প্রয়োজনে (ঊপড়ষড়মরধষ হববফং) সব সময় বহমান থাকবে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে বেশ কিছুকাল ধরে নদীর এ ধরনের প্রয়োজন, যাকে বলা হয় ঊহারৎড়হসবহঃধষ ভষড়,ি তা সব সময় নদীতে বহমান থাকবে_এমন ধারণা পানি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তা যদি না থাকে, তাহলে নদী শুকিয়ে যাবে এবং এর জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে।
সে যা-ই হোক, ১৯৮৭ সালে ভারত সরকার তাদের অংশের বাঁধ নির্মাণ সমাপ্ত করে। বাংলাদেশ নির্মাণকাজ আগে আরম্ভ করলেও শেষ করে ১৯৯০ সালে। পরবর্তী বছর উভয় দেশের সংশ্লিষ্ট সচিবদ্বয় এ নিয়ে সমঝোতা বৈঠকে বসেন। এ বৈঠকে একে অপরকে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি দেওয়ার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। বাংলাদেশ যথারীতি অপরপক্ষকে তথ্যাদি দেয়। বরাবরের মতো অপরপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুত দায়িত্ব পালন করেছে বলে আর শোনা যায়নি।
উভয় দেশের জন্য পানির গুরুত্ব ও প্রয়োজন কতটুকু তা সম্যকভাবে উপলব্ধির জন্য এখানে কিছু তথ্য দেওয়া হচ্ছে। নিউইয়র্কের কার্নেগি করপোরেশনের অর্থায়ন ও তত্ত্বাবধানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর পানির প্রয়োজন-সংক্রান্ত একটি গবেষণাভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এ গবেষণার সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারতসহ এ অঞ্চলের অনেক পানিবিশেষজ্ঞ সংশ্লিষ্ট ছিলেন। বর্তমান নিবন্ধের লেখকসহ এ দেশেরও আরো কেউ কেউ ওই গবেষণার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। গবেষণা প্রতিবেদনটি ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রতিবেদন থেকে দেখা যাবে যে ২০২৫ সালে বাংলাদেশে ৬৩০৬ মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানির ঘাটতি হবে। অপরপক্ষে একই প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় যে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ভারতে সামগ্রিকভাবে পানির কোনো ঘাটতি হবে না, তবে কোনো কোনো নদী অববাহিকায় এবং বিশেষ বিশেষ ঋতুতে কখনো কখনো ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
এমনিতেই আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় পানির প্রাপ্যতা কম, অর্থাৎ ঘাটতি সব সময়ের ব্যাপার। অন্যদিকে তিস্তা নদীর পানির সাহায্যে যে এলাকায় সেচকার্য পরিচালনার কথা, সেই অঞ্চল দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম বৃষ্টিবহুল এলাকা। জরিপে দেখা গেছে, শীত মৌসুমে ওই এলাকার প্রায় শতকরা ৭৫ ভাগ উর্বর জমি সেচের পানির অভাবে শীতের ফসল ফলানোর জন্য ব্যবহার করা যায় না। এ কথা তো মোটামুটি জানা যে সেচের জন্য প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া গেলে শীতের শুষ্ক মৌসুমই অধিক ফসল ফলানোর সময়। এক হিসাবে দেখা গেছে যে কৃষি, শিল্প, গৃহস্থালি ইত্যাদির জন্য শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রয়োজন প্রায় ১৫ হাজার কিউসেক। আর নৌ চলাচলের জন্য নদীর নাব্যতা রক্ষার প্রয়োজনে অন্তত আরো ছয় হাজার কিউসেক অত্যাবশ্যক। অন্যদিকে রয়েছে ভারতের প্রয়োজন, যা তাদের হিসাবে সাত হাজার কিউসেক। স্বভাবতই উভয় দেশের প্রয়োজন মেটানোর জন্য যে পরিমাণ পানির দরকার তা অন্তত শীত মৌসুমে পাওয়া যাবে না। তিস্তার সমস্যা মূলত এখানেই। একপক্ষের বিশেষ বিশেষ কারণে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা সমস্যাটি এমনিতেই জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে, তার ওপর উজানের দেশের নতুন নতুন শর্ত বা দাবি এটিকে আরো কঠিন করে তুলেছে। বিষয়টি যতটুকু জানা গেছে তা এ রকম।
ভারত উভয় দেশের মধ্য দিয়ে প্রবহমান সব নদীতে (এমনকি ছোট নদীগুলোতেও) কোনো না কোনো ধরনের পানি প্রবাহ আটকানোর ব্যবস্থা করে রেখেছে, যা ওদের কথামতো 'রেগুলেটর'। এসব নদীর মধ্যে তিস্তা, সানকোশ, রায়ঢাক, তরসা, জলঢাকা, আত্রাই_এই ছয়টির প্রতিটিতে সেচ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। একটি পত্রিকায় সম্প্রতি প্রকাশিত এক খবর থেকে জানা যাচ্ছে, এসব প্রকল্পে অর্থ সহায়তাদানকারী দাতাগোষ্ঠী একই অববাহিকায় অবস্থিত ভাটির দেশ বাংলাদেশের সম্মতি নিতে পরামর্শ দিয়েছে, যেহেতু সে প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলাসহ ১৮টি জেলায় বিস্তৃত আর ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার সেচ প্রকল্পের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। যতটুকু জানা গেছে, উজানের দেশের আগ্রহে গত বছর জানুয়ারি মাসে উভয় দেশের সংশ্লিষ্ট সচিবদ্বয় তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়ে একটি চুক্তি করার জন্য ঢাকায় এক বৈঠকে বসেন। ওই বৈঠকে উজানের প্রতিবেশী তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে কোনো সমঝোতায় রাজি হয়নি। উল্টো বাংলাদেশ পক্ষ ভারতকে ইছামতি ড্রেজিংয়ের অনুমতি দেয় এবং ফেনী নদী থেকে পাম্পের সাহায্যে পানি উত্তোলন করে ভারতীয় অংশে সেচকার্য করার বিষয়টি বিবেচনা করবে বলে আশ্বাস দেয়। ভারতের আগ্রহে এ বছর জানুয়ারি মাসে যৌথ নদী কমিশনের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এ সভায় কোনো বিষয়েই কোনো সমঝোতা হয়নি। সেই পাকিস্তান আমলে ১৯৫৫ সালে প্রথম তৎকালীন সরকার তিস্তায় তাদের প্রস্তাবিত বাঁধের বিষয় ভারতকে জানায়। এর পরে ৫৬ বছর চলে গেছে। কিন্তু তবুও যে সমস্যা আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলাম, তা আজও অসমাহিত রয়ে গেছে। এই হচ্ছে পানি নিয়ে আমাদের প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সম্পর্কের বিশেষ একটি দিক। আমরা জানি না, এরূপ মনোভাবের কোনো পরিবর্তনের আদৌ কোনো সম্ভাবনা আছে কি না!
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক রাষ্ট্রদূত, সেনেগাল

No comments

Powered by Blogger.