গণশুনানিতে সিএনজির মূল্যবৃদ্ধির বিতর্কিত প্রস্তাব by ড. এম শামসুল আলম
গত ৮ মার্চ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে সওয়াল-জবাবে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে পেট্রোবাংলার কাছে নিচের প্রশ্নগুলো উপস্থাপন করা হয় : ১. পেট্রোবাংলার প্রস্তাবে দেখা যায়, প্রতি ঘনমিটার সিএনজি ফিড গ্যাসের মূল্যহার ৯.৯৭ টাকা থেকে ১৮.০০ টাকা সরকার বৃদ্ধি করেছে।
এ মূল্যবৃদ্ধি ১৮.০০ টাকার কম বা বেশি না হওয়ার যৌক্তিকতা কী? ২. এ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের বিচার-বিশ্লেষণের প্রমাণাদি-সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র আছে কি? এ মূল্যবৃদ্ধির সরকারি আদেশের কোনো কপি বিইআরসিতে জমা দেওয়া হয়েছে কি? ৩. ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ঘনমিটারে কমিশন বৃদ্ধি পাবে ১২ পয়সা। এই ১২ পয়সা অপেক্ষা কম বা বেশি বৃদ্ধির প্রস্তাব না করার যৌক্তিকতা কী? ৪. মূল্যবৃদ্ধির যুক্তিতে বলা হয়েছে, অদক্ষ ও অলাভজনক যানবাহন কমবে এবং যানজট সমস্যার সমাধান হবে; বিদ্যুৎ, সার ও শিল্প-কারখানায় চাহিদামতো গ্যাস সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে; সিএনজির ব্যবহার মাত্রাতিরিক্ত হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় সরবরাহ লাইনে গ্যাসের যে চাপ হ্রাস পাচ্ছে, সে চাপ সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখা যাবে। তা ছাড়া সিএনজির বিকল্প জ্বালানি দেশে সহজলভ্য। কাজেই মূল্যবৃদ্ধিতে সিএনজি চালিত যানবাহনের কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না। এসব ধারণা বা বক্তব্যের ভিত্তি কী? ৫. এ মূল্য বৃদ্ধি ছাড়া সিএনজির ব্যবহার বৃদ্ধি রোধে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে? ৬. তেল চালিত যানবাহনের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ০.৯৭ টাকা। কিন্তু সিএনজি চালিত যানবাহনে ১.২০ টাকা। প্রস্তাবিত মূল্যবৃদ্ধি হলে সিএনজি চালিত যানবাহনে ভাড়া বৃদ্ধিতে কী প্রভাব পড়তে পারে তা কি বিশ্লেষণ করা হয়েছে? ৭. এ ভাড়া বৃদ্ধির ফলে সিএনজি এবং তেল চালিত যানবাহনের ভাড়ার মধ্যে যে তারতম্য হবে তার কোনো ক্ষতিকারক প্রভাব বিবেচনা করা হয়েছে কি না? ৮. সিএনজি স্টেশন অন্য ভোক্তাদের ন্যায় বিতরণ কম্পানির কাছ থেকে গ্যাস ক্রয় করে। ফলে সিএনজি স্টেশন বা স্টেশন মালিক ভোক্তা হিসেবে গণ্য হবে। এ গ্যাসের মূল্য নির্ধারণের এখতিয়ার বিইআরসির, সরকারের নয়। তাহলে মন্ত্রণালয় কোন আইনি ক্ষমতাবলে এ মূল্যহার নির্ধারণ করেছে? ৯. সরকার সিএনজি ফিড গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করেছে। কিন্তু ২০০৮ সালের ১৫ অক্টোবর আন্তমন্ত্রণালয়ের সভায় ট্যারিফ নির্ধারণের বিষয়ে বিইআরসি আইন সংশোধনের প্রস্তাব গ্রহণ করে এক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ওই সিদ্ধান্তে বলা হয় : '২০০৩ সালের ১৩ নং আইনের অধ্যায়-৭ এ ধারা ৩৪ এর পর নিম্নরূপ ধারা সংযোজন হইবে, যথা_৩৪(ক)। তবে যে সকল এনার্জি আমদানিনির্ভর এবং/অথবা যে সকল এনার্জির ট্যারিফ নির্ধারণে সরকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভর্তুকি প্রদান করে, সে সকল এনার্জি যেমন_পেট্রোলিয়াম পণ্য বা এর বিকল্প যেমন সিএনজি এর ট্যারিফ সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হইবে।' পরবর্তী সময় মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্ত স্থগিত করে। অথচ বিইআরসি আইন এ সিদ্ধান্ত মতে বা অনুরূপভাবে সংশোধনী না হওয়া সত্ত্বেও সরকার সিএনজির মূল্য নির্ধারণ করেছে। বিষয়টিকে ভোক্তারা বেআইনি বলেছে। এ ব্যাপারে পেট্রোবাংলার কী অভিমত? ১০. জ্বালানি মন্ত্রণালয়কে লেখা এক পত্রে বিইআরসি বলেছে, বিইআরসি একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ রেগুলেটরি কমিশন। ওই পত্রে আরো বলা হয়েছে, আইন অনুযায়ী বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থ বা জ্বালানি তেলের বিক্রয়মূল্য বা ট্যারিফ নির্ধারণের একক ও একমাত্র ক্ষমতা বিইআরসির। এই পরিপ্রেক্ষিতে যদি বিইআরসি মন্ত্রণালয়ের মূল্যবৃদ্ধি গ্রহণ করে, তাহলে বিইআরসি স্ব-বিরোধিতার শিকার হবে কি না? ১১. তাতে জনগণ বিইআরসির স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা বিতর্কিত বলে মনে করতে পারে কি না? ১২. আলোচ্য মূল্যহার বৃদ্ধির প্রস্তাবটি ট্যারিফ প্রবিধানমালা অনুযায়ী যদি দাখিল করা না হয়, তাহলে এ প্রস্তাব মোতাবেক মূল্যহার পুনর্নির্ধারণ করা হলে এ প্রবিধানমালা লঙ্ঘন হবে কি না? ১৩. উৎপাদন, বিতরণ ও সঞ্চালন কম্পানিগুলো লাভজনক। প্রতিবছর লভ্যাংশ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বোনাস হয়। সিএনজির মূল্যবৃদ্ধিতে যে বাড়তি অর্থ আয় হবে, সে অর্থ গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে প্রথমে জমা হওয়ার প্রস্তাব করা হলেও পরে তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাহলে এ অর্থ কী কাজে ব্যবহার হবে?
গণশুনানির ভিত্তিতে ১৩ মার্চ ক্যাব বিইআরসিতে যে প্রতিবেদন দাখিল করেছে, তাতে বলা হয়েছে:
গণশুনানিতে উলি্লখিত প্রশ্নগুলোর জবাবে পেট্রোবাংলা সরকার কর্তৃক সিএনজির মূল্যহার ১৮.০০ টাকায় বৃদ্ধির যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে পারেনি। সেই সঙ্গে ভোক্তা পর্র্যায়ে ১২ পয়সা কমিশন বৃদ্ধিরও যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে পারেনি। তা ছাড়া মূল্যহার বৃদ্ধির প্রস্তাবের পেছনে তথ্য ও তত্ত্বভিত্তিক কোনো বিশ্লেষণ শুনানিতে উপস্থাপন করতে পারেনি। ফলে পুরো প্রস্তাবটি ইচ্ছামাফিক ও মনগড়া বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তা ছাড়া গণশুনানিতে আরো প্রতীয়মান হয়, সিএনজি কিংবা জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কোনো এখতিয়ার সরকারের নেই। ২০০৮ সালের ১৫ অক্টোবর জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে জ্বালানি সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয়ের সভার ২ নং সিদ্ধান্তে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই প্রমাণ গণশুনানিতে বিইআরসির কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে এফবিসিসিআইয়ের প্রতিনিধি বিইআরসি আইনের ৪২ ও ৪৬ ধারার প্রতি কমিশন ও পেট্রোবাংলার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, সিএনজির মূল্যহার বিইআরসিকে পাশ কাটিয়ে একতরফাভাবে মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্ধারিত হওয়া বিইআরসি আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ অপরাধ আমলে নেওয়ার জন্য তিনি কমিশনকে অনুরোধ জানিয়েছেন। তা ছাড়া আলোচ্য মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবটি ট্যারিফ প্রবিধানমালা অনুযায়ী দাখিল করা হয়নি। ফলে এ প্রস্তাব খারিজ না করে মূল্যহার পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে এ প্রবিধানমালা লঙ্ঘন হবে, ক্যাবের এ অভিমতের ব্যাপারে পেট্রোবাংলা কোনো ভিন্নমত প্রকাশ করেনি। আরো উল্লেখ্য, মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিও গণশুনানিতে অংশ নেন। তিনিও উলি্লখিত মতামত ও বক্তব্যে ভিন্নমত প্রকাশ করেননি।
ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ওপরের তথ্য ও বক্তব্যের আলোকে যেহেতু প্রমাণিত হয়েছে, ১. মন্ত্রণালয় কর্তৃক সিএনজির মূল্যহার বৃদ্ধি বেআইনি এবং এখতিয়ার বহির্ভূত। ২. বিইআরসি আইন অনুযায়ী এই মূল্যবৃদ্ধি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ৩. সিএনজির মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবটি বিধিসম্মতভাবে প্রবিধানমালা অনুযায়ী দাখিল করা হয়নি। ৪. পেট্রোবাংলা মূল্যহার বৃদ্ধির প্রস্তাবটি ন্যায্য, যৌক্তিক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রমাণ করতে পারেনি।
সিএনজি মূল্যবৃদ্ধির পেট্রোবাংলার আবেদন নাকচ করে বিধিসম্মতভাবে আবার আবেদন দাখিল করার আদেশ দেওয়ার জন্য পুনরায় ভোক্তাদের পক্ষ থেকে ক্যাব আবেদন জানিয়েছে। সেই সঙ্গে বিইআরসিকে পাশ কাটিয়ে সিএনজির মূল্যহার বৃদ্ধি করার অভিযোগ আমলে নিয়ে বিইআরসি আইনের ৪২ ও ৪৬ ধারা মোতাবেক ন্যায়বিচারের স্বার্থে শাস্তিযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ওই প্রতিবেদনে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
লেখক : জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
No comments