চারদিক-সাতটি ছবির গল্প by শারমিন নাহার
প্রদর্শনীর ছবিগুলো দেখে ভালো লাগল। কত বৈচিত্র্যময় ছবিই না তোলা হচ্ছে, প্রদর্শিত হচ্ছে! এই ছবিগুলো দেখে নিজের ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়ার একটা আগ্রহ জাগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটোগ্রাফি সোসাইটি আয়োজিত স্বাধীনতাযুদ্ধের চিত্র প্রদর্শনীটি ছিল ধানমন্ডির দৃক গ্যালারিতে।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ‘সাতটি ছবির গল্প’ নিয়ে এই প্রদর্শনী। ১৮ জন আলোকচিত্রীর ৬৫টি ছবি স্থান পেয়েছিল এখানে।
সাধারণ দর্শক হয়ে ছবি দেখতে দেখতে একটা জিজ্ঞাসা জাগল মনে। প্রায়ই স্বাধীনতার কথা বলি আমরা, কিন্তু স্বাধীনতার ধারণা কতটা পরিষ্কার আমাদের কাছে? স্বাধীনতাযুদ্ধের ৩৯ বছর পার হলো, কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি আমরা ছড়িয়ে দিতে পেরেছি নতুন প্রজন্মের কাছে? ৩৯ বছর আগে কী ঘটেছিল এই বাংলার মাটিতে? প্রদর্শনী দেখতে আসা শিক্ষার্থীরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিল।
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তৎকালীন পূর্ববাংলার জনগণের স্বাধিকার আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে যে হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিল একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে, তাতেও আক্রান্ত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের গণকবর, শিববাড়ি মন্দিরে সাধু হত্যা, শামসুন্নাহার হলের গণহত্যাসহ বেশ কিছু ঘটনা আজও পাকিস্তানি হানাদারদের পৈশাচিকতার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকাকে প্রতীকায়িত করে নির্মাণ করা হয়েছে ‘অপরাজেয় বাংলা’। আলোকচিত্রের সাতটি গল্পের প্রথম গল্প এটি। শিরোনাম ‘স্বাধীনতাযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’।
১৯৭১ সালের নির্যাতনের শিকার নারীদের দেওয়া হয়েছিল ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি। তাঁদেরই একজন ‘রাজু বালা’। ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দী ‘রাজু বালা’ শুধু একজন ‘রাজু বালা’ই নন, তিনি এ দেশের শত-সহস্র বীরাঙ্গনার প্রতিনিধি। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে আসে আমাদের মাথা। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য সাহসিকতার জন্য যাঁদের ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধি দেওয়া হয়েছে, তাঁদের অন্যতম বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান। দেশের জন্য বীর সেনাদের উৎসর্গীকৃত প্রাণ আমাদের সাহস জোগায়। তাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া লাল-সবুজের সেই পতাকা আমাদের প্রত্যয়নিষ্ঠ মহান স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখার শপথে। ফ্রেমে ধরে রাখা এই বীর সেনারা নতুন প্রজন্মের পথনির্দেশক।
আলোকচিত্রশিল্পী রশিদ তালুকদার স্বাধীনতাসংগ্রামে এ দেশের মুক্তিপাগল একদল দামাল ছেলের দুঃসাহসী অভিযানের বিভিন্ন মুহূর্ত ধারণ করেছেন তাঁর ক্যামেরায়। স্বাধীনতাযুদ্ধে এই ক্যামেরাই যেন রশিদ তালুকদারের অস্ত্র। বাদ যায়নি যুদ্ধপরবর্তী হাহাকার, কান্না-দুঃখ-দুর্দশা আর মানবিক আবেদনের নানা চিত্র। তাঁর এই সব আলোকচিত্র ইতিহাসের সাক্ষী তথা প্রামাণিক দলিল হয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে। তাঁকে নিয়েও ছিল আয়োজন।
খুলনা শহরে একটি পতাকা লাগানো বাঁশের সঙ্গে সংযুক্ত হার্ডবোর্ডে লেখা ছিল ‘এই কবরের উপর আমরা আমাদের সোনার বাংলা গড়ব’। এর অদূরেই রাস্তার পাশে আবর্জনা, কুকুর ও শকুনের থাবায় ইতস্তত ছড়ানো-ছিটানো গলিত লাশ ও হাড়গোড়। এখানেই পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগীরা খুন করেছে বাঙালিদের। আজও সারা দেশের অসংখ্য জায়গা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এই পাশবিক হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী হয়ে আছে। বধ্যভূমিগুলো নীরব কণ্ঠে আমাদের জানিয়ে দেয়, হানাদার বাহিনী কতটুকু নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছিল। ‘বধ্যভূমি’ আলোকচিত্রে উঠে এসেছে সেই সব বীভৎসতার জ্বলন্ত প্রমাণ।
যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত মানুষ আশা করছিল সংগ্রামের চূড়ান্ত ফলাফল দেখতে। ১৯৭১ সালে এমনই এক সংকটময় মুহূর্তে বেতারকেন্দ্র থেকে ভেসে আসে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি...’। এক কথায় বর্ণনা করা খুব কঠিন যে, এই ঘোষণা বাঙালির মনোবলকে কীভাবে শত-সহস্র গুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনতাযুদ্ধের শব্দসৈনিকদের ছবি নিয়েও একটি ‘ছবির গল্প’ ছিল প্রদর্শনীতে। একাত্তরের রক্তের দাগ মুছে গেছে, ফুরিয়ে গেছে স্বজনহারানো বেদনা, কিন্তু চেতনায় মিশে আছে বাঙালি জাতির হার-না-মানা সেই সংগ্রামের ইতিহাস। সেই চেতনারই পুনর্জাগরণ ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই নয়, সব শ্রেণীর মানুষই এসেছিল প্রদর্শনী দেখতে।
No comments