চারদিক-প্রকৃতি ও প্রাকৃত জীবনের কথা by দীপংকর চন্দ
‘আমি যখন ছোট ছিলাম’ শীর্ষক স্মৃতিকথায় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন লিখেছেন, ‘ব্রহ্মপুত্রের ধারে ধারে ছেলেবেলায় খেলে বেড়াতাম। শীতের নদী কুলুকুলু করে বয়ে যেত। জেলে মাছ ধরত, মেয়েরা কাপড় কাচত, কলসি ভরে পানি নিয়ে যেত বাড়ি, যাত্রী এপার-ওপার করত খেয়ানৌকার মাঝি। আমি তন্ময় হয়ে দেখতাম মানুষের এই আসা-যাওয়া।
নদীর ওপারে ছিল ঘন বন, তাকালে দেখা যেত দূরে নীল আকাশের কোল ঘেঁষে ধূসর গারো পাহাড়। সব কিছু মিলে মায়ার মতো লাগত আমার কাছে।’ সেই মায়াই কি জয়নুলকে উদ্বুদ্ধ করেছিল ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র তীরঘেঁষা প্রান্তে ছায়াসুনিবিড় একটি চিত্র-সংগ্রহশালা গড়ে তুলতে? ‘সম্ভবত,’ ভাবতে ভাবতে কাঁচিঝুলি মোড় পার হলাম আমরা। ভিক্টোরিয়া মিশন গার্লস প্রাইমারি স্কুল অতিক্রম করে পৌঁছলাম সাহেব কোয়ার্টার এলাকার শেষ মাথায়। সামনেই ব্রহ্মপুত্র। সৌন্দর্যের ভিন্নমাত্রা অস্তিত্বে ধারণ করা এই নদের তীরেই প্রাণপ্রাচুর্যে পূর্ণ প্রতিষ্ঠান ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা’।
গ্রিল-ঘেরা বিশাল জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা সংগ্রহশালার মূল ভবনটি বর্তমানে দ্বিতল হলেও আদিতে এটি ছিল বাংলো ধরনের একতলা স্থাপনা। প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো স্থাপনাটির স্বত্বাধিকারী ছিলেন ব্রিটিশ আমলের পাটব্যবসায়ী বার্ডন সাহেব। পরবর্তী সময়ে অসাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশসমৃদ্ধ স্থাপনাটির মালিকানা হস্তান্তরিত হয়। স্থাপনার স্বত্ব গ্রহণ করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী নলিনী রঞ্জন সরকার। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর জায়গাজমিসহ স্থাপনাটি অর্পিত সম্পত্তি আইনে হুকুমদখল করে সদ্য প্রতিষ্ঠিত দেশের শাসকগোষ্ঠী। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জেলা প্রশাসকের আওতায় চলে আসে সম্পত্তিটি। ১৯৭৫ সালে শিল্পাচার্যের অন্তিম ইচ্ছায় ব্রহ্মপুত্র-তীরবর্তী এ সম্পত্তিতে স্থাপিত হয় ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা’। সে বছরেরই ১৫ এপ্রিল তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম উদ্বোধন করেন এই অনন্য সংগ্রহশালাটি। জয়নুল আবেদিনের ৭০টি অসাধারণ শিল্পকর্ম নিয়ে যাত্রা শুরু করে সংগ্রহশালা। ১৯৮৬ সালে সংগ্রহশালাটি পরিচালনার জন্য একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠিত হয়। ১৯৮৭ সালে হয় ভবনের সংস্কারকাজ ও দ্বিতলীকরণ প্রক্রিয়া। ১৯৯৯ সালে ট্রাস্টি বোর্ডের বিলোপ ঘটিয়ে ৪৪৫৪.৬১ বর্গফুটের ভবনসহ ৩ একর ১৯.৫ শতাংশ জমি ও সংগ্রহশালার সব সম্পদ সংরক্ষণের দায়িত্ব অর্পিত হয় জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের ওপর।
সে যা-ই হোক, ছায়াচ্ছন্ন প্রবেশতোরণ অতিক্রম করে, পিচঢালা পরিচ্ছন্ন পথ পেরিয়ে সংগ্রহশালার মূল ভবনে পদার্পণ করলাম আমরা। পরিচয় ঘটল সংগ্রহশালার ডেপুটি কিপার বিজয় কৃষ্ণ বণিকের সঙ্গে। অত্যন্ত অমায়িক ভঙ্গিতে তিনি সংগ্রহশালাটি ঘুরিয়ে দেখালেন আমাদের। দ্বিতল এই সংগ্রহশালার নিচতলার ছয়টি কক্ষ বর্তমানে ব্যবহূত হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এবং একটি কক্ষ ব্যবহূত হচ্ছে শিশুদের চিত্রাঙ্কন শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে। নিচতলার সুদীর্ঘ বারান্দার শেষ প্রান্তে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। সুপরিসর সিঁড়ির প্রথম বাঁকেই জয়নুল আবেদিনের চারটি পেনসিল স্কেচ। দোতলার বারান্দায় শেখ আফজালের আঁকা জয়নুল আবেদিনের প্রতিকৃতির একটি ডিজিটাল প্রিন্ট। তারপর অগুনতি আলোকচিত্রের স্মৃতিময় সমাহার। সেসব আলোকচিত্র আলো করে আছেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, কামরুল হাসান, কলিম শরাফী, তোফায়েল আহমেদসহ আরও কত স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব! দোতলার বারান্দার অন্তিম প্রান্তের দরজা অতিক্রম করলেই দুই কক্ষবিশিষ্ট মূল সংগ্রহশালা। ‘শিল্পাচার্যের ৭০টি ছবির সবগুলো বর্তমানে নেই এ সংগ্রহশালায়। কারণ ১৯৯২ সালের ২ মে, কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে চুরি হয়ে গিয়েছিল জয়নুলের ১৭টি ছবি। পরবর্তী সময়ে চুরি যাওয়া শিল্পকর্মের ১০টি উদ্ধার করা হলেও বাদবাকি সাতটি শিল্পকর্মের উদ্ধারকাজে অগ্রগতি সাধিত হয়নি মোটেই,’ জানালেন বিজয় কৃষ্ণ বণিক। চিত্র ও আলোকচিত্র ছাড়াও জয়নুলের ইজেল, তুলি, রং, ছবি রাখার ব্যাগ, চশমাসহ ব্যবহার্য দ্রব্যাদি সংরক্ষিত আছে সংগ্রহশালায়।
লোকবল ও অর্থবলের অভাব থাকা সত্ত্বেও শিল্পাচার্যের অমূল্য ছবিগুলো সংরক্ষণে সংগ্রহশালা কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা চোখে পড়ার মতো। অত্যন্ত সংবেদনশীল চিত্রগুলো সঠিক তাপমাত্রায়, যথার্থ আর্দ্রতায় সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে তারা ব্যবহার করছে থার্মোমিটার, হাইগ্রোমিটার, ডিহিউমিডিটিফায়ারের মতো কার্যকর যন্ত্রপাতি। আলোর ক্ষতিকর উপাদান থেকে চিত্রগুলো রক্ষা করার জন্য আলোক-উৎসের তির্যক নিপতনের ব্যবস্থা করেছে কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়াও ধুলোর আগ্রাসন ঠেকাতে চিত্রগুলোর ওপর বিশেষ ধরনের পলিমারের আবরণ ব্যবহার তো করেছেই তারা, উপরন্তু দেয়াল স্যাঁতসেঁতে হয়ে জন্ম নেওয়া ফাঙ্গাসের আক্রমণ থেকে চিত্রগুলো বাঁচাতে গ্রহণ করেছে কাপড় মোড়ানো হার্ডবোর্ডের প্রতিরোধ-ব্যবস্থা। কিন্তু মহামূল্যবান শিল্পকর্ম রক্ষা করার জন্য এসব প্রতিরোধ-ব্যবস্থাও যে প্রকৃতঅর্থে যথেষ্ট নয়, এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অবগত আছেন বিজয় কৃষ্ণ বণিক। তিনি জয়নুল সংগ্রহশালার আরও কয়েকটি সমস্যার কথা তুলে ধরেন মৃদু স্বরে। তাঁর কথা শুনতে শুনতে ১৯৫৪ সালে জয়নুলের আঁকা ‘জীবন সংগ্রাম’ ছবিটির সামনে দাঁড়াই আমরা, প্রত্যক্ষ করি রং-রেখার অসামান্য আঁচড়ে জীবনকে ফুটিয়ে তোলার শক্তি। অতুলনীয় এই শক্তি কোত্থেকে অর্জন করলেন জয়নুল? নিঃসন্দেহে প্রকৃতি ও প্রাকৃত জীবন থেকে।
No comments