ডাইরেক্ট অ্যাকশন না সংলাপ? by শামসুল আরেফিন খান
১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট মুসলিম লীগ আহূত সর্বভারতীয় হরতাল সাম্প্রদায়িক কুচক্রীদের কূটচালে লক্ষপ্রাণঘাতী গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের মতো ইতিহাসখ্যাত মানব বিপর্যয়ের সূচনা করে। ২৭, ২৮ ও ২৯ জুলাই ১৯৪৬। মুম্বাই শহরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কাউন্সিলের বিশেষ অধিবেশন ডেকে জিন্নাহ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিতে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ১৬ আগস্ট '৪৬ প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস তথা 'ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে' ঘোষণা করেন।
লীগ কাউন্সিল ওই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে। সম্মেলনে '...calls upon Muslims of India to suspend all business on August 16, 1946, and observe complete Hartal- ১৬ আগস্ট ১৯৪৬ ভারতীয় মুসলমানদের সব কাজকর্ম বন্ধ রাখিয়া পূর্ণ হরতাল পালনের আহ্বান জানাইতেছে' মর্মে প্রস্তাব গৃহীত হয়।
দিবসের কর্মসূচি সফল করার লক্ষ্যে স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন, নওয়াব ইসমাইল ও চৌধুরী খালেকুজ্জামানকে নিয়ে কমিটি অব অ্যাকশন গঠিত হয়। কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউটে আহূত লীগ কর্মী সম্মেলনে সাম্প্রদায়িক কুচক্রীরা শঠতা ও মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে ১৬ আগস্ট ব্রিটিশের বদলে হিন্দুদের বিরুদ্ধে 'ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে' ঘোষণা করে। পরিণামে কলকাতার রাজপথ হিন্দু-মুসলমানের রক্তের বন্যায় ভেসে যায়। সংঘাত প্রসারিত হয় সমগ্র ভারতবর্ষে। তখন থেকেই 'অ্যাকশন অ্যাকশন-ডাইরেক্ট অ্যাকশন' স্লোগান সাম্প্রদায়িক সহিংসতার রণহুঙ্কার হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। সাম্প্রদায়িক শক্তি এখনো সে স্লোগান পরিহার করতে পারেনি। হরতালের জঙ্গি মিছিলে আজও অ্যাকশন অ্যাকশন-ডাইরেক্ট অ্যাকশান' স্লোগান শোনা যায়। সেই সঙ্গে দুর্বার হয়ে ওঠে ভাঙচুর, শুরু হয় অগ্নিসংযোগ, ককটেল ও হাতবোমা বিস্ফোরণ।
স্বাধীন বাংলাদেশে 'আমরা ৪১ বছরে হরতাল করেছি সাড়ে তিন বছর।' মাসুল গুনেছি 'দেড় লক্ষ কোটি টাকা।' আগুনে জীবন্ত পুড়ে মরেছে অগণিত হতভাগ্য দরিদ্র মানুষ। গুরুতর আহত হয়েছে এবং পঙ্গুত্ব পেয়েছে অনেকে। ক্ষয়ক্ষতির তালিকায় যানবাহনই সবচেয়ে বেশি। বাস ও দোকানপাটে ঘুমিয়ে থাকা কর্মক্লান্ত দুঃখী মানুষ নির্মম অগ্নিদহনে মর্মন্তুদ মৃত্যুর শিকার হয়েছে। তবুও আমরা মনে করি, হরতাল জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার। আইন করে হরতাল নিষিদ্ধ করলে দেশবাসীর গণতান্ত্রিক অধিকারই হরণ করা হবে। হরতাল নিঃসন্দেহে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার। সে অধিকার সমগ্র জনতার। কোনো ব্যক্তি বা দলের একচেটিয়া মৌরসি পাট্টা নয়।
আমরা চিনেছি ও লালন করেছি, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে হরতালকে শান্তিপূর্ণ অহিংস গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সবচেয়ে শানিত হাতিয়াররূপে, তার ভাষা গণতান্ত্রিক, তার আচরণ গণতান্ত্রিক, তার আশাও গণতান্ত্রিক। তার মর্মবাণী অহিংস মন্ত্রে পূতঃ।
জনগণ যখন তার প্রাণের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে, ক্ষোভ প্রকাশ করতে এবং সর্বাত্মক প্রতিবাদ বাঙ্ময় করতে হরতাল নামক শানিত, শাব্দিক অসি কোশমুক্ত করে অনন্যোপায় হয়ে দুর্বার রণে অবতীর্ণ হয়, তখন সামগ্রিক গণ-অসন্তোষে অগ্নি-আহুতি ঘটে। অতিকায় উদ্বাহু গণসংগ্রামে উচ্চকিত দাবানল সংযোজন হয়।
প্রবল গণরোষ দুর্বিনীত গণবিদ্রোহের রূপ পরিগ্রহ করে। তেমনটি ঘটেছিল স্মরণকালে স্বদর্শিত মহান ভাষা আন্দোলনের উত্তপ্ত পটভূমিতে, ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের প্রবল বাত্যাতাড়িত প্রেক্ষায় এবং সুমহান স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল পটভূমিতে। সেসব হরতাল ছিল জনগণের দ্বারা স্বমতে আরোপিত এবং জনমতের অবিসংবাদী স্বতঃস্ফূর্ততায় বলীয়ান ও উজ্জীবিত। অফিস-আদালত, ব্যাংক, দোকানপাট, বাজার-হাট প্রভৃতি সর্বকর্মস্থলে জীবনের স্পন্দন থেমে যাওয়া, জলে-স্থলে, আকাশে সব যানবাহনের গতি স্তব্ধ হয়ে যাওয়া, জনজীবন অচল ও নিথর হয়ে যাওয়া ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং জবরদস্তিহীন আত্মতাড়িত ঘটনা। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছাত্রসমাজ আহূত ধর্মঘট সর্বাত্মক হরতালের রূপ পরিগ্রহ করেছিল সাবলীল গতিতে জনগণের নিরুপদ্রব আত্মতাগিদে। ১৯৫২ সালের ২১, ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি কারো আহ্বানের অপেক্ষা না করে বীর জনতা নজিরবিহীন আত্মতাড়নায় সর্বাত্মক হরতালের উত্তাল স্রোতধারার জন্ম দিয়েছিল।
১৯৭১ সালের ১ মার্চের কথা স্মরণ করা যায় বিশেষভাবে। ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ১২টা। পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক নবনির্বাচিত জাতীয় সংসদের তিন মার্চ আহূত অধিবেশন স্থগিত করার বেতার ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ জীবনযাত্রার সব আয়োজন থামিয়ে দিয়ে বিদ্রোহের নিশান হাতে রাজপথে নেমে এসে সমুদ্র নিনাদিত বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। সেটাই ছিল আমাদের স্মৃতিময় অতীতের সবচেয়ে বড় হরতাল। আমাদের গৌরবের হরতাল। আমাদের গর্বের-অহঙ্কারের হরতাল। জনগণের মহা উত্থান, মহা জাগরণ। স্বাধীনতা-পরবর্তী চার দশকে আমরা যেসব হরতাল করেছি, তাতে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল না, সে কথা বলব না। স্বৈরাচারবিরোধী আট বছর আন্দোলনে সম্মিলিত বিরোধী দলের যুগপৎ কর্মসূচিতেও হরতাল সার্বিক জনসমর্থনে বলীয়ান হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠায় সবিশেষ ভূমিকা রাখে অমর পথকবি নূর হোসেনের রক্তস্নাত ১০ নভেম্বর ১৯৮৭-র সর্বাত্মক হরতাল। সব হরতালেই অর্থনীতির বিপুল ক্ষতি হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পুলিশের গুলিতে অসামান্য প্রাণহানি ঘটেছে। পুলিশের ট্রাকচাপায় দেলোয়ার-সেলিম প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু যত দূর মনে পড়ে, স্বতঃস্ফূর্ত জনসমর্থনের কারণে হরতাল সফল করতে কখনো বল প্রয়োগ করতে হয়নি। পুলিশের বাধা প্রতিরোধে সক্রিয় কর্মীদের অহিংস ধারায় স্থিতধী রাখতে গুরুত্বপূর্ণ সর্বদলীয় নেতারা পিকেটিংয়ের সব ঘাটে সার্বক্ষণিক উপস্থিতি বজায় রেখেছেন। পাকিস্তান আমলে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও উদীয়মান জাতির নতুন কাণ্ডারি শেখ মুজিবুর রহমান হরতাল-ধর্মঘট সফল করতে রাজপথে সংগ্রামী জনতার মাঝে সশরীরে অবস্থান নিয়ে ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করেছেন।
অধুনা বাংলাদেশে আধা জঙ্গি সহিংস হরতাল কর্মসূচি পালনকালে কিছু অপরিণামদর্শী উচ্ছৃঙ্খল মানুষের সন্ত্রাসী তৎপরতা ও বেপরোয়া আচরণের কারণে বিপুল আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ঝুঁকির মুখে পড়ছে। সুনির্দিষ্ট নিবিড় গবেষণার অভাবে হরতালে সাধিত অপরিমেয় ক্ষয়ক্ষতির সঠিক হিসাব-নিকাশ সম্ভব হয় না বলে সচরাচর পর্যবেক্ষক সূত্রে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানগুলোর সবই হয় অনুমানভিত্তিক। তার ভেতরেই সত্যকে খুঁজে নিতে হয়। ২০০৫ সালের মার্চ মাসে ইউএনডিপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'হরতালের কারণে বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ জিডিপির ৩ থেকে ৪ শতাংশ।' হরতালের আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতি বন্ধ করা সম্ভব হলে বাংলাদেশ এশিয়ার উন্নত দেশগুলোর কাতারে এসে দাঁড়াতে পারে বলে মন্তব্য করেন ঢাকাস্থ ইউএনডিপি প্রধান। (কালের কণ্ঠ, ১০ মে ২০১২)
সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে যে স্বাধীনতা-পরবর্তী ৪১ বছরে আমরা যে সাড়ে তিন বছর (১২৭৮ দিবস) হরতাল পালন করেছি, তাতে দেড় লাখ কোটি টাকা পরিমাণ আর্থিক ক্ষতিসাধিত হয়েছে। বর্তমান প্রাক্কলিত ব্যয় ২৪ হাজার কোটি টাকা হারে ওই পরিমাণ টাকায় অনূ্যন ছয়টা পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। অনুমান করা হচ্ছে, পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মিত হলে প্রবৃদ্ধি হার দেড় শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, '১ শতাংশ জিডিপি হার বৃদ্ধি পাওয়া মানে সে বছর আড়াই লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়া, কম করে হলেও ১০ লাখ মানুষের দারিদ্র্য সীমার ওপরে উঠে আসা।'
উল্লেখ্য, নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধে আমাদের গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৪ শতাংশ। ১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত সে প্রবৃদ্ধির হার ৫ শতাংশে উন্নীত হয়। বঙ্গবন্ধু বহুমুখী (যমুনা) সেতু প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তা ৬ শতাংশে এসে দাঁড়ায়। বঙ্গবন্ধু সেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধির যুগে প্রবেশ করেছে। ২০২১ সালে আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির শুভলগ্নে দুই হাজার ডলার মাথাপ্রতি আয় এবং ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কাজ করে চলেছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়েছে। বিপুল পরিমাণ তেল-গ্যাস আহরণের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যুৎ ও যাতায়াত সমস্যা লাঘবের লক্ষ্যে বহুমুখী প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। একদা যারা নবীন বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে তাচ্ছিল্য করেছিল, তারাই আজ বাংলাদেশকে তৃতীয় বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল বলছে। আর পাকিস্তানকে বলছে ব্যর্থ রাষ্ট্র। বিদ্যুৎ ও যাতায়াত সংকট নিরসন এবং হরতাল নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে বিদেশি উদ্যোক্তারা বাংলাদেশকে উত্তম বিনিয়োগক্ষেত্র বলে বিবেচনা করছেন।
বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগ বহুবার হরতাল পালন করেছে। সে সময় ১. রমনা বটমূলে চিরায়ত বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা মেরে মানুষ হত্যা, ২. দশ ট্রাক অস্ত্র পাচার, ৩. সংসদ সদস্য আহসানউল্লাহ মাস্টারকে হত্যা, ৩. আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড মেরে আইভি রহমানসহ ২০ নেতা-নেত্রীকে হত্যা (২১ আগস্ট ২০০৫), ৪. একই মুহূর্তে ৪৫৯ উপজেলায় একযোগে বোমা বিস্ফোরণ, ৫. অর্থমন্ত্রী এস এ এম এস কিবরিয়া হত্যাকাণ্ড প্রভৃতি ভয়াবহ লোমহর্ষক ঘটনা দেশের কষ্টার্জিত গণতন্ত্রকে সংকটের মুখে ঠেলে দেওয়ায় হরতালের পথ ধরে লখিন্দরের বাসরে মনসার অদৃশ্য অনুপ্রবেশের মতো দেশে অশুভ শক্তির অভ্যুদয় ঘটার আশঙ্কা দেখা দেয়। সে কঠিন অগ্নিপরীক্ষার সময় স্বাধীনতার সপক্ষশক্তি অসীম ধৈর্যসহকারে ধাবমান গৃহযুদ্ধকে পরিহার করতে সক্ষম হয়। চলতি সময়ের সহিংসতাকেও তাই খাটো করে দেখা চলে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের প্রচেষ্টাও কোনো অদৃশ্য ব্যাপার নয়। এ সময় স্থিতাবস্থা অক্ষুণ্ন রাখতে তাই সংলাপ দরকার।
লেখক : সাংবাদিক, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা
email : muktisakhan@yahoo.com
দিবসের কর্মসূচি সফল করার লক্ষ্যে স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন, নওয়াব ইসমাইল ও চৌধুরী খালেকুজ্জামানকে নিয়ে কমিটি অব অ্যাকশন গঠিত হয়। কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউটে আহূত লীগ কর্মী সম্মেলনে সাম্প্রদায়িক কুচক্রীরা শঠতা ও মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে ১৬ আগস্ট ব্রিটিশের বদলে হিন্দুদের বিরুদ্ধে 'ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে' ঘোষণা করে। পরিণামে কলকাতার রাজপথ হিন্দু-মুসলমানের রক্তের বন্যায় ভেসে যায়। সংঘাত প্রসারিত হয় সমগ্র ভারতবর্ষে। তখন থেকেই 'অ্যাকশন অ্যাকশন-ডাইরেক্ট অ্যাকশন' স্লোগান সাম্প্রদায়িক সহিংসতার রণহুঙ্কার হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। সাম্প্রদায়িক শক্তি এখনো সে স্লোগান পরিহার করতে পারেনি। হরতালের জঙ্গি মিছিলে আজও অ্যাকশন অ্যাকশন-ডাইরেক্ট অ্যাকশান' স্লোগান শোনা যায়। সেই সঙ্গে দুর্বার হয়ে ওঠে ভাঙচুর, শুরু হয় অগ্নিসংযোগ, ককটেল ও হাতবোমা বিস্ফোরণ।
স্বাধীন বাংলাদেশে 'আমরা ৪১ বছরে হরতাল করেছি সাড়ে তিন বছর।' মাসুল গুনেছি 'দেড় লক্ষ কোটি টাকা।' আগুনে জীবন্ত পুড়ে মরেছে অগণিত হতভাগ্য দরিদ্র মানুষ। গুরুতর আহত হয়েছে এবং পঙ্গুত্ব পেয়েছে অনেকে। ক্ষয়ক্ষতির তালিকায় যানবাহনই সবচেয়ে বেশি। বাস ও দোকানপাটে ঘুমিয়ে থাকা কর্মক্লান্ত দুঃখী মানুষ নির্মম অগ্নিদহনে মর্মন্তুদ মৃত্যুর শিকার হয়েছে। তবুও আমরা মনে করি, হরতাল জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার। আইন করে হরতাল নিষিদ্ধ করলে দেশবাসীর গণতান্ত্রিক অধিকারই হরণ করা হবে। হরতাল নিঃসন্দেহে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার। সে অধিকার সমগ্র জনতার। কোনো ব্যক্তি বা দলের একচেটিয়া মৌরসি পাট্টা নয়।
আমরা চিনেছি ও লালন করেছি, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে হরতালকে শান্তিপূর্ণ অহিংস গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সবচেয়ে শানিত হাতিয়াররূপে, তার ভাষা গণতান্ত্রিক, তার আচরণ গণতান্ত্রিক, তার আশাও গণতান্ত্রিক। তার মর্মবাণী অহিংস মন্ত্রে পূতঃ।
জনগণ যখন তার প্রাণের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে, ক্ষোভ প্রকাশ করতে এবং সর্বাত্মক প্রতিবাদ বাঙ্ময় করতে হরতাল নামক শানিত, শাব্দিক অসি কোশমুক্ত করে অনন্যোপায় হয়ে দুর্বার রণে অবতীর্ণ হয়, তখন সামগ্রিক গণ-অসন্তোষে অগ্নি-আহুতি ঘটে। অতিকায় উদ্বাহু গণসংগ্রামে উচ্চকিত দাবানল সংযোজন হয়।
প্রবল গণরোষ দুর্বিনীত গণবিদ্রোহের রূপ পরিগ্রহ করে। তেমনটি ঘটেছিল স্মরণকালে স্বদর্শিত মহান ভাষা আন্দোলনের উত্তপ্ত পটভূমিতে, ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের প্রবল বাত্যাতাড়িত প্রেক্ষায় এবং সুমহান স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল পটভূমিতে। সেসব হরতাল ছিল জনগণের দ্বারা স্বমতে আরোপিত এবং জনমতের অবিসংবাদী স্বতঃস্ফূর্ততায় বলীয়ান ও উজ্জীবিত। অফিস-আদালত, ব্যাংক, দোকানপাট, বাজার-হাট প্রভৃতি সর্বকর্মস্থলে জীবনের স্পন্দন থেমে যাওয়া, জলে-স্থলে, আকাশে সব যানবাহনের গতি স্তব্ধ হয়ে যাওয়া, জনজীবন অচল ও নিথর হয়ে যাওয়া ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং জবরদস্তিহীন আত্মতাড়িত ঘটনা। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছাত্রসমাজ আহূত ধর্মঘট সর্বাত্মক হরতালের রূপ পরিগ্রহ করেছিল সাবলীল গতিতে জনগণের নিরুপদ্রব আত্মতাগিদে। ১৯৫২ সালের ২১, ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি কারো আহ্বানের অপেক্ষা না করে বীর জনতা নজিরবিহীন আত্মতাড়নায় সর্বাত্মক হরতালের উত্তাল স্রোতধারার জন্ম দিয়েছিল।
১৯৭১ সালের ১ মার্চের কথা স্মরণ করা যায় বিশেষভাবে। ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ১২টা। পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক নবনির্বাচিত জাতীয় সংসদের তিন মার্চ আহূত অধিবেশন স্থগিত করার বেতার ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ জীবনযাত্রার সব আয়োজন থামিয়ে দিয়ে বিদ্রোহের নিশান হাতে রাজপথে নেমে এসে সমুদ্র নিনাদিত বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। সেটাই ছিল আমাদের স্মৃতিময় অতীতের সবচেয়ে বড় হরতাল। আমাদের গৌরবের হরতাল। আমাদের গর্বের-অহঙ্কারের হরতাল। জনগণের মহা উত্থান, মহা জাগরণ। স্বাধীনতা-পরবর্তী চার দশকে আমরা যেসব হরতাল করেছি, তাতে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল না, সে কথা বলব না। স্বৈরাচারবিরোধী আট বছর আন্দোলনে সম্মিলিত বিরোধী দলের যুগপৎ কর্মসূচিতেও হরতাল সার্বিক জনসমর্থনে বলীয়ান হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠায় সবিশেষ ভূমিকা রাখে অমর পথকবি নূর হোসেনের রক্তস্নাত ১০ নভেম্বর ১৯৮৭-র সর্বাত্মক হরতাল। সব হরতালেই অর্থনীতির বিপুল ক্ষতি হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পুলিশের গুলিতে অসামান্য প্রাণহানি ঘটেছে। পুলিশের ট্রাকচাপায় দেলোয়ার-সেলিম প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু যত দূর মনে পড়ে, স্বতঃস্ফূর্ত জনসমর্থনের কারণে হরতাল সফল করতে কখনো বল প্রয়োগ করতে হয়নি। পুলিশের বাধা প্রতিরোধে সক্রিয় কর্মীদের অহিংস ধারায় স্থিতধী রাখতে গুরুত্বপূর্ণ সর্বদলীয় নেতারা পিকেটিংয়ের সব ঘাটে সার্বক্ষণিক উপস্থিতি বজায় রেখেছেন। পাকিস্তান আমলে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও উদীয়মান জাতির নতুন কাণ্ডারি শেখ মুজিবুর রহমান হরতাল-ধর্মঘট সফল করতে রাজপথে সংগ্রামী জনতার মাঝে সশরীরে অবস্থান নিয়ে ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করেছেন।
অধুনা বাংলাদেশে আধা জঙ্গি সহিংস হরতাল কর্মসূচি পালনকালে কিছু অপরিণামদর্শী উচ্ছৃঙ্খল মানুষের সন্ত্রাসী তৎপরতা ও বেপরোয়া আচরণের কারণে বিপুল আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ঝুঁকির মুখে পড়ছে। সুনির্দিষ্ট নিবিড় গবেষণার অভাবে হরতালে সাধিত অপরিমেয় ক্ষয়ক্ষতির সঠিক হিসাব-নিকাশ সম্ভব হয় না বলে সচরাচর পর্যবেক্ষক সূত্রে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানগুলোর সবই হয় অনুমানভিত্তিক। তার ভেতরেই সত্যকে খুঁজে নিতে হয়। ২০০৫ সালের মার্চ মাসে ইউএনডিপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'হরতালের কারণে বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ জিডিপির ৩ থেকে ৪ শতাংশ।' হরতালের আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতি বন্ধ করা সম্ভব হলে বাংলাদেশ এশিয়ার উন্নত দেশগুলোর কাতারে এসে দাঁড়াতে পারে বলে মন্তব্য করেন ঢাকাস্থ ইউএনডিপি প্রধান। (কালের কণ্ঠ, ১০ মে ২০১২)
সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে যে স্বাধীনতা-পরবর্তী ৪১ বছরে আমরা যে সাড়ে তিন বছর (১২৭৮ দিবস) হরতাল পালন করেছি, তাতে দেড় লাখ কোটি টাকা পরিমাণ আর্থিক ক্ষতিসাধিত হয়েছে। বর্তমান প্রাক্কলিত ব্যয় ২৪ হাজার কোটি টাকা হারে ওই পরিমাণ টাকায় অনূ্যন ছয়টা পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। অনুমান করা হচ্ছে, পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মিত হলে প্রবৃদ্ধি হার দেড় শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, '১ শতাংশ জিডিপি হার বৃদ্ধি পাওয়া মানে সে বছর আড়াই লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়া, কম করে হলেও ১০ লাখ মানুষের দারিদ্র্য সীমার ওপরে উঠে আসা।'
উল্লেখ্য, নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধে আমাদের গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৪ শতাংশ। ১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত সে প্রবৃদ্ধির হার ৫ শতাংশে উন্নীত হয়। বঙ্গবন্ধু বহুমুখী (যমুনা) সেতু প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তা ৬ শতাংশে এসে দাঁড়ায়। বঙ্গবন্ধু সেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধির যুগে প্রবেশ করেছে। ২০২১ সালে আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির শুভলগ্নে দুই হাজার ডলার মাথাপ্রতি আয় এবং ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কাজ করে চলেছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়েছে। বিপুল পরিমাণ তেল-গ্যাস আহরণের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যুৎ ও যাতায়াত সমস্যা লাঘবের লক্ষ্যে বহুমুখী প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। একদা যারা নবীন বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে তাচ্ছিল্য করেছিল, তারাই আজ বাংলাদেশকে তৃতীয় বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল বলছে। আর পাকিস্তানকে বলছে ব্যর্থ রাষ্ট্র। বিদ্যুৎ ও যাতায়াত সংকট নিরসন এবং হরতাল নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে বিদেশি উদ্যোক্তারা বাংলাদেশকে উত্তম বিনিয়োগক্ষেত্র বলে বিবেচনা করছেন।
বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগ বহুবার হরতাল পালন করেছে। সে সময় ১. রমনা বটমূলে চিরায়ত বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা মেরে মানুষ হত্যা, ২. দশ ট্রাক অস্ত্র পাচার, ৩. সংসদ সদস্য আহসানউল্লাহ মাস্টারকে হত্যা, ৩. আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড মেরে আইভি রহমানসহ ২০ নেতা-নেত্রীকে হত্যা (২১ আগস্ট ২০০৫), ৪. একই মুহূর্তে ৪৫৯ উপজেলায় একযোগে বোমা বিস্ফোরণ, ৫. অর্থমন্ত্রী এস এ এম এস কিবরিয়া হত্যাকাণ্ড প্রভৃতি ভয়াবহ লোমহর্ষক ঘটনা দেশের কষ্টার্জিত গণতন্ত্রকে সংকটের মুখে ঠেলে দেওয়ায় হরতালের পথ ধরে লখিন্দরের বাসরে মনসার অদৃশ্য অনুপ্রবেশের মতো দেশে অশুভ শক্তির অভ্যুদয় ঘটার আশঙ্কা দেখা দেয়। সে কঠিন অগ্নিপরীক্ষার সময় স্বাধীনতার সপক্ষশক্তি অসীম ধৈর্যসহকারে ধাবমান গৃহযুদ্ধকে পরিহার করতে সক্ষম হয়। চলতি সময়ের সহিংসতাকেও তাই খাটো করে দেখা চলে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের প্রচেষ্টাও কোনো অদৃশ্য ব্যাপার নয়। এ সময় স্থিতাবস্থা অক্ষুণ্ন রাখতে তাই সংলাপ দরকার।
লেখক : সাংবাদিক, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা
email : muktisakhan@yahoo.com
No comments