কালের পুরাণ-সাতক্ষীরা খুলনা নয়, খুলনাও নয় ঢাকা by সোহরাব হাসান
ঢাকা থেকে সাতক্ষীরা কত দূর? পথের দূরত্বে ৩৩০ কিলোমিটার। কিন্তু সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। ঢাকায় বসে নাগরিক-সুবিধার ঘাটতি নিয়ে যাঁরা আক্ষেপ করেন, তাঁরা একবার সাতক্ষীরা ঘুরে এলে বুঝবেন কতটা আরামে আছেন। সাতক্ষীরায় হাজারো সমস্যা।
বিদ্যুৎ নেই, সুপেয় পানি নেই, স্বল্প খরচের জ্বালানি-গ্যাসের কথা তারা চিন্তাও করতে পারে না। জেলায় চুরি-ডাকাতি বেড়েছে, যুবকদের মধ্যে মাদকাসক্তি, ইভ টিজিং বেড়েছে; অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বিকার।
২৬ মে বিকেলে উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে আয়োজন করা হয়েছিল প্রথম আলোর মতবিনিময় সভা। সেখানে ব্যক্তিগত অঅলাপচারিতায় সাতক্ষীরার নান সমস্যা তুলে ধরলেন নাগরিক সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধি। তাঁদের আক্ষেপ, গত এক বছরেও আইলা-দুর্গত লোকজনের পুনর্বাসন করেনি সরকার। ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ নির্মাণেও কোনো উদ্যোগ নেই।
মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর সাতক্ষীরাবাসী আশা করেছিল, অবহেলিত এই অঞ্চলের উন্নয়ন হবে। তিয়াত্তরের পর কোনো নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এত বেশি আসন পায়নি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী রুহুল হক সাতক্ষীরা-৩ আসনের সাংসদ। কিন্তু গত ১৬ মাসেও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি জেলায়। আইলা-দুর্গত লোকজনের পুনর্বাসনে মন্ত্রীর এলাকায় দেড় কোটি টাকা ও ৫০ বান টিন বরাদ্দ হলেও তা বিতরণ করা হয়নি সিদ্ধান্তের অভাবে। শ্যামনগরেও সমপরিমাণ ত্রাণসামগ্রী বিতরণ সম্ভব হয়নি সাংসদ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরোধের কারণে। দুর্গত মানুষকে নিয়েও চলছে রাজনীতি!
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা আরও জানালেন, জেলার একমাত্র টেক্সটাইল মিলটি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ আছে। বেকার যুবকদের অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে চোরাচালানে, মাদক ব্যবসায়। এ নিয়ে পুলিশ ও বিডিআরে চলছে রশি টানাটানি। পুলিশের দাবি, বিডিআর নিষ্ক্রিয় বলেই সীমান্ত দিয়ে মাদকদ্রব্য আসছে। বিডিআর বলছে, পুলিশের সহায়তায়ই মাদক কেনাবেচা হচ্ছে।
বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক টানাপোড়েনও কম নয়। সম্প্রতি কলেজপড়ুয়া এক মুসলমান মেয়ে হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করায় বিষয়টি থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়। ছেলেটির বাবা-চাচাকেও আসামি করা হয়েছে। এ নিয়ে ২২টি সংখ্যালঘু পরিবার আতঙ্কে আছে। তাদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে পুলিশ ও প্রভাবশালীরা।
কয়েক দিন আগে শ্যামনগর উপজেলার নওয়াবেকী গ্রামের বাসিন্দা ও ইডেন কলেজের ছাত্রী আত্মহত্যা করেছেন মুঠোফোনে বখাটেদের উৎপাত সইতে না পেরে। অভিযুক্ত গ্রেপ্তার হলেও পরিবারের লোকজন শঙ্কায় আছে। মাস ছয়েক আগে সাতক্ষীরা শহরেই খুন হন ভূমিহীন সমিতির নেতা সাইফুল্লাহ লস্কর। রাত দেড়টায় এক পুলিশ কর্মকর্তা তাঁকে মুঠোফোনে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যান। পরে তাঁর লাশ পাওয়া যায় বাড়ির সামনেই। সেই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, উদ্ঘাটিত হয়নি হত্যারহস্য। গত বুধবার রাতে শহরের কাচারিপাড়ায় প্রথম আলো প্রতিনিধি কল্যাণ ব্যানার্জির বাড়িতে চোর ঢুকে ল্যাপটপ নিয়ে যায়। এসব অপরাধ আর সাতক্ষীরায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে না। কেননা, ঘটনার পর কিছুদিন হইচই চলে। প্রতিকার হয় না।
সফল ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে সিটি ব্যাংক পুরস্কার পেয়েছিলেন কালীগঞ্জ উপজেলার শামিমা খাতুন; তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে নিজের গ্রামে ক্লিনিক করেছিলেন তিনি। সেই ক্লিনিকটি কোনোভাবে চললেও ভালো নেই শামীমা। তাঁর বাইরে যাওয়ার ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা। এভাবে হাজারো শামীমার স্বপ্ন ভেঙে যায় সমাজ ও সংসার নামের যূপকাষ্ঠে।
বিএনপি আমলে জেলামন্ত্রী ছিলেন বরকতউল্লা ভুলু। তিনি জলমহালের নামে এলাকার খাল-পুকুর বিএনপির লোকদের ইজারা দিয়েছিলেন। ক্ষমতার হাতবদলের সঙ্গে সঙ্গে ইজারাও বদল হয়ে গেছে।
জামায়াতে ইসলামীর শক্ত ঘাঁটি ছিল সাতক্ষীরা। জোট সরকারের আমলে পাঁচটি আসনের চারটিই ছিল জামায়াতের দখলে। তারা কি এখন নিশ্চুপ? সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তাঁরা জানালেন, জামায়াত এখন বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনের নামে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এসব অনুষ্ঠানে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারাও হাজির থাকছেন।
স্থানীয় সাংবাদিকদের ওপর কোনো চাপ আছে কি না? জবাবে একজন বললেন, রাজনৈতিক চাপ নেই, তবে প্রশাসনের চাপ আছে। বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসনের দুর্নীতি নিয়ে লিখলেই তারা নানা ফন্দি-ফিকির আঁটতে থাকে। সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাসেম খানকে প্রত্যাহার করে নিতে গণদরখাস্ত দেওয়ার পরও কোনো প্রতিকার হয়নি।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের এক নেতার বাড়ি থেকে অস্ত্রসহ তরুণের গ্রেপ্তারের ঘটনাটি সাজানো বলেই মনে করে স্থানীয় লোকজন। র্যাবকে দিয়ে প্রতিপক্ষ এ ঘটনা ঘটিয়েছে, যে খবর জাতীয় পত্রিকায় ফলাও করে প্রকাশ এবং উচ্চ আদালত সংশ্লিষ্ট র্যাব কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে অপসারণের নির্দেশ দেওয়ার পরও আশ্বস্ত হতে পারেনি আক্রান্ত পরিবারটি ও এলাকাবাসী। তাদের ভয়, র্যাব-পুলিশ যেকোনো সময় ফাঁসিয়ে দিতে পারে।
সাতক্ষীরায় বিদ্যুৎ-পরিস্থিতি অসহনীয়। এখানে বিদ্যুৎ থাকে না, মাঝে মাঝে আসে। ২৬ মে সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টা শহরে ছিলাম, এর মধ্যে বেশির ভাগ সময়ই লোডশেডিং চলছিল। সাতক্ষীরা শহরে দুটি বড় রাস্তা, তাও খানাখন্দে ভরা। সম্ভবত সাতক্ষীরাই দেশের একমাত্র জেলা শহর, যেখানে যেতে পিচের বদলে ইট-সুরকির রাস্তা পার হতে হয়।
২.
দেশের তৃতীয় বৃহত্তম নগর খুলনা; ঢাকার তুলনায় অনেক পরিচ্ছন্ন। মেয়রের উদ্যোগে রাস্তাঘাট সংস্কারের কাজও চলছে। ২৭ মে সকালে সহকর্মী মনোজ কুমার মজুমদারকে নিয়ে খালিশপুর যাই শিল্পাঞ্চলের হালচাল দেখতে। নয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের অধিকাংশ বন্ধ করে দিয়েছিল জোট ও জরুরি সরকার। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে কয়েকটি চালু করে। কিন্তু প্রয়োজনীয় পাট না পাওয়ায় মাঝেমধ্যে এগুলোও বন্ধ রাখতে হচ্ছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া দৌলতপুর ও পিপলস পাটকলের জীর্ণ চেহারা দেখে ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো। শিল্প কারখানা ধ্বংস করতেই কি আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম? গেট পেরোতেই কথা হলো মাস্টাররোলে কাজ করা কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে। তাঁরা আশা করছেন, মিলটি আবার চালু হবে।
পাশের শ্রমিক কলোনিগুলোর অবস্থাও শোচনীয়। মনে হচ্ছে, পরিত্যক্ত। দুটি কলোনি প্রায় ফাঁকা। চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের অনেকে গ্রামে চলে গেছেন; কেউ রিকশা চালিয়ে বা অন্য কোনো কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ছেলেমেয়েদের স্কুলেও পাঠাতে পারছেন না।
খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল অঙ্গনে এখন র্যাবের অফিস। শিল্পমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, মিল ফের চালু করা হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। একবার চালু করে যেন আবার বন্ধ করতে না হয়।
কেন রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধ হলো? এর জন্য কারা দায়ী? শ্রমিকেরা জানালেন, সরকারের ভুল নীতি, কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও সরকার-সমর্থক সিবিএর (সেন্ট্রাল বার্গেনিং এজেন্ট) অনাচার। সাধারণ শ্রমিকেরা কাজে ফাঁকি দেননি। আশির দশকে পাটকলগুলো লাভজনক ছিল; এ জন্য সরকার শ্রমিকদের বাড়তি বোনাসও দিয়েছে। এরশাদের আমলে পাটকলগুলোর লোকসান বাড়তে থাকে। কেন? তিনি সিবিএকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। পরবর্তী সময়ে বিএনপিও সেই ধারায় মিল চালাতে থাকে। শ্রমিকেরা আরও জানালেন, পাট কেনা থেকে শুরু করে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি—প্রতিটি স্তরে ব্যাপক চুরি হতো। পাট না কিনেও ভুয়া ভাউচার দেখানো হতো। পছন্দের লোকের কাছ থেকে খারাপ পাট কেনা হতো। শ্রমিকেরা লাভজনক কারখানা ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়ার প্রতিবাদ জানালে বিএনপির নেতারা বলতেন, ‘মেয়ে যেটি সুন্দরী, তাকেই আগে বিয়ে দিতে হয়।’ তাঁদের অভিযোগ, যাদের কারণে পাটকল বন্ধ হয়েছে, তাদের কিছু হয়নি। চাকরি হারিয়েছেন গরিব শ্রমিকেরা।
জানতে চাইলাম এই মুহূর্তে পাটকলগুলোর প্রধান সমস্যা কী? শ্রমিকেরা বললেন, সময়মতো পাট না পাওয়া। পাটের মৌসুমে বিজেএমসি ঠিকমতো পাট কেনার টাকা দেয় না। ফলে প্রয়োজনীয় পাটও কেনা সম্ভব হয় না। যখন তারা টাকা দেয়, তখন বাজারে পাট থাকে না। কর্মকর্তাদের কমিশন-বাণিজ্যের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে একজন বললেন, ‘পাটকল এলাকায় ব্যবসায়ীর কাছ থেকে যে পাট মণপ্রতি ৫০০ টাকায় কেনা হয়, সেই পাট জামালপুর বা ময়মনসিংহ থেকে এজেন্সির মাধ্যমে ৪৫০ টাকায় কিনে পরিবহন খরচ দেখানো হয় মণপ্রতি ২০০ টাকা। সে ক্ষেত্রে এক মণ পাটের দাম পড়ে ৬৫০ টাকা। পাটগুদাম নিয়েও চলে দুর্নীতি। দলীয় ও পছন্দের লোকদের গুদামে বেশি ভাড়ায় পাট রাখা হয়।’
বিকেলে প্রথম আলোর মতবিনিময় সভায়ও বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার প্রতিনিধিরা মহানগরের নানা সমস্যার কথা তুলে ধরে শিল্পনগর খুলনার হূত গৌরব ফিরিয়ে আনার কথা বললেন। জলবায়ু পরিবর্তনের হাত থেকে সুন্দরবন রক্ষার আহ্বান জানালেন। মংলা সমুদ্রবন্দর উন্নয়নে সরকারের প্রতিশ্রুতিরও দ্রুত বাস্তবায়ন দেখতে চান তাঁরা। সুন্দরবন কেবল খুলনার নয়, সারা দেশের গর্ব। প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের তালিকায় যাতে সুন্দরবন থাকে, সে জন্য বেশি বেশি ভোট করারও অনুরোধ করলেন। খুলনার সমস্যা নিয়ে কথা হলো প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হোসেন এবং চ্যানেল আইয়ের প্রতিনিধি এ কে হিরুর সঙ্গেও। তাঁরা বললেন, পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ খুলনাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি। কুষ্টিয়া পর্যন্ত গ্যাসলাইন নির্মাণ করা হয়েছে, বাকি কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে। প্রথম আলো খুলনা ব্যুরোপ্রধান শেখ আবু হাসান যোগ করলেন, আইলা ও সিডরে দুই লাখ লোক জলবায়ু-উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। তাঁদের স্থায়ী পুনর্বাসনে এখনই বাঁধের কাজ শুরু করা দরকার।
খুলনা ও সাতক্ষীরায় অনেক কিছু নেই। ঢাকা থেকে যেতেও বিপত্তি, আসতেও। ফেরিঘাটে যাত্রীদের ভোগান্তির শেষ নেই। আবহাওয়া খারাপ থাকলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরির অপেক্ষায় থাকতে হয়। ভোর ছয়টার বাস পৌঁছাতে ৯-১০টা লেগে যায়। খুলনার পাশে হলেও অবকাঠামোগত দিক থেকে সাতক্ষীরা বেশ পিছিয়ে। আবার ঢাকা থেকে পিছিয়ে আচে খুলনা। অর্থাৎ সাতক্ষীরা খুলনা নয়, আবার খুলনাও নয় ঢাকা।
দক্ষিণাঞ্চলের এই দুটি শহরের বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের নিত্যদিনের দুর্ভোগ ও সমস্যার কথা শুনলে স্বভাবতই মন খারাপ হয়ে যায়। এক দেশে থেকেও তারা কত দূরে। আবার ভালোলাগার দিকটিও একেবারে ফেলনা নয়। খুলনা ও সাতক্ষীরায়ও আওয়ামী লীগ, বিএনপি আছে, আছে ডান-বাম আরো অনেক দল। তবে রাজনৈতিক হানাহানি নেই, কেউ কারও জনসভা ভেঙে দেয় না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি বিষবাণ ছুড়ে মারে না।
রাজধানীতে বসবাসকারী আমাদের জাতীয় নেতা-মন্ত্রীরা ‘মফস্বল’ থেকে অন্তত এই রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতার সবকটি নিতে পারেন।
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments