সামান্য স্মৃতি by শেখ রোকন
অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের সঙ্গে দ্বিতীয়বার দেখার সময় যখন পরিবেশ-প্রকৃতি ও জনকর্তব্য নিয়ে বিস্তৃত আলাপ হয়, তিনি তখন সেসব ইস্যুতে তৎপর দেশের বৃহত্তম নাগরিক ফোরাম বাপার (বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন) সভাপতি। পেছনে ফেলে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাসহ এক বর্ণাঢ্য জীবন।
আর আমি সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে, কর্তব্যজ্ঞানে নয়, নেহাত আবেগবশত পরিবেশ আন্দোলনের অ আ ক খ বোঝার চেষ্টা করছি। নদী সুরক্ষায় রিভারাইন পিপল নামে যে অলাভজনক উদ্যোগ আমরা কয়েক তরুণ গড়ে তোলার চেষ্টা করছি, সেটা তখনও দানা বাঁধেনি। বহুজাতিক উন্নয়ন সংস্থার পক্ষে নদী বিষয়ক একটি প্রকাশনার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে আমি লেখা জোগাড় করতে এদিও-ওদিক ছুটছি মাত্র। পরিচিতজনের লেখা প্রাপ্তি যতটা সহজ ছিল, বিশিষ্টজনের আস্থা অর্জন যেন ততটাই কঠিন। নামি সংবাদপত্রের দামি সাংবাদিক যেখানে লেখার জন্য গলদঘর্ম; উটকো তরুণকে কে পাত্তা দেয়!
মোজাফ্ফর স্যার পাত্তা দিয়েছিলেন। আমার উদ্দেশ্য বিধেয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চেয়েছিলেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি সারাজীবন জ্ঞান বিলিয়েছেন। সেবার আমার কাছেই জানতে চেয়েছিলেন নদী, প্রকৃতি, পরিবেশ রক্ষায় আমাদের আসলে কী করা উচিত। দেশের শ্রেষ্ঠতম বিদ্যাপীঠে অর্ধযুগ কেটেছে বটে; তখনও নাগরিক এটিকেট রপ্ত করে উঠতে পারিনি। তার সামনে মফস্বলীয় কায়দায় নদী সুরক্ষার গুরুত্ব বিষয়ে দীর্ঘ বয়ান দিয়েছিলাম। এখন সেই দুঃসাহসের কথা ভাবতেও ভয় লাগে; কিন্তু তিনি বোধহয় খুশিই হয়েছিলেন।
তিনি কেবল আমাদের সেই প্রকাশনায় লিখতে সম্মতিই দেননি। নানা জটিলতায় 'নদী প্রসঙ্গ' প্রকাশ হতে বেশ সময় লেগেছিল। ওই সময়ের মাঝে কয়েকবার দেখা হওয়ার সময় প্রকাশনাটির ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছিলেন। অবশেষে ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে আলোর মুখ দেখে সেটা। প্রথম লেখাটি তার_ 'নদীর বাণিজ্যিকীকরণ নয়'। বইয়ের দুটি কপি যখন তার হাতে তুলে দিতে তার বাসায় যাই, তিনি আমার সামনেই বেশ সময় নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখেছিলেন। প্রচ্ছদ ও আধেয় আয়োজনের প্রশংসাও করেছিলেন। কয়েক দিন পর বোধহয় বাপার একটি সভা ছিল। সেখানে উপস্থিত শরিফ ভাই (সাবেক ছাত্রনেতা শরিফুজ্জামান শরিফ) পরে আমাকে জানিয়েছেন, মোজাফ্ফর স্যার বইটি সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন অন্যদের দেখানোর জন্য।
তারপর পেশাগত প্রয়োজনে স্যারের কাছে আরও অনেকবার গেছি। টেলিফোনে দীর্ঘ মন্তব্য নিতে চেয়েছি। তিনি সময় দিতে কার্পণ্য করেননি। অবশ্য তিনি কোনো সাংবাদিককেই বিমুখ করতেন না। একবার কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, মিডিয়াকে তিনি নাগরিক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মনে করেন।
স্যারের সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল সাংবাদিকতা সূত্রেই। আমি তখন দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদকীয় বিভাগের কনিষ্ঠতম কর্মী। জ্যেষ্ঠ সহকর্মী হাসান মামুন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলেন। আমি তার সঙ্গে গিয়েছিলাম শ্রুতিলিখন সহকারী হিসেবে। তারা দু'জন সুশাসন, প্রবৃদ্ধি প্রভৃতি বড় বড় বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন; আমি পুরনো আমলের রেকর্ডার স্যারের সামনে ধরে বসে ছিলাম। প্রবেশ ও প্রস্থানকালে সালাম দেওয়া ছাড়া কোনো কথা হয়নি।
বলাবাহুল্য, পরে অনেকবার অনেক কথা হয়েছে। শেষ দেখা হয়েছিল ২০১০ সালের শেষ দিকে। সমকালের 'ঈদ আনন্দ' সংখ্যা তার শৈশব নিয়ে বিশেষ আয়োজন করবে। সে ব্যাপারে সম্মতি আদায় করতে গিয়েছিলাম তার বাসায়। তখনই তিনি যেন শারীরিকভাবে দুর্বল হতে শুরু করেছেন। বলেছিলাম, আমার দুই সহকর্মী আসবেন আপনার শৈশব সম্পর্কে জানতে, ছবি তুলতে। লেখাটি কি ছাপার আগে দেখিয়ে নিতে হবে? তিনি বলেছিলেন, 'প্রয়োজন নেই। ভালোভাবে দেখে দেবেন।'
প্রায় প্রত্যেকবারই এই কথা শুনতে হয়েছে মোজাফ্ফর স্যারের কাছে। তার মৃত্যুর পরও সেই কথাটিই কানে ভাসছে। আসলে যা করার আমাদেরই ভালোভাবে, দেখেশুনে করতে হবে। তার যা বলার তিনি তো বলে দিয়েছেন।
skrokon@gmail.com
মোজাফ্ফর স্যার পাত্তা দিয়েছিলেন। আমার উদ্দেশ্য বিধেয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চেয়েছিলেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি সারাজীবন জ্ঞান বিলিয়েছেন। সেবার আমার কাছেই জানতে চেয়েছিলেন নদী, প্রকৃতি, পরিবেশ রক্ষায় আমাদের আসলে কী করা উচিত। দেশের শ্রেষ্ঠতম বিদ্যাপীঠে অর্ধযুগ কেটেছে বটে; তখনও নাগরিক এটিকেট রপ্ত করে উঠতে পারিনি। তার সামনে মফস্বলীয় কায়দায় নদী সুরক্ষার গুরুত্ব বিষয়ে দীর্ঘ বয়ান দিয়েছিলাম। এখন সেই দুঃসাহসের কথা ভাবতেও ভয় লাগে; কিন্তু তিনি বোধহয় খুশিই হয়েছিলেন।
তিনি কেবল আমাদের সেই প্রকাশনায় লিখতে সম্মতিই দেননি। নানা জটিলতায় 'নদী প্রসঙ্গ' প্রকাশ হতে বেশ সময় লেগেছিল। ওই সময়ের মাঝে কয়েকবার দেখা হওয়ার সময় প্রকাশনাটির ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছিলেন। অবশেষে ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে আলোর মুখ দেখে সেটা। প্রথম লেখাটি তার_ 'নদীর বাণিজ্যিকীকরণ নয়'। বইয়ের দুটি কপি যখন তার হাতে তুলে দিতে তার বাসায় যাই, তিনি আমার সামনেই বেশ সময় নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখেছিলেন। প্রচ্ছদ ও আধেয় আয়োজনের প্রশংসাও করেছিলেন। কয়েক দিন পর বোধহয় বাপার একটি সভা ছিল। সেখানে উপস্থিত শরিফ ভাই (সাবেক ছাত্রনেতা শরিফুজ্জামান শরিফ) পরে আমাকে জানিয়েছেন, মোজাফ্ফর স্যার বইটি সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন অন্যদের দেখানোর জন্য।
তারপর পেশাগত প্রয়োজনে স্যারের কাছে আরও অনেকবার গেছি। টেলিফোনে দীর্ঘ মন্তব্য নিতে চেয়েছি। তিনি সময় দিতে কার্পণ্য করেননি। অবশ্য তিনি কোনো সাংবাদিককেই বিমুখ করতেন না। একবার কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, মিডিয়াকে তিনি নাগরিক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মনে করেন।
স্যারের সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল সাংবাদিকতা সূত্রেই। আমি তখন দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদকীয় বিভাগের কনিষ্ঠতম কর্মী। জ্যেষ্ঠ সহকর্মী হাসান মামুন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলেন। আমি তার সঙ্গে গিয়েছিলাম শ্রুতিলিখন সহকারী হিসেবে। তারা দু'জন সুশাসন, প্রবৃদ্ধি প্রভৃতি বড় বড় বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন; আমি পুরনো আমলের রেকর্ডার স্যারের সামনে ধরে বসে ছিলাম। প্রবেশ ও প্রস্থানকালে সালাম দেওয়া ছাড়া কোনো কথা হয়নি।
বলাবাহুল্য, পরে অনেকবার অনেক কথা হয়েছে। শেষ দেখা হয়েছিল ২০১০ সালের শেষ দিকে। সমকালের 'ঈদ আনন্দ' সংখ্যা তার শৈশব নিয়ে বিশেষ আয়োজন করবে। সে ব্যাপারে সম্মতি আদায় করতে গিয়েছিলাম তার বাসায়। তখনই তিনি যেন শারীরিকভাবে দুর্বল হতে শুরু করেছেন। বলেছিলাম, আমার দুই সহকর্মী আসবেন আপনার শৈশব সম্পর্কে জানতে, ছবি তুলতে। লেখাটি কি ছাপার আগে দেখিয়ে নিতে হবে? তিনি বলেছিলেন, 'প্রয়োজন নেই। ভালোভাবে দেখে দেবেন।'
প্রায় প্রত্যেকবারই এই কথা শুনতে হয়েছে মোজাফ্ফর স্যারের কাছে। তার মৃত্যুর পরও সেই কথাটিই কানে ভাসছে। আসলে যা করার আমাদেরই ভালোভাবে, দেখেশুনে করতে হবে। তার যা বলার তিনি তো বলে দিয়েছেন।
skrokon@gmail.com
No comments