সিসিসি নির্বাচন-নগরের ভেতরে অজপাড়াগাঁ by মশিউল আলম
ইট বিছানো এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা শেষ হলে কাঁচামাটির সড়ক। দুই পাশে কৃষিজমি; টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে সেগুলো (বাইরের ধনী লোকেরা এসে কিনছে)। ঝোপ-জঙ্গল, ঘরবাড়ি। পশ্চিমে, দূরে সবুজ পাহাড়ের শ্রেণী এবং সেসবের পেছনে মেঘলা ছাইরঙা আকাশ। পাহাড়ের পটভূমিতে ইটভাটার চিমনি, ধোঁয়া।
কাঁচামাটির সড়কটি আমাদের নিয়ে এল এখানে, পাহাড়ের কোলে। একটি জনপদ। অচেনা মানুষ দেখে এগিয়ে এল কিছু লোক: একনজরেই চেনা যায় তাদের—হতদরিদ্র, পুষ্টিহীন, রোগে-শোকে কাতর, আর যেন হতাশায় ডুবন্ত।
‘কেমন আছেন আপনারা?’ আমার এই প্রশ্নের উত্তরে হাড্ডিসার এক যুবক বলা শুরু করলেন, ভালো নেই তাঁরা, ‘অত্যান্ত গরিব’; তাঁদের সুখ-দুঃখের খবর কেউ নিতে আসে না। সামনে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন, এখনো কি কেউ আসছে না তাঁদের কাছে? উত্তরে বলা হলো: এখনো আসা শুরু হয়নি, কিন্তু হবে। এখন অনেক প্রার্থী আর তাঁদের লোকজন আসবেন। তারা বলবে, ‘তোমরা ভোট দাও, আমি তোমাদের এইটা দিব, সেইটা দিব। কিন্তু ভোটের পরে যেই, সেই। কেউ কিছুই করবে না আমাদের জন্য।’
কথা হচ্ছিল গ্রামের মুখে একটি ছন্নছাড়া মলিন দোকানের চালার সামনে, সেখানে এক টুলে বসে ছিলেন বেশ বয়স্ক এক লোক। ‘আপনি কিছু বলেন।’ আমার অনুরোধে তিনি নড়েচড়ে উঠে আঞ্চলিক ভাষায় যা বললেন তার মানে বোঝার জন্য অনুবাদকের দরকার হলো। সঙ্গী ফটোগ্রাফার রফিক আমাকে বুঝিয়ে বললেন, লোকটি বলছেন, ‘আমাদের সব শেষ। আমাদের আর কিছু নাই।’
‘কেন? কীভাবে সব শেষ হলো?’
বৃদ্ধ লোকটি আবারও নিজের ভাষায় যা বললেন, তা এই রকম: ‘আমার দেশ চোরোর খোনি!’
এই হচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের শেষ প্রান্তের একটি গ্রাম মাহমুদাবাদ উত্তরপাড়া; বৃহত্তর ফতেয়াবাদের একটি অংশ, চট্টগ্রাম-হাটহাজারী সড়কের পশ্চিম পাশে মাইল খানেক ভেতরে। প্রায় ২০০টি পরিবারের বাস। প্রধান জীবিকা দিনমজুরি: মহাসড়কে চলাচলকারী ট্রাকগুলোর পণ্যপরিবহন, আশপাশের ইটভাটাগুলোর ইট পরিবহন আর আশপাশের কৃষিজমিতে। অধিকাংশ মানুুষেরই নিজের কোনো জমি নেই, একচিলতে বসতভিটা ছাড়া। আগে জমি ছিল অনেকের, কিন্তু দারিদ্র্যের চাপে বিক্রি করে এখন নিঃস্ব ভূমিহীন। সিটি করপোরেশনের কোনো নাগরিক সুযোগ-সুবিধা এখানে পৌঁছায়নি। পানি নেই, গ্যাস নেই, রাস্তাঘাট নেই, হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই; শিক্ষালয় বলতে একটি মাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যুৎ আছে, কিন্তু তা সিটি করপোরেশনের দান নয়; গ্রামের দরিদ্র মানুষ চাঁদা তুলে খাম্বা ও তার কেনার টাকা দিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ পেয়েছেন। কিন্তু সব ঘরে পৌঁছায়নি সে বিদ্যুতের আলো—মিটার কেনার বা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের সার্মথ্য নেই যাদের, তারা বঞ্চিত। দুই শ পরিবারের মধ্যে কুড়িজন মানুষও নেই যাঁরা এসএসসি পাস করেছেন। পরিবারগুলো বড়: কোনো কোনোটির সন্তানসংখ্যা ১০। ঘরগুলো বাঁশের বেড়া ও মাটি দিয়ে তৈরি, চারপাশে বেশ ঝোপঝাড়, জঙ্গল। প্রচুর মশা। শিশুগুলো উলঙ্গ, হাড্ডিসার দেহে ঢাউস পেট, পা সরু; নাকে সর্দি গড়াচ্ছে। পাশে ঝোপ-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটি ক্ষীণস্রোতা পাহাড়ি ছড়া। জানা গেল, বর্ষায় এ ছড়া উপচে আসে পানি, ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতরে।
একটি বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ি; অন্ধকার ঘরের দরজায় দেখা যায় আরও অন্ধকার নারীমুখ—কোলে শিশু, মুখে আঁচল। ‘কেমন আছেন আপনারা?’ এ জিজ্ঞাসার উত্তর আসে ভীষণ তীর্যক হয়ে: খুব ভালো, সিটি তাঁদের রেখেছে মহা সুখে! ভোটের সময় বলে পায়ে ধরে, ভোট গেলে মাথার ওপর তুলে আছাড় মারে। মহিলার মন্তব্য শুনে আমাদের সঙ্গের পুরুষ গ্রামবাসীরা শব্দ করে হেসে ওঠেন। একজন বলেন, ‘ঠিক কথাই কইছ, আরও কও।’ পাশে ঘরের কোণে একটি গাছের নিচে শিশু কোলে দাঁড়িয়ে আরেক নারী। তিনি বললেন, ‘নামেই সিটি, কামে কিছু নাই।’ তিনি জানালেন, কারা যেন মশারি বিতরণ করেছে পাশের এলাকায়, কিন্তু তাঁদের দেয়নি। কারণ, তারা বলেছে, ‘তোমরা সিটি করপোরেশনের ভিতরে। মশারি পাবে ইউনিয়নের মানুষ।’ এক পুরুষ ব্যাখ্যা করলেন বিষয়টি: মহাসড়কের পুব অংশটি পড়েছে হাটহাজারী উপজেলার মধ্যে, সেখানকার মানুুষ কাবিখা-টাবিখা ইত্যাদির সাহায্য পায়, ভিজিএফ প্রকল্পের খাদ্যসাহায্য পায়। কিন্তু সিটি করপোরেশনের দরিদ্র মানুষের জন্য এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই। ‘সিটির মধ্যে বলেই আমাদের হয়েছে মরণদশা।’ একজনের মন্তব্য।
‘আপনাদের এই সব দুঃখ-দুর্দশার কথা কি ওয়ার্ডের কাউন্সিলরকে আপনারা বলেন না?’ আমার এই প্রশ্নের উত্তরে একজন বলেন, ‘বলে কোনো লাভ হয় না। আমরা বাদ!’
সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত এই পীড়িত, বঞ্চিত, হতাশায় নিমজ্জিত মানুষগুলোর এসব অভিযোগ শুনতে শুনতে মনে পড়ল, আগের দিন আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কথা: তিনি চট্টগ্রাম বন্দরনগরকে গড়ে তুলতে চান সিঙ্গাপুরের আদলে! বিএনপির প্রার্থী এম মঞ্জুর আলম অবশ্য বলছিলেন, তাঁর অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে থাকবে সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত অনুন্নত, দরিদ্র জনপদগুলোর উন্নয়ন করা। মঞ্জুর আলমের সেই প্রতিশ্রুতির কথা জানালাম মাহমুদাবাদের লোকগুলোকে। তাঁরা ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘উনি তো মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন বছর দুয়েক, কই, তখন তো কিছুই করেননি!’
এখান থেকে বিদায় নিয়ে ছুটলাম তাঁদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাফর আলম চৌধুরীর সন্ধানে, যিনি ১৭ বছর ধরে নির্বাচিত কাউন্সিলর। কিন্তু ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে তালা। হানা দিলাম তাঁর বাড়িতে। পাওয়া গেল তাঁকে। বললাম, ‘আপনার ওয়ার্ডের লোকেরা তো আপনাকে চোর বলে গালাগাল করছেন, আপনি ১৭ বছর ধরে কাউন্সিলর কিন্তু কিছুই করেননি তাঁদের জন্য।’ জাফর আলম চৌধুরী বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘আমার এই লোকেরা মানবেতর জীবন যাপন করে, তাদের অভিযোগের অনেক কারণ আছে। আমার ওয়ার্ডের এই অংশটা এতই অনুন্নত যে এর উন্নয়ন করতে হলে যত টাকা দরকার, আমি তত বাজেট পাই না। উন্নত ওয়ার্ডের রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করতে যত টাকা লাগে, তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা দরকার অনুন্নত এলাকায় রাস্তা করতে; কারণ সেখানে নতুনভাবে রাস্তা বানাতে হয়। অত্যন্ত গরিব যারা, তাদের জন্য বাড়তি বাজেটের দরকার।’
দক্ষিণ পাহাড়তলি ও জঙ্গল দক্ষিণ পাহাড়তলি—এই দুটি মৌজা নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ড। ২৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই ওয়ার্ডের লোকসংখ্যা প্রায় এক লাখ। ভোটারসংখ্যা ২৪ হাজার। প্রায় ১০ হাজার মানুষ উদ্বাস্তু—নোয়াখালী, সন্দ্বীপ ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা এসব মানুষ বাস করে পাহাড়গুলোর পাদদেশে অস্থায়ী ঘর তুলে; জীবিকা দিনমজুরি— ইটভাটায়, কৃষিকাজে এবং পাহাড়খেকো ভূমিদস্যুদের হয়ে পাহাড় কাটার কাজ। ‘নিয়ন্ত্রণহীনভাবে পাহাড় কাটা চলছে আপনার ওয়ার্ডের মধ্যে, আপনি কী করছেন?’ আমার এই প্রশ্নের উত্তরে জাফর আলম অসহায়ের মতো মুখভঙ্গিতে বলেন, ‘হ্যাঁ, নিয়ন্ত্রণহীনভাবে রাতের অন্ধকারে পাহাড় কাটা চলছে। অনেক চেষ্টা করছি বন্ধ করার, কিন্তু পারা যাচ্ছে না। তারা অত্যন্ত শক্তিশালী, প্রভাবশালী; আর পাহাড় কাটা হয় রাতের অন্ধকারে।’
মোট ৪১টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতায় মাহমুদাবাদের মতো হতদরিদ্র, অনুন্নত এলাকা আছে বেশ কিছু; যেমন—জালালাবাদ, পাঁচলাইশ, উপকূলীয় কিছু এলাকা। সুষম উন্নয়ন বলে কোনো ব্যাপার এখানে নেই। সেদিকে কোনো প্রার্থীর বিশেষ নজর আছে বলে মনে হলো না। সিটি করপোরেশন যেন বা শুধু ধনী, প্রভাবশালী নাগরিকদের স্বার্থের দিকেই বেশি মনোযোগী। এবারের নির্বাচনে এই বিষয়টিও হতে পারত ভোট আকর্ষণের একটি বড় ইস্যু। কিন্তু কোনো প্রার্থীর নির্বাচনী অঙ্গীকারের তালিকায় এটি বিশেষ কোনো স্থান পাচ্ছে না। সিটি করপোরেশন—নামেই বলে দেয়, এ হচ্ছে সুবিধাভোগী নাগরিকদের স্বার্থরক্ষার প্রতিষ্ঠান; দরিদ্র, চিরবঞ্চিত মানুষেরা যেন বিয়োজিত—এক্সক্লুডেড!
চট্টগ্রাম, ২ জুন ২০১০
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
‘কেমন আছেন আপনারা?’ আমার এই প্রশ্নের উত্তরে হাড্ডিসার এক যুবক বলা শুরু করলেন, ভালো নেই তাঁরা, ‘অত্যান্ত গরিব’; তাঁদের সুখ-দুঃখের খবর কেউ নিতে আসে না। সামনে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন, এখনো কি কেউ আসছে না তাঁদের কাছে? উত্তরে বলা হলো: এখনো আসা শুরু হয়নি, কিন্তু হবে। এখন অনেক প্রার্থী আর তাঁদের লোকজন আসবেন। তারা বলবে, ‘তোমরা ভোট দাও, আমি তোমাদের এইটা দিব, সেইটা দিব। কিন্তু ভোটের পরে যেই, সেই। কেউ কিছুই করবে না আমাদের জন্য।’
কথা হচ্ছিল গ্রামের মুখে একটি ছন্নছাড়া মলিন দোকানের চালার সামনে, সেখানে এক টুলে বসে ছিলেন বেশ বয়স্ক এক লোক। ‘আপনি কিছু বলেন।’ আমার অনুরোধে তিনি নড়েচড়ে উঠে আঞ্চলিক ভাষায় যা বললেন তার মানে বোঝার জন্য অনুবাদকের দরকার হলো। সঙ্গী ফটোগ্রাফার রফিক আমাকে বুঝিয়ে বললেন, লোকটি বলছেন, ‘আমাদের সব শেষ। আমাদের আর কিছু নাই।’
‘কেন? কীভাবে সব শেষ হলো?’
বৃদ্ধ লোকটি আবারও নিজের ভাষায় যা বললেন, তা এই রকম: ‘আমার দেশ চোরোর খোনি!’
এই হচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের শেষ প্রান্তের একটি গ্রাম মাহমুদাবাদ উত্তরপাড়া; বৃহত্তর ফতেয়াবাদের একটি অংশ, চট্টগ্রাম-হাটহাজারী সড়কের পশ্চিম পাশে মাইল খানেক ভেতরে। প্রায় ২০০টি পরিবারের বাস। প্রধান জীবিকা দিনমজুরি: মহাসড়কে চলাচলকারী ট্রাকগুলোর পণ্যপরিবহন, আশপাশের ইটভাটাগুলোর ইট পরিবহন আর আশপাশের কৃষিজমিতে। অধিকাংশ মানুুষেরই নিজের কোনো জমি নেই, একচিলতে বসতভিটা ছাড়া। আগে জমি ছিল অনেকের, কিন্তু দারিদ্র্যের চাপে বিক্রি করে এখন নিঃস্ব ভূমিহীন। সিটি করপোরেশনের কোনো নাগরিক সুযোগ-সুবিধা এখানে পৌঁছায়নি। পানি নেই, গ্যাস নেই, রাস্তাঘাট নেই, হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই; শিক্ষালয় বলতে একটি মাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যুৎ আছে, কিন্তু তা সিটি করপোরেশনের দান নয়; গ্রামের দরিদ্র মানুষ চাঁদা তুলে খাম্বা ও তার কেনার টাকা দিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ পেয়েছেন। কিন্তু সব ঘরে পৌঁছায়নি সে বিদ্যুতের আলো—মিটার কেনার বা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের সার্মথ্য নেই যাদের, তারা বঞ্চিত। দুই শ পরিবারের মধ্যে কুড়িজন মানুষও নেই যাঁরা এসএসসি পাস করেছেন। পরিবারগুলো বড়: কোনো কোনোটির সন্তানসংখ্যা ১০। ঘরগুলো বাঁশের বেড়া ও মাটি দিয়ে তৈরি, চারপাশে বেশ ঝোপঝাড়, জঙ্গল। প্রচুর মশা। শিশুগুলো উলঙ্গ, হাড্ডিসার দেহে ঢাউস পেট, পা সরু; নাকে সর্দি গড়াচ্ছে। পাশে ঝোপ-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটি ক্ষীণস্রোতা পাহাড়ি ছড়া। জানা গেল, বর্ষায় এ ছড়া উপচে আসে পানি, ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতরে।
একটি বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ি; অন্ধকার ঘরের দরজায় দেখা যায় আরও অন্ধকার নারীমুখ—কোলে শিশু, মুখে আঁচল। ‘কেমন আছেন আপনারা?’ এ জিজ্ঞাসার উত্তর আসে ভীষণ তীর্যক হয়ে: খুব ভালো, সিটি তাঁদের রেখেছে মহা সুখে! ভোটের সময় বলে পায়ে ধরে, ভোট গেলে মাথার ওপর তুলে আছাড় মারে। মহিলার মন্তব্য শুনে আমাদের সঙ্গের পুরুষ গ্রামবাসীরা শব্দ করে হেসে ওঠেন। একজন বলেন, ‘ঠিক কথাই কইছ, আরও কও।’ পাশে ঘরের কোণে একটি গাছের নিচে শিশু কোলে দাঁড়িয়ে আরেক নারী। তিনি বললেন, ‘নামেই সিটি, কামে কিছু নাই।’ তিনি জানালেন, কারা যেন মশারি বিতরণ করেছে পাশের এলাকায়, কিন্তু তাঁদের দেয়নি। কারণ, তারা বলেছে, ‘তোমরা সিটি করপোরেশনের ভিতরে। মশারি পাবে ইউনিয়নের মানুষ।’ এক পুরুষ ব্যাখ্যা করলেন বিষয়টি: মহাসড়কের পুব অংশটি পড়েছে হাটহাজারী উপজেলার মধ্যে, সেখানকার মানুুষ কাবিখা-টাবিখা ইত্যাদির সাহায্য পায়, ভিজিএফ প্রকল্পের খাদ্যসাহায্য পায়। কিন্তু সিটি করপোরেশনের দরিদ্র মানুষের জন্য এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই। ‘সিটির মধ্যে বলেই আমাদের হয়েছে মরণদশা।’ একজনের মন্তব্য।
‘আপনাদের এই সব দুঃখ-দুর্দশার কথা কি ওয়ার্ডের কাউন্সিলরকে আপনারা বলেন না?’ আমার এই প্রশ্নের উত্তরে একজন বলেন, ‘বলে কোনো লাভ হয় না। আমরা বাদ!’
সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত এই পীড়িত, বঞ্চিত, হতাশায় নিমজ্জিত মানুষগুলোর এসব অভিযোগ শুনতে শুনতে মনে পড়ল, আগের দিন আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কথা: তিনি চট্টগ্রাম বন্দরনগরকে গড়ে তুলতে চান সিঙ্গাপুরের আদলে! বিএনপির প্রার্থী এম মঞ্জুর আলম অবশ্য বলছিলেন, তাঁর অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে থাকবে সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত অনুন্নত, দরিদ্র জনপদগুলোর উন্নয়ন করা। মঞ্জুর আলমের সেই প্রতিশ্রুতির কথা জানালাম মাহমুদাবাদের লোকগুলোকে। তাঁরা ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘উনি তো মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন বছর দুয়েক, কই, তখন তো কিছুই করেননি!’
এখান থেকে বিদায় নিয়ে ছুটলাম তাঁদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাফর আলম চৌধুরীর সন্ধানে, যিনি ১৭ বছর ধরে নির্বাচিত কাউন্সিলর। কিন্তু ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে তালা। হানা দিলাম তাঁর বাড়িতে। পাওয়া গেল তাঁকে। বললাম, ‘আপনার ওয়ার্ডের লোকেরা তো আপনাকে চোর বলে গালাগাল করছেন, আপনি ১৭ বছর ধরে কাউন্সিলর কিন্তু কিছুই করেননি তাঁদের জন্য।’ জাফর আলম চৌধুরী বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘আমার এই লোকেরা মানবেতর জীবন যাপন করে, তাদের অভিযোগের অনেক কারণ আছে। আমার ওয়ার্ডের এই অংশটা এতই অনুন্নত যে এর উন্নয়ন করতে হলে যত টাকা দরকার, আমি তত বাজেট পাই না। উন্নত ওয়ার্ডের রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করতে যত টাকা লাগে, তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা দরকার অনুন্নত এলাকায় রাস্তা করতে; কারণ সেখানে নতুনভাবে রাস্তা বানাতে হয়। অত্যন্ত গরিব যারা, তাদের জন্য বাড়তি বাজেটের দরকার।’
দক্ষিণ পাহাড়তলি ও জঙ্গল দক্ষিণ পাহাড়তলি—এই দুটি মৌজা নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ড। ২৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই ওয়ার্ডের লোকসংখ্যা প্রায় এক লাখ। ভোটারসংখ্যা ২৪ হাজার। প্রায় ১০ হাজার মানুষ উদ্বাস্তু—নোয়াখালী, সন্দ্বীপ ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা এসব মানুষ বাস করে পাহাড়গুলোর পাদদেশে অস্থায়ী ঘর তুলে; জীবিকা দিনমজুরি— ইটভাটায়, কৃষিকাজে এবং পাহাড়খেকো ভূমিদস্যুদের হয়ে পাহাড় কাটার কাজ। ‘নিয়ন্ত্রণহীনভাবে পাহাড় কাটা চলছে আপনার ওয়ার্ডের মধ্যে, আপনি কী করছেন?’ আমার এই প্রশ্নের উত্তরে জাফর আলম অসহায়ের মতো মুখভঙ্গিতে বলেন, ‘হ্যাঁ, নিয়ন্ত্রণহীনভাবে রাতের অন্ধকারে পাহাড় কাটা চলছে। অনেক চেষ্টা করছি বন্ধ করার, কিন্তু পারা যাচ্ছে না। তারা অত্যন্ত শক্তিশালী, প্রভাবশালী; আর পাহাড় কাটা হয় রাতের অন্ধকারে।’
মোট ৪১টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতায় মাহমুদাবাদের মতো হতদরিদ্র, অনুন্নত এলাকা আছে বেশ কিছু; যেমন—জালালাবাদ, পাঁচলাইশ, উপকূলীয় কিছু এলাকা। সুষম উন্নয়ন বলে কোনো ব্যাপার এখানে নেই। সেদিকে কোনো প্রার্থীর বিশেষ নজর আছে বলে মনে হলো না। সিটি করপোরেশন যেন বা শুধু ধনী, প্রভাবশালী নাগরিকদের স্বার্থের দিকেই বেশি মনোযোগী। এবারের নির্বাচনে এই বিষয়টিও হতে পারত ভোট আকর্ষণের একটি বড় ইস্যু। কিন্তু কোনো প্রার্থীর নির্বাচনী অঙ্গীকারের তালিকায় এটি বিশেষ কোনো স্থান পাচ্ছে না। সিটি করপোরেশন—নামেই বলে দেয়, এ হচ্ছে সুবিধাভোগী নাগরিকদের স্বার্থরক্ষার প্রতিষ্ঠান; দরিদ্র, চিরবঞ্চিত মানুষেরা যেন বিয়োজিত—এক্সক্লুডেড!
চট্টগ্রাম, ২ জুন ২০১০
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
No comments