বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে তদন্তে সহযোগিতা করছে না স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, রাষ্ট্রপতির দ্বারস্থ হচ্ছে কমিশন-ক্ষুব্ধ মানবাধিকার কমিশন by শেখ সাবিহা আলম
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অসহযোগিতায় ক্ষুব্ধ জাতীয় মানবাধিকার কমিশন রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০০৮ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে সংঘটিত আলোচিত তিনটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও একজন নিখোঁজের ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।
কায়সার মাহমুদ, মহিউদ্দীন আরিফ ও নূর আলম হত্যাকাণ্ডের পর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে। কিন্তু ওই কমিটির কোনো প্রতিবেদন কমিশনকে পাঠানো হয়নি। একমাত্র তুষার ইসলামের নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কমিশনে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। কমিশন বলছে, ওই প্রতিবেদনটিও ত্রুটিপূর্ণ।
কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, গত ১৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বৈঠকে সংস্থাটি রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইনের ১৪(৬) ধারা অনুযায়ী, কমিশন ‘যথাযথ বিবেচনা করলে’ রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে এবং রাষ্ট্রপতি মানবাধিকার লঙ্ঘন-সম্পর্কিত তদন্ত প্রতিবেদনের কপি সংসদে উত্থাপনের ব্যবস্থা করবেন।
তবে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের আগে শেষবারের মতো কমিশন মন্ত্রণালয়কে ৯ মে একটি চিঠি দিয়েছে। ওই চিঠিতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব সি কিউ কে মুস্তাক আহমেদকে বলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়ার আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলাকে কমিশন ‘শোভন ও সমুচিত’ বলে মনে করে।
কমিশনের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্পৃক্ততা আছে বলেই বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিবেদন পাঠাতে চাইছে না। প্রতিবেদন হাতে পেলে কমিশন আইনের ১৪(ক) ধারা অনুসারে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা বা অন্য কোনো কার্যধারা দায়ের করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করবে। এতে ঘটনার শিকার পরিবারগুলো ন্যায়বিচার পেতে পারে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার মানবাধিকার কমিশনের কার্যক্রমকে গুরুত্বের সঙ্গে না নিচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত একটি কার্যকর সংস্থা হিসেবে কমিশন কাজ করতে পারবে না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব সি কিউ কে মুশতাক আহমেদ বলেন, মন্ত্রণালয় নিয়মিত কমিশনকে প্রতিবেদন পাঠায়। রাষ্ট্রীয় এ সংস্থাটিকে প্রতিবেদন পাঠাতে মন্ত্রণালয় বাধ্য। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে প্রতিবেদন পাঠানো হয়নি, বিষয়টি তা নয়। কোনো কারণে দেরি হয়ে থাকতে পারে।
কমিশনের দফায় দফায় চিঠি: জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কায়সার মাহমুদ ওরফে বাপ্পীর মৃত্যুর পর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কমিটি গঠনের সুপারিশ করে। কায়সারের পরিবারের অভিযোগ ছিল, ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে র্যাব-১-এর অপারেশন অফিসার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রায়হান আসগর খানের নেতৃত্বে একদল র্যাব সদস্য ঢাকার ৩২৩ পূর্ব রামপুরায় আফতাব টাওয়ারে অভিযান চালান। এ সময় তাঁরা রামপুরার ৩৩৫/৫৬ বিটিভি রোডের বাসিন্দা মডেল ও অভিনেতা কায়সার মাহমুদকে গুলি করে হত্যা করেন। পরিবারের অভিযোগ, কথিত সন্ত্রাসী কামরুল ইসলাম বাপ্পী ওরফে কামরুজ্জামান বাপ্পীকে ধরতে গিয়ে ভুলক্রমে র্যাব ক্রসফায়ার করে। র্যাব এই অভিযোগ অস্বীকার করে।
জানা গেছে, ১৯ এপ্রিল ২০১০ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব বেগম স্মৃতি রানী ঘরামীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে তদন্ত কমিটি র্যাবের একতরফা গুলিতে কায়সার নিহত হয়ে থাকতে পারে বলে মন্তব্য করে। এমনকি র্যাবকে সোর্স বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হওয়ারও সুপারিশ করে। মানবাধিকার কমিশন ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে মোট পাঁচ দফা প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য অনুরোধ জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিলেও কাজ হয়নি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অপর শিকার মহিউদ্দীন আরিফের বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে জানায় এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি), ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান রাইটসসহ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ক্রোয়েশিয়া ও স্কটল্যান্ডভিত্তিক কয়েকটি সংস্থা। এর পরিপ্রেক্ষিতে মানবাধিকার কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ঘটনা তদন্তের সুপারিশ করে।
এএইচআরসির পাঠানো চিঠি থেকে কমিশন জানতে পারে, আরিফ র্যাব-৪-এর হেফাজতে ২৪ জানুয়ারি সকাল আটটা থেকে ২৫ জানুয়ারি রাত আটটা পর্যন্ত মোট ৩৬ ঘণ্টা ও পল্লবী পুলিশের হেফাজতে ছিল আরও ৩৬ ঘণ্টা। সুরতহাল প্রতিবেদনে মৃতদেহের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতসহ আরিফের পা ভাঙা ও ফোলা এবং চোখও ফোলা ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। ১১ অক্টোবর থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে মোট ১০টি চিঠি দেয়। এ বছরই প্রতিবেদন চেয়ে কমিশন মোট চারবার তাগাদা দিয়েছে। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিবেদন পাঠায়নি।
হত্যাকাণ্ডের আরেক শিকার নূর আলমের বাবা আলী আক্কাস কমিশনের কাছে লিখিত অভিযোগ করলে কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ঘটনা তদন্তের সুপারিশ করে। আলী আক্কাসের অভিযোগ, নূর আলমকে ২০০৯ সালের ১৩ মে রাসেল নামের এক ব্যক্তি ডেকে নিয়ে র্যাবকে দিয়ে ক্রসফায়ার করায়। রাসেলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাবুর পরিবার র্যাব ৩, ৪ ও ডিবি অফিসে খুঁজেও ছেলের কোনো সন্ধান পায়নি। ১৫ মে রাতে টিভির খবরে তারা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার খবর জানতে পারে।
ওই ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপসচিব বেগম কামরুননাহার বেগমের নেতৃত্বাধীন একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি কয়েকজন র্যাব সদস্যকে আইনি প্রক্রিয়ার আওতায় আনার সুপারিশ করে। কমিশন বিভিন্ন সূত্র থেকে বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে পারলেও প্রতিবেদন হাতে না পাওয়ায় কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি।
পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে কমিশন ১০/১১/২০০৮ তারিখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তুষার ইসলামের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানায়। তুষারের পরিবারের অভিযোগ, তুষার একজন কাপড় ব্যবসায়ী, গ্রাম থেকে কাপড় কিনে ঢাকায় বিক্রি করতেন। ২২ জুলাই ২০০৮ সকাল ১০টার দিকে বাজার করতে তুষার ধুকুরিয়া বেড়া বাজারে গিয়েছিলেন। স্ত্রীর জন্য চুড়ি কেনার সময় পাঁচ-ছয়জন সাদা পোশাকধারী লোক র্যাবের পরিচয় দিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। ওই দিনই র্যাব সদস্যরা শেরনগর গ্রামের ফারুক সরকার ও হাজি আশরাফের কাছ থেকে দুটি মোটরসাইকেল নেন এবং একটিতে তুষারকে তুলে নিয়ে চলে যান। সেই থেকে তুষার নিখোঁজ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ২৪ জুন ২০১০ তারিখে এ ঘটনার তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন কমিশনে পাঠানো হয়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, র্যাব সদস্যরা তুষারকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি অস্বীকার করেন। তাঁরা জানান, ধুকুরিয়া বেড়া বাজার থেকে কোনো লোককে ধরে ঢাকায় আনা হয়নি। কিন্তু বেলকুচি থানার জিডি নং ৬৫৬, তারিখ ২২ জুলাই, ২০০৮ ও জিডি নং ৬৮০ তারিখ ২৩ জুলাই ২০০৮ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, র্যাব সদস্যরা একজন ধৃত ব্যক্তিতে ঢাকায় নিয়ে আসার জন্য জিডিতে উল্লিখিত মোটরসাইকেল দুটি ব্যবহার করেন। এ ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটির সামনে র্যাব সদস্যদের বক্তব্য সঠিক নয় বলে মনে করেছে কমিশন।
কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, তদন্ত সঠিক মনে না হওয়ায় তাঁরা কমিশনকে যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে নতুন একটি কমিটি করে তদন্ত করে দেখার সুপারিশ করেন। সে সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে সম্পর্কে কমিশন এখনো জানতে পারেনি।
কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, গত ১৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বৈঠকে সংস্থাটি রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইনের ১৪(৬) ধারা অনুযায়ী, কমিশন ‘যথাযথ বিবেচনা করলে’ রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে এবং রাষ্ট্রপতি মানবাধিকার লঙ্ঘন-সম্পর্কিত তদন্ত প্রতিবেদনের কপি সংসদে উত্থাপনের ব্যবস্থা করবেন।
তবে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের আগে শেষবারের মতো কমিশন মন্ত্রণালয়কে ৯ মে একটি চিঠি দিয়েছে। ওই চিঠিতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব সি কিউ কে মুস্তাক আহমেদকে বলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়ার আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলাকে কমিশন ‘শোভন ও সমুচিত’ বলে মনে করে।
কমিশনের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্পৃক্ততা আছে বলেই বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিবেদন পাঠাতে চাইছে না। প্রতিবেদন হাতে পেলে কমিশন আইনের ১৪(ক) ধারা অনুসারে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা বা অন্য কোনো কার্যধারা দায়ের করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করবে। এতে ঘটনার শিকার পরিবারগুলো ন্যায়বিচার পেতে পারে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার মানবাধিকার কমিশনের কার্যক্রমকে গুরুত্বের সঙ্গে না নিচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত একটি কার্যকর সংস্থা হিসেবে কমিশন কাজ করতে পারবে না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব সি কিউ কে মুশতাক আহমেদ বলেন, মন্ত্রণালয় নিয়মিত কমিশনকে প্রতিবেদন পাঠায়। রাষ্ট্রীয় এ সংস্থাটিকে প্রতিবেদন পাঠাতে মন্ত্রণালয় বাধ্য। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে প্রতিবেদন পাঠানো হয়নি, বিষয়টি তা নয়। কোনো কারণে দেরি হয়ে থাকতে পারে।
কমিশনের দফায় দফায় চিঠি: জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কায়সার মাহমুদ ওরফে বাপ্পীর মৃত্যুর পর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কমিটি গঠনের সুপারিশ করে। কায়সারের পরিবারের অভিযোগ ছিল, ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে র্যাব-১-এর অপারেশন অফিসার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রায়হান আসগর খানের নেতৃত্বে একদল র্যাব সদস্য ঢাকার ৩২৩ পূর্ব রামপুরায় আফতাব টাওয়ারে অভিযান চালান। এ সময় তাঁরা রামপুরার ৩৩৫/৫৬ বিটিভি রোডের বাসিন্দা মডেল ও অভিনেতা কায়সার মাহমুদকে গুলি করে হত্যা করেন। পরিবারের অভিযোগ, কথিত সন্ত্রাসী কামরুল ইসলাম বাপ্পী ওরফে কামরুজ্জামান বাপ্পীকে ধরতে গিয়ে ভুলক্রমে র্যাব ক্রসফায়ার করে। র্যাব এই অভিযোগ অস্বীকার করে।
জানা গেছে, ১৯ এপ্রিল ২০১০ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব বেগম স্মৃতি রানী ঘরামীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে তদন্ত কমিটি র্যাবের একতরফা গুলিতে কায়সার নিহত হয়ে থাকতে পারে বলে মন্তব্য করে। এমনকি র্যাবকে সোর্স বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হওয়ারও সুপারিশ করে। মানবাধিকার কমিশন ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে মোট পাঁচ দফা প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য অনুরোধ জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিলেও কাজ হয়নি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অপর শিকার মহিউদ্দীন আরিফের বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে জানায় এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি), ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান রাইটসসহ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ক্রোয়েশিয়া ও স্কটল্যান্ডভিত্তিক কয়েকটি সংস্থা। এর পরিপ্রেক্ষিতে মানবাধিকার কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ঘটনা তদন্তের সুপারিশ করে।
এএইচআরসির পাঠানো চিঠি থেকে কমিশন জানতে পারে, আরিফ র্যাব-৪-এর হেফাজতে ২৪ জানুয়ারি সকাল আটটা থেকে ২৫ জানুয়ারি রাত আটটা পর্যন্ত মোট ৩৬ ঘণ্টা ও পল্লবী পুলিশের হেফাজতে ছিল আরও ৩৬ ঘণ্টা। সুরতহাল প্রতিবেদনে মৃতদেহের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতসহ আরিফের পা ভাঙা ও ফোলা এবং চোখও ফোলা ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। ১১ অক্টোবর থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে মোট ১০টি চিঠি দেয়। এ বছরই প্রতিবেদন চেয়ে কমিশন মোট চারবার তাগাদা দিয়েছে। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিবেদন পাঠায়নি।
হত্যাকাণ্ডের আরেক শিকার নূর আলমের বাবা আলী আক্কাস কমিশনের কাছে লিখিত অভিযোগ করলে কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ঘটনা তদন্তের সুপারিশ করে। আলী আক্কাসের অভিযোগ, নূর আলমকে ২০০৯ সালের ১৩ মে রাসেল নামের এক ব্যক্তি ডেকে নিয়ে র্যাবকে দিয়ে ক্রসফায়ার করায়। রাসেলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাবুর পরিবার র্যাব ৩, ৪ ও ডিবি অফিসে খুঁজেও ছেলের কোনো সন্ধান পায়নি। ১৫ মে রাতে টিভির খবরে তারা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার খবর জানতে পারে।
ওই ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপসচিব বেগম কামরুননাহার বেগমের নেতৃত্বাধীন একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি কয়েকজন র্যাব সদস্যকে আইনি প্রক্রিয়ার আওতায় আনার সুপারিশ করে। কমিশন বিভিন্ন সূত্র থেকে বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে পারলেও প্রতিবেদন হাতে না পাওয়ায় কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি।
পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে কমিশন ১০/১১/২০০৮ তারিখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তুষার ইসলামের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানায়। তুষারের পরিবারের অভিযোগ, তুষার একজন কাপড় ব্যবসায়ী, গ্রাম থেকে কাপড় কিনে ঢাকায় বিক্রি করতেন। ২২ জুলাই ২০০৮ সকাল ১০টার দিকে বাজার করতে তুষার ধুকুরিয়া বেড়া বাজারে গিয়েছিলেন। স্ত্রীর জন্য চুড়ি কেনার সময় পাঁচ-ছয়জন সাদা পোশাকধারী লোক র্যাবের পরিচয় দিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। ওই দিনই র্যাব সদস্যরা শেরনগর গ্রামের ফারুক সরকার ও হাজি আশরাফের কাছ থেকে দুটি মোটরসাইকেল নেন এবং একটিতে তুষারকে তুলে নিয়ে চলে যান। সেই থেকে তুষার নিখোঁজ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ২৪ জুন ২০১০ তারিখে এ ঘটনার তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন কমিশনে পাঠানো হয়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, র্যাব সদস্যরা তুষারকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি অস্বীকার করেন। তাঁরা জানান, ধুকুরিয়া বেড়া বাজার থেকে কোনো লোককে ধরে ঢাকায় আনা হয়নি। কিন্তু বেলকুচি থানার জিডি নং ৬৫৬, তারিখ ২২ জুলাই, ২০০৮ ও জিডি নং ৬৮০ তারিখ ২৩ জুলাই ২০০৮ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, র্যাব সদস্যরা একজন ধৃত ব্যক্তিতে ঢাকায় নিয়ে আসার জন্য জিডিতে উল্লিখিত মোটরসাইকেল দুটি ব্যবহার করেন। এ ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটির সামনে র্যাব সদস্যদের বক্তব্য সঠিক নয় বলে মনে করেছে কমিশন।
কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, তদন্ত সঠিক মনে না হওয়ায় তাঁরা কমিশনকে যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে নতুন একটি কমিটি করে তদন্ত করে দেখার সুপারিশ করেন। সে সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে সম্পর্কে কমিশন এখনো জানতে পারেনি।
No comments