বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৪০৬ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ রঙ্গু মিয়া, বীর বিক্রম অতুলনীয় এক যোদ্ধা অমিত সাহসী যোদ্ধা ছিলেন রঙ্গু মিয়া। হাতীবান্ধা অপারেশনে তিনি শহীদ হন। হাতীবান্ধা লালমনিরহাট জেলার অন্তর্গত। মুক্তিযুদ্ধকালে এই এলাকা ছিল মুক্তিবাহিনীর ৬ নম্বর সেক্টরের পাটগ্রাম সাবসেক্টরের আওতাধীন।


এই সাবসেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান (বীর বিক্রম, পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল, ১৯৮১ সালে জিয়া হত্যা ঘটনায় নিহত)। তাঁর বয়ানে আছে এই যুদ্ধের বিবরণ ও রঙ্গু মিয়ার বীরত্বের কথা। তিনি বলেন:
‘আমাদের হাতীবান্ধা অপারেশন ছিল ভয়াবহ। হাতীবান্ধাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি কোম্পানি ছিল। আমি ইতিপূর্বে কয়েকবার চেষ্টা করেছি হাতীবান্ধা দখল করতে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। নভেম্বরের ২০-২১ হবে। ঈদের দিন ছিল। আমরা ঈদের সুযোগ নিয়ে ঠিক সকাল আটটায় হাতীবান্ধা আক্রমণ করি। যদিও দিনের আলোয় ওই সময় আক্রমণের উপযোগী ছিল না।
‘আমরা ভেবেছিলাম, ঈদের দিন পাকিস্তানি সেনারা হয়তো রিলাক্স করবে এবং অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকবে। আমরা চার কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে দুই দিক থেকে আক্রমণ করি। আমাদের সৌভাগ্য ছিল বলতে হবে। কারণ, সেদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোম্পানি বদল হচ্ছিল। অর্থাৎ নতুন দল সেখানে মোতায়েন হচ্ছিল। পুরোনো সেনারা কিছু রওনা হয়েছে, কিছু হচ্ছে। নতুন যারা তাদের কিছু সেনা পজিশনে গেছে। ঠিক এমন সময়ে আমরা আক্রমণ করি।
‘আমাদের প্রথম আক্রমণেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার নিহত হয়। কমান্ডার নিহত হওয়ায় পাকিস্তানি সেনারা পেছনে পালাতে থাকে। তারা প্রায় এক হাজার গজের মতো পিছু হটে একটি গ্রামে ডিফেন্স নেয়। সেখানে তাদের আর্টিলারি পজিশন ছিল। আমরা সামনে অগ্রসর হয়ে ডিফেন্স নিই। ক্রমশ আঘাত হেনে পাকিস্তানিদের পিছু হটিয়ে অগ্রসর হতে থাকি। ১০ ডিসেম্বর লাঙ্গলের হাটে পৌঁছি।
‘আমি আমাদের দলের একজনের কথা বলব। হাবিলদার রঙ্গু মিয়া। তাঁর চেহারা দেখলে মনে হতো যেন একটা ডাকাত। রঙ্গু মিয়া ও লুৎফর রহমান হাতীবান্ধা অপারেশনে শহীদ হন। তাঁদের কথা না বললেই নয়।
‘তখন বেলা সাড়ে আটটা। পাকিস্তানিদের ডান দিকের পজিশন ফল করেছে। কিন্তু বাঁ দিকের অবস্থান ছিল একটি বিওপিতে। বেশ উঁচুতে। আমাদের উচিত ছিল আগে বাঁ দিকের পজিশন দখল করা, পরে ডান দিকের পজিশনে আঘাত হানা। আমার প্ল্যানিংয়ে ভুল হওয়ায় আমি প্রথমে ডান ও পরে বাঁ দিকে আক্রমণ চালাই। কিন্তু ডান দিকে আক্রমণ চালিয়েই আমি আমার ভুল বুঝতে পারি। বাঁ দিক দখল না করতে পারলে যে আমরা সেখানে থাকতে পারব না, তাও বুঝতে পারলাম।
‘আমাদের একটি কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন লুৎফর রহমান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন রঙ্গু মিয়া। আমরা অ্যাটাকিং পজিশন থেকে এগোচ্ছি, বাঁ দিকে। সময় তখন বেলা সাড়ে ১০টা। আমরা অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি আর্টিলারির গোলা এসে পড়তে থাকল। এই গোলা শূন্যেই ফাটে এবং ক্ষয়ক্ষতি হয় বেশি। এর মধ্য দিয়ে ওই দুজন (রঙ্গু মিয়া ও লুৎফর রহমান) নির্ভয়ে পাকিস্তানিদের বাংকারে চার্জ করেন। তাঁদের সাহস ও আত্মত্যাগ অতুলনীয়। দুজনই বাংকারে চার্জ করতে গিয়ে শহীদ হন।’
রঙ্গু মিয়া চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন রংপুর সেনানিবাসে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সেনানিবাস থেকে পালিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ রঙ্গু মিয়াকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৫১।
শহীদ রঙ্গু মিয়ার পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার মোকরা (মৌবাড়ি) গ্রামে। বাবার নাম আবু মিয়া, মা লালমতি বিবি। স্ত্রী জয়তুন নেছা। তাঁদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। শহীদ রঙ্গু মিয়ার ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, মো. আবদুল হান্নান।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.