চিরকুট-কলম্বাসের ডায়েরি by শাহাদুজ্জামান
এই অক্টোবর মাসে আমেরিকা ‘কলম্বাস দিবস’ পালন করে থাকে। কলম্বাস ১৪৯২ সালের ১২ অক্টোবর আমেরিকার ভূখণ্ডে পা রেখেছিলেন। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের বিজয়োৎসব পালন করে তারা। কিন্তু সবাই এদিনে উৎসব করে না, কেউ কেউ করে পরিতাপ।
যেমন—আমেরিকার এক শিক্ষক বিল বিগলো কলম্বাস দিবসে ক্লাসে ঢুকে টেবিলের ওপর রাখা তাঁর ছাত্রীর পার্সটি বগলদাবা করে হাঁটতে শুরু করেন। ছাত্রীটি চেঁচিয়ে ওঠে, ‘এ কি! আপনি আমার পার্স নিয়ে যাচ্ছেন কেন?’ বিগলো বলেন, ‘নিলাম কোথায়, আমি তো এটা আবিষ্কার করলাম।’ ‘কলম্বাস এভাবেই আবিষ্কার করেছিলেন আমেরিকাকে।’ ছাত্রছাত্রীদের বলেন বিগলো। তিনি বলেন, ‘ওটা আবিষ্কার নয়, বরং স্রেফ লুটতরাজ। কলম্বাসের মহান বীরত্বপূর্ণ ইমেজকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইটি লিখেছেন আমেরিকার বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক হাওয়ার্ড জিন এ পিপলস হিস্টরি অব ইউনাইটেড স্টেটস নামে। এ বইয়ে জিন-উপাত্ত হিসেবে বিশেষভাবে ব্যবহার করেছেন কলম্বাসের রেখে যাওয়া ‘লগ বই’ বা ডায়েরিটিকে। কলম্বাসের ডায়েরির পাতায় পাতায় যে মানুষটিকে পাওয়া যায়, তিনি নেহাতই বর্বর, ধূর্ত, উচ্চাকাঙ্ক্ষী এক লুটেরা মাত্র।
কলম্বাস ব্যবসার উদ্দেশে ভারতে যাত্রা করে ভুল করে পৌঁছেছিলেন বাহামা দ্বীপে। সেখানে পৌঁছানোর পর তাঁর প্রথম অভিজ্ঞতার কথা ডায়েরিতে লিখেছেন কলম্বাস। লিখেছেন, কীভাবে সেখানকার আরোয়াক আদিবাসীরা সৈকত থেকে সমুদ্রে নেমে গিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। লিখেছেন, সেই আদিবাসীরা কত উপহার নিয়ে এসেছিল তাঁর জন্য। কলম্বাসের নিজের ভাষায়, ‘আরোয়াকরা খুব ভদ্র আর শান্তিপ্রিয় মানুষ। ওদের হাতে কোনো অস্ত্র নেই, অস্ত্র তারা চেনে না। আমি যখন ওদের হাতে একটা তলোয়ার তুলে দিলাম, ওরা তলোয়ারের ধারালো দিকটাতেই ধরল, তাতে ওদের হাত কেটে একেবারে একাকার।...এই আদিবাসীরা খুবই সরল আর সৎ এবং নিজেদের সম্পত্তি অন্যদের দিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে এরা খুবই উদার।’ এর পরই কলম্বাস লিখছেন, ‘আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, এরা দাস হিসেবে হবে চমৎকার। এদের সবাইকে বশে আনতে আমাদের জনা পঞ্চাশেক মানুষই যথেষ্ট। তারপর এদের দিয়ে আমরা যেমন খুশি কাজ করিয়ে নিতে পারব।’ অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে খুব অল্প সময়েই কলম্বাস বশে এনেছিলেন এই সরল মানুষগুলোকে এবং যেমন খুশি কাজ করিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁর ডায়েরির প্রথম পাতাগুলোয় যে শব্দটি ঘুরেফিরে এসেছে অসংখ্যবার, সেটি হচ্ছে ‘সোনা’। আদিবাসীরা কলম্বাসের জন্য যে উপহার এনেছিল, তার অন্যতম ছিল সোনার খণ্ড। কলম্বাস অস্ত্রের মুখে আদিবাসীদের বাধ্য করেছিলেন বাহামার সব সোনা এনে তাঁর হাতে তুলে দিতে। কলম্বাসের জীবনীকার স্যামুয়েল মরিসন লিখেছেন, ‘প্রত্যেক আদিবাসীকে কলম্বাস প্রতিদিন এক নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনা আনতে আদেশ করতেন। যারা সেই পরিমাণ সোনা আনতে ব্যর্থ হতো, তিনি কেটে ফেলতেন তাদের হাত। এ শাস্তি থেকে বাঁচতে কিছু আদিবাসী ভয়ে পাহাড়ে লুকিয়ে ছিল, কিন্তু কলম্বাস তাদের কুকুর দিয়ে ধরে আনেন। বহু আদিবাসী উপায়ান্তর না দেখে কাসাভা ফলের বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে।’ মরিসন আরও জানাচ্ছেন, ‘যেহেতু আদিবাসীদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির কোনো ধারণা ছিল না, ফলে তারা যেমন তাদের নিজেদের জিনিস কলম্বাসের স্প্যানিশ সঙ্গীদের এমনিতেই দিয়ে দিত, তেমনি অনেক সময় স্প্যানিশদের ব্যবহূত জিনিস নিয়ে যেত সঙ্গে করে। কিন্তু কলম্বাসের দল সেসব আদিবাসীকে চোর সাব্যস্ত করে হয় ফাঁসি দিয়েছে, নয়তো পুড়িয়ে মেরেছে।’ ইতিহাস আরও বলছে, কলম্বাসের সঙ্গীরা এই নতুন ভূখণ্ডে শুধু অস্ত্র নয়, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন বসন্ত, হাম ইত্যাদি ধরনের বিবিধ নতুন রোগ, যার বিরুদ্ধে আদিবাসীদের ছিল না কোনো প্রতিরোধ। ফলে দ্রুত এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে আদিবাসীরা। মরিসন হিসাব করে দেখিয়েছেন, কলম্বাস এই নতুন ভূখণ্ডে পা দেওয়ার বছর চারেকের মধ্যে ওই এলাকার জনসংখ্যা কমে হয়েছিল তিন ভাগের এক ভাগ। হত্যা, আত্মহত্যা আর রোগে আক্রান্ত হয়ে যখন আদিবাসীদের অবিরাম মৃত্যু হচ্ছে, কলম্বাস তখন তাঁর ডায়েরিতে লিখছেন, ‘ঈশ্বর সহায়, বিক্রির জন্য এখান থেকে যত খুশি দাস পাঠানো সম্ভব।’ কলম্বাস তাঁর প্রথম চালান হিসেবে ৫০০ জন আদিবাসীকে জোর করে ধরে এনে স্পেনের উদ্দেশে জাহাজে উঠিয়ে দিয়েছিলেন গাদাগাদি করে। অসুখে ও শীতে ধুঁকে ধুঁকে পথেই মারা যায় ২০০ জন।
এভাবেই শুরু হয়েছে কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের জয়যাত্রা। এভাবেই আদিবাসীদের জন্মভূমি থেকে তাদের বিতাড়িত করে শুরু হয়েছে কথিত নতুন সভ্যতার গোড়াপত্তন। নেহাত প্রান্তিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী হিসেবে রেড ইন্ডিয়ান নামে যে আদিবাসীরা আমেরিকায় টিকে গেছে, তাদের তথাকথিত সভ্য করে তোলার জন্য চলেছে অব্যাহত চাপ। আমেরিকার প্রাইভেটাইজেশনের আইনপ্রণেতা হেনরি লুইস ১৮৮০-তে সে দেশের আদিবাসী সম্পর্কে বলছেন, ‘...নিজে আলাদাভাবে উন্নতি করার কোনো স্পৃহা তাদের নেই। তোমার বাড়িটা যে তোমার প্রতিবেশীর চেয়ে আরও সুন্দর হতে পারে, এ বোধই তাদের মধ্যে কাজ করে না। তাদের ভেতর স্বার্থপরতার কোনো বোধ নেই, অথচ স্বার্থপরতাই তো সভ্যতার ভিত্তি।’ স্বার্থপরতার ভিত্তিতে যে সভ্যতা আমেরিকা গড়ে তুলেছে, তাতে সেই সরল আদিবাসীরা অবিরাম পিষ্টই হয়েছে কেবল। কিন্তু আদিবাসীরা আর তলোয়ারের ভুল প্রান্ত ধরে হাত রক্তাক্ত করতে রাজি নয়। দাবি উঠেছে, আমেরিকার প্রকৃত ইতিহাসের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির। এ বছর তাই আমেরিকায় অনেকেই কলম্বাস দিবসকে পালন করেছে আদিবাসীদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা দিবস হিসেবে।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
কলম্বাস ব্যবসার উদ্দেশে ভারতে যাত্রা করে ভুল করে পৌঁছেছিলেন বাহামা দ্বীপে। সেখানে পৌঁছানোর পর তাঁর প্রথম অভিজ্ঞতার কথা ডায়েরিতে লিখেছেন কলম্বাস। লিখেছেন, কীভাবে সেখানকার আরোয়াক আদিবাসীরা সৈকত থেকে সমুদ্রে নেমে গিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। লিখেছেন, সেই আদিবাসীরা কত উপহার নিয়ে এসেছিল তাঁর জন্য। কলম্বাসের নিজের ভাষায়, ‘আরোয়াকরা খুব ভদ্র আর শান্তিপ্রিয় মানুষ। ওদের হাতে কোনো অস্ত্র নেই, অস্ত্র তারা চেনে না। আমি যখন ওদের হাতে একটা তলোয়ার তুলে দিলাম, ওরা তলোয়ারের ধারালো দিকটাতেই ধরল, তাতে ওদের হাত কেটে একেবারে একাকার।...এই আদিবাসীরা খুবই সরল আর সৎ এবং নিজেদের সম্পত্তি অন্যদের দিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে এরা খুবই উদার।’ এর পরই কলম্বাস লিখছেন, ‘আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, এরা দাস হিসেবে হবে চমৎকার। এদের সবাইকে বশে আনতে আমাদের জনা পঞ্চাশেক মানুষই যথেষ্ট। তারপর এদের দিয়ে আমরা যেমন খুশি কাজ করিয়ে নিতে পারব।’ অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে খুব অল্প সময়েই কলম্বাস বশে এনেছিলেন এই সরল মানুষগুলোকে এবং যেমন খুশি কাজ করিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁর ডায়েরির প্রথম পাতাগুলোয় যে শব্দটি ঘুরেফিরে এসেছে অসংখ্যবার, সেটি হচ্ছে ‘সোনা’। আদিবাসীরা কলম্বাসের জন্য যে উপহার এনেছিল, তার অন্যতম ছিল সোনার খণ্ড। কলম্বাস অস্ত্রের মুখে আদিবাসীদের বাধ্য করেছিলেন বাহামার সব সোনা এনে তাঁর হাতে তুলে দিতে। কলম্বাসের জীবনীকার স্যামুয়েল মরিসন লিখেছেন, ‘প্রত্যেক আদিবাসীকে কলম্বাস প্রতিদিন এক নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনা আনতে আদেশ করতেন। যারা সেই পরিমাণ সোনা আনতে ব্যর্থ হতো, তিনি কেটে ফেলতেন তাদের হাত। এ শাস্তি থেকে বাঁচতে কিছু আদিবাসী ভয়ে পাহাড়ে লুকিয়ে ছিল, কিন্তু কলম্বাস তাদের কুকুর দিয়ে ধরে আনেন। বহু আদিবাসী উপায়ান্তর না দেখে কাসাভা ফলের বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে।’ মরিসন আরও জানাচ্ছেন, ‘যেহেতু আদিবাসীদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির কোনো ধারণা ছিল না, ফলে তারা যেমন তাদের নিজেদের জিনিস কলম্বাসের স্প্যানিশ সঙ্গীদের এমনিতেই দিয়ে দিত, তেমনি অনেক সময় স্প্যানিশদের ব্যবহূত জিনিস নিয়ে যেত সঙ্গে করে। কিন্তু কলম্বাসের দল সেসব আদিবাসীকে চোর সাব্যস্ত করে হয় ফাঁসি দিয়েছে, নয়তো পুড়িয়ে মেরেছে।’ ইতিহাস আরও বলছে, কলম্বাসের সঙ্গীরা এই নতুন ভূখণ্ডে শুধু অস্ত্র নয়, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন বসন্ত, হাম ইত্যাদি ধরনের বিবিধ নতুন রোগ, যার বিরুদ্ধে আদিবাসীদের ছিল না কোনো প্রতিরোধ। ফলে দ্রুত এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে আদিবাসীরা। মরিসন হিসাব করে দেখিয়েছেন, কলম্বাস এই নতুন ভূখণ্ডে পা দেওয়ার বছর চারেকের মধ্যে ওই এলাকার জনসংখ্যা কমে হয়েছিল তিন ভাগের এক ভাগ। হত্যা, আত্মহত্যা আর রোগে আক্রান্ত হয়ে যখন আদিবাসীদের অবিরাম মৃত্যু হচ্ছে, কলম্বাস তখন তাঁর ডায়েরিতে লিখছেন, ‘ঈশ্বর সহায়, বিক্রির জন্য এখান থেকে যত খুশি দাস পাঠানো সম্ভব।’ কলম্বাস তাঁর প্রথম চালান হিসেবে ৫০০ জন আদিবাসীকে জোর করে ধরে এনে স্পেনের উদ্দেশে জাহাজে উঠিয়ে দিয়েছিলেন গাদাগাদি করে। অসুখে ও শীতে ধুঁকে ধুঁকে পথেই মারা যায় ২০০ জন।
এভাবেই শুরু হয়েছে কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের জয়যাত্রা। এভাবেই আদিবাসীদের জন্মভূমি থেকে তাদের বিতাড়িত করে শুরু হয়েছে কথিত নতুন সভ্যতার গোড়াপত্তন। নেহাত প্রান্তিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী হিসেবে রেড ইন্ডিয়ান নামে যে আদিবাসীরা আমেরিকায় টিকে গেছে, তাদের তথাকথিত সভ্য করে তোলার জন্য চলেছে অব্যাহত চাপ। আমেরিকার প্রাইভেটাইজেশনের আইনপ্রণেতা হেনরি লুইস ১৮৮০-তে সে দেশের আদিবাসী সম্পর্কে বলছেন, ‘...নিজে আলাদাভাবে উন্নতি করার কোনো স্পৃহা তাদের নেই। তোমার বাড়িটা যে তোমার প্রতিবেশীর চেয়ে আরও সুন্দর হতে পারে, এ বোধই তাদের মধ্যে কাজ করে না। তাদের ভেতর স্বার্থপরতার কোনো বোধ নেই, অথচ স্বার্থপরতাই তো সভ্যতার ভিত্তি।’ স্বার্থপরতার ভিত্তিতে যে সভ্যতা আমেরিকা গড়ে তুলেছে, তাতে সেই সরল আদিবাসীরা অবিরাম পিষ্টই হয়েছে কেবল। কিন্তু আদিবাসীরা আর তলোয়ারের ভুল প্রান্ত ধরে হাত রক্তাক্ত করতে রাজি নয়। দাবি উঠেছে, আমেরিকার প্রকৃত ইতিহাসের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির। এ বছর তাই আমেরিকায় অনেকেই কলম্বাস দিবসকে পালন করেছে আদিবাসীদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা দিবস হিসেবে।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
No comments