সরল গরল-বিচারপতি রশীদের ইঁদুর-দর্শনের পর by মিজানুর রহমান খান
বিচারপতি মো. আবদুর রশীদের অভিষেকপর্বে আইন কমিশনে গিয়েছিলাম। তাঁর কাছ থেকে ইঁদুরের গল্প শুনেছিলাম। ঘরের অবস্থা যা তখনো ছিল, তাতে চাইলে ইঁদুর দেখতে বেগ পেতে হতো না। তখনকার ভারপ্রাপ্ত আইনসচিব এসেছিলেন। তাঁকে বেশ আশ্বস্ত করতে শুনেছিলাম। কিন্তু মন সায় দেয়নি।
কারণ, চেয়ার-টেবিল পাল্টে কী হবে? আগে তো মন-মানসিকতা বদলাতে হবে। সরকার ও সংসদের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে আমলারাও আইন কমিশনকে পাত্তা দেন না। অবশ্য সে কারণে কমিশনের যা করার কথা, তার তা না করা সাজে না। মন্ত্রকমহলে অভিযোগ উঠেছে যে পুনর্গঠিত কমিশন যথাযথভাবে কাজ করেনি। সে কারণে মাস দুই আগে আইন মন্ত্রণালয় কমিশনকে চিঠি দিয়েছিল। তারা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল, ৬ ধারায় (কমিশনের করণীয়) কী লেখা আছে। তবে দায় যারই হোক, বাংলাদেশের জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে। তারা যে লক্ষ্যে কমিশনের পেছনে বছরে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা খরচ করছে, তা বেশ পানিতে যাচ্ছে। আমাদের মাথাব্যথার কারণ সেটাই।
আইন কমিশনে সত্যি ইঁদুর বাসা বেঁধেছিল। সেটাই ছিল স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের আগে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যপদ অনেক দিন খালি ছিল। সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি মোস্তাফা কামাল শেষ দিনগুলোতে অসন্তোষ ব্যক্ত করেছিলেন। তাঁর অগোচরে প্রেষণে থাকা বিচারিক কর্মকর্তাদের অন্যত্র বদলি করা হয়েছিল। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে তিনি চলে যান। এরপর ১৬ মাস চেয়ারম্যানের পদ খালি ছিল। পরে ১৩ মাস কেটেছে এক সদস্যে। জরুরি অবস্থায় অধ্যাদেশ দিয়ে আইন তৈরির ধুম পড়েছিল। তখনো দেখলাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন কমিশনকে আস্থায় নেয়নি। তখন আইন মন্ত্রণলয়ের ‘কেরানি’রাই হয়ে উঠেছিলেন অপ্রতিরোধ্য আইনপ্রণেতা। আমাদের প্রায় চার দশকের ইতিহাস। এর অধিকাংশ সময় আইন মন্ত্রকই উর্বর আইন প্রজননকেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে। সুতরাং আইন পয়দার কৃতিত্ব আমলাদের। বড় আইন সংস্কার হয়েছে সেনাশাসনে।
যা হোক, নবনিযুক্ত চেয়ারম্যানের ইঁদুর-দর্শন আমাকে কমিশন নিয়ে লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিল। তখন একটি লেখার শিরোনামও ঠিক করেছিলাম। সেটি হলো বিচারপতি আবদুর রশীদের ইঁদুর-দর্শন। তিনি সম্প্রতি পদত্যাগ করেন। এ নিয়ে গণমাধ্যমে নানামুখী বিশ্লেষণ। সংবিধান পুনর্মুদ্রণে তাঁর সায় নেই। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের প্রসঙ্গও এসেছে। তিনি তখন প্রায় ৪০ জনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এর মধ্যে জামায়াতের ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ছিলেন। কমিশনের সদস্যদের বিদেশ সফর নিয়ে টানাপোড়েনের কথাও ছাপা হয়েছে। বাংলাদেশে কোনটা কখন, কোথায়, কীভাবে প্রতিক্রিয়া কিংবা বুদবুদ তৈরি করে বা তৈরি করানো হয়, তা বলা মুশকিল। আদালতপাড়ার লোকেরা ভালোই জানেন যে আইন ও বিচারমন্ত্রীর সঙ্গে বিচারপতি আবদুর রশীদের সম্পর্ক পুরোনো। পারিবারিকভাবেও। চার দশকের সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় ছন্দপতন ঘটেনি বলেই জানা যায়। আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ এতকাল সাবেক প্রধান বিচারপতিদের দেওয়া হতো। বিচারপতি রশীদ অবশ্য হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠতম বিচারক হিসেবে অবসর নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সুনামের কারণেই হয়তো কথা ওঠেনি।
বিচারপতি আবদুর রশীদ তাঁর পদত্যাগপত্র গত ৫ অক্টোবর আইনমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে পৌঁছে দেন। ছাত্র ইউনিয়ন করার সূত্রে উভয় পরিবারের পূর্ব যোগাযোগ আছে। বামঘেঁষা একটি আইনজীবী সংগঠনের যৌথ নেতৃত্বও দেন। ইস্তফা দিয়েও বিচারপতি রশীদ কিন্তু সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত বিশেষ কমিটিতে গিয়েছেন। সেখানে সাজেদা চৌধুরী ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তাঁর সঙ্গে এ নিয়ে দু-চারটি বাক্যবিনিময়ও করেন। এমনকি বিশেষ কমিটির বৈঠকের কার্যবিবরণীতে তিনি নাকি সই দেন প্রশ্নচিহ্ন এঁকে। যেহেতু তিনি চেয়ারম্যানের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন, তাই এই প্রশ্নচিহ্ন। আরও একটি তথ্য প্রাসঙ্গিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিচারপতি রশীদের সহধর্মিণীর নৈকট্য রয়েছে। তা-ও পুরোনো। এসব বলা এই কারণে যে বিচারপতি রশীদের পদত্যাগ করার পর তা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয় না। সবাই চুপচাপ থাকেন। তা প্রশ্ন তৈরি করে কিন্তু জবাব মেলায় না। সত্যিই তিনি কাজ করেননি? আর সেটাই সংকট সৃষ্টি করেছে? নাকি স্বার্থের সূক্ষ্ম সংঘাত, যা আমরা বুঝতে পারি না?
সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে বিচারপতি রশীদ কী অভিমত রেখেছিলেন, তার বিস্তারিত এখনো গোপনীয়। এ দেশে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকেও গোপনীয়তার মোড়কে রাখা হয়। আইন কমিশনের অপর সদস্য শাহ আলম অবশ্য তাঁর অভিমত ডেইলি স্টার-এ প্রকাশ করেছেন। যত দূর বুঝতে পারি, কমিশনের চেয়ারম্যান ও এই সদস্যের মতামতে একটি ফারাক আছে। দুই মেয়াদে কমিশনের সঙ্গে থাকা অধ্যাপক আলম মনে করেন, সরকার যখন স্পষ্ট করেছে যে তাঁরা ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করবে না। ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম থাকবে। আর আদালতের রায় যখন একটি দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে, তখন আর মুদ্রণ কেন? সংসদে উপযুক্তমতে শুধরে নিয়ে ছাপাই ভালো। খুবই যুক্তিপূর্ণ কথা। অন্যদিকে কমিশনের চেয়ারম্যানের যুক্তি অনেকটাই তাত্ত্বিক। সেটা সংসদীয় সার্বভৌমত্ব ও বিচার বিভাগের এখতিয়ারগত ধ্রুপদি বিষয় মনে হয়। আমরা শাহ আলমের মতটিকে অধিকতর যৌক্তিক মনে করি। কিন্তু এখানে সেটা বিচার্য নয়। নিতান্ত ভিন্নমতের কারণে তিক্ততা সৃষ্টি হলো? তাহলে তা আমাদের কী শিক্ষা দেয়? গণতন্ত্র থাকবে, ভিন্নমত থাকবে না?
আইন কমিশনের কাজে সন্তুষ্ট ছিল না আইন মন্ত্রণালয়। ১৮ অক্টোবর আইন মন্ত্রণালয়ে দুই সদস্য শাহ আলম, এম এ মোবারকসহ অন্যান্য কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেন আইনমন্ত্রী। কমিশনের চেয়ারম্যানের পদত্যাগপত্র ঝুলছিল। একটা গুমোট পরিবেশ। এ অবস্থায় কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে ‘গঠনমূলক’ আলোচনা হলো। আইন কমিশন ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৯ কমিশনের কর্মপরিকল্পনা (২০১০-২০১১) আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। তারা এ বিষয়ে কখনো সাড়া দেয়নি। ওই বৈঠকে শাহ আলম সে কথা তোলেন। শুনেছি, আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সাড়া দেওয়া আইনে বাধ্যতামূলক নয়। আপনারা তো কর্মসূচিমতে আইনের খসড়া তৈরি করতে পারতেন। তা করেননি। করলে আমাকে দোষ দিতে পারতেন।’ আইনমন্ত্রীর কথা ধারালো হয়ে ওঠে। কারণ, কমিশনের অবৈতনিক সদস্য এম এ মোবারক বলেন, ‘কমিশনের কোনো বৈঠকে তিনি আইন নিয়ে আলোচনা হতে দেখেননি।’ আইন সংস্কারে তিনি একজন অকৃত্রিম অনুরাগী। জনাব মোবারক বলেন, বাংলাদেশ কোডভুক্ত আইন সংশোধনের অনেক প্রস্তাব তিনি দিয়েছেন। কিন্তু কমিশন তা প্রত্যাখ্যান করেছে। কমিশনের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিয়েও তাঁর প্রশ্ন আছে। সরকারের নেতিবাচক মনোভাব স্বীকার করেও তিনি মনে করেন, যত কাজ হতে পারত, তা হয়নি। স্পষ্টতই কমিশন সদস্যদের মধ্যে কার্যধারা নিয়ে মতানৈক্য ছিল।
বিচারপতি রশীদের পদত্যাগের খবর আইন কমিশন থেকে নয়, ‘ওপরের সম্মতিতে’ দুই সপ্তাহ বাদে প্রকাশ পায়। তবে এই পদত্যাগ আমাদের লেখা বা মনোযোগের বড় বিষয় নয়। আমাদের উদ্বেগ, কমিশনকে শক্তিশালী করার কোনো উদ্যোগ নেই। কোনো অবকাঠামোগত অবস্থাও বাস্তবে বিদ্যমান নেই। আমাদের আইন কমিশনের জন্ম ১৯৯৬ সালে, নির্বাচিত সরকারের আমলে। এরই মধ্যে ১৪ বছর কেটে গেছে। কিন্তু হিসাবের খাতা খুলে মেলাতে বসলে হিসাব মিলবে না। কী চেয়েছিলাম, কী পেলাম—তাহলে হতাশাব্যঞ্জক চিত্রই ভেসে উঠবে। দুই বড় দল প্রতিযোগিতামূলক কিংবা যৌথভাবে একে বাড়তে দেয়নি। এর টুঁটি চেপে রেখেছে। ‘দুর্নীতি’, ‘তথ্য’ ও ‘মানবাধিকার’ যেমন, তেমনি ‘আইন’ বিদেশিদের আকর্ষণের বিষয়। দুনিয়ার সব সভ্য দেশে ওসব নিয়ে কমিশন থাকে। তাই আমাদের শাসকেরাও এসব দোকানপাট খুলে রেখেছেন। সাইনবোর্ডগুলো বাক-বিলাসের চাহিদা মেটায়। আইন কমিশন নিয়ে নির্বাচিত সরকারগুলোর তামাশা উদগ্র। আইন কমিশন গঠনের পর এটা কাজ করুক, তা নির্বাহী বিভাগ চায়নি। সংসদও চায়নি। আইনপ্রণেতারা আইন ছাড়া বাদবাকি বহু বিষয়ে বেজায় আগ্রহী!
২০০৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক একটি অপ্রিয় সত্য উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আইনসভার সদস্যদের আইন সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা উচিত। কেরানি সাহেবরা খসড়া পাঠিয়ে দেন, আর সবাই হু হু করে পাস করে দেন।’ আমাদের আইন প্রতিমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া দেখে পরম আনন্দ পেয়েছিলাম। তিনি গত ২০ ডিসেম্বর তাঁর দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বিচারকের এই উক্তির (প্রতিমন্ত্রীর ভাষায় যা অশোভন) বিরুদ্ধে তাঁরা সংসদে নিন্দা প্রস্তাব আনবেন। সংসদে এ রকম একটা আলোচনা হলে কত ভালো হয়। আমরা তখন হয়তো মহান সংসদের মহান সাংসদদের গবেষণা ও এর ফলাফল জানতে পারব। যেমনটা আমরা উন্নত কিংবা প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে পাই।
ব্রিটেনের আইন কমিশন একটি সংবিধিবদ্ধ স্বাধীন সংস্থা। বাংলাদেশেরটা পুরোপুরি সরকারনিয়ন্ত্রিত, যদিও কমিশনের সদস্যদের অপসারণের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আছে। এ পর্যন্ত ব্রিটিশ আইন কমিশনের সুপারিশের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংসদ গ্রহণ করেছে। ভারত উপমহাদেশে ৩০০ বছর ধরে আইন সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত। ১৮৩৪ সালে লর্ড ম্যাকলের সভাপতিত্বে প্রথম আইন কমিশন গঠিত হয়। আমাদের দণ্ডবিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধি কিন্তু সেই কমিশনেরই ফসল। আমরা আজও তা সময়োপযোগী করতে পারিনি। ভারত ও পাকিস্তান করেছে। আমাদের আইন কমিশন কবে এ দুটিতে হাত দেবে, আমরা জানি না। ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় আইন কমিশন এ পর্যন্ত (২০০৯) ২৩৪টি প্রতিবেদন পেশ করেছে। এর প্রায় ৮০ শতাংশই গ্রহণ করেছে সংসদ। আমাদের আইন কমিশন এ পর্যন্ত ১০৪টি রিপোর্ট (ভারতের সঙ্গে তুলনা করা চলে এমন প্রতিবেদন খুবই কম) পেশ করেছে। কিন্তু এর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ বা আইন সংশোধনের উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব নগণ্য। উপরন্তু, সুপারিশ বাস্তবায়নের হার ২০ শতাংশের কম।
আগেই বলেছি, আইন কমিশনের প্রতি শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি অভিন্ন। এখানে আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয়ে সমান। কিছু নমুনা দেওয়া চলে। তিন বছর আগে ৬০-৭০ লাখ টাকা খরচ করে আইন শিক্ষা সংস্কার বিষয়ে আইন কমিশন একটি বড় কাজ করে। সেটি আইন মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে। একজন সদস্যের ভাষায়, মন্ত্রণালয় সেটির পৃষ্ঠা উল্টেও দেখেনি। ২০০৬ সালে আইন কমিশন আরেকটি বড় কাজ করে। সেটি হলো ভিকটিমস ও উইটনেস প্রটেকশন অ্যাক্টের খসড়া তৈরি। সেটিও ফিতাবন্দী।
পরিহাস যে কতটা প্রকট, তা বুঝতে আরেকটি মানদণ্ড আছে। ১৯৯৬ সালে আইন কমিশন-সংক্রান্ত আইনটি হয়েছিল। কিন্তু তার আওতায় বিধিমালা গত ১৪ বছরেও হয়নি। এতে কমিশনেরও শৈথিল্য ছিল। বিচারপতি মো. আবদুর রশীদ তাঁর সময়ের কাজের একটি ফর্দ সাংবাদিকদের দিয়েছেন। এটা দেখলে বোঝা যাবে, তিনি অলস বসে ছিলেন না। ২৫টি কর্মতৎপরতার বিবরণ আছে তাতে। এর মধ্যে আইন কমিশনের নিজের বিষয় ১০টির কম নয়। যাতে আছে, আইন কমিশন (কর্মকর্তা) নিয়োগ বিধিমালা ২০০৯, ১৯৯৬ সালের কমিশন আইনের সংশোধন, আইন কমিশন বিধিমালা (খসড়া) ২০০৯, আইন কমিশন কর্মকর্তা চাকরি বিধিমালা (খসড়া) ২০১০ এবং তফসিল ও অর্গানোগ্রাম। আইন মন্ত্রণালয়ে টাকা পড়ে আছে—এ কথা শুনে কমিশন একটি প্রকল্প বানায় গত ফেব্রুয়ারি মাসে। দুই কোটি টাকার। আইন মন্ত্রণালয় তাতে সাড়া দেয়নি। আইন কমিশন চেয়েছিল, তাদের তদারক করবে আইন মন্ত্রণালয়ের বিচার শাখা। এটাও অগ্রাহ্য হয়েছে। তাদের তদারক করছে ড্রাফটিং উইং।
আইন কমিশনের একজনও নিজস্ব কর্মকর্তা নেই। ২০০৫ সালে তিন কমিশনারসহ ১৪ জনের লোকবল অনুমোদন করা হয়। কিন্তু ১১ কর্মকর্তার কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তবে প্রায় ২০ জনের স্টাফ টিম আছে। তারা সবাই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর। স্থায়ী কমিশনের মূল শক্তি হলো প্রেষণে আসা কর্মকর্তারা। এখন আছেন ছয় বিচারক। সেখানেও কোনো নিয়মনীতি নেই। তাঁদের আসা-যাওয়া চলে। ওই ছয় বিচারকের দুজন প্রশাসন দেখেন। চারজন গবেষণায়। কাজের গভীরে যেতে না যেতেই তাঁদের বদলির সময় হয়। কেউ তদবির করে আরও আকর্ষণীয় কর্মস্থল জুটিয়ে নেন। ব্যাপক ও নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা ছাড়া কোনো সুষ্ঠু আইন তৈরি হতে পারে না। এরপর আসে পাকা হাতে খসড়া তৈরির পালা। এ কাজেরও লোক নেই। এসবে কী প্রমাণিত হয়? গত ১৮ অক্টোবর আইন মন্ত্রণালয়ে সমন দিয়ে খোঁজখবর নেওয়ার মধ্যে কোন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে?
আইন কমিশনকে ইঁদুরের অভয়াশ্রম রাখতে যাঁরা অভ্যস্ত, তাঁরাই কিন্তু ‘হু হু করে আইন পাস’ করেন। এই হু হু মানে হুজুর হুজুর। এই হু হু মানে হাঁ-জয়যুক্ত হয়েছে। হুজুর হুজুর সংস্কৃতিতে পদত্যাগ শব্দটি হারিয়ে গিয়েছিল। স্বেচ্ছায় বিচারাঙ্গনের কেউ পদত্যাগ করেন, তা-ও আমরা ভুলতে বসেছিলাম। বিচারপতি আবদুর রশীদ অন্তত সে জন্য ধন্যবাদ পেতেই পারেন। তবে তিনিও প্রথাবন্দী থাকলেন। পদত্যাগপত্রে ত্যাগের কারণ লেখেননি। তবে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘কাজ করতে পারিনি বলে চলে এসেছি।’ আইনমন্ত্রী মন্তব্য করেননি। বলেছেন, ‘তিনি কোনো কারণ দেখেন না।’ গতকালই নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেলেন ড. এম শাহ আলম। তাঁকে অভিনন্দন। তিনিও একদিন যাবেন। মন্ত্রিত্বও ঠুনকো। কিন্তু তাঁরা কি অদৃশ্য ইঁদুর তাড়াতে পারবেন? সরকার (হাইকমান্ড) না চাইলে কী হয়, তার জ্বলন্ত উদাহরণ দুদক, তথ্য ও মানবাধিকার কমিশনের মতো ‘স্বাধীন’ সংস্থা। এরা সবাই জীবন্মৃত। তাদের জেরবার থাকার কারণগুলো একই সূত্রে গাঁথা। সেখানে মন্ত্রী ও কমিশনপ্রধানদের তেমন জায়গা নেই।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
আইন কমিশনে সত্যি ইঁদুর বাসা বেঁধেছিল। সেটাই ছিল স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের আগে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যপদ অনেক দিন খালি ছিল। সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি মোস্তাফা কামাল শেষ দিনগুলোতে অসন্তোষ ব্যক্ত করেছিলেন। তাঁর অগোচরে প্রেষণে থাকা বিচারিক কর্মকর্তাদের অন্যত্র বদলি করা হয়েছিল। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে তিনি চলে যান। এরপর ১৬ মাস চেয়ারম্যানের পদ খালি ছিল। পরে ১৩ মাস কেটেছে এক সদস্যে। জরুরি অবস্থায় অধ্যাদেশ দিয়ে আইন তৈরির ধুম পড়েছিল। তখনো দেখলাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন কমিশনকে আস্থায় নেয়নি। তখন আইন মন্ত্রণলয়ের ‘কেরানি’রাই হয়ে উঠেছিলেন অপ্রতিরোধ্য আইনপ্রণেতা। আমাদের প্রায় চার দশকের ইতিহাস। এর অধিকাংশ সময় আইন মন্ত্রকই উর্বর আইন প্রজননকেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে। সুতরাং আইন পয়দার কৃতিত্ব আমলাদের। বড় আইন সংস্কার হয়েছে সেনাশাসনে।
যা হোক, নবনিযুক্ত চেয়ারম্যানের ইঁদুর-দর্শন আমাকে কমিশন নিয়ে লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিল। তখন একটি লেখার শিরোনামও ঠিক করেছিলাম। সেটি হলো বিচারপতি আবদুর রশীদের ইঁদুর-দর্শন। তিনি সম্প্রতি পদত্যাগ করেন। এ নিয়ে গণমাধ্যমে নানামুখী বিশ্লেষণ। সংবিধান পুনর্মুদ্রণে তাঁর সায় নেই। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের প্রসঙ্গও এসেছে। তিনি তখন প্রায় ৪০ জনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এর মধ্যে জামায়াতের ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ছিলেন। কমিশনের সদস্যদের বিদেশ সফর নিয়ে টানাপোড়েনের কথাও ছাপা হয়েছে। বাংলাদেশে কোনটা কখন, কোথায়, কীভাবে প্রতিক্রিয়া কিংবা বুদবুদ তৈরি করে বা তৈরি করানো হয়, তা বলা মুশকিল। আদালতপাড়ার লোকেরা ভালোই জানেন যে আইন ও বিচারমন্ত্রীর সঙ্গে বিচারপতি আবদুর রশীদের সম্পর্ক পুরোনো। পারিবারিকভাবেও। চার দশকের সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় ছন্দপতন ঘটেনি বলেই জানা যায়। আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ এতকাল সাবেক প্রধান বিচারপতিদের দেওয়া হতো। বিচারপতি রশীদ অবশ্য হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠতম বিচারক হিসেবে অবসর নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সুনামের কারণেই হয়তো কথা ওঠেনি।
বিচারপতি আবদুর রশীদ তাঁর পদত্যাগপত্র গত ৫ অক্টোবর আইনমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে পৌঁছে দেন। ছাত্র ইউনিয়ন করার সূত্রে উভয় পরিবারের পূর্ব যোগাযোগ আছে। বামঘেঁষা একটি আইনজীবী সংগঠনের যৌথ নেতৃত্বও দেন। ইস্তফা দিয়েও বিচারপতি রশীদ কিন্তু সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত বিশেষ কমিটিতে গিয়েছেন। সেখানে সাজেদা চৌধুরী ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তাঁর সঙ্গে এ নিয়ে দু-চারটি বাক্যবিনিময়ও করেন। এমনকি বিশেষ কমিটির বৈঠকের কার্যবিবরণীতে তিনি নাকি সই দেন প্রশ্নচিহ্ন এঁকে। যেহেতু তিনি চেয়ারম্যানের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন, তাই এই প্রশ্নচিহ্ন। আরও একটি তথ্য প্রাসঙ্গিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিচারপতি রশীদের সহধর্মিণীর নৈকট্য রয়েছে। তা-ও পুরোনো। এসব বলা এই কারণে যে বিচারপতি রশীদের পদত্যাগ করার পর তা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয় না। সবাই চুপচাপ থাকেন। তা প্রশ্ন তৈরি করে কিন্তু জবাব মেলায় না। সত্যিই তিনি কাজ করেননি? আর সেটাই সংকট সৃষ্টি করেছে? নাকি স্বার্থের সূক্ষ্ম সংঘাত, যা আমরা বুঝতে পারি না?
সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে বিচারপতি রশীদ কী অভিমত রেখেছিলেন, তার বিস্তারিত এখনো গোপনীয়। এ দেশে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকেও গোপনীয়তার মোড়কে রাখা হয়। আইন কমিশনের অপর সদস্য শাহ আলম অবশ্য তাঁর অভিমত ডেইলি স্টার-এ প্রকাশ করেছেন। যত দূর বুঝতে পারি, কমিশনের চেয়ারম্যান ও এই সদস্যের মতামতে একটি ফারাক আছে। দুই মেয়াদে কমিশনের সঙ্গে থাকা অধ্যাপক আলম মনে করেন, সরকার যখন স্পষ্ট করেছে যে তাঁরা ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করবে না। ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম থাকবে। আর আদালতের রায় যখন একটি দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে, তখন আর মুদ্রণ কেন? সংসদে উপযুক্তমতে শুধরে নিয়ে ছাপাই ভালো। খুবই যুক্তিপূর্ণ কথা। অন্যদিকে কমিশনের চেয়ারম্যানের যুক্তি অনেকটাই তাত্ত্বিক। সেটা সংসদীয় সার্বভৌমত্ব ও বিচার বিভাগের এখতিয়ারগত ধ্রুপদি বিষয় মনে হয়। আমরা শাহ আলমের মতটিকে অধিকতর যৌক্তিক মনে করি। কিন্তু এখানে সেটা বিচার্য নয়। নিতান্ত ভিন্নমতের কারণে তিক্ততা সৃষ্টি হলো? তাহলে তা আমাদের কী শিক্ষা দেয়? গণতন্ত্র থাকবে, ভিন্নমত থাকবে না?
আইন কমিশনের কাজে সন্তুষ্ট ছিল না আইন মন্ত্রণালয়। ১৮ অক্টোবর আইন মন্ত্রণালয়ে দুই সদস্য শাহ আলম, এম এ মোবারকসহ অন্যান্য কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেন আইনমন্ত্রী। কমিশনের চেয়ারম্যানের পদত্যাগপত্র ঝুলছিল। একটা গুমোট পরিবেশ। এ অবস্থায় কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে ‘গঠনমূলক’ আলোচনা হলো। আইন কমিশন ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৯ কমিশনের কর্মপরিকল্পনা (২০১০-২০১১) আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। তারা এ বিষয়ে কখনো সাড়া দেয়নি। ওই বৈঠকে শাহ আলম সে কথা তোলেন। শুনেছি, আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সাড়া দেওয়া আইনে বাধ্যতামূলক নয়। আপনারা তো কর্মসূচিমতে আইনের খসড়া তৈরি করতে পারতেন। তা করেননি। করলে আমাকে দোষ দিতে পারতেন।’ আইনমন্ত্রীর কথা ধারালো হয়ে ওঠে। কারণ, কমিশনের অবৈতনিক সদস্য এম এ মোবারক বলেন, ‘কমিশনের কোনো বৈঠকে তিনি আইন নিয়ে আলোচনা হতে দেখেননি।’ আইন সংস্কারে তিনি একজন অকৃত্রিম অনুরাগী। জনাব মোবারক বলেন, বাংলাদেশ কোডভুক্ত আইন সংশোধনের অনেক প্রস্তাব তিনি দিয়েছেন। কিন্তু কমিশন তা প্রত্যাখ্যান করেছে। কমিশনের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিয়েও তাঁর প্রশ্ন আছে। সরকারের নেতিবাচক মনোভাব স্বীকার করেও তিনি মনে করেন, যত কাজ হতে পারত, তা হয়নি। স্পষ্টতই কমিশন সদস্যদের মধ্যে কার্যধারা নিয়ে মতানৈক্য ছিল।
বিচারপতি রশীদের পদত্যাগের খবর আইন কমিশন থেকে নয়, ‘ওপরের সম্মতিতে’ দুই সপ্তাহ বাদে প্রকাশ পায়। তবে এই পদত্যাগ আমাদের লেখা বা মনোযোগের বড় বিষয় নয়। আমাদের উদ্বেগ, কমিশনকে শক্তিশালী করার কোনো উদ্যোগ নেই। কোনো অবকাঠামোগত অবস্থাও বাস্তবে বিদ্যমান নেই। আমাদের আইন কমিশনের জন্ম ১৯৯৬ সালে, নির্বাচিত সরকারের আমলে। এরই মধ্যে ১৪ বছর কেটে গেছে। কিন্তু হিসাবের খাতা খুলে মেলাতে বসলে হিসাব মিলবে না। কী চেয়েছিলাম, কী পেলাম—তাহলে হতাশাব্যঞ্জক চিত্রই ভেসে উঠবে। দুই বড় দল প্রতিযোগিতামূলক কিংবা যৌথভাবে একে বাড়তে দেয়নি। এর টুঁটি চেপে রেখেছে। ‘দুর্নীতি’, ‘তথ্য’ ও ‘মানবাধিকার’ যেমন, তেমনি ‘আইন’ বিদেশিদের আকর্ষণের বিষয়। দুনিয়ার সব সভ্য দেশে ওসব নিয়ে কমিশন থাকে। তাই আমাদের শাসকেরাও এসব দোকানপাট খুলে রেখেছেন। সাইনবোর্ডগুলো বাক-বিলাসের চাহিদা মেটায়। আইন কমিশন নিয়ে নির্বাচিত সরকারগুলোর তামাশা উদগ্র। আইন কমিশন গঠনের পর এটা কাজ করুক, তা নির্বাহী বিভাগ চায়নি। সংসদও চায়নি। আইনপ্রণেতারা আইন ছাড়া বাদবাকি বহু বিষয়ে বেজায় আগ্রহী!
২০০৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক একটি অপ্রিয় সত্য উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আইনসভার সদস্যদের আইন সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা উচিত। কেরানি সাহেবরা খসড়া পাঠিয়ে দেন, আর সবাই হু হু করে পাস করে দেন।’ আমাদের আইন প্রতিমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া দেখে পরম আনন্দ পেয়েছিলাম। তিনি গত ২০ ডিসেম্বর তাঁর দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বিচারকের এই উক্তির (প্রতিমন্ত্রীর ভাষায় যা অশোভন) বিরুদ্ধে তাঁরা সংসদে নিন্দা প্রস্তাব আনবেন। সংসদে এ রকম একটা আলোচনা হলে কত ভালো হয়। আমরা তখন হয়তো মহান সংসদের মহান সাংসদদের গবেষণা ও এর ফলাফল জানতে পারব। যেমনটা আমরা উন্নত কিংবা প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে পাই।
ব্রিটেনের আইন কমিশন একটি সংবিধিবদ্ধ স্বাধীন সংস্থা। বাংলাদেশেরটা পুরোপুরি সরকারনিয়ন্ত্রিত, যদিও কমিশনের সদস্যদের অপসারণের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আছে। এ পর্যন্ত ব্রিটিশ আইন কমিশনের সুপারিশের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংসদ গ্রহণ করেছে। ভারত উপমহাদেশে ৩০০ বছর ধরে আইন সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত। ১৮৩৪ সালে লর্ড ম্যাকলের সভাপতিত্বে প্রথম আইন কমিশন গঠিত হয়। আমাদের দণ্ডবিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধি কিন্তু সেই কমিশনেরই ফসল। আমরা আজও তা সময়োপযোগী করতে পারিনি। ভারত ও পাকিস্তান করেছে। আমাদের আইন কমিশন কবে এ দুটিতে হাত দেবে, আমরা জানি না। ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় আইন কমিশন এ পর্যন্ত (২০০৯) ২৩৪টি প্রতিবেদন পেশ করেছে। এর প্রায় ৮০ শতাংশই গ্রহণ করেছে সংসদ। আমাদের আইন কমিশন এ পর্যন্ত ১০৪টি রিপোর্ট (ভারতের সঙ্গে তুলনা করা চলে এমন প্রতিবেদন খুবই কম) পেশ করেছে। কিন্তু এর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ বা আইন সংশোধনের উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব নগণ্য। উপরন্তু, সুপারিশ বাস্তবায়নের হার ২০ শতাংশের কম।
আগেই বলেছি, আইন কমিশনের প্রতি শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি অভিন্ন। এখানে আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয়ে সমান। কিছু নমুনা দেওয়া চলে। তিন বছর আগে ৬০-৭০ লাখ টাকা খরচ করে আইন শিক্ষা সংস্কার বিষয়ে আইন কমিশন একটি বড় কাজ করে। সেটি আইন মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে। একজন সদস্যের ভাষায়, মন্ত্রণালয় সেটির পৃষ্ঠা উল্টেও দেখেনি। ২০০৬ সালে আইন কমিশন আরেকটি বড় কাজ করে। সেটি হলো ভিকটিমস ও উইটনেস প্রটেকশন অ্যাক্টের খসড়া তৈরি। সেটিও ফিতাবন্দী।
পরিহাস যে কতটা প্রকট, তা বুঝতে আরেকটি মানদণ্ড আছে। ১৯৯৬ সালে আইন কমিশন-সংক্রান্ত আইনটি হয়েছিল। কিন্তু তার আওতায় বিধিমালা গত ১৪ বছরেও হয়নি। এতে কমিশনেরও শৈথিল্য ছিল। বিচারপতি মো. আবদুর রশীদ তাঁর সময়ের কাজের একটি ফর্দ সাংবাদিকদের দিয়েছেন। এটা দেখলে বোঝা যাবে, তিনি অলস বসে ছিলেন না। ২৫টি কর্মতৎপরতার বিবরণ আছে তাতে। এর মধ্যে আইন কমিশনের নিজের বিষয় ১০টির কম নয়। যাতে আছে, আইন কমিশন (কর্মকর্তা) নিয়োগ বিধিমালা ২০০৯, ১৯৯৬ সালের কমিশন আইনের সংশোধন, আইন কমিশন বিধিমালা (খসড়া) ২০০৯, আইন কমিশন কর্মকর্তা চাকরি বিধিমালা (খসড়া) ২০১০ এবং তফসিল ও অর্গানোগ্রাম। আইন মন্ত্রণালয়ে টাকা পড়ে আছে—এ কথা শুনে কমিশন একটি প্রকল্প বানায় গত ফেব্রুয়ারি মাসে। দুই কোটি টাকার। আইন মন্ত্রণালয় তাতে সাড়া দেয়নি। আইন কমিশন চেয়েছিল, তাদের তদারক করবে আইন মন্ত্রণালয়ের বিচার শাখা। এটাও অগ্রাহ্য হয়েছে। তাদের তদারক করছে ড্রাফটিং উইং।
আইন কমিশনের একজনও নিজস্ব কর্মকর্তা নেই। ২০০৫ সালে তিন কমিশনারসহ ১৪ জনের লোকবল অনুমোদন করা হয়। কিন্তু ১১ কর্মকর্তার কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তবে প্রায় ২০ জনের স্টাফ টিম আছে। তারা সবাই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর। স্থায়ী কমিশনের মূল শক্তি হলো প্রেষণে আসা কর্মকর্তারা। এখন আছেন ছয় বিচারক। সেখানেও কোনো নিয়মনীতি নেই। তাঁদের আসা-যাওয়া চলে। ওই ছয় বিচারকের দুজন প্রশাসন দেখেন। চারজন গবেষণায়। কাজের গভীরে যেতে না যেতেই তাঁদের বদলির সময় হয়। কেউ তদবির করে আরও আকর্ষণীয় কর্মস্থল জুটিয়ে নেন। ব্যাপক ও নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা ছাড়া কোনো সুষ্ঠু আইন তৈরি হতে পারে না। এরপর আসে পাকা হাতে খসড়া তৈরির পালা। এ কাজেরও লোক নেই। এসবে কী প্রমাণিত হয়? গত ১৮ অক্টোবর আইন মন্ত্রণালয়ে সমন দিয়ে খোঁজখবর নেওয়ার মধ্যে কোন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে?
আইন কমিশনকে ইঁদুরের অভয়াশ্রম রাখতে যাঁরা অভ্যস্ত, তাঁরাই কিন্তু ‘হু হু করে আইন পাস’ করেন। এই হু হু মানে হুজুর হুজুর। এই হু হু মানে হাঁ-জয়যুক্ত হয়েছে। হুজুর হুজুর সংস্কৃতিতে পদত্যাগ শব্দটি হারিয়ে গিয়েছিল। স্বেচ্ছায় বিচারাঙ্গনের কেউ পদত্যাগ করেন, তা-ও আমরা ভুলতে বসেছিলাম। বিচারপতি আবদুর রশীদ অন্তত সে জন্য ধন্যবাদ পেতেই পারেন। তবে তিনিও প্রথাবন্দী থাকলেন। পদত্যাগপত্রে ত্যাগের কারণ লেখেননি। তবে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘কাজ করতে পারিনি বলে চলে এসেছি।’ আইনমন্ত্রী মন্তব্য করেননি। বলেছেন, ‘তিনি কোনো কারণ দেখেন না।’ গতকালই নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেলেন ড. এম শাহ আলম। তাঁকে অভিনন্দন। তিনিও একদিন যাবেন। মন্ত্রিত্বও ঠুনকো। কিন্তু তাঁরা কি অদৃশ্য ইঁদুর তাড়াতে পারবেন? সরকার (হাইকমান্ড) না চাইলে কী হয়, তার জ্বলন্ত উদাহরণ দুদক, তথ্য ও মানবাধিকার কমিশনের মতো ‘স্বাধীন’ সংস্থা। এরা সবাই জীবন্মৃত। তাদের জেরবার থাকার কারণগুলো একই সূত্রে গাঁথা। সেখানে মন্ত্রী ও কমিশনপ্রধানদের তেমন জায়গা নেই।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments