গণমাধ্যম-গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ by গোলাম মুরশিদ

এবার যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে, তাকে জনগণের রায় বলে আখ্যা দিলে অন্যায় হয় না। অন্তত এই নির্বাচনের মাধ্যমে আগেকার বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার—উভয়ের প্রতি জনগণের যে সমর্থন নেই, তা তাঁরা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।


এবং ক্ষমতায় আসার পর বর্তমান সরকার অনেকগুলো ইতিবাচক পদক্ষেপও নিয়েছে। সেটা বিদ্যুতের অভাব দূর করার ব্যাপারেই হোক, কিংবা যানজট নিরসন করার ব্যাপারেই হোক, এবং তাতে সফলতা যত কমই এসে থাকুক। দ্রব্যমূল্য সহনশীলতার মধ্যে থেকেছে, কৃষি, শিক্ষা, খাদ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে সংস্কার ও উন্নতির চেষ্টা লক্ষ করা গেছে। বিশেষ কোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির বড় কোনো অভিযোগ ওঠেনি। ভারতের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয় দিয়ে কয়েক দশক ধরে যে কৃত্রিম বিরোধ জিইয়ে রাখার প্রয়াস দেখা গেছে, তারও সমাধান করতে চেষ্টা করেছে। ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভর্তির দরখাস্ত, টেন্ডারের ফরম ও আয়কর দাখিল করার প্রক্রিয়া সহজ করেছে—কোনো কেনো ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। এগুলো সবই ইতিবাচক পদক্ষেপ।
এসব সফলতা এবং ইতিবাচক পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রলীগ-যুবলীগ ক্ষমতাসীন দলের ঘাড়ে বিষফোড়ার মতো। আইন হাতে তুলে নিয়ে তারা যেসব কীর্তি দেখাচ্ছে, তা স্বৈরাচারী শাসনে দেখা যায়, গণতন্ত্রে নয়। এমনকি আওয়ামী লীগের কোনো কোনো সাংসদ যে রকমের আচরণ দেখাচ্ছেন, তা থেকেও সরকার সত্যিকার গণতান্ত্রিক কি না, সে প্রশ্ন সাধারণ মানুষের কাছে দেখা দিতেই পারে। তাঁদের কেউ সরকারি কর্মকর্তাদের নির্যাতন করছেন, কেউ সাংবাদিকদের শাসাচ্ছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্মচারীদেরও থাপড় দিতে কুণ্ঠিত হচ্ছেন না। তাঁরা সরকারের সম্পদ নন, সরকারের দায়।
এমনকি বহু বছর পর কাউন্সিল শেষে সবগুলো কমিটি গঠনের যে দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া হলো, তাকেও ঠিক গণতান্ত্রিক বলা কঠিন। গণতন্ত্র পিরামিডের মতো নিচ থেকে ওপরের দিকে ওঠে, ওপর থেকে নিচের দিকে নেমে আসে না।
আর একটা কথা, যেকোনো গণতান্ত্রিক সরকারেরই মনে রাখা উচিত, তা হলো: সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেই সে সরকার জনগণের সরকারে অথবা জনগণের সেবা করার সরকারে পরিণত হয় না। পার্লামেন্টে হিটলারেরও সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। সাদ্দাম হোসেনেরও ছিল। এমনকি টনি ব্লেয়ার আর জর্জ বুশেরও ছিল। কিন্তু তাঁরা যেসব অপকীর্তি করেছেন, তা জনগণের পক্ষে যায়নি। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও ব্লেয়ারকে মেয়াদ ফুরোনোর আগেই ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়েছিল। এমনকি তিনি এমন দায় রেখে গেছেন, যার ফলে পরের নির্বাচনে শ্রমিক দলই শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। এগুলোকে ইতিহাসের শিক্ষা বলা যেতে পারে। সামনে আবার নির্বাচন হবে—এ কথাটা আওয়ামী লীগ সরকারেরও মনে রাখা উচিত।
আসলে গণতান্ত্রিক সরকারের ক্ষমতা কোনো একনায়কত্বের চেয়ে কম নয়। তবে, একজন একনায়ক জনমতকে উপেক্ষা করতে পারেন, কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকার পারে না। যদি পারে অথবা যদি তা করতে চেষ্টা করে, তা হলে তার চরিত্র আর গণতান্ত্রিক থাকে না। ক্ষমতার একটা নেশা আছে, আরও ক্ষমতা লাভের লোভ। অতিরিক্ত ক্ষমতা তাই অতিরিক্ত পরিমাণে বিকৃতি লাভ করে। সে তখন স্বাধিকারপ্রমত্ত হয়, অর্থাৎ নিজের অধিকারে নিজেই প্রমত্ত হয়ে ওঠে। একবার সে পথে পা বাড়ালে সত্যিই সাময়িক কালের জন্য ক্ষমতার দাপট দেখানো সম্ভব হয়, কিন্তু পরিণতিতে তার পতন অবশ্যম্ভাবী। সে জন্যই গণতন্ত্র যাতে বিকৃত না হয়, তার জন্য কতগুলো রক্ষাকবচ থাকে।
প্রথমেই থাকে পার্লামেন্ট। সেখানে বিরোধী দল অথবা দলগুলো সরকারের পদক্ষেপের সমালোচনা করতে পারে। সে সমালোচনা যুক্তিপূর্ণ হলে সরকারের উচিত তার পরিপ্রেক্ষিতে হয় সে পদক্ষেপ আদৌ না নেওয়া; নয়তো পদক্ষেপে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে নেওয়া। কিন্তু আমাদের দেশের এই রক্ষাকবচটি বর্তমানে নেই। কারণ, বিরোধী দল সংসদের অধিবেশনে যোগই দিচ্ছে না। যোগ না দিয়ে সাংসদের ভাতা নেওয়া উচিত কি না, সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়; তার থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—১. তাঁরা সংসদে যোগ দিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে জনগণের ইচ্ছাকে তুলে ধরছেন না, ২. সংসদে তাঁরা কি কেবল সরকারের সমালোচনা করার খাতিরেই সমালোচনা করছেন, নাকি সরকারের যে কাজটা প্রশংসার যোগ্য তার প্রশংসা করছেন এবং যে কাজটা সমালোচনার যোগ্য তার সমালোচনা করছেন? বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করলে সেটা উল্টো ফল দেয়। তাকে গণতান্ত্রিক স্পিরিট বলে না।
বিরোধী দলের সদস্যসংখ্যা কজন এবং সেই অনুসারে তাঁদের বসার আসন নির্ধারণ করার যে বিষয়টি এবারের সংসদের ঘোরতর হইচই সৃষ্টি করেছে, সেটা নিতান্ত তুচ্ছ এবং ছেলেমানুষি। ইংরেজিতে বলে সিলি। তাঁরা যদি প্রথম সারিতে বেশির ভাগ বসেন, তা হলেও সংসদে তাঁদের গৌরব বৃদ্ধি পাবে না অথবা তাঁদের সমালোচনা বেশি জোরালো হবে না। আমার ধারণা, আওয়ামী লীগের যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে, তাতে তাদের পক্ষে এ ব্যাপারে আর একটু উদার হলে শোভন হতো। এ ক্ষেত্রে আগের পার্লামেন্টে বিএনপি কী করেছিল, সে ইতিহাস বিচার না করলেও চলত।
মোট কথা, বিরোধী দলের অভাবে গণতন্ত্রকে রক্ষা করার বিষয়ে সংসদের যে রক্ষাকবচের ভূমিকা, তা ব্যর্থ হয়েছে—কেবল এবার নয়, আগের কয়েকবারের সংসদেও।
গণতন্ত্রের দ্বিতীয় রক্ষাকবচ দেশের প্রধান—রাষ্ট্রপতি। কিন্তু রাষ্ট্রপতি যদি জনগণের নির্বাচিত না হয়ে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নির্বাচিত হন, তা হলে এ রক্ষাকবচটিও ব্যর্থ হয়। কারণ, সরকারি দল যা সংসদে পাস করবে, তিনি তাকে প্রায় অন্ধভাবে অনুমোদন করবেন, অথবা করতে বাধ্য হবেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা-ই ঘটেছে। আমেরিকায় তা ঘটে না। সেখানে প্রেসিডেন্ট অনুমোদন না দিলে আইন পাস হয় না; আবার প্রেসিডেন্ট আদেশ দিলে কংগ্রেসে তা অনুমোদিত না হলে, তা-ও আইনে পরিণত হয় না। বাংলাদেশের আগেকার একাধিক রাষ্ট্রপতি ব্যক্তিগত বিবেচনা কাজে লাগাতে গেলে তাঁদের অবশ্যম্ভাবী পতন হয়েছিল।
গণতন্ত্রের তৃতীয় রক্ষাকবচ হলো বিচার বিভাগ এবং এই বিচার বিভাগকে হতে হবে স্বাধীন। একটা দেশে সত্যিকারের স্বাধীন বিচারব্যবস্থা থাকলে, সরকার কোনো বেআইনি কাজ করলে তার বিরুদ্ধে রায় দিতে পারে। এবং সরকারকে সে রায়ও মেনে নিতে হবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় ৪০ বছর পরে তত্ত্বগতভাবে বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু সে কি সত্যি স্বাধীন? এ নিয়ে দেশের বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবীই একমত নন। সীমিত স্বাধীনতা নিয়ে সত্যিকারের স্বাধীন বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় না। একটা শক্তিশালী এবং সত্যিকারের স্বাধীন বিচারব্যবস্থাই পারে গণতন্ত্রের রক্ষাকবচের ভূমিকা পালন করতে। এ পরিপ্রেক্ষিতেও বাংলাদেশের গণতন্ত্র অসহায় অনাথ বালকের মতো।
গণতন্ত্রের চতুর্থ রক্ষাকবচ হলো সংবাদমাধ্যম। সংবাদমাধ্যমের কাজ হলো জনমতের প্রতিফলন ঘটানো। এই সংবাদমাধ্যম নিজে যত স্বাধীন হবে, তার পক্ষে ততই স্বাধীন জনমত প্রকাশ করা সম্ভব হবে। প্রতিটি পত্রপত্রিকা অথবা বেতার কিংবা টিভি চ্যানেলের নিজস্ব একটা নীতি আছে। কেউ এ দল সমর্থন করে, কেউ বা অন্য দল সমর্থন করে। কিন্তু এই পছন্দ-অপছন্দ থাকলেও সংবাদমাধ্যমের একধরনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হয় অথবা নিরপেক্ষতা বজায় রাখার ভান করতে হয়। বছর পনেরো আগে পর্যন্ত ব্রিটেনের প্রায় প্রতিটি দৈনিক পত্রিকাই ছিল ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল দলের সমর্থক। ব্যতিক্রম ছিল গার্ডিয়ান। এই পত্রিকা লেবার দলের অধিকাংশ নীতি সমর্থন করত।
আমাদের দেশের পত্রপত্রিকার সঙ্গে গার্ডিয়ান পত্রিকার পার্থক্য এই যে বিরোধী পত্রিকাগুলোও যেখানে সরকার বদল হলে সরকারি সুর বাজাতে শুরু করে, গার্ডিয়ান তার বদলে লেবার দলের যেসব পদক্ষেপ সমর্থন করতে পারল না, সেগুলোর তীব্র সমালোচনা করতে শুরু করল। গার্ডিয়ান প্রমাণ করল, সে কোনো দলের পত্রিকা নয়, সে নিজের স্বাধীন মতবাদই প্রচার করে।
বিবিসিও অনুরূপ প্রতিষ্ঠান। সে কোনো সংবাদ দেওয়ার সময় কোনো এক পক্ষের মতামত অথবা দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরে না, বরং উভয় পক্ষের বক্তব্যই প্রকাশ করতে চেষ্টা করে। কেবল তা-ই নয়, শেষে নিজেদের সাংবাদিকদের স্বাধীন মন্তব্যও জুড়ে দিতে চেষ্টা করে।
বাংলাদেশে পত্রিকার সংখ্যা অনেক, পাঠকসংখ্যা সে অনুপাতে কম। অনেক পত্রিকার ঠিকানা আছে, কিন্তু সেখান থেকে যা প্রকাশিত হয়, তাকে রীতিমতো দৈনিক পত্রিকা বলা যায় না। নিতান্ত সরকারি বিজ্ঞাপনের লোভে এসব পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এসব পত্রিকার নিজস্ব কোনো মতবাদ নেই, কোনো জনমতও এসব পত্রিকা প্রকাশ করতে পারে না। আবার কোনো কোনো বড় পত্রিকা আছে, যারা সরকারের পক্ষে অথবা বিপক্ষে মতামত প্রকাশ করে সরকারের অনুগ্রহ আদায় করতে চায়।
সংবাদমাধ্যমকে মার্কিন দেশে বলা হয় ফোর্থ এস্টেট। বাংলাদেশের সে রকম কোনো ফোর্থ এস্টেট তৈরি হয়নি। সুতরাং জনগণ যা-ই ভাবুন না কেন, সেটা সরকার হয় জানে না, নয়তো জানার প্রয়োজন বোধ করে না। ফলে কোনো পত্রিকা কোনো সরকারি নীতি অথবা সরকারি দলের লড়াকু চেলাদের সমালোচনা করলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন না দেওয়া, পত্রিকার সাংবাদিকদের ধরে মারধর করা, ভয়ভীতি দেখানো ইত্যাদি নানা উপায় অবলম্বন করা হয়। সম্প্রতি একটি পত্রিকা নিয়ে জাতীয় সংসদে পর্যন্ত আলোচনা হয়েছে। এটা গণতন্ত্রের শেষ রক্ষাকবচের জন্য ভালো লক্ষণ নয়।
বাল্য বয়সে কোনো প্রতিকারহীন রোগে ধরলে সে শিশুর গলায় সাধারণত তাবিজ-কবচ ইত্যাদি টানিয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের শিশু-গণতন্ত্র সত্যি দুর্বল এবং অসহায়। তাকে বাঁচানোর জন্য চারটি কবচই প্রয়োজন। বিশেষ করে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করলে সরকার এই আত্মতৃপ্তি নিয়ে বোকার স্বর্গে বাস করতে পারে যে তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা হচ্ছে না। তারা বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু শেষ ভয়ংকর দিনটি যখন ঘনিয়ে আসবে, তখন আর সেই লোকসান কাটিয়ে ওঠার কোনো সময় অথবা সুযোগ থাকবে না। সরকারের নিজের স্বার্থেই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখা দরকার।
আওয়ামী লীগ সরকার এসেছে বেশির ভাগ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করতে পারবে—এই ভরসা নিয়ে। স্বাধীনতার পক্ষের দল হিসেবে। দিন বদল করতে। কিন্তু তার বদলে যদি সে তার শক্তির অপব্যয় করে ক্ষুদ্রতার আশ্রয় নেয়, প্রতিশোধ নেওয়ার রাজনীতি করে, তা হলে দিনবদল হবে না। আগেকার দলবাজির নমুনাই আরও মজবুত হবে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েও সে গণতন্ত্রকে পাকাপোক্ত করতে পারবে না। বিরোধী দল তো এরই মধ্যে হুমকি দিতে শুরু করেছে যে সামনের নির্বাচনে জয়ী হলে তারা এবারের নেতাদের দেখে নেবে। সত্য-মিথ্যা মামলা করবে। হয়রানি-নাজেহাল করবে। সেটা কি গণতন্ত্রের জন্য সুখকর হবে?
গোলাম মুরশিদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক।
ghulammurshid@aol.com

No comments

Powered by Blogger.