সুশাসন-দুর্নীতি প্রতিরোধে অগ্রগতি: জনগণের প্রত্যাশা by ইফতেখারুজ্জামান
দুর্নীতি একটি বিশ্বজনীন সমস্যা। পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে দুর্নীতি হয় না। মানবসভ্যতার বিবর্তনে এমন কোনো পর্যায় হয়তো পাওয়া যাবে না, যেখানে দুর্নীতি ছিল না বলা যাবে। দুর্নীতি সব কালে, সব দেশেই ছিল—যদিও এর বিস্তৃতি, গভীরতা ও প্রভাবে তারতম্য রয়েছে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও রয়েছে সাফল্য-ব্যর্থতার প্রকারভেদ।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বার্ষিক দুর্নীতির ধারণাসূচক (সিপিআই), যার মাধ্যমে পৃথিবীর প্রায় ১৮০টি দেশের দুর্নীতির মাপকাঠিতে তুলনামূলক অবস্থান নিরূপণ করা হয়। তাতে উন্নত বিশ্বের যেসব দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা, গভীরতা ও প্রভাব সবচেয়ে কম বলে চিহ্নিত হয়ে থাকে, তারাও এখন পর্যন্ত সূচকের ০-১০-এর স্কেলে সর্বোচ্চ ৯.৪-এর ঊর্ধ্বে স্কোর করেনি। অর্থাৎ দুর্নীতি কেবল উন্নয়নশীল দেশগুলোর মনোপলি বা একচেটিয়া সমস্যা নয়, যদিও এ কথা নিরঙ্কুশভাবেই সত্যি যে উন্নয়নশীল দেশগুলো দুর্নীতির প্রকোপ তুলনামূলকভাবে বেশি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দুর্নীতি উন্নয়ন, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও সমাজ পরিবর্তনের পথে শুধু অন্তরায় নয়, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসনসহ আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণের প্রতিবন্ধক শক্তিগুলোর অন্যতম ব্যাধি এই দুর্নীতি।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, দুর্নীতি বাংলাদেশে সব সময় ছিল, যদিও এর ব্যাপকতা ও প্রভাব পরিমাপের জন্য তেমন কোনো মাপকাঠি খুব একটা ছিল না। ২০০১ সালে বাংলাদেশ দুর্নীতির ধারণা সূচকের তালিকার শীর্ষস্থান পেল। তবে পর পর আরও চারবার অর্থাৎ ২০০৫ পর্যন্ত এই শীর্ষস্থানের বোঝা ও গ্লানি আমাদের বইতে হয়েছে। পরে ক্রমান্বয়ে ২০০৬-এ তৃতীয়, ২০০৭-এ সপ্তম, ২০০৮-এ দশম, ২০০৯-এ ত্রয়োদশ এবং সর্বশেষ ২০১০-এ দ্বাদশ স্থানে বাংলাদেশের অবস্থান নিরূপিত হয়।
তালিকায় অবস্থানের ক্ষেত্রে যতটুকু পরিবর্তন হয়েছে, তার তুলনায় আরও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সূচিত হয়েছে স্কোরের মাপকাঠিতে। ২০০১ সালে প্রাপ্ত ০.৪ থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে ২০০৯-এ বাংলাদেশ এই সূচকের ০-১০-এর স্কেলে ২.৪ অর্জন করে। ২০০৮-এ প্রাপ্ত ২.১-এর তুলনায় এই অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। ২০০৯ সালে আর মাত্র আটটি দেশে অনুরূপ অগ্রগতি অর্জিত হয়। দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল একমাত্র দেশ, যেখানে গত বছরের সূচকে ইতিবাচক অর্জন পরিলক্ষিত হয়।
এই অর্জন অবশ্যই সুসংবাদ ছিল, যদিও সূচক অনুযায়ী ৩ বা তার কম স্কোরপ্রাপ্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশে এখনো দুর্নীতির প্রভাব ব্যাপক ও গভীর হিসেবেই বিবেচিত। গত বছরের এই অগ্রগতি একদিকে যেমন আমাদের উৎসাহিত করেছিল, তেমনি এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে কি না, এই প্রশ্ন আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে। বাস্তবে তা-ই হলো ২০০৯-এর অগ্রগতির ধারা, যা ২০১০-এ অব্যাহত থাকল না—স্কোর গতবারের মতোই ২.৪-এ অপরিবর্তিত রইল।
২০০৮-এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে নির্বাচিত বর্তমান সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অঙ্গীকার এবং সাম্প্রতিক কালের বেশ কিছু প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার-পদক্ষেপ অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি এ সূচকে ইতিবাচকভাবে মূল্যায়িত হয়েছিল। সে কারণে ২০০৯-এর সূচকটি প্রকাশকালে আমরা এই মর্মে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম যে বাংলাদেশের এই অগ্রগতি স্থায়ী হওয়া না-হওয়া এবং আরও অগ্রগতি হবে কি না, তা নির্ভর করছে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার কার্যকর বাস্তবায়নের ওপর।
আওয়ামী লীগের ইশতেহারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের বিষয়গুলোর মধ্যে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ আর যুদ্ধাপরাধের বিচারের পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় ও সুনির্দিষ্ট প্রত্যয় ব্যক্ত হয়। কমপক্ষে এক ডজন সুস্পষ্ট নীতিমালার উল্লেখ পাওয়া যায় আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে, যার বাস্তবায়ন বাংলাদেশে দুর্নীতিকে কার্যকর ও স্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য অপরিহার্য। এর মধ্যে ছিল: ক) সরকারকে দায়বদ্ধ করতে জাতীয় সংসদ কার্যকর করা; খ) প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, সাংসদ ও তাঁদের পরিবার-পরিজনসহ ক্ষমতাবানদের সম্পদের বার্ষিক বিবরণ প্রকাশ; গ) বিচার বিভাগের নিরেট স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা ও আইনের শাসন; ঘ) দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিতকরণ; ঙ) প্রশাসনকে জনমুখী ও দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা; চ) নিয়োগ ও পদোন্নতিতে মেধা ও যোগ্যতাকে মাপকাঠি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা ও পাশাপাশি কর্মকর্তাদের একচ্ছত্র ক্ষমতার ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করা; ছ) ই-গর্ভনেন্স বা প্রযুক্তিনির্ভর সুশাসনব্যবস্থা বাস্তবায়ন; জ) পুলিশ ও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা; ঝ) ঘুষ ও প্রশাসনিক জটিলতা দূর করে ব্যবসা ও শিল্প খাতে প্রতিযোগিতানির্ভর ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা; ঞ) অনুপার্জিত আয় ও কালো টাকা, ঋণখেলাপি, টেন্ডারবাজি ও পেশিশক্তির প্রতিরোধ ও নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা; ট) কার্যকর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা; ঠ) ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা; ড) জনগণের তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করা ও ঢ) প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে নাগরিক সনদ চালু করা ও ব্যাপক কম্পিউটারাইজড করা।
সরকার গঠনের পর সর্বোচ্চ পর্যায়সহ সার্বিকভাবে প্রতিশ্রুতিগুলো মোটামুটি ধারাবাহিকভাবে পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। তবে দুর্নীতি প্রতিরোধে সমন্বিত বাস্তবসম্মত জাতীয় কৌশল প্রণয়নের কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে রচিত হয়েছে প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতার আশঙ্কা। দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের কতিপয় সংশোধনীর প্রস্তাব অনুমোদন করে মন্ত্রিপরিষদ কমিশনের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠার পথে বড় ধরনের নৈরাশ্যজনক সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল। টিআইবিসহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি স্থগিত রয়েছে। তবে বিষয়টির সুরাহা হয়নি, যা উদ্বেগের কারণ।
প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, তাঁদের পরিবার-পরিজনসহ ক্ষমতাবানদের সম্পদের বিবরণ প্রকাশের অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হয়নি। এ ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীর ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত তাঁর অন্য সহকর্মীরা কবে অনুসরণ করবেন, তার কোনো ইঙ্গিত নেই। জাতীয় বাজেটে অব্যাহতভাবে বিভিন্ন কৌশলে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট নির্বাচনী অঙ্গীকার থেকে সরে এসে যুক্তিহীনভাবে কর ন্যায়পাল পদটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। দুর্নীতি প্রতিরোধে বিশেষ সহায়ক স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়নের সম্ভাবনাকে প্রতিহত করে যেভাবে সাংসদদের হাতে স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তুলে দেওয়া হলো, তা সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারের সঙ্গে মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। একইভাবে প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা’ নিষ্পত্তিকরণের উদ্যোগও ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
এরূপ বিতর্কিত পদক্ষেপের পাশাপাশি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দুর্নীতি প্রতিরোধের পক্ষে অব্যাহত অঙ্গীকার অবশ্যই আশার উদ্রেক করে। প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার জনপ্রশাসনে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেছেন সততার সঙ্গে জনগণের সেবকের মনোবৃত্তি নিয়ে কাজ করতে। নির্বাচনের পর সংসদের ভেতরে ও বাইরে প্রায় প্রতিটি বক্তৃতায় তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেছেন।
তথ্য অধিকার আইনের মতো দুর্নীতি প্রতিরোধে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টিকারী আইনটি সংসদে অনুমোদনের মাধ্যমে সরকার জনগণের প্রতি অঙ্গীকার পূরণের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সম্পূরক অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি নতুন আইন তথ্য প্রদানকারীর সুরক্ষা আইন সংসদে উপস্থাপিত হয়েছে, যা আরও উৎসাহব্যঞ্জক। এসব আইনের সুফল জনগণের কাছে পৌঁছানোর লক্ষ্যে ও গোপনীয়তার সংস্কৃতি থেকে উন্মুক্ততার সংস্কৃতিতে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট কৌশল প্রণয়ন।
ভূমিদস্যুতা প্রতিরোধে ড্যাপ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ ও পরে এ-সংক্রান্ত নতুন আইন সংসদে গৃহীত হওয়া অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে, অন্যদিকে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বা তাঁদের সমর্থনপুষ্ট ব্যক্তিরা সাম্প্রতিক কালে যেভাবে স্থানীয় পর্যায়ে টেন্ডারবাজি, নদী-বনাঞ্চল-ভূমি দখল, টোলবাজিসহ আইনের শাসন পরিপন্থী কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হচ্ছেন, তাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে অপরিহার্য প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ক্রমান্বয়ে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হওয়ার আশঙ্কা বেড়েই চলেছে।
সরকারি ক্রয় খাতে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী সম্প্রতি প্রবর্তিত নীতিমালার সংস্কার কোনো অবস্থায়ই সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধক পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক হবে না। বিশেষ করে টেলিযোগাযোগ আইন, ২০১০ এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) বিল, ২০১০ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় নির্বাচনী অঙ্গীকারের পরিপন্থী।
দুর্নীতিকে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দুর্নীতি, তা যে পর্যায়েই ঘটুক না কেন, কারও প্রতি কোনো ধরনের ভয় বা করুণা না করে দলীয় বা রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে থেকে তার বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্নীতির অভিযোগ ও তার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়গুলো সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।
দুর্নীতির বিচার হতে হবে, তবে তা যেন সম্পূর্ণ স্বচ্ছ বিচার-প্রক্রিয়ায় হয়, আইনের সুষ্ঠু এবং কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে হয়। বিশেষ করে আইন প্রয়োগে আদালতকে কোনো অবস্থাতেই প্রভাবিত না করা দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত। দুর্নীতিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে তখনই সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে, যখন বিচার-প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ সম্ভব হবে। অন্যদিকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা তখনই সুফল আনবে, যখন এই বিভাগে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে থেকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা, পেশাগত উৎকর্ষ ও সততার সঙ্গে কার্য পরিচালনার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।
জাতীয় সংসদ কার্যকর করা যেকোনো সংসদীয় গণতন্ত্রে দুর্নীতিবিরোধী প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি সৃষ্টির জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নবম সংসদের প্রথম অধিবেশনেই সংসদীয় কমিটিগুলো গঠিত হয়েছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে। বেশ কিছু কমিটি তুলনামূলকভাবে সক্রিয়ভাবে কার্যক্রম পরিচালনায় হাত দিয়েছিল। তবে অনেক ক্ষেত্রেই সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব কমিটির কার্যক্রম ও কার্যকারিতাকে এরই মধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
দুর্নীতি প্রতিরোধে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন জনপ্রশাসন তথা সরকারি কর্মকর্তারা। পৃথিবীর যেসব দেশে সাফল্যের সঙ্গে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে, সেসব দেশে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, যোগ্যতাসম্পন্ন প্রশাসনকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি প্রভৃতি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব দূর করা অপরিহার্য। সরকার পরিবর্তনের পর এ ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, তাতে উৎসাহিত হওয়ার খুব বেশি সুযোগ নেই।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত ব্যক্তি কর্তৃক স্বাস্থ্য খাতে সরকারি পদে নিয়োগে শুধু দলীয় সমর্থনপুষ্ট কর্মীদের নিয়োগের ঘোষণা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে পাবনায় সরকারি পদে নিয়োগ পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট নৈরাজ্যের দৃষ্টান্ত সরকারের জন্য সুখকর ভাবা কঠিন। অন্যদিকে জনপ্রশাসনে বেতন-ভাতার যথার্থতা ও পর্যাপ্ততা নিশ্চিত না করে প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করার প্রত্যাশা করাও অমূলক। যেসব কারণে প্রশাসনে দুর্নীতি হয়, তার অন্যতম হচ্ছে বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধার বাস্তবতাবর্জিত চিত্র। বেতন কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সরকারি খাতের বেতনকাঠামোর কিছুটা পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, এটা আশাব্যঞ্জক। তবে শুধু বেতন বৃদ্ধি করে প্রশাসনে স্বচ্ছতার প্রণোদনা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে, এটা ভাবা অমূলক। সরকারি খাতের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে, বিভাগে ও মন্ত্রণালয়ে প্রতিষ্ঠা করতে হবে নির্ভেজাল প্রক্রিয়ার বাস্তবায়নযোগ্য নৈতিক আচরণবিধি, যার স্খলন ঘটলে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রণোদনার সমন্বয়েই কেবল প্রশাসনে কার্যকর পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব।
দুর্নীতি প্রতিরোধে বেসরকারি খাতের ভূমিকাও অপরিসীম। সরকারি খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধ কখনোই সম্ভব হবে না, যদি বেসরকারি খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব না হয়। এ ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি, বহুজাতিকসহ বেসরকারি খাতে কর্মরত সব প্রতিষ্ঠানেই সততা, স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য।
দুর্নীতি প্রতিরোধে একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে যেকোনো দেশের গণমাধ্যম, যার সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ অব্যাহত রাখতে হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধে অন্যতম পূর্বশর্ত তথ্যপ্রবাহের অবাধ স্বাধীনতা। তথ্যের স্বাধীনতা একদিকে যেমন গণমাধ্যমের জন্য অপরিহার্য, অন্যদিকে অবাধ তথ্যপ্রবাহই নিশ্চিত করতে পারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সংস্কৃতি, যা ব্যতিরেকে কোনো দুর্নীতিবিরোধী অভিযানই পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি, বিশেষ করে সমালোচনা সইবার সৎসাহসের অভাবের প্রতিফলন ঘটিয়ে গণমাধ্যমকে ঢালাওভাবে আক্রমণ করার দৃষ্টান্ত কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য সহায়ক হবে না।
বাংলাদেশে দুর্নীতির কার্যকর ও স্থায়ী সমাধান স্বল্প মেয়াদে বা শুধু ক্ষেত্রবিশেষের ওপর নির্ভর করে অর্জন করা অসম্ভব। প্রয়োজন সুচিন্তিত ও বহুমুখী কৌশল এবং তার বাস্তবায়নে সদিচ্ছার সুনির্দিষ্ট দৃষ্টান্ত। এর অভাবে গগনচুম্বী প্রত্যাশা নিয়ে যাঁরা দুর্নীতি প্রতিরোধ ও পরিবর্তনের অঙ্গীকারের পক্ষে রায় দিয়েছেন, একইভাবে তাঁরা আবার শিগগিরই নিরাশ হবেন। তবে সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এটি চাইবেন না—জনগণ এ প্রত্যাশাই করে।
ইফতেখারুজ্জামান: নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, দুর্নীতি বাংলাদেশে সব সময় ছিল, যদিও এর ব্যাপকতা ও প্রভাব পরিমাপের জন্য তেমন কোনো মাপকাঠি খুব একটা ছিল না। ২০০১ সালে বাংলাদেশ দুর্নীতির ধারণা সূচকের তালিকার শীর্ষস্থান পেল। তবে পর পর আরও চারবার অর্থাৎ ২০০৫ পর্যন্ত এই শীর্ষস্থানের বোঝা ও গ্লানি আমাদের বইতে হয়েছে। পরে ক্রমান্বয়ে ২০০৬-এ তৃতীয়, ২০০৭-এ সপ্তম, ২০০৮-এ দশম, ২০০৯-এ ত্রয়োদশ এবং সর্বশেষ ২০১০-এ দ্বাদশ স্থানে বাংলাদেশের অবস্থান নিরূপিত হয়।
তালিকায় অবস্থানের ক্ষেত্রে যতটুকু পরিবর্তন হয়েছে, তার তুলনায় আরও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সূচিত হয়েছে স্কোরের মাপকাঠিতে। ২০০১ সালে প্রাপ্ত ০.৪ থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে ২০০৯-এ বাংলাদেশ এই সূচকের ০-১০-এর স্কেলে ২.৪ অর্জন করে। ২০০৮-এ প্রাপ্ত ২.১-এর তুলনায় এই অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। ২০০৯ সালে আর মাত্র আটটি দেশে অনুরূপ অগ্রগতি অর্জিত হয়। দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল একমাত্র দেশ, যেখানে গত বছরের সূচকে ইতিবাচক অর্জন পরিলক্ষিত হয়।
এই অর্জন অবশ্যই সুসংবাদ ছিল, যদিও সূচক অনুযায়ী ৩ বা তার কম স্কোরপ্রাপ্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশে এখনো দুর্নীতির প্রভাব ব্যাপক ও গভীর হিসেবেই বিবেচিত। গত বছরের এই অগ্রগতি একদিকে যেমন আমাদের উৎসাহিত করেছিল, তেমনি এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে কি না, এই প্রশ্ন আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে। বাস্তবে তা-ই হলো ২০০৯-এর অগ্রগতির ধারা, যা ২০১০-এ অব্যাহত থাকল না—স্কোর গতবারের মতোই ২.৪-এ অপরিবর্তিত রইল।
২০০৮-এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে নির্বাচিত বর্তমান সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অঙ্গীকার এবং সাম্প্রতিক কালের বেশ কিছু প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার-পদক্ষেপ অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি এ সূচকে ইতিবাচকভাবে মূল্যায়িত হয়েছিল। সে কারণে ২০০৯-এর সূচকটি প্রকাশকালে আমরা এই মর্মে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম যে বাংলাদেশের এই অগ্রগতি স্থায়ী হওয়া না-হওয়া এবং আরও অগ্রগতি হবে কি না, তা নির্ভর করছে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার কার্যকর বাস্তবায়নের ওপর।
আওয়ামী লীগের ইশতেহারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের বিষয়গুলোর মধ্যে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ আর যুদ্ধাপরাধের বিচারের পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় ও সুনির্দিষ্ট প্রত্যয় ব্যক্ত হয়। কমপক্ষে এক ডজন সুস্পষ্ট নীতিমালার উল্লেখ পাওয়া যায় আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে, যার বাস্তবায়ন বাংলাদেশে দুর্নীতিকে কার্যকর ও স্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য অপরিহার্য। এর মধ্যে ছিল: ক) সরকারকে দায়বদ্ধ করতে জাতীয় সংসদ কার্যকর করা; খ) প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, সাংসদ ও তাঁদের পরিবার-পরিজনসহ ক্ষমতাবানদের সম্পদের বার্ষিক বিবরণ প্রকাশ; গ) বিচার বিভাগের নিরেট স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা ও আইনের শাসন; ঘ) দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিতকরণ; ঙ) প্রশাসনকে জনমুখী ও দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা; চ) নিয়োগ ও পদোন্নতিতে মেধা ও যোগ্যতাকে মাপকাঠি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা ও পাশাপাশি কর্মকর্তাদের একচ্ছত্র ক্ষমতার ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করা; ছ) ই-গর্ভনেন্স বা প্রযুক্তিনির্ভর সুশাসনব্যবস্থা বাস্তবায়ন; জ) পুলিশ ও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা; ঝ) ঘুষ ও প্রশাসনিক জটিলতা দূর করে ব্যবসা ও শিল্প খাতে প্রতিযোগিতানির্ভর ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা; ঞ) অনুপার্জিত আয় ও কালো টাকা, ঋণখেলাপি, টেন্ডারবাজি ও পেশিশক্তির প্রতিরোধ ও নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা; ট) কার্যকর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা; ঠ) ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা; ড) জনগণের তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করা ও ঢ) প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে নাগরিক সনদ চালু করা ও ব্যাপক কম্পিউটারাইজড করা।
সরকার গঠনের পর সর্বোচ্চ পর্যায়সহ সার্বিকভাবে প্রতিশ্রুতিগুলো মোটামুটি ধারাবাহিকভাবে পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। তবে দুর্নীতি প্রতিরোধে সমন্বিত বাস্তবসম্মত জাতীয় কৌশল প্রণয়নের কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে রচিত হয়েছে প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতার আশঙ্কা। দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের কতিপয় সংশোধনীর প্রস্তাব অনুমোদন করে মন্ত্রিপরিষদ কমিশনের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠার পথে বড় ধরনের নৈরাশ্যজনক সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল। টিআইবিসহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি স্থগিত রয়েছে। তবে বিষয়টির সুরাহা হয়নি, যা উদ্বেগের কারণ।
প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, তাঁদের পরিবার-পরিজনসহ ক্ষমতাবানদের সম্পদের বিবরণ প্রকাশের অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হয়নি। এ ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীর ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত তাঁর অন্য সহকর্মীরা কবে অনুসরণ করবেন, তার কোনো ইঙ্গিত নেই। জাতীয় বাজেটে অব্যাহতভাবে বিভিন্ন কৌশলে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট নির্বাচনী অঙ্গীকার থেকে সরে এসে যুক্তিহীনভাবে কর ন্যায়পাল পদটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। দুর্নীতি প্রতিরোধে বিশেষ সহায়ক স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়নের সম্ভাবনাকে প্রতিহত করে যেভাবে সাংসদদের হাতে স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তুলে দেওয়া হলো, তা সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারের সঙ্গে মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। একইভাবে প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা’ নিষ্পত্তিকরণের উদ্যোগও ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
এরূপ বিতর্কিত পদক্ষেপের পাশাপাশি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দুর্নীতি প্রতিরোধের পক্ষে অব্যাহত অঙ্গীকার অবশ্যই আশার উদ্রেক করে। প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার জনপ্রশাসনে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেছেন সততার সঙ্গে জনগণের সেবকের মনোবৃত্তি নিয়ে কাজ করতে। নির্বাচনের পর সংসদের ভেতরে ও বাইরে প্রায় প্রতিটি বক্তৃতায় তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেছেন।
তথ্য অধিকার আইনের মতো দুর্নীতি প্রতিরোধে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টিকারী আইনটি সংসদে অনুমোদনের মাধ্যমে সরকার জনগণের প্রতি অঙ্গীকার পূরণের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সম্পূরক অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি নতুন আইন তথ্য প্রদানকারীর সুরক্ষা আইন সংসদে উপস্থাপিত হয়েছে, যা আরও উৎসাহব্যঞ্জক। এসব আইনের সুফল জনগণের কাছে পৌঁছানোর লক্ষ্যে ও গোপনীয়তার সংস্কৃতি থেকে উন্মুক্ততার সংস্কৃতিতে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট কৌশল প্রণয়ন।
ভূমিদস্যুতা প্রতিরোধে ড্যাপ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ ও পরে এ-সংক্রান্ত নতুন আইন সংসদে গৃহীত হওয়া অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে, অন্যদিকে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বা তাঁদের সমর্থনপুষ্ট ব্যক্তিরা সাম্প্রতিক কালে যেভাবে স্থানীয় পর্যায়ে টেন্ডারবাজি, নদী-বনাঞ্চল-ভূমি দখল, টোলবাজিসহ আইনের শাসন পরিপন্থী কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হচ্ছেন, তাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে অপরিহার্য প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ক্রমান্বয়ে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হওয়ার আশঙ্কা বেড়েই চলেছে।
সরকারি ক্রয় খাতে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী সম্প্রতি প্রবর্তিত নীতিমালার সংস্কার কোনো অবস্থায়ই সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধক পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক হবে না। বিশেষ করে টেলিযোগাযোগ আইন, ২০১০ এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) বিল, ২০১০ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় নির্বাচনী অঙ্গীকারের পরিপন্থী।
দুর্নীতিকে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দুর্নীতি, তা যে পর্যায়েই ঘটুক না কেন, কারও প্রতি কোনো ধরনের ভয় বা করুণা না করে দলীয় বা রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে থেকে তার বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্নীতির অভিযোগ ও তার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়গুলো সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।
দুর্নীতির বিচার হতে হবে, তবে তা যেন সম্পূর্ণ স্বচ্ছ বিচার-প্রক্রিয়ায় হয়, আইনের সুষ্ঠু এবং কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে হয়। বিশেষ করে আইন প্রয়োগে আদালতকে কোনো অবস্থাতেই প্রভাবিত না করা দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত। দুর্নীতিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে তখনই সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে, যখন বিচার-প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ সম্ভব হবে। অন্যদিকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা তখনই সুফল আনবে, যখন এই বিভাগে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে থেকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা, পেশাগত উৎকর্ষ ও সততার সঙ্গে কার্য পরিচালনার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।
জাতীয় সংসদ কার্যকর করা যেকোনো সংসদীয় গণতন্ত্রে দুর্নীতিবিরোধী প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি সৃষ্টির জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নবম সংসদের প্রথম অধিবেশনেই সংসদীয় কমিটিগুলো গঠিত হয়েছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে। বেশ কিছু কমিটি তুলনামূলকভাবে সক্রিয়ভাবে কার্যক্রম পরিচালনায় হাত দিয়েছিল। তবে অনেক ক্ষেত্রেই সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব কমিটির কার্যক্রম ও কার্যকারিতাকে এরই মধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
দুর্নীতি প্রতিরোধে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন জনপ্রশাসন তথা সরকারি কর্মকর্তারা। পৃথিবীর যেসব দেশে সাফল্যের সঙ্গে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে, সেসব দেশে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, যোগ্যতাসম্পন্ন প্রশাসনকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি প্রভৃতি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব দূর করা অপরিহার্য। সরকার পরিবর্তনের পর এ ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, তাতে উৎসাহিত হওয়ার খুব বেশি সুযোগ নেই।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত ব্যক্তি কর্তৃক স্বাস্থ্য খাতে সরকারি পদে নিয়োগে শুধু দলীয় সমর্থনপুষ্ট কর্মীদের নিয়োগের ঘোষণা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে পাবনায় সরকারি পদে নিয়োগ পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট নৈরাজ্যের দৃষ্টান্ত সরকারের জন্য সুখকর ভাবা কঠিন। অন্যদিকে জনপ্রশাসনে বেতন-ভাতার যথার্থতা ও পর্যাপ্ততা নিশ্চিত না করে প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করার প্রত্যাশা করাও অমূলক। যেসব কারণে প্রশাসনে দুর্নীতি হয়, তার অন্যতম হচ্ছে বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধার বাস্তবতাবর্জিত চিত্র। বেতন কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সরকারি খাতের বেতনকাঠামোর কিছুটা পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, এটা আশাব্যঞ্জক। তবে শুধু বেতন বৃদ্ধি করে প্রশাসনে স্বচ্ছতার প্রণোদনা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে, এটা ভাবা অমূলক। সরকারি খাতের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে, বিভাগে ও মন্ত্রণালয়ে প্রতিষ্ঠা করতে হবে নির্ভেজাল প্রক্রিয়ার বাস্তবায়নযোগ্য নৈতিক আচরণবিধি, যার স্খলন ঘটলে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রণোদনার সমন্বয়েই কেবল প্রশাসনে কার্যকর পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব।
দুর্নীতি প্রতিরোধে বেসরকারি খাতের ভূমিকাও অপরিসীম। সরকারি খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধ কখনোই সম্ভব হবে না, যদি বেসরকারি খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব না হয়। এ ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি, বহুজাতিকসহ বেসরকারি খাতে কর্মরত সব প্রতিষ্ঠানেই সততা, স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য।
দুর্নীতি প্রতিরোধে একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে যেকোনো দেশের গণমাধ্যম, যার সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ অব্যাহত রাখতে হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধে অন্যতম পূর্বশর্ত তথ্যপ্রবাহের অবাধ স্বাধীনতা। তথ্যের স্বাধীনতা একদিকে যেমন গণমাধ্যমের জন্য অপরিহার্য, অন্যদিকে অবাধ তথ্যপ্রবাহই নিশ্চিত করতে পারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সংস্কৃতি, যা ব্যতিরেকে কোনো দুর্নীতিবিরোধী অভিযানই পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি, বিশেষ করে সমালোচনা সইবার সৎসাহসের অভাবের প্রতিফলন ঘটিয়ে গণমাধ্যমকে ঢালাওভাবে আক্রমণ করার দৃষ্টান্ত কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য সহায়ক হবে না।
বাংলাদেশে দুর্নীতির কার্যকর ও স্থায়ী সমাধান স্বল্প মেয়াদে বা শুধু ক্ষেত্রবিশেষের ওপর নির্ভর করে অর্জন করা অসম্ভব। প্রয়োজন সুচিন্তিত ও বহুমুখী কৌশল এবং তার বাস্তবায়নে সদিচ্ছার সুনির্দিষ্ট দৃষ্টান্ত। এর অভাবে গগনচুম্বী প্রত্যাশা নিয়ে যাঁরা দুর্নীতি প্রতিরোধ ও পরিবর্তনের অঙ্গীকারের পক্ষে রায় দিয়েছেন, একইভাবে তাঁরা আবার শিগগিরই নিরাশ হবেন। তবে সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এটি চাইবেন না—জনগণ এ প্রত্যাশাই করে।
ইফতেখারুজ্জামান: নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি।
No comments