জন্মদিন-মানুষটা কেমন যেন! by নির্লিপ্ত নয়ন

‘মানুষটা কেমন যেন, লিকার চা ছাড়া কিছুই খেতে দেয় না... এই যে এতক্ষণ কথা বললাম, এখন এত রাতে খাবার পাব কোথায়, বটতলার দোকান সব বন্ধ হয়ে গেছে না?’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেটসংলগ্ন কবি মোহাম্মদ রফিকের বাসার চৌকাঠ ডিঙিয়ে আমরা তখন বটতলার দিকে হাঁটছি খাবারের সন্ধানে। রাত ১০টা ছুঁই ছুঁই।


সেই সন্ধ্যায় খাওয়া লিকার চা এর মধ্যে পেটেই জুড়িয়ে গেছে। ভয়ংকর ক্ষুধার্ত আমরা প্রতিজ্ঞা করলাম, রফিক স্যারের সঙ্গে আর না...কিন্তু কী আশ্চর্য, তার পরদিন, এমনকি পরদিনের পরদিনও সন্ধ্যা লাগতেই গুটিসুটি পায়ে তাঁর বাসার দরজায় আমাদের উপস্থিতি দেখা যায়! প্রান্তিকে বসে তাঁর সঙ্গে লিকার চায়ে গলা ভেজানো এবং দীর্ঘক্ষণ আড্ডা শেষে বেশ রাতে যথারীতি অভুক্ত অবস্থায় হলে ফেরা। প্রতিদিনই প্রতিজ্ঞা করি, আজই শেষ—আর যাব না। কিন্তু পরদিন আবার ওই একই নিয়ম। নিয়ম করে মোহাম্মদ রফিকের বাসায় যেতাম মূলত তাঁর কবিতা এবং কথার আকর্ষণে। অনর্গল বলতে পারেন তিনি, অসাধারণভাবে আড্ডা দেন। সেই আড্ডায় মঙ্গলকাব্য থেকে মাচাদো হয়ে ঘুরেফিরে আসেন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ— ল্যাটিন আমেরিকান ও আফ্রিকান সাহিত্য। কখনো মহাভারত নিয়ে আলাপ করতে করতে আমরা পৌঁছে যাই সাম্প্রতিককালের তরুণতম কোনো কবির কবিতায়। অবশেষে আড্ডা ভাঙতেই পেটে ছুঁচোর কেত্তন, প্রতিজ্ঞা এবং অবশ্যই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের ইতিহাস।
সামান্য কবিতা-গল্প লেখার বাতিক নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্বের খাতায় আমরা যারা নাম লিখিয়েছিলাম একদিন, তখনকার অনেক শিক্ষকের মধ্যে আমাদের কাছে দুজন ছিলেন অগ্রগণ্য—সেলিম আল দীন এবং মোহাম্মদ রফিক। সেলিম স্যার কথায় কথায় একবার বললেন, বাংলাদেশে জীবিত যে কজন কবিকে তিনি মান্য করেন, তাঁদের একজন আল মাহমুদ হলে আরেকজনের নাম মোহাম্মদ রফিক। রফিকের কবিতা আমাদেরও ভালো লাগে। তাঁর কপিলা পড়ে মুগ্ধতা বোধ করি, সেই মুগ্ধতা ছড়িয়েও দিই সতীর্থ বন্ধুদের মধ্যে। কিন্তু সামনা-সামনি সব প্রশংসার মুখে কুলুপ এঁটে উল্টো তাঁর সঙ্গে তর্কের দোকান খুলে বসি। রাতের বেলা তিনি যে আমাদের খাবার সাধেন না—সেই রাগ কিন্তু মনে মনে আছেই। তবে তখনো আমরা ঠিক বুঝতে চাইতাম না যে পরিজনহীন একাকী বসবাস করা কবির পক্ষে আমাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা সহজসাধ্য ছিল না।
মাঝেমধ্যে তাঁকে আবেগহীন, নির্দয় বলে মনে হতো। কী রকম নিরাবেগ চিত্তে কথা বলেন। তাঁর স্ত্রী কবি জিনাত আরা রফিকের মৃত্যুসংবাদও তিনি আমাদের নিরাবেগ কণ্ঠে দিয়েছিলেন। আমরা ভেবেছি, আহা, লোকটা কেমন যেন। এই তো সেদিনও তাঁকে দেখেছি অসুস্থ স্ত্রীর শয্যাপাশে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে জাহাঙ্গীরনগর থেকে ঢাকার বাস ধরছেন। আমরা গেলে বলেছেন, ‘এখন সময় নেই, তোমাদের ম্যাডাম খুব অসুস্থ...।’ আর আজ মৃত্যুসংবাদ দেওয়ার সময় তাঁর কণ্ঠটি একটুও কাঁপল না। সেদিন আমরা তাঁকে মেলাতে পারিনি। তাঁর আপাত আবেগহীনতার মাঝে যে আবেগের ক্ষীণতোয়া নদীটি নিশ্চুপ বয়ে যাচ্ছে—এসব বুঝতে তখনো আমাদের অনেক দেরি।
এর মধ্যে সেলিম আল দীন চলে গেলেন। ইংরেজি বিভাগের শিক্ষকতা থেকে মোহাম্মদ রফিকের অবসর নেওয়ার সময় এল। আমাদের ক্যাম্পাসের শাল কিংবা গজারিগাছের সমান যে দুজন মানুষের উচ্চতা, তাঁদের একজনও থাকবেন না এখানে, আমাদের পাঠশালার কানাই মাস্টাররা ছুটি নিয়ে নেবেন যে যাঁর ইচ্ছেমতো! গেলাম রফিক স্যারের বাসায়। দেখি সেখানে তখন তিনি নিজের মনের মধ্যে রং ছড়াতে ব্যাকুল। বললেন, এবার নতুনভাবে লেখা শুরু করব। আমরা আড্ডায় ভেসে গেলাম।
এরপর ৬৭তম জন্মদিনের ঠিক এক মাস আগে ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে কলকাতায় প্রথম স্ট্রোক হলো তাঁর। গিয়েছিলেন কবি বিষ্ণু দের ওপর প্রবন্ধ পড়তে। ফিরে এলেন চশমার ফ্রেমে আরও ভারী কাচ ঝুলিয়ে। কীর্তিনাশা, গাওদিয়া, মৎসগন্ধার কবি, নিজের প্রবন্ধটি নিয়ে দেশে ফিরলেন বটে, কিন্তু লিখলেন না অনেক দিন। জিজ্ঞেস করলেই বলতেন, ‘মাথা ঝিম ঝিম করে, লিখতে পারি না। আসলে এই জীবনে যখনই আমি নতুন করে কিছু লিখতে চেয়েছি তখনই আমার কোনো সমস্যা হয়েছে। আমি বোধ হয় আর লিখতে পারব না।’ আবার মনে হলো, মানুষটা সত্যিই কেমন যেন, এত অল্পতেই ভয়! মানুষের জীবনে কত কিছুই না ঘটে।
আমরা মোহাম্মদ রফিকের বাসায় প্রায় দিনই যাই। এক ঘোর বিষণ্নতার সঙ্গে আমাদের নিয়ে বসে থাকেন তিনি, আড্ডা দেন। কিন্তু সেই আড্ডার সুর-লয় একেবারেই ভিন্ন। কেমন গুমোট। বারবার কথার খেই কেটে যায়। সুরের সঙ্গে সুর জোড়া লাগে না। দেখি, আমাদের মধ্যে থেকেও নিঃসঙ্গতার আবাস গড়ছেন তিনি মনের গহিনে। একদিন বললেন, ‘লেখায় যদি রিপিটেশন আসে তবে লেখার চেয়ে না লেখা ভালো।’ এই চরম সত্যটি তো দেশের অনেক লেখক উপলব্ধি করতে পারেন না জীবদ্দশায়। ‘সব শালা কবি হবে’—এ রকম পঙিক্তর পর পঙিক্ত লিখে খোলা কবিতার স্রষ্টা কবি মোহাম্মদ রফিকও কি তাহলে এত দিনে বললেন বিষাদে...মেনে নিলেন পরাজয়? ভুল ভাঙল অল্প কদিনেই। নতুন করে আবার কবিতার জন্ম হলো—চকচকে ঝলমলে কবিতা। এগুলোকে কপিলা, কালাপানি, নোনাঝাউ কিংবা, তাঁর সাম্প্রতিকতম গ্রন্থ দোমাটির মুখ-এর সঙ্গে মেলানো যাবে না। মোহাম্মদ রফিক বিরচিত ছোট ছোট এই কবিতার স্বাদ একেবারেই ভিন্ন। আজও তাই কাশফুলের রঙে রাঙানো সাদা চুলের এই চির তরুণের ৬৮তম জন্মদিনের ক্ষণে কেন জানি বারবার মনে হয়, মানুষটা কেমন যেন! যাকে নিয়ে এই এত কথার ঘনঘটা— ভালোবাসার সেই মোহাম্মদ রফিক আসলেই কেমন যেন একটা মানুষ!

No comments

Powered by Blogger.