জেল হত্যা-আলোর প্রত্যাশা by সিমিন হোসেন রিমি

প্রিয় বাবা, তুমি চলে যাওয়ার পর গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত শান্ত নিথর তোমার চোখ বুজে থাকা মুখটি যখন আমার মনের চোখে ভেসে উঠত, তোমার মুখটি মুছে গিয়ে স্পষ্ট দেখতে পেতাম বাংলাদেশের মানচিত্র। সীমাহীন প্রতিটি আশা আলোর বিন্দু হয়ে মানচিত্রটিকে আলোকিত করে তুলছে, ভেসে উঠত সেই ছবি।


মনে হতো, তোমার সুখী-সমৃদ্ধ সুন্দর একটি দেশ গড়ে তোলার অসম্পূর্ণ স্বপ্নকে দায়িত্ব নিয়ে সমাধা করবে ওই আলোর বিন্দুর মতো মানুষেরা। অজান্তেই আনন্দে ভরে উঠত মন। কিন্তু বাবা, দিনে দিনে আমার সেই মানচিত্র, আলোর বিন্দু কেমন যেন ঝাপসা দেখায়। তোমার শান্ত মুখ জলছাপের মতো মানচিত্রজুড়ে ভেসে ওঠে। আমার খুব কান্না পায় বাবা! আমি আলোর বিন্দুতে কোনো শৃঙ্খলা দেখতে পাই না। দপ করে জ্বলে, সঙ্গে সঙ্গেই নিভে যায়। আলোকিত করতে পারে না মানচিত্রকে।
বাবা, তোমার সাধনা, তিল তিল করে নিজেকে গড়ে তোলা, চরম বিপদের দিনে একাত্তরে মাত্র ৪৬ বছর বয়সে দৃঢ় হাতে যুদ্ধের হাল ধরা, লাখ লাখ শহীদের আত্মদান, কত হাহাকার, কত বেদনা, কত অশ্রু—তারপর স্বাধীন ভূখণ্ড, উন্নতশির পতাকা। পৃথিবীর বুকে অসামান্য কীর্তির গর্বিত দেশ বাংলাদেশ। এত বিশাল যার উত্তরাধিকার, দেশপ্রেম যার মাথার মুকুট, সেখানে আলো কেন অস্পষ্ট হয়ে যায়, বাবা?
জানো বাবা, বেশ অনেক বছর আগে দেখা একটি উজ্জ্বল রঙিন ছবিতে ভরা বইয়ের কথা আজকাল খুব মনে পড়ে। বইটিতে পৃথিবীর বেশ কিছু প্রাণী আর তার নবজাতক শিশুর ছবি ছিল। মানবশিশুর ছবিও ছিল। সেখানে এক এক করে বর্ণনা করা হয়েছিল কোন প্রাণী তার শিশুসন্তানকে কত দিন লালন-পালন করলে সেই সন্তান প্রকৃতিপ্রদত্ত সহজাত আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ প্রাণিকুলে টিকে থাকার মতো স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে। সবশেষে ছিল মানবশিশুর ছবি। লেখা ছিল, সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয় মানবশিশুকে বড় করে তুলতে।
বই এখানেই শেষ। কিন্তু বাবা, আমি নিজে যত বড় হয়েছি, মনে মনে সেই বইয়ের শেষে যুক্ত করতে চেষ্টা করেছি আর কিছু পাঠ।
মানবশিশু বেড়ে উঠছে। হামাগুড়ি, দাঁড়ানো, হাঁটতে শেখা—তৈরি হলো শিশুর শরীর। আর ভবিষ্যৎ পৃথিবীর পথে, রাষ্ট্রব্যবস্থায়, সমাজে, পরিবারে টিকে থাকার জন্য তৈরি করার সুযোগ দিতে হয় তার মনকে। এই মন তৈরি এক নিরন্তর গভীর প্রচেষ্টা, যা শুরু হয় পরিবারে, শেষ হয় রাষ্ট্রে। এই প্রচেষ্টায় জড়ানো থাকে মূলত শিক্ষা, আনন্দময় পরিবেশ, খেলাধুলা, নীতিবোধ জাগানোর সব অনুষঙ্গ, সমাজের সুন্দর নানা উদাহরণ, জ্ঞানচর্চার উন্মুক্ত পরিবেশ, দায়িত্বশীল নাগরিক হয়ে বেড়ে উঠতে পারার সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা।
এই পর্যন্ত যখন আমার ভাবনা এসে দাঁড়ায়, তখন কী মনে হয় জানো, বাবা? কোথায় যেন মস্ত বড় ফাঁক রয়ে গেছে। মানবশিশুকে পূর্ণাঙ্গ মানুষে পরিণত হতে যে সহযোগিতার প্রয়োজন হয়, তাতে বিস্তর ঘাটতির চিহ্ন পদে পদে।
বড় স্বার্থপর একটা সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা। স্বার্থপর নয় কেন, বাবা? বাড়ির নিচতলায় কেমিক্যালের কারখানা, ওপরে মানুষের বসবাস। বিস্ফোরণ ঘটে কারখানায়, পুড়ে মরে মানুষ। খাদ্যে ভেজাল। মাছ-মাংস, ফলমূল-সবজিতে বিষ। এই বিষক্রিয়া তাৎক্ষণিক নয় বলে চোখে ধরা পড়ে না। কিন্তু ভুক্তভোগী তো জনগণই। লোভ আর দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের কাছে জনগণের অসহায় আত্মসমর্পণ।
দেশের কোথাও না কোথাও প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে কত মানুষ! আহত অগুনতি। কেউ কি তাদের খবর রাখে? কেমন যেন সয়ে যাচ্ছে সব। ধরেই নেওয়া যেন, খবরের কাগজের এক কোণে প্রতিদিন থাকবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত অথবা আহত ব্যক্তির খবর। অনেক কিছুর মতোই দৃষ্টিতে আস্তে আস্তে সয়ে যাবে সব। এখন পর্যন্ত চোখে পড়ে না রাষ্ট্রীয় কোনো সবল উদ্যোগ।
বাবা, পৃথিবীর যে দু-চারটি দেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার, তার কোথাও সড়কপথে দীর্ঘ চলাচলে একটিবারের জন্যও মনে হয়নি সড়ক দুর্ঘটনার কথা। অথচ ঢাকা থেকে বের হলেই আতঙ্ক কাজ করে মনে। অলৌকিক মনে হয় দুর্ঘটনার কবলে না পড়ে বাড়ি ফিরে আসা।
জানো বাবা, সেই যে ১৯৭৫ সালে আমাদের ধানমন্ডির বাসার নিচতলায় গ্রীন হেরাল্ড স্কুল ছিল, তার প্রধান শিক্ষিকা সিস্টার মেরী ইমেলডাকে বলতে শুনেছিলাম, শিশুদের উদ্দেশে বলতেন, প্রিয় শিশুরা মনে রেখো, জগতে ভালো ও মন্দ দুই-ই আছে। তবে তোমাকে বেছে নিতে হবে ভালোকেই।
এই নীতি শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে কে পৌঁছে দেবে, বাবা?
বাবা, তুমি বলতে, দায়িত্বশীল নাগরিক হয়ে যথাযথ ভূমিকা রাখবে তরুণসমাজ। সেই লক্ষ্যে এগিয়ে নিতে তোমার ভাবনা ছিল একেবারে পরিষ্কার। তুমি বলেছিলে, তরুণসমাজ অদম্য শক্তির অধিকারী। এই শক্তিকে যদি সুষ্ঠুপথে পরিচালনা না করা যায়, তবে সেই শক্তি যদি বিপথে যায়, উদ্দেশ্যবিহীন হয়ে যায়, লক্ষ্যবিহীন হয়ে যায়, তবে অবস্থা মারাত্মক হয়ে যাবে। যুবশক্তিকে কাজ দিতে হবে। না হয় তারা গল্পের দৈত্যের মতো আমাদের ঘাড় মটকাবে। এটা তো খুবই স্বাভাবিক। তুমি বলেছিলে, যুবকদের পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে মন ও মননশীলতা বিকাশের সুযোগ করে দিতে হবে। পাঠাগারের সংখ্যা ও আয়তন বাড়াতে হবে। খেলাধুলার ব্যবস্থা করতে হবে। নিষ্কলুষ আনন্দ লাভের সুযোগ করে দিতে হবে। তা না হলে এরা ফুটপাতে ঘুরে বেড়াবে। ঘুরে বেড়ালে হাত শুধু পকেটেই যাবে না, নানা দিকে যাবে।
বাবা, তুমি বলেছিলে, দেশে আজ সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশি করে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রয়োজন। কেবল সাধারণ শিক্ষার ফলে সমাজে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। তুমি বলেছিলে জনকল্যাণমুখী শিক্ষাব্যবস্থার কথা। যে শিক্ষাব্যবস্থা দেশের অগ্রগতির প্রতিটি স্তরে প্রয়োজনীয়সংখ্যক অনুশীলনপ্রাপ্ত কর্মীর জোগান দেবে। পরিকল্পিত একটি শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে দেশের অগ্রগতির পথে সর্বস্তরের সব রকম কর্মী পাওয়া যাবে। কোনো দিক শূন্য থাকবে না।
বাবা, তোমাকে বলতে খুব কষ্ট হয়, কিন্তু তবুও বলি। মাদকের কালো থাবায় ধিকিধিকি জ্বলছে তরুণসমাজের বড় একটি অংশ। এরা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। এদের হাতের মুঠোয় থাকা সহজলভ্য প্রযুক্তির জঘন্য অপব্যবহার, নীতি শিক্ষার অভাব, জীবনে আদর্শ-লক্ষ্য না থাকা, মূল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে মেয়ে আর শিশুদের।
প্রতিদিন এত বেশি না-চাওয়া ঘটনা ঘটছে চারপাশে যে এক ঘটনার রেশ ফুরায় না, তার আগেই ঘটে যায় আরও ঘটনা। আমরা কি আদিম অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগে বসবাস করছি? যে সমাজ নারী ও শিশুর জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষায় ন্যূনতম নিরাপত্তা দিতে পারে না, সে সমাজ সভ্যতার দাবি করে কোন মুখে?
বাবা, তুমি স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ গড়তে চেয়েছিলে।

প্রিয় বাবা,
আজ থেকে ৬২ বছর আগে তুমি যখন ২২ বছরের তরুণ, মহাত্মা গান্ধীর নিহত হওয়ার সংবাদে শক্তি সঞ্চারক এক অপূর্ব শোকগাথা লিখেছিলে তোমার ডায়েরির পাতায়। সেই শক্তিগাথা তোমার স্মরণে আজ আবার নিবেদন করছি। আলোককে কি তুমি ধ্বংস করতে পারো? আলোর কণিকা আমাদের কাছ থেকে বহু দূরে অবস্থিত হতে পারে। কিন্তু তাতে কী? ধ্রুবতারার দূরত্ব অকল্পনীয়। কিন্তু বিজন মেরুতে অভিযানকারীর সে-ই তো একমাত্র দিক-নির্ধারক। যুগ থেকে যুগে। তার চোখের ক্ষুদ্র কল্পনাটিও আমাদের পথের দিশা প্রদান করে। তাহলে বেদনা কেন? বহু যুগের এই ধ্রুবতারার কাছ থেকে আমরা নির্দেশ গ্রহণ করব। তার ফেলে যাওয়া পায়ের চিহ্ন ধরে আমরা অগ্রসর হব। তিনি শান্তি লাভ করুন।
সিমিন হোসেন রিমি: সমাজকর্মী।
simrim_71@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.