মতপ্রকাশ-সমস্যা কে, লেখক না সন্ত্রাসী? by অরুন্ধতী রায়
রোববার বেলা ১১টায় কয়েক শ খ্যাপাটে লোকের দঙ্গল আমার বাড়ির দরজায় আছড়ে পড়ে। সদর দরজা ভেঙে তারা ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং সবকিছু তছনছ করে। কাশ্মীর নিয়ে আমার চিন্তার জন্য তারা আমার বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। তারা আমাকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার ঘোষণাও দেয়।
এনডিটিভি, টাইমস নাউ ও নিউজ টুয়েন্টিফোরও ততক্ষণে সেখানে হাজির। তাদের ভাবসাব ছিল যেন তারা ঘটনাটি সরাসরি সম্প্রচারের জন্যই এসেছে। টেলিভিশন সংবাদে বলা হয়, যারা আমার বাসায় হামলা করেছে, তাদের বেশির ভাগই বিজেপির মহিলা মোর্চা সংগঠনের সদস্য।
তারা চলে গেলে পুলিশ আমাকে বলে, এরপর যখনই টেলিভিশনের ওবি ভ্যান আমার বাড়ির আশপাশে দেখতে পাব, তখনই যেন পুলিশে খবর দিই। কারণ, ওবি ভ্যান মানেই কোথাও দল বেঁধে আমার বাড়িতে হামলার জন্য খ্যাপাটেরা জড়ো হয়েছে। প্রশ্ন হলো, পুলিশ জানার আগেই কীভাবে টেলিভিশন চ্যানেলের লোকেরা সম্ভাব্য হামলার খবর পেয়ে যায়? এ বছরেরই জুন মাসের ঘটনা, ভারতের সরকারি সংবাদ সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার (পিটিআই) বরাত দিয়ে আমাকে নিয়ে একটা ভুয়া খবর সংবাদপত্রগুলোতে ছাপা হয়। ওই বানোয়াট খবরের অসিলায় দুজন মোটরসাইকেল আরোহী আমার বাড়ির জানালার কাচ ভেঙে দিয়ে চলে যায়। এবং কী আশ্চর্য, এ দুজনেরও সঙ্গে ছিল টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান।
এই খ্যাপাটেদের দঙ্গলের সঙ্গে মিডিয়ার কি কোনো চুক্তি আছে যে, তারা হামলা চালাতে আসার সময় ওদের খবর দেবে আর মিডিয়ার ক্যামেরা দিয়ে সেই ঘটনা সরাসরি প্রচার করা হবে? মিডিয়ার সঙ্গে কি তারা সমঝোতা করেই এসেছে যে, ঘটনা ঘটার স্থানে মিডিয়ার লোক হাজির থাকা মানেই বিক্ষুব্ধরা সহিংস হয়ে উঠবে না? রোববারের মতো যদি আবার আইনের বরখেলাপ করে আমার বাড়িতে অনুপ্রবেশ করা হয়, কিংবা তার থেকেও খারাপ কিছু ঘটলে তারা কী করবে? তখন কি মিডিয়া ওই অপরাধের সহযোগী হয়ে উঠবে? কিংবা ইতিমধ্যেই কি তারা সেটাই করছে না? বিজেপি ও মিডিয়া কি পরিকল্পিতভাবে আমার ওপর হামলা চালানোয় মানুষকে উৎসাহিত করছে না?
প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ইতিমধ্যে কিছু টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্র সরাসরি আমার বিরুদ্ধে মানুষকে খেপিয়ে তোলার কাজে খোলাখুলিভাবে নিয়োজিত।
স্পর্শকাতর খবর প্রকাশ করার প্রতিযোগিতার দৌড়ে খবর জানানো আর খবর করার মধ্যে পার্থক্য আসলেই ঘুচে যাচ্ছে। টেলিভিশনের দর্শক বাড়ানোর এই খেলায় কিছু মানুষের বলি হওয়ার সম্ভাবনা কি তারা পরোয়া করছে?
সরকার জানিয়ে দিয়েছে যে, কাশ্মীরের স্বাধীনতা বিষয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে আমিসহ আর কারও কারও দেওয়া বক্তব্যের কারণে আমাদের বিরুদ্ধে হঠকারিতার অভিযোগ নিয়ে তারা অগ্রসর হবে না। তাই এখন মনে হচ্ছে, আমাকে শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব তুলে নিয়েছে ডানপন্থী ঝটিকা আক্রমণকারীরা।
চরমপন্থী বজরং দল ও আরএসএস খোলাখুলিভাবে জানিয়ে দিয়েছে, যেকোনো মূল্যে তারা আমার দফারফা করবে। প্রয়োজনে সারা দেশে আমার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। তারা কী কী করতে পারে এবং কী কী করার সামর্থ্য ধারণ করে আর করতে চায়, তার সাক্ষী এখন সারা দেশ।
এ অবস্থায় যখন খোদ সরকারই সহনশীলতার মাত্রা অবলম্বন করছে, তখন কি মিডিয়ার একটি অংশকে এবং গণতন্ত্রের বিভিন্ন কাঠামো ভাড়া করে আমার বিরুদ্ধে গণ-অসন্তোষ দিয়ে বিচার করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে? আমি বুঝতে পারছি যে, বিজেপির মহিলা মোর্চা আমার বিরুদ্ধে লোক খেপিয়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে। এসবের মাধ্যমে তারা আসলে নিজেদের জঙ্গি কার্যকলাপ ফাঁস হওয়ার ঘটনা থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে সরাতে চায়। সম্প্রতি ভারতের কেন্দ্রীয়গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই আজমির শরিফে বোমা বিস্ফোরণের অভিযোগে বিজেপি কর্মী ইন্দ্রেশ কুমারের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। ওই ঘটনায় বেশ কয়েকজন মানুষ নিহত হন এবং আহত হন অনেকে।
কিন্তু কী কারণে প্রধান প্রধান গণমাধ্যমই সেই একই কাজে লিপ্ত হয়েছে?
অজনপ্রিয় চিন্তাভাবনা লালনকারী কোনো লেখকের থেকে কি সন্ত্রাসী বোমা বিস্ফোরণের দায়ে অভিযুক্ত কোনো সন্ত্রাসী কম বিপজ্জনক? নাকি সেইসব গণমাধ্যম ও সন্ত্রাসী উভয়ই একই সহিংস আদর্শের অনুসারী?
কাউন্টারকারেন্টস থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ
অরুন্ধতী রায়: বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতীয় ভিন্নমতাবলম্বী লেখক, ঔপন্যাসিক ও অধিকারকর্মী।
তারা চলে গেলে পুলিশ আমাকে বলে, এরপর যখনই টেলিভিশনের ওবি ভ্যান আমার বাড়ির আশপাশে দেখতে পাব, তখনই যেন পুলিশে খবর দিই। কারণ, ওবি ভ্যান মানেই কোথাও দল বেঁধে আমার বাড়িতে হামলার জন্য খ্যাপাটেরা জড়ো হয়েছে। প্রশ্ন হলো, পুলিশ জানার আগেই কীভাবে টেলিভিশন চ্যানেলের লোকেরা সম্ভাব্য হামলার খবর পেয়ে যায়? এ বছরেরই জুন মাসের ঘটনা, ভারতের সরকারি সংবাদ সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার (পিটিআই) বরাত দিয়ে আমাকে নিয়ে একটা ভুয়া খবর সংবাদপত্রগুলোতে ছাপা হয়। ওই বানোয়াট খবরের অসিলায় দুজন মোটরসাইকেল আরোহী আমার বাড়ির জানালার কাচ ভেঙে দিয়ে চলে যায়। এবং কী আশ্চর্য, এ দুজনেরও সঙ্গে ছিল টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান।
এই খ্যাপাটেদের দঙ্গলের সঙ্গে মিডিয়ার কি কোনো চুক্তি আছে যে, তারা হামলা চালাতে আসার সময় ওদের খবর দেবে আর মিডিয়ার ক্যামেরা দিয়ে সেই ঘটনা সরাসরি প্রচার করা হবে? মিডিয়ার সঙ্গে কি তারা সমঝোতা করেই এসেছে যে, ঘটনা ঘটার স্থানে মিডিয়ার লোক হাজির থাকা মানেই বিক্ষুব্ধরা সহিংস হয়ে উঠবে না? রোববারের মতো যদি আবার আইনের বরখেলাপ করে আমার বাড়িতে অনুপ্রবেশ করা হয়, কিংবা তার থেকেও খারাপ কিছু ঘটলে তারা কী করবে? তখন কি মিডিয়া ওই অপরাধের সহযোগী হয়ে উঠবে? কিংবা ইতিমধ্যেই কি তারা সেটাই করছে না? বিজেপি ও মিডিয়া কি পরিকল্পিতভাবে আমার ওপর হামলা চালানোয় মানুষকে উৎসাহিত করছে না?
প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ইতিমধ্যে কিছু টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্র সরাসরি আমার বিরুদ্ধে মানুষকে খেপিয়ে তোলার কাজে খোলাখুলিভাবে নিয়োজিত।
স্পর্শকাতর খবর প্রকাশ করার প্রতিযোগিতার দৌড়ে খবর জানানো আর খবর করার মধ্যে পার্থক্য আসলেই ঘুচে যাচ্ছে। টেলিভিশনের দর্শক বাড়ানোর এই খেলায় কিছু মানুষের বলি হওয়ার সম্ভাবনা কি তারা পরোয়া করছে?
সরকার জানিয়ে দিয়েছে যে, কাশ্মীরের স্বাধীনতা বিষয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে আমিসহ আর কারও কারও দেওয়া বক্তব্যের কারণে আমাদের বিরুদ্ধে হঠকারিতার অভিযোগ নিয়ে তারা অগ্রসর হবে না। তাই এখন মনে হচ্ছে, আমাকে শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব তুলে নিয়েছে ডানপন্থী ঝটিকা আক্রমণকারীরা।
চরমপন্থী বজরং দল ও আরএসএস খোলাখুলিভাবে জানিয়ে দিয়েছে, যেকোনো মূল্যে তারা আমার দফারফা করবে। প্রয়োজনে সারা দেশে আমার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। তারা কী কী করতে পারে এবং কী কী করার সামর্থ্য ধারণ করে আর করতে চায়, তার সাক্ষী এখন সারা দেশ।
এ অবস্থায় যখন খোদ সরকারই সহনশীলতার মাত্রা অবলম্বন করছে, তখন কি মিডিয়ার একটি অংশকে এবং গণতন্ত্রের বিভিন্ন কাঠামো ভাড়া করে আমার বিরুদ্ধে গণ-অসন্তোষ দিয়ে বিচার করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে? আমি বুঝতে পারছি যে, বিজেপির মহিলা মোর্চা আমার বিরুদ্ধে লোক খেপিয়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে। এসবের মাধ্যমে তারা আসলে নিজেদের জঙ্গি কার্যকলাপ ফাঁস হওয়ার ঘটনা থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে সরাতে চায়। সম্প্রতি ভারতের কেন্দ্রীয়গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই আজমির শরিফে বোমা বিস্ফোরণের অভিযোগে বিজেপি কর্মী ইন্দ্রেশ কুমারের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। ওই ঘটনায় বেশ কয়েকজন মানুষ নিহত হন এবং আহত হন অনেকে।
কিন্তু কী কারণে প্রধান প্রধান গণমাধ্যমই সেই একই কাজে লিপ্ত হয়েছে?
অজনপ্রিয় চিন্তাভাবনা লালনকারী কোনো লেখকের থেকে কি সন্ত্রাসী বোমা বিস্ফোরণের দায়ে অভিযুক্ত কোনো সন্ত্রাসী কম বিপজ্জনক? নাকি সেইসব গণমাধ্যম ও সন্ত্রাসী উভয়ই একই সহিংস আদর্শের অনুসারী?
কাউন্টারকারেন্টস থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ
অরুন্ধতী রায়: বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতীয় ভিন্নমতাবলম্বী লেখক, ঔপন্যাসিক ও অধিকারকর্মী।
No comments