বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪৩০ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। জুম্মা মিয়া, বীর বিক্রম মাটি কামড়ে যুদ্ধ করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে একদল মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নেন বিবিরবাজারে। কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত বিবিরবাজার, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে।
জেলা সদর থেকে ৬ কিলোমিটার পুবে। কুমিল্লা-বিবিরবাজার সড়কের উত্তরে প্রায় সমান্তরাল বহমান গোমতী নদী। বিবিরবাজারের কাছে দক্ষিণে বাঁক নিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। নদীর বাঁক ঘেষেই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিবিরবাজারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানিরা অতর্কিতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে আক্রমণ করে। ৩৯ বালুচ রেজিমেন্ট, গোলন্দাজ ও ট্যাংক বাহিনীর সমন্বয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ। তারা প্রথমে পশ্চিম দিকে অবস্থান নিয়ে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে সেই আক্রমণ প্রতিহত করে দেন। তাঁদের পাল্টা আক্রমণে হতাহত হয় বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা।
এরপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করে। প্রচণ্ড আক্রমণের চাপে মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ পিছু হটে যায়। দুটি দল সাহসিকতার সঙ্গে তাদের অবস্থান ধরে রাখে। এই দুটি দলের একটির নেতৃত্বে ছিলেন জুম্মা মিয়া। তিনি সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে বিপুল বিক্রমে পাকিস্থানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করেন। তাঁদের বীরত্বে থেমে যায় পাকিস্তানিদের অগ্রযাত্রা।
পরের দিনও যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। সেদিন মুক্তিবাহিনীর নতুন একটি দলও বিবির বাজারে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেয়। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি ও মনোবল বৃদ্ধি পায়। দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকে।
কুমিল্লা শহরের খুব কাছে বিবিরবাজার। ওই স্থান থেকে যখন তখন কুমিল্লা সেনানিবাস ও বিমানবন্দরে আক্রমণ চালানো সম্ভব। তাই বিবিরবাজার দখলের জন্য পাকিস্তানিরা ক্রমেই মরিয়া হয়ে উঠল। এ জন্য তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করল। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর কাছেও ছিল বিবিরবাজার সমান গুরুত্বপূর্ণ।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের একাংশের পতন ঘটলেও জুম্মা মিয়া তাঁর দল নিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকলেন। কোনো কিছুই তাঁকে টলাতে পারল না। বরং তাঁর দলের পাল্টা আক্রমণে নিহত হলো অগ্রসরমান কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা। সে দিন পাকিস্তানি সেনারাও দুর্দমনীয়। একপর্যায়ে ট্যাংকের ছত্রচ্ছায়ায় তারা চলে এল জুম্মা মিয়াদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের খুব কাছে। বৃষ্টির মতো গুলি করতে করতে তারা এগোতে থাকল।
জুম্মা মিয়া সহযোদ্ধাদের নিয়ে সাহসকিতার সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। এমন সময় এক ঝাঁক গুলি ছুটে এল তাঁর দিকে। নিজেকে রক্ষা করতে পারলেন না তিনি। কয়েকটি গুলি বিদ্ধ হলো তাঁর শরীরে। সঙ্গে সঙ্গে ঢলে পড়লেন মাটিতে। বেরিয়ে গেল তাঁর প্রাণবায়ু। শহীদ হলেন তিনি। এর পর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ভেঙে পড়ে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিবিরবাজার দখল করে নেয়।
জুম্মা মিয়া চাকরি করতেন ইপিআরে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন কুমিল্লা উইংয়ে (বর্তমানে ব্যাটালিয়ন)। তখন তাঁর পদবি ছিল হাবিলদার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ জুম্মা মিয়াকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৯৭।
শহীদ জুম্মা মিয়ার পৈতৃক বাড়ি সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার হেতিমগঞ্জ গ্রামে। মা-বাবার একমাত্র সন্তান ছিলেন তিনি। তাঁর বাবার নাম ওসমান আলী, মা সরিফা খাতুন। স্ত্রীর নাম পাওয়া যায়নি। তাঁর চার মেয়ে ও এক ছেলে।
শহীদ জুম্মা মিয়ার ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২ এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, মো. আবদুল হান্নান।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিবিরবাজারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানিরা অতর্কিতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে আক্রমণ করে। ৩৯ বালুচ রেজিমেন্ট, গোলন্দাজ ও ট্যাংক বাহিনীর সমন্বয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ। তারা প্রথমে পশ্চিম দিকে অবস্থান নিয়ে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে সেই আক্রমণ প্রতিহত করে দেন। তাঁদের পাল্টা আক্রমণে হতাহত হয় বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা।
এরপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করে। প্রচণ্ড আক্রমণের চাপে মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ পিছু হটে যায়। দুটি দল সাহসিকতার সঙ্গে তাদের অবস্থান ধরে রাখে। এই দুটি দলের একটির নেতৃত্বে ছিলেন জুম্মা মিয়া। তিনি সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে বিপুল বিক্রমে পাকিস্থানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করেন। তাঁদের বীরত্বে থেমে যায় পাকিস্তানিদের অগ্রযাত্রা।
পরের দিনও যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। সেদিন মুক্তিবাহিনীর নতুন একটি দলও বিবির বাজারে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেয়। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি ও মনোবল বৃদ্ধি পায়। দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকে।
কুমিল্লা শহরের খুব কাছে বিবিরবাজার। ওই স্থান থেকে যখন তখন কুমিল্লা সেনানিবাস ও বিমানবন্দরে আক্রমণ চালানো সম্ভব। তাই বিবিরবাজার দখলের জন্য পাকিস্তানিরা ক্রমেই মরিয়া হয়ে উঠল। এ জন্য তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করল। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর কাছেও ছিল বিবিরবাজার সমান গুরুত্বপূর্ণ।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের একাংশের পতন ঘটলেও জুম্মা মিয়া তাঁর দল নিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকলেন। কোনো কিছুই তাঁকে টলাতে পারল না। বরং তাঁর দলের পাল্টা আক্রমণে নিহত হলো অগ্রসরমান কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা। সে দিন পাকিস্তানি সেনারাও দুর্দমনীয়। একপর্যায়ে ট্যাংকের ছত্রচ্ছায়ায় তারা চলে এল জুম্মা মিয়াদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের খুব কাছে। বৃষ্টির মতো গুলি করতে করতে তারা এগোতে থাকল।
জুম্মা মিয়া সহযোদ্ধাদের নিয়ে সাহসকিতার সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। এমন সময় এক ঝাঁক গুলি ছুটে এল তাঁর দিকে। নিজেকে রক্ষা করতে পারলেন না তিনি। কয়েকটি গুলি বিদ্ধ হলো তাঁর শরীরে। সঙ্গে সঙ্গে ঢলে পড়লেন মাটিতে। বেরিয়ে গেল তাঁর প্রাণবায়ু। শহীদ হলেন তিনি। এর পর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ভেঙে পড়ে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিবিরবাজার দখল করে নেয়।
জুম্মা মিয়া চাকরি করতেন ইপিআরে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন কুমিল্লা উইংয়ে (বর্তমানে ব্যাটালিয়ন)। তখন তাঁর পদবি ছিল হাবিলদার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ জুম্মা মিয়াকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৯৭।
শহীদ জুম্মা মিয়ার পৈতৃক বাড়ি সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার হেতিমগঞ্জ গ্রামে। মা-বাবার একমাত্র সন্তান ছিলেন তিনি। তাঁর বাবার নাম ওসমান আলী, মা সরিফা খাতুন। স্ত্রীর নাম পাওয়া যায়নি। তাঁর চার মেয়ে ও এক ছেলে।
শহীদ জুম্মা মিয়ার ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২ এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, মো. আবদুল হান্নান।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments