সময়চিত্র-এই ছবিটি দেখেছেন কি by আসিফ নজরুল
রাত একটায় ফিরেছি বাসায়। গভীর রাতে ইন্টারনেটে পত্রিকা পড়ার অভ্যাস, আজও তা-ই করি। সবচেয়ে আগে দেখি ডেইলি স্টার। ২৬ অক্টোবরের পাতা খুলছে ধীরে। প্রধান শিরোনামের নিচে বিলাপরত নারীর ছবি। নিশ্চয়ই মিজানুরের স্ত্রীর ছবি। এই নীতিমান শিক্ষককে জীবন হারাতে হয়েছে যৌন-উৎপীড়কদের হাতে।
এখন কী সান্ত্বনা নিয়ে বাঁচবেন তাঁর স্ত্রী! ভাবি আর অপলক তাকিয়ে থাকি। ততক্ষণে পুরো ছবি ওপেন হয়েছে। বিলাপরত স্ত্রী চেয়ারে বসা, ছবির নিচের অংশে ফুটফুটে এক শিশু ঘুমাচ্ছে নিরুদ্বেগে। তার উঁচু হয়ে থাকা এলোমেলো চুল, ঘুমে ভারী চোখের পাতা, গভীর আদুরে মুখ! এক হাত গালের নিচে, আরেক হাতে সেই হাতের কনুই স্পর্শ করা। কাত হয়ে শুয়ে আছে সে আমার দিকে, আমাদের দিকে। মিজানুরের মেয়ে! কিছুক্ষণ আগে নিহত হওয়া এক গভীর স্নেহময় পিতার মেয়ে। সে জানে না, এই নিষ্ঠুর পৃথিবী তাকে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে ইতিমধ্যেই।
আশ্চর্য় ব্যাপার, আমার রাগ হয় মিজানুরের ওপরই। কী দরকার ছিল তাঁর প্রতিবাদ করার। এই সমাজ পচে গলে নষ্ট হয়ে যাক, তাতে তাঁর কী ক্ষতি হতো! এখন এই বোকা বাবাটা কেমন করে থাকবেন এই মেয়েকে ফেলে! অনন্ত কোনো দূরত্বে কেমন করে কাটবে তাঁর দিনরাত! এমন মেয়েকে এক পলক চোখের আড়াল করতে পারে কোনো বাবা! মিজানুর নাকি তাঁর শিশুকন্যা—কার দুঃখে দুচোখ ভিজে যায় আমার। মিজানুরের মেয়ে কি আমার মেয়ের মতো দেখতে! ওর বয়স কি আমারই শিশুকন্যার মতো। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে! কেমন করে আমরা মেনে নেব এমন পিতা-কন্যার অনন্ত বিচ্ছেদ!
মিজানুরের মেয়ের ঘুমন্ত ছবি দেখেছেন কি আপনি! দেখুন। এই পৃথিবীর কোনো ক্লেদ, কালিমা স্পর্শ করেনি তাকে। এমন এক শিশুর বাবাকে মোটরসাইকেলে রাস্তায় ফেলে রড দিয়ে পিটিয়ে মেরেছে দুই অমানুষ। মিজানুরের অপরাধ, তিনি তাদের শাসন করেছিলেন। তাঁর কলেজের মেয়েদের উত্ত্যক্ত করতে বারণ করেছিলেন!
মিজানুরের মেয়েকে দেখুন। এই নিষ্পাপ শিশুকে পিতৃহীন করেছে দুই নরপিশাচ। সেই পিশাচদের পক্ষেও কথা বলার মানুষ আছে আমাদের সমাজে। তিনি দুই হত্যাকারীর একজনের আত্মীয় এবং তিনি সরকারি দলের একজন স্থানীয় নেতা! তিনি দাবি করেছেন, হত্যাকারী ও তার পরিবারও সরকারি দলের লোক। সরকারি দলের লোক বলে তাদের সাত খুন মাফ? তিনি অবশ্য গল্প তৈরি করে ফেলেছেন ইতিমধ্যে—পিশাচদের বাঁচানোর গল্প। মিজানুরকে মোটরসাইকেলে ধাক্কা, নাকি ছিল দুর্ঘটনা! কিন্তু এরপর তাঁকে রাস্তায় ফেলে পিটিয়ে মারা, সেটিও কি দুর্ঘটনা?
স্থানীয় লোকজন বলছেন, হত্যাকারী দুজন আসলে বিরোধী দলের ছাত্রসংগঠনের। আওয়ামী লীগ জেতার পর তারা বোল পাল্টিয়েছে। এ দেশে এসব সম্ভব। এ দেশে রং বদলে সরকারি দলে ঢোকা যায়! সরকারি দলে থাকলে মানুষ খুন করা যায়। স্ত্রীকে বিধবা করা যায়, শিশুকে পিতৃহীন করা যায়, মা-বাবাকে সন্তানহীন করা যায়। এ দেশে অমানুষ হলেও পক্ষে বলার লোক পাওয়া যায়!
সবই হয়তো সত্যি! কিন্তু এটিও সত্যি, এ দেশের মানুষই সবচেয়ে বর্বর হত্যাকারী, সবচেয়ে বড় ধর্ষক, সবচেয়ে বড় অমানুষদের পরাজিত করেছিল একাত্তরে। ৪০ বছরে কি পুরোপুরি বদলে গেছি আমরা? না, বদলাইনি। এ দেশে অবশ্যই মিজানুরের হত্যার বিচার হবে।
মিজানুরের মেয়ের ছবি আরেকবার দেখুন। আসুন, আমরা এই দেবশিশুকে, তার মতো সব শিশুকে রক্ষা করি। খুনি, ধর্ষক আর যৌন-নিপীড়কদের হাত থেকে আমাদের সন্তানদের রক্ষা করি। মিজানুরের অনন্ত কান্না নিজেদের বুকে ধারণ করি। মিজানুরদের সন্তানদের কান্না মুছে দেওয়ার শপথ গ্রহণ করি।
অক্ষম শপথ হয়তো। তবুও তা-ই করতে হবে। তাতে যদি সামান্য পাপমোচন হয় আমাদের!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আশ্চর্য় ব্যাপার, আমার রাগ হয় মিজানুরের ওপরই। কী দরকার ছিল তাঁর প্রতিবাদ করার। এই সমাজ পচে গলে নষ্ট হয়ে যাক, তাতে তাঁর কী ক্ষতি হতো! এখন এই বোকা বাবাটা কেমন করে থাকবেন এই মেয়েকে ফেলে! অনন্ত কোনো দূরত্বে কেমন করে কাটবে তাঁর দিনরাত! এমন মেয়েকে এক পলক চোখের আড়াল করতে পারে কোনো বাবা! মিজানুর নাকি তাঁর শিশুকন্যা—কার দুঃখে দুচোখ ভিজে যায় আমার। মিজানুরের মেয়ে কি আমার মেয়ের মতো দেখতে! ওর বয়স কি আমারই শিশুকন্যার মতো। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে! কেমন করে আমরা মেনে নেব এমন পিতা-কন্যার অনন্ত বিচ্ছেদ!
মিজানুরের মেয়ের ঘুমন্ত ছবি দেখেছেন কি আপনি! দেখুন। এই পৃথিবীর কোনো ক্লেদ, কালিমা স্পর্শ করেনি তাকে। এমন এক শিশুর বাবাকে মোটরসাইকেলে রাস্তায় ফেলে রড দিয়ে পিটিয়ে মেরেছে দুই অমানুষ। মিজানুরের অপরাধ, তিনি তাদের শাসন করেছিলেন। তাঁর কলেজের মেয়েদের উত্ত্যক্ত করতে বারণ করেছিলেন!
মিজানুরের মেয়েকে দেখুন। এই নিষ্পাপ শিশুকে পিতৃহীন করেছে দুই নরপিশাচ। সেই পিশাচদের পক্ষেও কথা বলার মানুষ আছে আমাদের সমাজে। তিনি দুই হত্যাকারীর একজনের আত্মীয় এবং তিনি সরকারি দলের একজন স্থানীয় নেতা! তিনি দাবি করেছেন, হত্যাকারী ও তার পরিবারও সরকারি দলের লোক। সরকারি দলের লোক বলে তাদের সাত খুন মাফ? তিনি অবশ্য গল্প তৈরি করে ফেলেছেন ইতিমধ্যে—পিশাচদের বাঁচানোর গল্প। মিজানুরকে মোটরসাইকেলে ধাক্কা, নাকি ছিল দুর্ঘটনা! কিন্তু এরপর তাঁকে রাস্তায় ফেলে পিটিয়ে মারা, সেটিও কি দুর্ঘটনা?
স্থানীয় লোকজন বলছেন, হত্যাকারী দুজন আসলে বিরোধী দলের ছাত্রসংগঠনের। আওয়ামী লীগ জেতার পর তারা বোল পাল্টিয়েছে। এ দেশে এসব সম্ভব। এ দেশে রং বদলে সরকারি দলে ঢোকা যায়! সরকারি দলে থাকলে মানুষ খুন করা যায়। স্ত্রীকে বিধবা করা যায়, শিশুকে পিতৃহীন করা যায়, মা-বাবাকে সন্তানহীন করা যায়। এ দেশে অমানুষ হলেও পক্ষে বলার লোক পাওয়া যায়!
সবই হয়তো সত্যি! কিন্তু এটিও সত্যি, এ দেশের মানুষই সবচেয়ে বর্বর হত্যাকারী, সবচেয়ে বড় ধর্ষক, সবচেয়ে বড় অমানুষদের পরাজিত করেছিল একাত্তরে। ৪০ বছরে কি পুরোপুরি বদলে গেছি আমরা? না, বদলাইনি। এ দেশে অবশ্যই মিজানুরের হত্যার বিচার হবে।
মিজানুরের মেয়ের ছবি আরেকবার দেখুন। আসুন, আমরা এই দেবশিশুকে, তার মতো সব শিশুকে রক্ষা করি। খুনি, ধর্ষক আর যৌন-নিপীড়কদের হাত থেকে আমাদের সন্তানদের রক্ষা করি। মিজানুরের অনন্ত কান্না নিজেদের বুকে ধারণ করি। মিজানুরদের সন্তানদের কান্না মুছে দেওয়ার শপথ গ্রহণ করি।
অক্ষম শপথ হয়তো। তবুও তা-ই করতে হবে। তাতে যদি সামান্য পাপমোচন হয় আমাদের!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments