প্রথম আলো মাদকবিরোধী আন্দোলন-চিকিৎসা দরকার হতে পারে মা-বাবারও
১১ জুন বিকেল পাঁচটায় ‘পরামর্শ সহায়তা ২৭’-এর আসর বসেছিল ধানমন্ডির ডব্লিউভিএ মিলনায়তনে। এ আসরে উপস্থিত ছিলেন মনোরোগ চিকিৎসক মোহিত কামাল, তাজুল ইসলাম, অভ্রদাস ভৌমিক, ফারজানা রহমান, সিফাত ই সাঈদ, মনোয়ার আহমেদ খান ও ক্রিয়ার পরিচালক ইফতেখার আহমেদ।
পরামর্শ সহায়তা আসরে আলোচিত বিষয়গুলো তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন: আমার সন্তান ১৫ বছর ধরে মাদকাসক্ত। একটি নিরাময়কেন্দ্রে কয়েকবার চিকিৎসা করিয়েছি। এখন সে হাতে ছুরি নিয়ে ঘোরে। তার বাবা তাকে বের করে দিয়েছে। কয়েক দিন হলো গ্রামে আছে, সেখানেও খুব খারাপ ব্যবহার করছে।
পরামর্শ: ধৈর্য ধরে চিকিৎসা করে যেতে হবে। কোনো নিরাময়কেন্দ্রে ভর্তি করলে ভালো হয়ে গেল, এই ধারণা মোটেই সঠিক নয়। মাদকাসক্ত রোগীরা কখনো খুব ভালো আচরণ করে, আবার কখনো খু্বই খারাপ ব্যবহার করে। মাঝে মাঝে নিজেই ভালো হওয়ার চেষ্টা করে। পরক্ষণেই আবার কোনোরকম চিকিৎসা নিতে চায় না। আপনার সন্তানের যে অবস্থা, তাকে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য বোঝাতে হবে। আপনারা বোঝাতে না পারলে, যাদের কথা সে শুনে তাদের মাধ্যমে বোঝাতে হবে। বুঝিয়ে কোনো কাজ না হলে জোর করে তাকে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। এ মুহূর্তে চিকিৎসা ছাড়া তার জন্য আর কোনো বিকল্প নেই।
প্রশ্ন: আমার সন্তান অত্যন্ত খারাপ আচরণ করছে। স্থানীয় থানায় তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাকে পাঁচবার ভর্তি করা হয়েছে নিরাময়কেন্দ্রে। ফিরে এসে সে চাকরি করে। কিছুদিন পর আবার মাদক গ্রহণ করে। তখন সে জোর করে টাকা নিয়ে যায়। কোনো ওষুধ নিয়মিত খায় না। এ অবস্থায় আমাদের করণীয় কী?
পরমর্শ: আপনার আইনি ব্যবস্থাকে আমরা সমর্থন করি না। কিন্তু আপনি বললেন, সে অনেক টাকা নষ্ট করে ফেলেছে, জোর ইদানীং করে টাকা নিয়ে যায়। এগুলো আবেগের কথা। বাবা-মা সন্তানকে ভালোবাসবেন, কিন্তু তাকে নষ্ট হওয়ার জন্য নিশ্চয়ই টাকা দেবেন না। আর একবার ভয়ভীতি দেখিয়ে বা অত্যাচার করে টাকা নিতে পারলে বারবার সে এই সুযোগ নিতে থাকবে।
মাদক গ্রহণ করার যতগুলো সুযোগ আছে, সব কটি পথ বন্ধ করে দিতে হবে। মা-বাবা কোনোভাবেই সন্তানকে মাদক নেওয়ার জন্য টাকা দেবেন না। আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে যেন কোনো রকম সাহায্য না পায়, তাদের এ বিষয়ে সতর্ক করতে হবে। মাদক গ্রহণ করার যত অসুবিধা আছে, সব তাকে ভোগ করতে দিতে হবে। ফলে একসময় সে নিজ থেকে অনুভব করবে যে এভাবে আর চলতে পারে না। নিজের ভেতর থেকে ভালো হওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করবে। মাদকাসক্ত রোগী যখন নিজে ভালো হতে চায়, কেবল তখনই তাকে সম্পূর্ণ ভালো করা সম্ভব। আপনার সন্তানের ক্ষেত্রে খুবই আশাবাদের বিষয় যে তাকে ভালো করা সম্ভব।
প্রশ্ন: আমার সন্তান দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। তাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে এখন আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ছি। আমাদের করণীয় কী?
পরামর্শ: মাদকাসক্ত রোগীরা সব সময় এক রকম থাকে না। একসময় তাদের মধ্যে গভীর উপলব্ধি আসে। তারা ভালো হতে চায়। তখন যাতে তাকে সাহায্য করতে পারেন, এ জন্য মা-বাবাকে সব সময় সুস্থ থাকতে হবে। মাদকাসক্ত রোগীর চিকিৎসার একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো চিকিৎসকের সঙ্গে তার পরিবারের অভিভাবকদের কাউন্সেলিং করতে হয়। আপনারা মানসিক যন্ত্রণায় অসুস্থ হয়ে পড়লে সব শেষ হয়ে যাবে। এ জন্য আমরা অনেক সময় মাদকাসক্ত রোগীর মা-বাবাকেও চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসি। মা-বাবার সুস্থ থাকা ও মাদকাসক্ত সন্তানকে দেখাশোনার জন্য মা-বাবার কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা আছে। আপনারা এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন।
প্রশ্ন: আমার সন্তান মাদকাসক্ত। তাকে চার-পাঁচবার ভালো করা হয়েছে। এখন গ্রামে মাদকাসক্ত হয়ে অসুস্থ। সে চায় আমি গ্রামে যাই। এ ক্ষেত্রে তাকে কি বলতে পারি, ‘তুমি যদি সুস্থ হতে চাও, তাহলে ঢাকায় আসো। আমি গ্রামে যাব না’? এ কৌশল নিতে পারি কি না?
পরামর্শ: এটি নির্ভর করে আপনার সন্তানের ব্যক্তিত্বের ওপর। এ ধরনের কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। তাকে অনেক সময় বিপদের মধ্যে ফেলে বুঝতে দেওয়া উচিত যে সে যা করছে তা ঠিক হচ্ছে না। আবার ক্ষতিও হতে পারে। সবকিছু নির্ভর করবে তার মানসিক অবস্থার ওপর। তবে তার জন্য সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন হলো তাকে দ্রুত নিরাময়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া। আর আপনি মা, আপনাকে অনেক ধৈর্য ধরতে হবে। যখন মন ভালো থাকে, তখন তার ভালো গুণের কথা, কাজের কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। তার সঙ্গে কোনো রকম তর্কে যাওয়া যাবে না। বরং সে যা বলে তা মন দিয়ে শুনতে হবে। একসময় সে তার সব সমস্যার কথা, মনের কথা বলবে; ভালো হওয়ার কথা বলবে। তখন তাকে আমাদের কাছে নিয়ে আসতে হবে। আপনার সন্তান চার-পাঁচবার ভালো হয়েছে। আমরা এমন সব রোগীকে চিকিৎসা করে ভালো করেছি যারা ১০ বার, ১৫ বার এমনকি ১৮ বার মাদকাসক্ত হওয়ার পরও ভালো হয়েছে। সে জন্য আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে। আপনার সন্তান নিশ্চয়ই ভালো হবে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, মাদকাসক্ত রোগীর পরিবারের অভিভাবকদের কাউন্সেলিং করতে হয়। তাহলে মাদকাসক্ত রোগীর চিকিৎসা অনেক সহজ হয়। আপনার পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করলে ভালো হয়।
প্রশ্ন: ১৫ বছর ধরে আমি ছেলের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে অধৈর্য হয়ে গেছি। এখন সে চিকিৎসা নিতে চায় না। তার নামে থানায় কেস করা হয়েছে। এখন আমার কী করার আছে?
পরামর্শ: মনে করতে হবে যে আপনি একটি যুদ্ধে নেমেছেন। নেশার সঙ্গে আপনার পরিবারের যুদ্ধ। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে হবে। এ যুদ্ধে আপনাকে জিততে হবে। যুদ্ধে নানারকম কৌশল নিতে হয়। কখনো এগিয়ে যেতে হয়, কখনো পিছিয়ে আসতে হয়। আপনি এ কৌশলগুলো অবলম্বন করছেন। জয় আপনার আসবেই। এই জয়ের জন্য প্রথম প্রয়োজন নিজেকে সুস্থ রাখা। এটি নিয়ে সব সময় চিন্তা করে নিজের শরীর নষ্ট করবেন না। মাদকাসক্তিকে আর দশটি রোগের মতোই মনে করবেন। এর বেশি কিছু ভাবার দরকার নেই। আপনার ছেলে বেশি খারাপ আচরণ করছে। এ ক্ষেত্রে আপনি কিছুটা শক্ত হয়েছেন। ঠিকই আছে। কিন্তু আপনি থানায় যে কেস করেছেন, এটি আপনার ও আপনার সন্তান দুজনের জন্য সমস্যা তৈরি করবে। আপনি বলেছেন, সে চিকিৎসা নিতে চায় না। এ ক্ষেত্রে তার চিকিৎসাকেন্দ্র পরিবর্তন করে দেখতে পারেন। একই জায়গায় বারবার যেতে যেতে সে হতাশা বোধ করতে পারে।
প্রশ্ন: সাধারণত দেখা যায়, চিকিৎসার পর ভালো হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আবার তারা মাদকাসক্ত হচ্ছে। তাহলে এটিকে কি পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা বলা যাবে, নাকি ত্রুটিপূর্ণ চিকিৎসা?
পরামর্শ: চিকিৎসা যখন হয়, তখন পূর্ণাঙ্গ হয়। ভালো থাকাটা নির্ভর করে রোগী কতটা ভালো থাকতে চায় এবং পরিবারের সদস্যরা তাকে কতটা সহযোগিতা করে, তার ওপর। সাধারণত চিকিৎসার পর রোগী ও অভিভাবকেরা মনে করেন যে আর কোনো দায়দায়িত্ব নেই। মাদকাসক্ত রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসার পরও একটা চিকিৎসা থাকে। দায়দায়িত্ব আরও আনেক বেড়ে যায়। অনেকেই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেন না।
আপনারা জানেন, রোগীদের নিরাময়কেন্দ্র থেকে ছেড়ে দেওয়ার পর তাদের কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, প্রথম প্রথম কয়েক দিন মেনে চললেও তারপর আর ঠিকমতো নিয়ম মানা হয় না। ফলে রোগীরা আবার মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।
রোগীর প্রতি আরও কিছু বিশেষ নির্দেশনা থাকে; যেমন—রোগীর নিজেকে সব সময় ভালো থাকার চিন্তা করতে হবে, মাদকাসক্ত বন্ধুদের সঙ্গে মেশা যাবে না, কেউ মাদক নিতে বললে তাকে শক্তি ও সাহসের সঙ্গে ‘না’ বলতে হবে, মানুষের জন্য কিছু ভালো কাজ করার কথা ভাবতে হবে, বড় বড় মানুষের জীবনী পড়তে হবে, নিজেকে সব সময় ভালো কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখতে হবে। সামান্য মাদকের কাছে আত্মসমর্পণ করে ধ্বংস করার জন্য এ জীবন নয়। আমরা দেখেছি, যত বড় মাদকাসক্ত রোগীই হোক না কেন, সে নিজে যদি ভালো হতে ইচ্ছে করে তাহলে অবশ্যই সে ভালো হতে পারে।
প্রশ্ন: আমার স্বামী চার-পাঁচ বছর ধরে মাদক নিচ্ছে। সে প্রায় সব ধরনের মাদক নেয়। অনেক বুঝিয়েছি, কোনো কাজ হচ্ছে না। আমাদের একমাত্র সন্তানের অপারেশনের সময় ছয় মাস ভালো ছিল। তারপর আবার শুরু করেছে। এখন আমার কী করার আছে?
পরামর্শ: যত দ্রুত সম্ভব আপনার স্বামীকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে। কিন্তু উনি একজন আত্মনির্ভরশীল মানুষ। এ ক্ষেত্রে যদি নিজে আসতে না চান তাহলে বিষয়টি কঠিন হয়ে যাবে। ছয় মাস আপনার স্বামী ভালো ছিলেন। উনি যদি ইচ্ছে করেন তাহলে সারা জীবন ভালো থাকতে পারবেন। মাদক গ্রহণের ক্ষেত্রে বিপদগামী বন্ধুরাই হচ্ছে আসল শত্রু। একমাত্র বন্ধুদের জন্যই অনেক মেধাবী ছেলে মাদক নিয়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আপনার স্বামী যেহেতু সচেতন মানুষ, তাঁকেই ঠিক করতে হবে যে তিনি আর বন্ধুদের সঙ্গে চলবেন না। আরেকটা বিষয় হলো, তিনি যে জায়গাগুলোতে গেলে মাদক নিতে ইচ্ছে করবে, তাঁকে নিজ থেকেই ভাবতে হবে যে ওই জায়গাগুলোতে যাবেন না। মাদকাসক্তদের ক্ষেত্রে এক-একজন রোগীর জন্য এক-এক ধরনের কৌশল থাকে। মাদক গ্রহণের তিনটি মাত্রা আছে—স্বল্প, মধ্য ও তীব্র। আপনার স্বামী শিরিঞ্জ বা ইনজেকশন নিচ্ছে। এটিকে আমরা বলি তীব্র মাত্রার মাদকাসক্তি। এ ক্ষেত্রে কারও একার পক্ষে এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব। এ যুদ্ধে আপনি একা পেরে উঠবেন না। আপনার স্বামীর বিষয়ে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
প্রশ্ন: আমার ছেলে ১৪ বছর ধরে মাদক নিচ্ছে। তার চার বছরের একটি সন্তান আছে। সব ধরনের মাদক গ্রহণ করে। কুমিল্লায় একটি নিরাময়কেন্দ্রে তাকে ভর্তি করা হয়েছিল, সেখানে চিকিৎসা হয় না; তারা আটকিয়ে রাখে এবং মারধর করে। এখন সে কোনো নিরাময়কেন্দ্রে যেতে চায় না। রাতে জেগে থাকে, দিনে ঘুমায়। সবার সঙ্গে রাগারাগি করে। এমনকি তার চার বছরের সন্তান ও ছোট বোনকে মারে।
পরামর্শ: আপনার সন্তানকে একটি নিরাময়কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছিল, যেখানে চিকিৎসার পরিবর্তে তার ওপর অত্যাচার করা হয়েছে। এ জন্য হয়তো সব ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতির ওপর তার ভীতি তৈরি হয়েছে। কিন্তু মাদকাসক্তির চিকিৎসা সম্পূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক। মাদকের কোনো পর্যায়ের চিকিৎসার মধ্যেই মারপিট নেই। দ্রুত তাকে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন, সাইদুজ্জামান রওশন।
গ্রন্থণা: আশফাকুজ্জামান
No comments