অব্যবস্থাপনা-চট্টগ্রাম বন্দর অস্থির কেন? by জহির আহমেদ
চট্টগ্রাম বন্দরে আবার অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। বলা হচ্ছে, ‘শ্রমিক অসন্তোষ’ এ অস্থিরতার জন্য দায়ী। ‘গত এক সপ্তাহে আংশিক অচল থাকায় বহির্নোঙর ও জেটিতে ৪৯টি জাহাজ আটকা পড়ে’ (প্রথম আলো, ১৪ অক্টোবর, ২০১০)। নৌপরিবহনমন্ত্রীর বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পুনঃপুন বৈঠক কার্যকর কোনো ফল বয়ে আনেনি।
অনিবার্য হস্তক্ষেপ হিসেবে সেনাবাহিনীকে ডেকে আনা হয় বন্দরের নিরাপত্তার জন্য। ফলে বন্দর এখন অনেকটাই ‘স্থিতিশীল’। জাহাজজট ক্রমেই কমে আসছে, আমদানি-রপ্তানিকারকেরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন, গণমাধ্যমগুলো চট্টগ্রাম বন্দরের প্রাত্যহিক ‘স্বাভাবিকতার’ প্রতিবেদন দিচ্ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই স্বাভাবিকতার স্থায়িত্বকাল কত দিন? যে শ্রমিক অসন্তোষকে কেন্দ্র করে অচলাবস্থার সৃষ্টি হলো, তাকে পাশ কাটিয়ে সেনাবাহিনী দিয়ে সদ্যনিযুক্ত বার্থ অপারেটররা কাজ কত দিন চালু রাখতে পারবে? মৌলিক প্রশ্ন হলো, গণতান্ত্রিক সরকারের এমন কী অসহায়ত্ব দেখা দিল, যার কারণে ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে (নিজস্ব দলীয় শ্রমিক সংগঠনসহ) আস্থায় না এনে সেনাবাহিনীকে নির্ভরযোগ্য মনে করা হলো? আসলে একটি জটিল এবং দীর্ঘ সময়ের অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর টেকনিক্যাল সমাধান পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলবে বলেই মনে হয়।
২০০৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দরসংক্রান্ত একটি গবেষণায় যুক্ত ছিলাম। দেখেছি কনটেইনার-জট, জাহাজে ওঠানো-নামানোর দীর্ঘ সময়কাল—সর্বোপরি দুর্নীতির ভয়াবহতা ছিল। শুনেছিলাম ডক শ্রমিক ম্যানেজমেন্ট বোর্ড বিলুপ্ত করার তোড়জোড়। অভিযোগ ছিল শ্রমিক-রাজনীতি, দলাদলি, ব্যক্তিস্বার্থে শ্রমিকদের রাজনৈতিকীকরণের। বন্দরের অদক্ষতার পর্বতপ্রমাণ অভিযোগ শুনতে পেয়েছিলাম সর্বত্র।
ঠিক পাঁচ বছর পর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আবার আরেকটি গবেষণায় চট্টগ্রাম বন্দর ও এর কার্যক্রম দেখার সুযোগ পাই। লক্ষ করি কার্গো হ্যান্ডলিং-কাজে প্রচুর অগ্রগতি, জাহাজে ওঠানো-নামানোর সময়কাল তিন-চার দিনে নেমে এসেছে, দৃশ্যমান দুর্নীতি অনেকাংশে কমেছে, ওয়ান স্টপ সার্ভিস বন্দরের কাজে গতি এনেছে, কাস্টমসে অটোমেশন চালু হয়েছে—এ রকম আরও কিছু। পদক্ষেপগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের টাস্কফোর্সের হস্তক্ষেপের ফল। এক অর্থে বন্দর সংস্কারের চলমান প্রক্রিয়া।
বন্দর কর্তৃপক্ষসহ বহু স্টেকহোল্ডার মনে করেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর চট্টগ্রাম বন্দর অনেক স্বাভাবিক ছিল। নিয়মনীতির মধ্যেই সবকিছু চলছিল। ওই সময় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছিল। ডক শ্রমিকদের ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেক’ কর্মসূচির মাধ্যমে বদলি শ্রমিক, অতিরিক্ত শ্রমিক ও বয়স্ক শ্রমিকদের বিদায় করা হলো। এ পদক্ষেপগুলো ছিল বন্দরের ‘দক্ষতা’ বৃদ্ধি করার জন্য। তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন হলো: বন্দরের এই স্থিতিশীলতা মানবসম্পদ বিষয়টিকে কীভাবে দেখেছে? অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার শ্রমিক ছাঁটাই প্রকল্পটি কীভাবে সম্পাদন করেছে?
বেশির ভাগ সাধারণ শ্রমিক জানিয়েছেন যে তাঁদের সংগঠন, এমনকি ব্যক্তিক পর্যায়েও, আলোচনা না করে তাঁদের চলে যেতে বলা হয়েছে। ক্ষতিপূরণ নিয়েও বিতর্ক আছে। ডক শ্রমিক বোর্ড বিলুপ্ত করে শ্রমিকদের বার্থ অপারেটিং সিস্টেমে আনা হলো। হারিয়ে যায় তাঁদের মার্চেন্ট শ্রমিক, ডক শ্রমিক কিংবা স্টিভিডোরিং কর্মচারী পরিচিতি। বন্দর কর্তৃপক্ষ ৫৭-ঊর্ধ্ব ৯০০ ডক শ্রমিককে অবসর দেয়। চার হাজার ১৯২ ডক শ্রমিকদের মধ্যে তিন হাজার ৯৬৭ জন চেকের মাধ্যমে অবসরের টাকা পান। এটা ছিল বন্দর কর্তৃপক্ষের হিসাব।
বাস্তবে এর সত্যতা পাওয়া দুষ্কর। সব শ্রমিক তাঁদের প্রাপ্য টাকা পাননি। ৫৭ বছরে অবসরে যাওয়ার হিসাবটিও ছিল সমস্যাজনক। তাঁরা বঞ্চিত হন প্রকৃত গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড ও কল্যাণ তহবিলের টাকা থেকে। মার্চেন্ট শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। পাঁচ হাজার শ্রমিক আগে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট দ্বারা নিযুক্ত হতেন। নতুন বার্থ অপারেটিং সিস্টেমে রেজিস্টার্ড দুই হাজার ৯০৩ জনকে আত্তীকরণ করা হয়েছে। বাকি শ্রমিকেরা তাঁদের ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি কিংবা পুনর্বহালও হতে পারেননি। একই রকমের ভাগ্য ঘটেছে স্টিভিডোরিং স্টাফদের ক্ষেত্রে।
এক হাজার ৪৩৫ জন স্টাফের সবাই ২০০৭ সালের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক স্কিমের আওতায় আসেন। অনেকেই (মতান্তরে ২৮৭ জন) তখন পর্যন্ত তাঁদের টাকা পাননি। বন্দর সংস্কারের অংশ হিসেবে বার্থ অপারেটিং সিস্টেম চালু হয়েছে বলে দাবি করা হয়। ২০০৭ সালের ১৬ মে এই সিস্টেম চালু হওয়ার ফলে শ্রমিকেরা নিজেদের অসহায় মনে করতে শুরু করেন। ১৩টি বার্থ অপারেটর তাদের ইচ্ছামাফিক শ্রমিক নিয়োগ করে। তাদের স্বাধীনতা রয়েছে বাইরে থেকে শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার।
বন্দরের শ্রমিকেরা যে কারণে বেপরোয়া তার প্রধান কারণ: বর্তমান নৌমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী, দুই হাজার ৬০০ তালিকাভুক্ত শ্রমিক নিয়োগ পেতে কর্তৃপক্ষ ও বার্থ অপারেটরদের চাপ সৃষ্টি করেন। কিন্তু বার্থ অপারেটররা তাঁদের নিয়োগ দিতে অস্বীকার করে। স্বভাবতই বন্দরের অভ্যন্তরে শ্রমিকদের সঙ্গে বিরোধ অনিবার্য হয়ে পড়ে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বন্দরের গতিশীলতা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়। নৌপরিবহনমন্ত্রী ও শ্রম প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে ঢাকায় একাধিক বৈঠকে বিলুপ্তিকৃত ডক শ্রমিকদের পুনর্বহাল করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। বন্দরসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিও চট্টগ্রাম বন্দরে একই কথা বলেছে। ওই প্রতিশ্রুতি শ্রমিকদের মৌলিক দাবি-দাওয়ায় পরিণত হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই দাবি-দাওয়াকে শ্রমিকদের অন্তঃকলহ, দলাদলি তথা রাজনৈতিকীকরণের আবরণ দেওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরের সংকটের মূল জায়গায় মনোযোগ দিতে পারেনি যেমন নিকট অতীতের সরকারগুলো, তেমনি বর্তমান সরকারও।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ হচ্ছে বন্দরের প্রশাসক, বন্দর ব্যবস্থাপনা সমন্বয় ও বন্দর কার্যক্রমের পরিকল্পনার দায়িত্ব তার। বন্দরের অভ্যন্তরে সেবা প্রদান যেমন কার্গো হ্যান্ডলিং, যন্ত্রপাতি ও পরিচালন এবং নিরাপত্তা প্রদানও বন্দর কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। বাস্তবে লক্ষ করি, বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্বের অভাবে তার হাত বাঁধা।
বন্দরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডার যেমন পোর্ট ইউজার ফোরাম, চট্টগ্রাম চেম্বারস, শ্রমিক সংগঠন, কাস্টমস, সিঅ্যান্ডএফ, বার্থ অপারেটর, বিজিএমইএ, ব্যক্তিমালিকানাধীন ডিপো, আমদানি-রপ্তানিকারক—এদের মধ্যে সমন্বয়ের বড় অভাব। প্রতিটি স্টেকহোল্ডার নিজস্ব স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়। বিভিন্ন সময়ে স্টেকহোল্ডারদের স্বার্থগত সংঘাত চট্টগ্রাম বন্দরকে অস্থিতিশীল করে তোলে। বন্দরের দক্ষতা ও গতিশীলতা বৃদ্ধিকল্পে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, কখনো শ্রমিক সংগঠন, কখনো পোর্ট ইউজার ফোরামের দ্বন্দ্ব বন্দরের জটিলতা তৈরি করে।
বন্দরের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে রয়েছে অস্থিরতা। ২০০৯-এর এপ্রিলে সংসদীয় কমিটি বন্দর পরিদর্শন করে এবং শ্রমিক স্বার্থ রক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে। বাছাইকৃত ডক শ্রমিকদের কাজে পুনর্বহালসহ সিপিএর দক্ষতা বৃদ্ধির সুপারিশও করে সংসদীয় কমিটি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এসব সুপারিশ আমলে নেওয়া হয়নি। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়সহ সিপিএ বন্দরে ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা কত তা আজও নির্ধারণ করতে পারেনি। ফলে রাজনৈতিক সুবিধাবাদ ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠেছে। শ্রমিক সংগঠনগুলোর উপদলীয় কোন্দল অবিশ্বাস্য এবং তাদের ওপর সিপিএর নিয়ন্ত্রণহীনতা, স্টেকহোল্ডারদের আন্তযোগাযোগের অভাব—সবই চট্টগ্রাম বন্দরকে অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এ অবস্থা যেন ‘ট্র্যাজেডি অব দ্য কমন্স’, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়, জাতীয় স্বার্থের জন্য সামষ্টিক চেষ্টা থেকে যায় অনুচ্চারিত। বন্দরের মালিক সিপিএর মাথায় অনেক ছাতা—মন্ত্রণালয়, সাংসদ ও সংসদীয় কমিটি, স্থানীয় রাজনৈতিক চাপ, বিভিন্ন ধরনের স্টেকহোল্ডার, পোর্ট ইউজার ফোরাম, ট্রেড ইউনিয়ন ইত্যাদি। সময় সময় যুক্ত হতে থাকে সেনাবাহিনীর জরুরি হস্তক্ষেপ। তাহলে সিপিএ কী করছে?
চট্টগ্রাম বন্দরকে গতিশীল করতে বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এই দায়িত্ব নিতে পারে। সিপিএর ব্যবস্থাপনা কাঠামো, জনবল বৃদ্ধি ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি। সিপিএকে ল্যান্ডলর্ড মডেলের আওতায় আনতে হবে, যেখানে সরকারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ থাকবে না কিন্তু রেগুলেটরি ভূমিকা থাকবে। মানবসম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারকরণের প্রতি নজর দিতে হবে সিপিএকে। বার্থ শ্রমিক সংগঠনসহ বন্দর ব্যবহারকারী ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে সংলাপ করা জরুরি। একটি সমন্বিত সমাধানের পথ খুঁজে বের করার মাধ্যমে স্থিতিশীল চট্টগ্রাম বন্দরের আশা আমরা করতেই পারি।
ড. জহির আহমেদ: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
zahmed69@hotmail.com
প্রশ্ন হচ্ছে, এই স্বাভাবিকতার স্থায়িত্বকাল কত দিন? যে শ্রমিক অসন্তোষকে কেন্দ্র করে অচলাবস্থার সৃষ্টি হলো, তাকে পাশ কাটিয়ে সেনাবাহিনী দিয়ে সদ্যনিযুক্ত বার্থ অপারেটররা কাজ কত দিন চালু রাখতে পারবে? মৌলিক প্রশ্ন হলো, গণতান্ত্রিক সরকারের এমন কী অসহায়ত্ব দেখা দিল, যার কারণে ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে (নিজস্ব দলীয় শ্রমিক সংগঠনসহ) আস্থায় না এনে সেনাবাহিনীকে নির্ভরযোগ্য মনে করা হলো? আসলে একটি জটিল এবং দীর্ঘ সময়ের অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর টেকনিক্যাল সমাধান পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলবে বলেই মনে হয়।
২০০৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দরসংক্রান্ত একটি গবেষণায় যুক্ত ছিলাম। দেখেছি কনটেইনার-জট, জাহাজে ওঠানো-নামানোর দীর্ঘ সময়কাল—সর্বোপরি দুর্নীতির ভয়াবহতা ছিল। শুনেছিলাম ডক শ্রমিক ম্যানেজমেন্ট বোর্ড বিলুপ্ত করার তোড়জোড়। অভিযোগ ছিল শ্রমিক-রাজনীতি, দলাদলি, ব্যক্তিস্বার্থে শ্রমিকদের রাজনৈতিকীকরণের। বন্দরের অদক্ষতার পর্বতপ্রমাণ অভিযোগ শুনতে পেয়েছিলাম সর্বত্র।
ঠিক পাঁচ বছর পর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আবার আরেকটি গবেষণায় চট্টগ্রাম বন্দর ও এর কার্যক্রম দেখার সুযোগ পাই। লক্ষ করি কার্গো হ্যান্ডলিং-কাজে প্রচুর অগ্রগতি, জাহাজে ওঠানো-নামানোর সময়কাল তিন-চার দিনে নেমে এসেছে, দৃশ্যমান দুর্নীতি অনেকাংশে কমেছে, ওয়ান স্টপ সার্ভিস বন্দরের কাজে গতি এনেছে, কাস্টমসে অটোমেশন চালু হয়েছে—এ রকম আরও কিছু। পদক্ষেপগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের টাস্কফোর্সের হস্তক্ষেপের ফল। এক অর্থে বন্দর সংস্কারের চলমান প্রক্রিয়া।
বন্দর কর্তৃপক্ষসহ বহু স্টেকহোল্ডার মনে করেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর চট্টগ্রাম বন্দর অনেক স্বাভাবিক ছিল। নিয়মনীতির মধ্যেই সবকিছু চলছিল। ওই সময় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছিল। ডক শ্রমিকদের ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেক’ কর্মসূচির মাধ্যমে বদলি শ্রমিক, অতিরিক্ত শ্রমিক ও বয়স্ক শ্রমিকদের বিদায় করা হলো। এ পদক্ষেপগুলো ছিল বন্দরের ‘দক্ষতা’ বৃদ্ধি করার জন্য। তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন হলো: বন্দরের এই স্থিতিশীলতা মানবসম্পদ বিষয়টিকে কীভাবে দেখেছে? অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার শ্রমিক ছাঁটাই প্রকল্পটি কীভাবে সম্পাদন করেছে?
বেশির ভাগ সাধারণ শ্রমিক জানিয়েছেন যে তাঁদের সংগঠন, এমনকি ব্যক্তিক পর্যায়েও, আলোচনা না করে তাঁদের চলে যেতে বলা হয়েছে। ক্ষতিপূরণ নিয়েও বিতর্ক আছে। ডক শ্রমিক বোর্ড বিলুপ্ত করে শ্রমিকদের বার্থ অপারেটিং সিস্টেমে আনা হলো। হারিয়ে যায় তাঁদের মার্চেন্ট শ্রমিক, ডক শ্রমিক কিংবা স্টিভিডোরিং কর্মচারী পরিচিতি। বন্দর কর্তৃপক্ষ ৫৭-ঊর্ধ্ব ৯০০ ডক শ্রমিককে অবসর দেয়। চার হাজার ১৯২ ডক শ্রমিকদের মধ্যে তিন হাজার ৯৬৭ জন চেকের মাধ্যমে অবসরের টাকা পান। এটা ছিল বন্দর কর্তৃপক্ষের হিসাব।
বাস্তবে এর সত্যতা পাওয়া দুষ্কর। সব শ্রমিক তাঁদের প্রাপ্য টাকা পাননি। ৫৭ বছরে অবসরে যাওয়ার হিসাবটিও ছিল সমস্যাজনক। তাঁরা বঞ্চিত হন প্রকৃত গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড ও কল্যাণ তহবিলের টাকা থেকে। মার্চেন্ট শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। পাঁচ হাজার শ্রমিক আগে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট দ্বারা নিযুক্ত হতেন। নতুন বার্থ অপারেটিং সিস্টেমে রেজিস্টার্ড দুই হাজার ৯০৩ জনকে আত্তীকরণ করা হয়েছে। বাকি শ্রমিকেরা তাঁদের ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি কিংবা পুনর্বহালও হতে পারেননি। একই রকমের ভাগ্য ঘটেছে স্টিভিডোরিং স্টাফদের ক্ষেত্রে।
এক হাজার ৪৩৫ জন স্টাফের সবাই ২০০৭ সালের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক স্কিমের আওতায় আসেন। অনেকেই (মতান্তরে ২৮৭ জন) তখন পর্যন্ত তাঁদের টাকা পাননি। বন্দর সংস্কারের অংশ হিসেবে বার্থ অপারেটিং সিস্টেম চালু হয়েছে বলে দাবি করা হয়। ২০০৭ সালের ১৬ মে এই সিস্টেম চালু হওয়ার ফলে শ্রমিকেরা নিজেদের অসহায় মনে করতে শুরু করেন। ১৩টি বার্থ অপারেটর তাদের ইচ্ছামাফিক শ্রমিক নিয়োগ করে। তাদের স্বাধীনতা রয়েছে বাইরে থেকে শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার।
বন্দরের শ্রমিকেরা যে কারণে বেপরোয়া তার প্রধান কারণ: বর্তমান নৌমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী, দুই হাজার ৬০০ তালিকাভুক্ত শ্রমিক নিয়োগ পেতে কর্তৃপক্ষ ও বার্থ অপারেটরদের চাপ সৃষ্টি করেন। কিন্তু বার্থ অপারেটররা তাঁদের নিয়োগ দিতে অস্বীকার করে। স্বভাবতই বন্দরের অভ্যন্তরে শ্রমিকদের সঙ্গে বিরোধ অনিবার্য হয়ে পড়ে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বন্দরের গতিশীলতা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়। নৌপরিবহনমন্ত্রী ও শ্রম প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে ঢাকায় একাধিক বৈঠকে বিলুপ্তিকৃত ডক শ্রমিকদের পুনর্বহাল করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। বন্দরসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিও চট্টগ্রাম বন্দরে একই কথা বলেছে। ওই প্রতিশ্রুতি শ্রমিকদের মৌলিক দাবি-দাওয়ায় পরিণত হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই দাবি-দাওয়াকে শ্রমিকদের অন্তঃকলহ, দলাদলি তথা রাজনৈতিকীকরণের আবরণ দেওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরের সংকটের মূল জায়গায় মনোযোগ দিতে পারেনি যেমন নিকট অতীতের সরকারগুলো, তেমনি বর্তমান সরকারও।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ হচ্ছে বন্দরের প্রশাসক, বন্দর ব্যবস্থাপনা সমন্বয় ও বন্দর কার্যক্রমের পরিকল্পনার দায়িত্ব তার। বন্দরের অভ্যন্তরে সেবা প্রদান যেমন কার্গো হ্যান্ডলিং, যন্ত্রপাতি ও পরিচালন এবং নিরাপত্তা প্রদানও বন্দর কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। বাস্তবে লক্ষ করি, বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্বের অভাবে তার হাত বাঁধা।
বন্দরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডার যেমন পোর্ট ইউজার ফোরাম, চট্টগ্রাম চেম্বারস, শ্রমিক সংগঠন, কাস্টমস, সিঅ্যান্ডএফ, বার্থ অপারেটর, বিজিএমইএ, ব্যক্তিমালিকানাধীন ডিপো, আমদানি-রপ্তানিকারক—এদের মধ্যে সমন্বয়ের বড় অভাব। প্রতিটি স্টেকহোল্ডার নিজস্ব স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়। বিভিন্ন সময়ে স্টেকহোল্ডারদের স্বার্থগত সংঘাত চট্টগ্রাম বন্দরকে অস্থিতিশীল করে তোলে। বন্দরের দক্ষতা ও গতিশীলতা বৃদ্ধিকল্পে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, কখনো শ্রমিক সংগঠন, কখনো পোর্ট ইউজার ফোরামের দ্বন্দ্ব বন্দরের জটিলতা তৈরি করে।
বন্দরের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে রয়েছে অস্থিরতা। ২০০৯-এর এপ্রিলে সংসদীয় কমিটি বন্দর পরিদর্শন করে এবং শ্রমিক স্বার্থ রক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে। বাছাইকৃত ডক শ্রমিকদের কাজে পুনর্বহালসহ সিপিএর দক্ষতা বৃদ্ধির সুপারিশও করে সংসদীয় কমিটি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এসব সুপারিশ আমলে নেওয়া হয়নি। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়সহ সিপিএ বন্দরে ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা কত তা আজও নির্ধারণ করতে পারেনি। ফলে রাজনৈতিক সুবিধাবাদ ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠেছে। শ্রমিক সংগঠনগুলোর উপদলীয় কোন্দল অবিশ্বাস্য এবং তাদের ওপর সিপিএর নিয়ন্ত্রণহীনতা, স্টেকহোল্ডারদের আন্তযোগাযোগের অভাব—সবই চট্টগ্রাম বন্দরকে অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এ অবস্থা যেন ‘ট্র্যাজেডি অব দ্য কমন্স’, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়, জাতীয় স্বার্থের জন্য সামষ্টিক চেষ্টা থেকে যায় অনুচ্চারিত। বন্দরের মালিক সিপিএর মাথায় অনেক ছাতা—মন্ত্রণালয়, সাংসদ ও সংসদীয় কমিটি, স্থানীয় রাজনৈতিক চাপ, বিভিন্ন ধরনের স্টেকহোল্ডার, পোর্ট ইউজার ফোরাম, ট্রেড ইউনিয়ন ইত্যাদি। সময় সময় যুক্ত হতে থাকে সেনাবাহিনীর জরুরি হস্তক্ষেপ। তাহলে সিপিএ কী করছে?
চট্টগ্রাম বন্দরকে গতিশীল করতে বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এই দায়িত্ব নিতে পারে। সিপিএর ব্যবস্থাপনা কাঠামো, জনবল বৃদ্ধি ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি। সিপিএকে ল্যান্ডলর্ড মডেলের আওতায় আনতে হবে, যেখানে সরকারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ থাকবে না কিন্তু রেগুলেটরি ভূমিকা থাকবে। মানবসম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারকরণের প্রতি নজর দিতে হবে সিপিএকে। বার্থ শ্রমিক সংগঠনসহ বন্দর ব্যবহারকারী ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে সংলাপ করা জরুরি। একটি সমন্বিত সমাধানের পথ খুঁজে বের করার মাধ্যমে স্থিতিশীল চট্টগ্রাম বন্দরের আশা আমরা করতেই পারি।
ড. জহির আহমেদ: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
zahmed69@hotmail.com
No comments