পাকিস্তান-গণতন্ত্র আবারও হুমকির মুখে by আসমা জাহাঙ্গীর
পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আবারও ইতিহাসের অংশ হয়ে যেতে পারে, বিশ্ববাসী অবাক হয়ে ভাববে, সামনে সুদিন আসবে মনে করে আমরা কীভাবে ইচ্ছে করেই নিজেদের বিষাক্ত করে তুলতে পারি। যাঁরা ক্ষমতায় আসীন, তাঁরা জনসাধারণকে যুগের পর যুগ ধরে নির্মমভাবে দলিত করে চলেছেন। কিন্তু জনগণ কিছুই বোঝে না—এ কথা ঠিক নয়।
বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে ক্ষমতাধরদের বিভিন্ন পক্ষের প্রত্যেকের নিজ নিজ স্বার্থরক্ষার চেষ্টায় নানা রকম কারসাজির মুখে জনসাধারণ হয়তো অসহায় বোধ করে, কিন্তু সবশেষে সত্যেরই জয় হয়।
পাকিস্তান এখন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার আরেক পর্যায়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, এর পরিণতি হতে পারে আবারও এক স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা। শেষ পর্যন্ত হয়তো হুঁশ ফিরে আসবে, কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় অনেকের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে, অনেক আশার মৃত্যু ঘটবে। পাকিস্তানের এখন দুর্দিন। চার বছরের গণতান্ত্রিক শাসনে জনসাধারণ আনন্দিত হওয়ার মতো তেমন কিছুই পায়নি। অন্ধকার রাত আর শূন্য পেটের স্মৃতি গণতন্ত্রের প্রতীক হতে শুরু করবে। রাজনৈতিক দলগুলো টিভিতে কে কত বড় বড় কথা বলতে পারে, জনগণকে ধোঁকা দিতে কারা কত দক্ষ, তার ওপরই নির্ভর করবে তাদের মূল্যায়ন। একমাত্র ভরসার জায়গা ছিল বিচার বিভাগ, যার ওপর জনসাধারণ আস্থা রেখেছিল। কিন্তু দিন দিন বিচার বিভাগেরও অবক্ষয় ঘটেছে। আদালতের অনেক রায়কেই এখন আত্মপ্রশস্তিমূলক মনে হয়, বিভিন্ন বিচারকের বিচারের মানদণ্ড মনে হয় বিভিন্ন রকমের। যাঁরা সাংবিধানিক রুলিং অনুসরণ করেন, তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়গুলোর প্রতিটি দিক নিয়ে দ্বিমত প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে যেখানে দেখা যায়, সুয়োমোটো মামলাগুলো বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিচারের মানদণ্ড প্রয়োগে, ১৮৪(৩) অনুচ্ছেদের অধীনে মামলার আমলযোগ্যতা নির্ধারণে এবং বিচারপ্রক্রিয়ায় একই ধরনের মানদণ্ড প্রয়োগ করা হয় না।
প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মুহাম্মদ চৌধুরীর ছেলে আরসালান ইফতিখারের মামলাটিও কোনো ব্যতিক্রম নয়। পুরো রায়টি যুক্তির বিচারে দুর্বল এবং নিজের প্রশস্তি গাওয়ায় সবল বলে মনে হয়। শুধু একজন সম্মানিত বিচারকের একটি অতিরিক্ত নোট সম্ভবত এই রায়ের একটি সংযত দিক। বিচারপতি খিলজি আরিফ হোসেনের ওই অতিরিক্ত নোটে বলা হয়েছে: ‘বিচারক হিসেবে আমাদের প্রতি জনগণের বিশেষ দৃষ্টি থাকে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন এমন প্রত্যেক ব্যক্তিই জনগণের নজরদারির অধীন। যদিও সরকারি কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যরা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন না, তবু এই মামলার অভিযোগে যেসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্য দিয়ে এটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে তাঁদের পরিবারের সদস্যদের একান্ত ব্যক্তিগত ও সামাজিক আচরণ ও কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে অতিশয় সতর্কতা ও বিশেষ অধিকার রক্ষা করা প্রয়োজন।’
বিচারকদের সততা, তাঁদের রায়ের গুণগত মানের ভিত্তিতেই তাঁদের মূল্যায়ন হওয়া উচিত, আইনজীবী সমিতির কক্ষগুলোতে তাঁদের সমর্থকের সংখ্যা কত, তার ভিত্তিতে নয়। একইভাবে আইনজীবী সমিতিগুলোর স্বাধীনতা নিহিত থাকে তাদের নিরপেক্ষতা, সুস্থ পেশাদারির ওপর; তাদেরও মূল্যায়ন হওয়া উচিত আদালতে মামলার শুনানিতে তাদের সওয়াল-জবাবের গুণমানের ভিত্তিতে; বৈঠকগুলোতে তারা কত হইচই করতে পারে, তার ভিত্তিতে নয়। বিচার বিভাগ বা নির্বাহী বিভাগকে তুষ্ট করে চলা তাদের কাজ নয়। তাদের এজেন্ডা পরিচালিত হওয়া উচিত নীতির দ্বারা, কোনো রাজনৈতিক দলের গৃহীত অবস্থানের দ্বারা নয়।
আইনজীবী সম্প্রদায়ের সদস্যদের যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই আইনজীবী সমিতিগুলোতে অংশ নিতে না দেওয়া মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। আইনজীবীদের কোনো মামলা না নেওয়ার জন্য হুমকি দেওয়া স্বাধীন আইনজীবী সমিতির অনুশীলন হতে পারে না। কারণ, গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত অপরাধীদেরও আইনজীবী নিয়োগের অধিকার রয়েছে। অন্য আইনজীবীদের আইনজীবী সমিতির সদস্য হতে না দেওয়া, মক্কেলের মামলা না নেওয়ার জন্য ভয়ভীতি দেখানোর মধ্য দিয়ে আইনের শাসন কীভাবে বিকশিত হতে পারে? কীভাবেই বা আইনজীবী সমিতি ও আদালতের স্বাধীনতা বৃদ্ধি পেতে পারে?
আরসালান ইফতিখারের মামলাটি আইনজীবী মহলকে খেপিয়ে দিয়েছে। তাদের সন্দেহ, বিচার বিভাগের মর্যাদাহানি ঘটানোর উদ্দেশ্যে একজন সন্দেহভাজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ীকে নামানো হয়েছিল। এটা পুরোপুরিই সম্ভব। সবাই স্বীকার করেন, সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে জ্বালাতন করেছেন। আবার, পাকিস্তানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রধান বিচারপতির ছেলের অনৈতিক কর্মকাণ্ড ফাঁস করে দেওয়ার মতো বিরাট ঝুঁকি একজন ব্যবসায়ী নিতে যাবেন, এটাও প্রায় অকল্পনীয় বলে মনে হয়।
অন্যদিকে, ষড়যন্ত্রের আভাসগুলোরও বেশ ভিত্তি আছে। ওই ব্যবসায়ীর পেছনে হয়তো বেশ শক্ত খুঁটি আছে বলেই তিনি এত বড় ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। আর প্রধান বিচারপতির ছেলে আরসালান ইফতিখারের অর্জিত সম্পদের উৎস নিয়েও নানা সন্দেহ আছে।
ঘটনাটি হয়তো একটি কেলেঙ্কারিই বটে। তবু তা বিশদভাবে তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন। সুপ্রিম কোর্টের রুলিংয়ে এই ঘটনাকে ‘অতিশয় জাতীয় গুরুত্বসম্পন্ন’ বিষয় বলে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু তার বেশি আর অগ্রসর হয়নি। বিষয়টি হস্তান্তর করা হয়েছে অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে, যিনি নির্বাহী বিভাগের নিয়োজিত একজন কর্মকর্তা। এটাকে অযৌক্তিক বলে মনে হয়। কারণ, অ্যাটর্নি জেনারেল সেই নির্বাহী ব্যক্তিরই প্রতিনিধি, যিনি এই নোংরা ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে রয়েছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এ রকম একজন নির্বাহী কর্মকর্তার কাছ থেকে আরসালান ইফতিখার কি ন্যায়বিচার পাবেন? সুপ্রিম কোর্টের উচিত ছিল বিষয়টি নিয়ে আরও বেশি চিন্তাভাবনা করা।
ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
আসমা জাহাঙ্গীর: পাকিস্তানের মানবাধিকার নেত্রী ও আইনজীবী।
পাকিস্তান এখন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার আরেক পর্যায়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, এর পরিণতি হতে পারে আবারও এক স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা। শেষ পর্যন্ত হয়তো হুঁশ ফিরে আসবে, কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় অনেকের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে, অনেক আশার মৃত্যু ঘটবে। পাকিস্তানের এখন দুর্দিন। চার বছরের গণতান্ত্রিক শাসনে জনসাধারণ আনন্দিত হওয়ার মতো তেমন কিছুই পায়নি। অন্ধকার রাত আর শূন্য পেটের স্মৃতি গণতন্ত্রের প্রতীক হতে শুরু করবে। রাজনৈতিক দলগুলো টিভিতে কে কত বড় বড় কথা বলতে পারে, জনগণকে ধোঁকা দিতে কারা কত দক্ষ, তার ওপরই নির্ভর করবে তাদের মূল্যায়ন। একমাত্র ভরসার জায়গা ছিল বিচার বিভাগ, যার ওপর জনসাধারণ আস্থা রেখেছিল। কিন্তু দিন দিন বিচার বিভাগেরও অবক্ষয় ঘটেছে। আদালতের অনেক রায়কেই এখন আত্মপ্রশস্তিমূলক মনে হয়, বিভিন্ন বিচারকের বিচারের মানদণ্ড মনে হয় বিভিন্ন রকমের। যাঁরা সাংবিধানিক রুলিং অনুসরণ করেন, তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়গুলোর প্রতিটি দিক নিয়ে দ্বিমত প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে যেখানে দেখা যায়, সুয়োমোটো মামলাগুলো বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিচারের মানদণ্ড প্রয়োগে, ১৮৪(৩) অনুচ্ছেদের অধীনে মামলার আমলযোগ্যতা নির্ধারণে এবং বিচারপ্রক্রিয়ায় একই ধরনের মানদণ্ড প্রয়োগ করা হয় না।
প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মুহাম্মদ চৌধুরীর ছেলে আরসালান ইফতিখারের মামলাটিও কোনো ব্যতিক্রম নয়। পুরো রায়টি যুক্তির বিচারে দুর্বল এবং নিজের প্রশস্তি গাওয়ায় সবল বলে মনে হয়। শুধু একজন সম্মানিত বিচারকের একটি অতিরিক্ত নোট সম্ভবত এই রায়ের একটি সংযত দিক। বিচারপতি খিলজি আরিফ হোসেনের ওই অতিরিক্ত নোটে বলা হয়েছে: ‘বিচারক হিসেবে আমাদের প্রতি জনগণের বিশেষ দৃষ্টি থাকে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন এমন প্রত্যেক ব্যক্তিই জনগণের নজরদারির অধীন। যদিও সরকারি কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যরা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন না, তবু এই মামলার অভিযোগে যেসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্য দিয়ে এটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে তাঁদের পরিবারের সদস্যদের একান্ত ব্যক্তিগত ও সামাজিক আচরণ ও কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে অতিশয় সতর্কতা ও বিশেষ অধিকার রক্ষা করা প্রয়োজন।’
বিচারকদের সততা, তাঁদের রায়ের গুণগত মানের ভিত্তিতেই তাঁদের মূল্যায়ন হওয়া উচিত, আইনজীবী সমিতির কক্ষগুলোতে তাঁদের সমর্থকের সংখ্যা কত, তার ভিত্তিতে নয়। একইভাবে আইনজীবী সমিতিগুলোর স্বাধীনতা নিহিত থাকে তাদের নিরপেক্ষতা, সুস্থ পেশাদারির ওপর; তাদেরও মূল্যায়ন হওয়া উচিত আদালতে মামলার শুনানিতে তাদের সওয়াল-জবাবের গুণমানের ভিত্তিতে; বৈঠকগুলোতে তারা কত হইচই করতে পারে, তার ভিত্তিতে নয়। বিচার বিভাগ বা নির্বাহী বিভাগকে তুষ্ট করে চলা তাদের কাজ নয়। তাদের এজেন্ডা পরিচালিত হওয়া উচিত নীতির দ্বারা, কোনো রাজনৈতিক দলের গৃহীত অবস্থানের দ্বারা নয়।
আইনজীবী সম্প্রদায়ের সদস্যদের যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই আইনজীবী সমিতিগুলোতে অংশ নিতে না দেওয়া মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। আইনজীবীদের কোনো মামলা না নেওয়ার জন্য হুমকি দেওয়া স্বাধীন আইনজীবী সমিতির অনুশীলন হতে পারে না। কারণ, গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত অপরাধীদেরও আইনজীবী নিয়োগের অধিকার রয়েছে। অন্য আইনজীবীদের আইনজীবী সমিতির সদস্য হতে না দেওয়া, মক্কেলের মামলা না নেওয়ার জন্য ভয়ভীতি দেখানোর মধ্য দিয়ে আইনের শাসন কীভাবে বিকশিত হতে পারে? কীভাবেই বা আইনজীবী সমিতি ও আদালতের স্বাধীনতা বৃদ্ধি পেতে পারে?
আরসালান ইফতিখারের মামলাটি আইনজীবী মহলকে খেপিয়ে দিয়েছে। তাদের সন্দেহ, বিচার বিভাগের মর্যাদাহানি ঘটানোর উদ্দেশ্যে একজন সন্দেহভাজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ীকে নামানো হয়েছিল। এটা পুরোপুরিই সম্ভব। সবাই স্বীকার করেন, সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে জ্বালাতন করেছেন। আবার, পাকিস্তানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রধান বিচারপতির ছেলের অনৈতিক কর্মকাণ্ড ফাঁস করে দেওয়ার মতো বিরাট ঝুঁকি একজন ব্যবসায়ী নিতে যাবেন, এটাও প্রায় অকল্পনীয় বলে মনে হয়।
অন্যদিকে, ষড়যন্ত্রের আভাসগুলোরও বেশ ভিত্তি আছে। ওই ব্যবসায়ীর পেছনে হয়তো বেশ শক্ত খুঁটি আছে বলেই তিনি এত বড় ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। আর প্রধান বিচারপতির ছেলে আরসালান ইফতিখারের অর্জিত সম্পদের উৎস নিয়েও নানা সন্দেহ আছে।
ঘটনাটি হয়তো একটি কেলেঙ্কারিই বটে। তবু তা বিশদভাবে তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন। সুপ্রিম কোর্টের রুলিংয়ে এই ঘটনাকে ‘অতিশয় জাতীয় গুরুত্বসম্পন্ন’ বিষয় বলে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু তার বেশি আর অগ্রসর হয়নি। বিষয়টি হস্তান্তর করা হয়েছে অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে, যিনি নির্বাহী বিভাগের নিয়োজিত একজন কর্মকর্তা। এটাকে অযৌক্তিক বলে মনে হয়। কারণ, অ্যাটর্নি জেনারেল সেই নির্বাহী ব্যক্তিরই প্রতিনিধি, যিনি এই নোংরা ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে রয়েছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এ রকম একজন নির্বাহী কর্মকর্তার কাছ থেকে আরসালান ইফতিখার কি ন্যায়বিচার পাবেন? সুপ্রিম কোর্টের উচিত ছিল বিষয়টি নিয়ে আরও বেশি চিন্তাভাবনা করা।
ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
আসমা জাহাঙ্গীর: পাকিস্তানের মানবাধিকার নেত্রী ও আইনজীবী।
No comments