ইউরোপ-নয়া উদারতাবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নবায়ন by পিটার কাস্টার্স

ফ্রান্সের ডানপন্থী শাসক সারকোজির পেনশন সংস্কারের সিদ্ধান্তে ফ্রান্সজুড়ে উত্তাল বিক্ষোভ চলছে। ২১ অক্টোবর এ নিয়ে সিনেটে তীব্র বাদানুবাদও চলেছে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট অবসর গ্রহণের বয়স বাড়াতে চান। প্রথম দৃষ্টিতেই এটা অগ্রহণযোগ্য মনে হয়। প্রথমত, ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো ফ্রান্সের জনগণও দ্রুত বুড়িয়ে যাচ্ছে।


ফরাসি সরকার বলতে চাইছে, এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে অবসর নেওয়ার নিয়মকানুনও দ্রুতই বদলানো দরকার। স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ এবং অবসর-ভাতা পাওয়ার জন্য বর্তমান অনুমোদিত বয়স ৬০ থেকে বাড়িয়ে ৬২ করার প্রস্তাব করা হয়েছে (এরই মধ্যে এ-বিষয়ক আইন ফরাসি সংসদে পাসও হয়েছে)। এ ছাড়া বর্তমানে স্বাভাবিকভাবে মানুষ ৬৫ বছর বয়সে অবসর নিয়ে পূর্ণ অবসর-ভাতা পেয়ে এলেও সারকোজি তা বাড়িয়ে ৬৭ করতে চান। ইউরোপের অন্য কোথাও এ ধরনের সংস্কার জনগণকে তেমন বিক্ষুব্ধ করেনি। কিন্তু ফরাসিদের প্রতিক্রিয়া হয়েছে তীব্র এবং এক মাসজুড়ে যেভাবে ফ্রান্সের শহরগুলোতে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা সরকোজি সরকারের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হাজির করেছে।
এত বিপুল সাড়া পড়া এবং সামাজিক আন্দোলনে সফল হওয়ার বিষয়টি বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের দুটি বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে: ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস ও জঙ্গিত্ব। এক মাসজুড়ে সমগ্র ফ্রান্সে এবং একই সঙ্গে একাধিক শহরে গণবিক্ষোভ ও আন্দোলন চলছে। প্রতিবাদগুলোর মধ্যে ফ্রান্সের মূল ট্রেড ইউনিয়নগুলোর একতা দেখা যায়। বিক্ষোভ সমাবেশগুলোতে ব্যাপক জনতার অংশগ্রহণ এরই ফল। কিন্তু কয়েক বছর আগে এ রকম বিক্ষোভের সময় সরকারি পরিকল্পনার বিরুদ্ধে তাদের এই ঐক্য দেখা যায়নি। পর পর ছয় দিনজুড়ে যে বিক্ষোভ হলো, তাতে প্রতিদিন ১০ থেকে ৩০ লাখ মানুষ অংশ নিয়েছে। পাশাপাশি এসব বিক্ষোভ ব্যাপক জনগণের সহানুভূতিও অর্জন করেছে। ফ্রান্সের প্রধান দৈনিক লা মঁদে-এর ভাষ্য অনুসারে, ফ্রান্সের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ সারকোজি সরকারের পেনশন সংস্কারের বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভকে যৌক্তিক মনে করে।
ফরাসি ক্ষমতাসীনেরা এসব বিক্ষোভের ক্রমবর্ধমান জঙ্গি বৈশিষ্ট্য খেয়াল করেছে। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে সিনেটে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হওয়ার আগের দিনগুলো ছিল সবচেয়ে নাজুক। দেশের বড় বড় সব অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ধর্মঘট চলেছে। সরকারের জন্য সবচেয়ে হুমকির হলো, এই ধর্মঘটে তেল শোধনাগারের শ্রমিকদের অংশগ্রহণ। ফরাসি ও ইউরোপীয় সংবাদপত্রগুলো জানাচ্ছে, সপ্তাহ ধরে ফ্রান্সের ১২টি শোধনাগারই শ্রমিক ধর্মঘটে অচল হয়ে ছিল। এখানেই শেষ নয়, শ্রমিকেরা তেল বিতরণকেন্দ্রগুলো থেকে তেল পরিবহনও বন্ধ করার লক্ষ্যে তৎপর ছিল। এসবে জনগণের মধ্যে আন্দোলনের প্রতি সমর্থনে চিড় ধরার কথা থাকলেও অবরোধগুলো অতিমাত্রায় সফল ছিল। প্যারিসের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অর্ধেকেরও বেশি উড্ডয়ন বাতিল করতে হয়েছে জ্বালানি সরবরাহের অভাবে। একই কারণে গত সপ্তাহের মাঝামাঝি চার হাজার পেট্রলপাম্পের এক হাজার ৬০০টিই বন্ধ ছিল। এ পর্যায়ে এসে সারকোজি সরাসরি হস্তক্ষেপ করে তেল পরিবহনে বাধা অপসারণের নির্দেশ দেন।
ফ্রান্সের বর্তমান বিক্ষোভের জোয়ারের তৃতীয় একটি দিকও রয়েছে: তরুণেরা দলে দলে এসব বিক্ষোভে শামিল হয়েছে। ২০ অক্টোবরের বিক্ষোভে উচ্চবিদ্যালয়ের প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে। এমনিতেই ফরাসি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সামাজিক প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে আছে। তাদের সঙ্গে উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এবার সারকোজি সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াল। হঠাৎ করে অবাকই হতে হয়, যে শিক্ষার্থীরা এখন কেবল কর্মজীবনে ঢোকার মুখে, তারা কেন অনেক পরের অবসর নেওয়ার বয়স নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ল? সাংবাদিকের কাছে কর্মীরা যা প্রকাশ করেছেন তা হলো: বয়স্ক ব্যক্তিদের অবসর নেওয়ার সময় বেড়ে গেলে তাদের জন্য চাকরি কমে যাবে এবং আজকের ফ্রান্সে বেকারত্বের বিষয়টিকে আর হালকাভাবে নেওয়া যায় না। সরকারি হিসাবে গত জুন মাসে সেখানকার বেকারত্বের হার ছিল ১০ শতাংশ। ইউরোপীয় অর্থনৈতিক মন্দা শুরুর আগে ২০০৮ সালে এ হার ছিল সাড়ে সাত শতাংশ। ২৫ বছর বয়সীদের নিচে বেকারত্বের বর্তমান হার হলো ২৮ দশমিক ১ শতাংশ। এর মানে প্রতি চারজনের একজনেরও কম চাকরি পাচ্ছেন।
সারকোজির পক্ষের অর্থনীতিবিদেরা বোঝাতে চাইছেন, বয়স্ক ব্যক্তিদের অবসর নেওয়ার বয়সসীমা বাড়ানো মানেই তরুণদের জন্য কম চাকরির সুযোগ নয়। তা হলেও ফ্রান্সের বর্তমান গণ-অসন্তোষের পটভূমি আরও ব্যাপক। ২০০৮ সাল থেকেই ইউরোপজুড়ে দেউলিয়ার মুখে পড়া শক্তিশালী ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বিপুল ভর্তুকি দেওয়া হয়। এ অবস্থায় নীতিনির্ধারকেরা পুরোনো নীতিগুলো সংস্কারেও বিমুখ থাকেন। কিন্তু ফরাসি জনগণ মনে করে, আর্থিক বাজারের বেসরকারীকরণ ও নব্য উদারতাবাদী ওই সব নীতিই চলমান অর্থনৈতিক সংকটের জন্য দায়ী। এ অবস্থায় ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর বদলে সরকার বরং বাজেটে বরাদ্দ কমাচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি তৈরির মতো প্রকল্প বেগবান করা দরকার ছিল। কয়েক বছর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংবিধান প্রণয়ন বিষয়ে গণভোট করা হলে বেশির ভাগ ফরাসি এর বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। কারণ, তারা মনে করেছিল, খসড়া সংবিধান নব্য উদারতাবাদী অর্থনৈতিক নীতিকেই প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এই পটভূমিতে ফরাসি বিক্ষোভকে নয়া উদারতাবাদী পুঁজিবাদী নীতির বিরুদ্ধে গণরায় হিসেবে ধরা চলে।
প্রথম আলোর জন্য পাঠানো বিশেষ প্রতিবেদন।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
পিটার কাস্টার্স: ডাচ্ গবেষক, সমাজতাত্ত্বিক এবং প্রথম আলোর ইউরোপীয় প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.