তৃতীয় পক্ষ by হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

বিয়ের পরের মাসেই স্ত্রী মারা গেল। ভুবনমোহনের তখন জোয়ান বয়স, তার ওপর মা বেঁচে। মাস চারেকের মধ্যে আবার নতুন বউ ঘরে এল। কিন্তু বরাত ভুবনমোহনের। বছর ছয়েক, তার বেশি নয়। একটি মেয়ে ভুবনমোহনের কোলে তুলে দিয়ে এই বউও চোখ বুজল। তিন দিন, তিন রাত ভুবনমোহন বিছানা ছাড়ল না। কেঁদে কেঁদে চোখ লাল।


মা আর ছিলেন না। দূর সম্পর্কের এক পিসি সান্ত্বনা দিতে এসে কেঁদেই আকুল। ভুবনমোহনের পেশা হোমিওপ্যাথি ডাক্তারি। শুধু বাপের রোগীগুলোই নয়, তাঁর নাড়ীজ্ঞানও পেয়েছিল। আশপাশের গোটা চারেক গাঁয়েতে আর কেউ পাত্তা পায় না। সর্দি থেকে সান্নিপাতিক, হাঁপানি থেকে হার্নিয়া—সব ব্যাপারে ভুবনমোহনের ডাক পড়ে। অনেক বোঝাবার পর ভুবনমোহন বিছানা ছেড়ে ডিসপেনসারিতে এসে বসল, কিন্তু ওই বসাই সার। রোগীদের ভালো করে দেখলও না, ওষুধপত্রও হাতের কাছে যা পেল, তাই বিলিয়ে কাজ সারল।
দিন কয়েক পরে তাল বুঝে পিসি একবার চেষ্টা করল। তোর আর এমন কী বয়স ভুবন! এ-বয়সে অনেকের বিয়েই হয় না। আর একটা বিয়ে কর। ভুবনমোহন গীতাপাঠ করছিল। একমুখ গোঁফদাড়ি। শীর্ণ দুটি চোখ। মুখ তুলে পিসির দিকে চেয়ে বলল, বিয়ে করব পিসি, আপত্তি করব না। খাটিয়ার চার ধারে ফুল সাজিয়ে ভালো লগ্ন দেখে যাত্রা শুরু করব। সঙ্গে নাম-সংকীর্তন, খই ছড়ানো, সব হবে।
বালাই ষাট, অলুক্ষুণে কথা শোন ছেলের। ভুবনমোহনের কথা শেষ হওয়ার আগেই চোখে আঁচলচাপা দিয়ে পিসি উঠে গিয়েছিল।
ভুবনমোহনের অবস্থা দেখে রোগীরা প্রমাদ গুনল। ভুবনমোহন কিন্তু অটল। হাত জোড় করে বলল, আমাকে মাফ করুন আপনারা। ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। উঠে দাঁড়াবার জোর পাচ্ছি না। নিজের ওপরই বিশ্বাস হারিয়েছি, কাজেই আপনাদের চিকিৎসা করব কোন ভরসায়।
দিন কতক পর একটু বুঝি টলল ভুবনমোহন। কাঁচাপাকা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, আমি দিন কতকের জন্য বাইরে যেতে চাই। তীর্থে তীর্থে ঘুরে যদি মনটা ঠিক করতে পারি। গয়া, প্রয়াগ, মথুরা, বৃন্দাবন।
দিন কয়েক নয়, ভুবনমোহন ফিরল মাস দুয়েক পর। গোঁফদাড়ির চিহ্ন নেই, বপু কিষ্ণিৎ স্ফীত, মুখে সলজ্জ হাসি। পেছনে অবগুণ্ঠনবতী তরুণী। নতুন বউ মালতী ঘোমটা টেনে এগিয়ে গিয়ে পিসিকে প্রণাম করেই ছোট মেয়েটাকে কোলে তুলে নিল।
পড়শিরা অবাক। পাড়ার দু-একজন জিজ্ঞেসও করে ফেলল। ডিসপেনসারির টেবিল-চেয়ার মুছতে মুছতে ভুবনমোহন মুখে অমায়িক হাসি ফোটাল।
মিছেই আমরা লাফালাফি করে মরি। আমরা কেউ নই ভাই, অন্তরাল থেকে আরেকজন সুতো টেনে চলেছেন। তিনি নাচাচ্ছেন, আমরা নাচছি।
অবশ্য এই নাচানাচির ব্যাপারটা ভুবনমোহন এক সময় পরিষ্কার করেও বলল। আলাপ ধর্মশালায়। বাপ হাঁপানিতে কাত। মালতী ভুবনমোহনের কামরায় ঢুকেছিল সাহায্যের আশায়। বিদেশ, বিভূঁই, একলা মেয়েছেলে যদি দয়া করে একটা ডাক্তার ডেকে দেয় ভুবনমোহন।
ওষুধের বাক্সটা ভুবনমোহনের কাছেই ছিল। নিজের যদি চিকিৎসার দরকার হয়, সেই ভেবেই সঙ্গে নিয়েছিল। কাজে লেগে গেল। মিনিট পনেরোর মধ্যেই মালতীর বাপ অনেকটা সামলে নিল। আলাপ-পরিচয় তো হলোই, সেই সঙ্গে বিগত জীবনের টুকরো টুকরো কথারও লেনদেন। বিয়ের কথাটা মালতীর বাপ পাড়ল বৃন্দাবনে। ভুবনমোহনের অবস্থা তখন ভিজে ভিজে। যত্ন তোয়াজে কাদাকাদা ভাব। জোর গলায় আপত্তি করতে পারল না। কেবল নিজের বয়সের উল্লেখ করে মৃদু প্রতিবাদ করল। আপত্তি টিকল না।
ভুবনমোহনের হালচাল বদলাল। মাথায় যে কয়টা চুল আছে,তার যত্ন নিতে শুরু করল। শুধু শাড়ি নয়, মাঝে মাঝে বিপিনের দোকান থেকে স্নো, পাউডার, কাঁচের চুড়িও কিনতে শুরু করল ভুবনমোহন।
আগে তার কোনো গোলমাল ছিল না। দিনে-রাতে যখন রোগী এসে দাঁড়িয়েছে, ভুবনমোহন এক পায়ে খাড়া। শুধু হাতের মুঠোয় দর্শনী পেলেই হলো। বাক্স বগলদাবা করে, স্টেথোস্কোপ গলায় ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ত। আজকাল কিন্তু সন্ধ্যার পরে তাকে বাড়ির বার করাই মুশকিল। নানা ওজর আপত্তি তুলে পাশ কাটাবার চেষ্টা। রাতে চোখে ভালো দেখতে পাই না, কিংবা বাড়িতে ওর শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছে না। আর একেবারে পা জড়িয়ে ধরলে সাকরেদ বিশ্বনাথকে এগিয়ে দিয়েছে। বিশ্বনাথ পাড়ার ছেলে। বি-এ পর্যন্ত পড়েছে, তারপর বছর চারেক অফিসের চৌকাটে মাথা ঠুকে ঠুকে ক্লান্ত হয়ে ভুবনমোহনের কাছে এসে দাঁড়াল।
হোমিওপ্যাথিতে বিশ্বনাথের আগ্রহ প্রবল। প্রায় খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে কোথা থেকে হোমিওপ্যাথির আনকোরা পত্রিকা জোটাল। নতুন নতুন কেসের বিবরণ নিয়ে সময়-অসময়ে আলোচনাও চালাল ভুবমোহনের সঙ্গে।
ছোট ছোট কেসে ভুবনমোহন তাকে পাঠাতে লাগল। কিন্তু একদিন বেঁকে দাঁড়াল মালতী। নিজের কবর যে নিজে খুঁড়ছ। এমনিতেই আজকাল সদরে হাসপাতাল হয়ে রোগীর ভিড় বেশ কম। তারপর দেখবে রোগীগুলোকে হাত ধরে তোমার নাকের সামনে বিশ্বনাথ আর একটা ডাক্তারখানা খুলে বসবে। ভুবনমোহন মালতীর কাছে সরে এসে থুতনি ধরে একটু আদরের চেষ্টা করে বলল, কী যে বল গিন্নী, বই-পড়া বিদ্যেয় হোমিওপ্যাথি চলে না। এ সব শিখতে, বিশ্বনাথের এক জন্ম। কথা বাড়ায় না মালতী। কেমন গোঁজ হয়ে থাকে। রাত্রির কলে ভিজিট বেশি। ভুবনমোহন ইদানীং রাত্রির ডাকে একবারেই বেরোয় না বাড়ি থেকে। বিশ্বনাথকে ঠেকিয়ে দেয়।
একদিন মালতী ভ্রূ বাঁকা করে জিজ্ঞাসা করেছে, আসল কথাটা কী বলো ত, যাচ্ছ না কেন বাইরের কলে?
একটু ইতস্তত করে ভুবনমোহন আসল কথাটাই বলেছে, কথাটা কী জানো গিন্নী, রাত্রে তোমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করে না, দিনের বেলা কোনোরকমে কাটাতে পারি। কিন্তু রাত্রে তোমাকে ছেড়ে থাকবার কথা মনে হলেই কেমন বুক ধড়ফড় করে।
মুখ-চোখের অপূর্ব ভঙ্গি করে মালতী সরে গিয়েছে সেখান থেকে। আঁচল চাপা দিয়েও হাসি লুকোতে পারেনি। কেবল বলেছে ঢং।
সেদিন বিকেল হতেই ভুবনমোহনের দরজায় লোক এসে দাঁড়াল। কুমিরখালির মেজবাবুর অবস্থা খারাপ। সঙ্গে পাল্কি আছে। ডাক্তারবাবুকে এখনি রওনা হতে হবে।
ভুবনমোহন চোখে অন্ধকার দেখল। কুমিরখালিমানে আজ আর ফেরা হবে না। একবার মনে ভাবল বিশ্বনাথকেই পাঠিয়ে দেবে নিজের শরীর খারাপের অজুহাতে, কিন্তু সাহস হলো না। কুমিরখালির বাবুদের দোর্দণ্ড প্রতাপ লাঠিয়েলের বংশ। মালতীকে বুঝিয়ে শুনিয়ে দুর্গানাম স্মরণ করে ভুবনমোহন রওনা হয়ে পড়ল। মন ভার, মেজাজও তিরিক্ষে।
ভুবনমোহনের ভাগ্য ভালো। হারানগঞ্জের মাঝামাঝি গিয়েই খবর মিলল। জনকয়েক পাইক রাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করছিল, পাল্কি আটক করল। আর যাবার দরকার নেই। মেজকর্তা সুস্থ হয়ে উঠেছেন। ভুবনমোহনের ইচ্ছা হলো পালকি থেকে নেমে একটু নেচে নেয়।
পালকি ফিরল। বাড়ির কাছ বরাবর এসে মতলবটা ভুবনমোহনের মাথায় এল। ঠিক আছে। মালতীকে অবাক করে দিতে হবে। বেহারাদের বলে পালকি নামাল। দ্রুত পায়ে রওনা হলো বাড়ির দিকে। এ-দিকটা অন্ধকার, খিড়কির দরজা খোলা। কেউ কোথাও নেই। চুপি চুপি ভুবনমোহন শোবার ঘরে ঢুকে পড়ল। আলমারির ওপর ওষুধের বাক্স রেখে সাবধানে জামা ছেড়ে সোজা বিছানায় শুয়ে পড়ল।
মালতী পান খেয়ে রান্নাঘরে তদারক করে তবে শুতে আসবে। হঠাৎ চুড়ির শব্দ হতেই ভুবনমোহন আপাদমস্তক চাদর চাপা দিল। আজ মালতী একটু তাড়াতাড়িই শুতে আসছে। ভুবনমোহন নিশ্বাস রোধ করে শুয়ে রইল। আওয়াজে বুঝল মালতী চৌকাঠের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
কখন চোখে ধুলো দিয়ে ওপরে উঠে এসেছ, বলো তো? মালতীর মিহি গলা শোনা গেল। ভুবনমোহন অবাক! অন্ধকারে পা টিপে টিপে এসে কোনো লাভ হলো না। তবু ভুবনমোহন কোনো উত্তর দিল না। দেখাই যাক না কী করে মালতী। মালতী বাইরের কমানো হারিকেনটা নিভিয়ে দিয়ে খাটের বাজু ধরে দাঁড়াল। মশলা দেওয়া পানের মিষ্টি গন্ধ, চুলের সুবাস, তা ছাড়াও মালতীর সান্নিধ্যের একটা মৃদু গন্ধ ভুবনমোহনের নাকে এল।
ঝুঁকে পড়ে মালতী মোলায়েম গলায় বলল, জানো বিশুদা, বুড়ো যেন মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। আবার সোহাগ জানানোর কী ঢং, আমায় ছেড়ে থাকতে ওর নাকি কষ্ট হয়। মরণ আর কি!
কথা শেষ হবার আগেই খিলখিল করে মালতী হেসে উঠল। বাঁধভাঙ্গা স্রোতের উচ্ছ্বাস সেই হাসিতে। (সংক্ষেপিত)
হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়: ভারতীয় লেখক।

No comments

Powered by Blogger.