চার দিক-পুণ্যের খোঁজে পুণ্যসন্ধানীদের ভিড়ে by খাদিজা ফাল্গুনী

‘আমি আমার আত্মমর্যাদার ওপর নির্ভর করে প্রতিজ্ঞা করছি যে, আল্লাহ ও আমার দেশের প্রতি কর্তব্য পালন করতে, সর্বদা অপরকে সাহায্য করতে, স্কাউট আইন মেনে চলতে যথাসাধ্য চেষ্টা করব।’ একজন স্কাউট হিসেবে হজযাত্রীদের সেবা দিতে দিতে আমার বারবার মনে পড়ছিল স্কাউট-প্রতিজ্ঞাটি।


যেদিন এই প্রতিজ্ঞা পাঠ করে স্কাউট হওয়ার দীক্ষা নিচ্ছিলাম, সেদিনও আমি সন্দিহান ছিলাম—প্রতিজ্ঞা যে করে ফেললাম, কিন্তু পালন করব কীভাবে? দেশের প্রতি কর্তব্য, সর্বদা অপরকে সাহায্য, তার ওপর স্কাউট আইন। বাংলাদেশের সাধারণ আইনগুলো পালন করতেই হিমশিম খেয়ে যাই। কিন্তু সেই ‘কিন্তু কিন্তু ভাব’ পুরোপুরি উড়ে গেল হজক্যাম্প ২০১০-এ কাজ শুরু করার পর। গার্ল ইন রোভার হওয়ার কারণে আমার দায়িত্ব ছিল মহিলা ডরমেটরি ও মেডিকেল সেন্টারে সেবা প্রদান করা। প্রায় সব নারী হজযাত্রীর বয়স ষাট কি সত্তরের মধ্যে।
অভিজ্ঞতার শেওলা পড়া মুখে একটু শঙ্কা, একটু অনিশ্চয়তা, আর পবিত্র একটি কাজ করার পবিত্রতম খুশি। ক্ষীণকায় দেহে তাঁরা যখন গুটি গুটি পায়ে হেঁটে চলেন ডরমেটরির দিকে, তাঁদের সঙ্গে থাকে নিজের শরীরেরও বেশি ওজনের কয়েকটা বিশাল ব্যাগ। নিজেদের ব্যাগ তাঁরা নিজেরাই বহন করবেন, এটাই ছিল নিয়ম। এটি তাঁদের প্রশিক্ষণের একটি অংশ। তবু স্কাউট মেয়েরা প্রত্যেকের ব্যাগ বয়ে নিয়েছেন হাসিমুখে। অধিকাংশ সময় তাঁদের অনুরোধে, বাকিটা নিজেদের দায়িত্ববোধে। দাদু বা নানুর বয়সী কেউ ব্যাগ বইছেন, দেখতেও তো কষ্ট লাগে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিল তাঁদের সঙ্গে কথা বলা।
জামালপুর থেকে আসা নূরজাহানের বয়স সত্তরেরও বেশি। ব্যাগের তালা খুলতেই হিমশিম খাচ্ছিলেন তিনি। তালা খুলে যখন চিন্তিত গলায় বললাম, ‘দাদু, মক্কায় তো আমি থাকব না। তখন আপনার কী হবে বলুন তো?’ তিনিও ঝটপট বললেন, ‘ওইটা আল্লাহর রহমতের জায়গা না? আল্লায় দেখব।’ তাঁর প্রবল বিশ্বাসে আমার মনেও শান্তি ফিরে আসে।
সবচেয়ে ভালো লাগার ব্যাপার ছিল তাঁদের দোয়া পাওয়া। মানিকগঞ্জের রাবেয়া খাতুন আজীবন পুকুরে অজু করেছেন। হজক্যাম্পে পুকুর নেই। এদিকে তিনি পানির ট্যাপও ব্যবহার করতে জানেন না। পানির ট্যাপ কীভাবে খুলতে ও বন্ধ করতে হয়, তা দেখিয়ে দেওয়ার পর তিনি ফোকলা দাঁতে হেসে বললেন, ‘তুই ভালা মাইয়া। তোর ভালা পোলার লগে বিয়া হইব!’ পানির কলের সঙ্গে ‘ভালা পোলার’ কোনো সম্পর্ক না খুঁজে পেলেও তাঁর আন্তরিকতার উষ্ণতাটুকু বুঝে হেসে উঠি। তাঁকে জড়িয়ে ধরি। ময়মনসিংহের হালিমা বেগম দোয়া করেছেন—যত দিন চাই, তত দিন যেন বাঁচি। টঙ্গীর লুৎফুন্নাহার বলেছেন, ‘আল্লায় তোমারে সবার রাগ থেকে বাঁচাক।’ নারায়ণগঞ্জের আনোয়ারা আলমকে যখন বলেছি হজে আমার জন্য দোয়া করতে, তখন তিনি বলেছেন, ‘তোর মতো লক্ষ্মী মেয়ের জন্য দোয়া করব না তো কার জন্য করব?’ শুনে আজীবন ডানপিটে বেপরোয়া মনে ‘লক্ষ্মী মেয়ে’ হওয়ার শখ জেগে উঠেছিল!
বেশি মনে পড়ে সিঙ্গাইরের রাবেয়া বেগমের কথা। যখন শুনলেন স্কাউটরা নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে সেবা দিচ্ছে, তিনি অবাক হয়ে পড়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘যা, অগোর থন পয়সা চা গা। না দিলে আমার কাছে আইছ। আমার লগে খাইবি।’ ৮০ বছর বয়সের এক অচেনা বৃদ্ধার চোখে সেদিন আমি কোনো দিন না দেখে দাদির ছায়া দেখেছিলাম।
এমনি কত মধুর স্মৃতি! হজক্যাম্পের সুবাদে কত মধুর মায়াভরা কথা গেঁথে যায় মনে! তবে আমার সঙ্গের স্কাউট বন্ধুদের কথা না বললেই নয়। মুন্নী, গোলাপ, সম্পা, লাকি, বহ্নি, নাসরিন, নাজমুল, সিরাজ কিংবা বাদশা—প্রত্যেকেই নিজেকে নির্দয়ভাবে খাটিয়েছেন। চেনা-অচেনা প্রত্যেক স্কাউট দিতে চেষ্টা করেছেন সর্বোচ্চ। প্রতিদিন আসছেন নতুন নতুন মুখ। প্রতিদিন ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম, পালা করে খাওয়া, পালা করে গোসল, মেঝেতে পাতলা ম্যাট্রেস পেতে তিন কি চার ঘণ্টা ঘুম, নিজের পয়সা খরচ করে ব্যয়বহুল খাবার—এসব সহ্য করেও শুধু সেবা দিতে দেশের আনাচ-কানাচ থেকে স্কাউটরা ছুটে আসছেন হজক্যাম্পে। দোয়া, সার্টিফিকেট কিংবা নগদ অর্থের লোভে নয়, শুধুই মনের টানে। আমরা কেউ জানি না, এই জীবনে হজ করব কি না। তবু যাঁরা পুণ্যের খোঁজে ছুটে চলেছেন অচিন দেশে, তাঁদের সেবা করে একটু পুণ্য করলে ক্ষতি কী?
বিদায় নেওয়ার সময় যখন ময়মনসিংহের রাজিয়া সুলতানা আয়াতুল কুরসি পড়ে ফুঁ দিচ্ছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল, এই তো দেশের সেবা, এই তো অপরকে সাহায্য, এই তো স্কাউটিং। স্কাউট-প্রতিজ্ঞা যেন মিলেমিশে গেছে হজক্যাম্পে। পুণ্যের খোঁজে চলা সব হজযাত্রীর পুণ্য-প্রয়াস সফল ও নিরাপদ হোক।

No comments

Powered by Blogger.