প্রথম আলো গোলটেবিল বৈঠক-‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা’
২১ অক্টোবর প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা আলোচনায় অংশ নেন। তাঁদের বক্তব্য এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপা হলো:
যাঁরা অংশ নিলেন
আবুল কালাম আজাদ
তথ্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
এবিএম মূসা
প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক
মাহবুবুল আলম
সম্পাদক, দ্য ইনডিপেন্ডেন্ট
গোলাম সারওয়ার
সম্পাদক, সমকাল
সৈয়দ আবুল মকসুদ
সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
রিয়াজউদ্দিন আহমেদ
সম্পাদক, দ্য নিউজ টুডে
মাহফুজ আনাম
সম্পাদক, দ্য ডেইলি স্টার
ইকবাল সোবহান চৌধুরী
সভাপতি
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন
শাইখ সিরাজ
পরিচালক (বার্তা), চ্যানেল আই
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব
আলমগীর মহিউদ্দিন
সম্পাদক, নয়া দিগন্ত
ড. গীতি আরা নাসরীন
চেয়ারপারসন
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নাঈমুল ইসলাম খান
সম্পাদক, আমাদের সময়
মনজুরুল আহসান বুলবুল
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
বৈশাখী টেলিভিশন
সানাউল্লাহ
বার্তা ও অনুষ্ঠানপ্রধান, এবিসি রেডিও
শ্যামল দত্ত
সম্পাদক, ভোরের কাগজ
নূরুল কবীর
সম্পাদক, নিউ এইজ
মোজাম্মেল হক
সম্পাদক, দৈনিক করতোয়া
শাহ আলমগীর,
বার্তাপ্রধান, মাছরাঙা টেলিভিশন
সভাপতি, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন
জ ই মামুন
বার্তাপ্রধান, এটিএন বাংলা
মুন্নী সাহা
বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ
মতিউর রহমান
সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম
যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
মতিউর রহমান
আপনারা শত ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের গোলটেবিল বৈঠকে এসেছেন। তাই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। আজকের আলোচনার বিষয় স্থির করার সময় আমরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সঙ্গে দায়বদ্ধতার কথাটাও সমগুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেছি। গণমাধ্যমের প্রধান কাজ বস্তুনিষ্ঠভাবে সংবাদ পরিবেশন, নির্ভয়ে সত্য প্রকাশ করা। পাশাপাশি এটাও নিশ্চিত করা, যেন সেসব সংবাদ বস্তুনিষ্ঠ হয়, উদ্দেশ্যমূলক না হয়।
সংবাদপত্র বা ব্যাপক অর্থে গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। তার মানে, দায়িত্বশীল গণমাধ্যমের কাজ হলো সরকারের জবাবদিহির ব্যবস্থা করা আর সরকারের দায়িত্ব হলো তাকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া। আমি এখানে ‘দায়িত্বশীল গণমাধ্যমের’ কথা বলছি। দায়িত্বশীলতা থেকে বিচ্যুত হলে গণমাধ্যম পত্রিকা তার পাঠক হারাবে আর রেডিও তার শ্রোতা, টেলিভিশন তার দর্শক হারাবে। যেহেতু পাঠক টাকা দিয়ে পত্রিকা কিনে পড়েন, তাই পত্রিকার দায়বদ্ধতা অনেক বেশি। কারণ পাঠক আগেই স্থির করে রাখেন, কোন পত্রিকাটি তিনি পড়বেন। গণমাধ্যমকে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে পাঠকের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। তাই সত্যিকার গণমাধ্যম কখনো উদ্দেশ্যমূলক, ভিত্তিহীন, দায়িত্বহীন সংবাদ পরিবেশন করতে পারে না, করা উচিতও নয়।
বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতাসংগ্রামের সময়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে সংবাদ পরিবেশনে কখনো ভুল হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ভুল স্বীকার করা আমাদের কর্তব্য। এটি সর্বজনস্বীকৃত পদ্ধতি। বাংলাদেশে গণমাধ্যম নানা ভুলত্রুটি শুধরে নিয়ে এগিয়ে চলেছে।
রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে বিভিন্ন অঙ্গীকার করে থাকে। সরকার বিভিন্ন সময়ে অনেক অঙ্গীকার করে, অনেক কথা বলে, যেগুলো শেষ পর্যন্ত কাজে পরিণত করে না বা করতে পারে না। গণমাধ্যমে সেসব কথা তুলে ধরে আমরা সরকারের জবাবদিহির উদ্যোগ নিই। এখানে কোনো বিভ্রান্তির সুযোগ নেই। আমাদের আসল উদ্দেশ্য সরকারকে তার ভুলভ্রান্তি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করা।
আমাদের সব কাজের কেন্দ্রবিন্দু মানুষ। মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, দেশের অগ্রগতি চাই, অর্থনীতির বিকাশ চাই। সরকারেরও সব কাজের মূল কথা হলো মানুষের কল্যাণ। তাই সরকার ও গণমাধ্যম পরস্পরের পরিপূরক, প্রতিপক্ষ নয়।
সরকারের বিশেষভাবে দেখা দরকার, যেন গণমাধ্যম, সম্পাদক ও সাংবাদিকেরা সরকার বা কারও তরফ থেকে হুমকির মুখে না পড়েন। প্রায় এক দশক ধরে বেসরকারি টিভি চ্যানেল কাজ করছে। অনেক তরুণ টিভি সাংবাদিকতায় এসেছেন। অনেক নতুন পত্রিকাও এসেছে। পত্রিকা ও বেসরকারি রেডিওতে অনেক তরুণ সাংবাদিক আসছেন। তরুণ সাংবাদিকদের কাজে ভুলত্রুটি যাতে না হয়, সে ব্যাপারে আমরা সচেতন থাকার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিই। আমরা এসব তরুণকে সঙ্গে নিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছি। সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ভবিষ্যতে গণমাধ্যমের ভূমিকা আরও বাড়বে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি।
সরকার গণমাধ্যমের জন্য নীতিমালা করার উদ্যোগ নিয়েছে। কাগজে-কলমে অনেক আইন-কানুন করা যেতে পারে। কিন্তু সবার মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ ও আস্থার পরিবেশ গড়ে তোলা না হলে কোনো নীতিমালাই ঈপ্সিত ফল দেবে না। আর এই আস্থার সম্পর্ক সৃষ্টিতে সরকার ও গণমাধ্যমের পারস্পরিক সহযোগিতা দরকার।
বর্তমান সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী বলেবারবার বলছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের ১৯ অনুচ্ছেদে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও অবাধ তথ্যপ্রবাহের অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে। সব ধরনের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, তথ্যপ্রবাহের অবাধ চলাচল সুনিশ্চিত ও সংরক্ষণ করা, স্থানীয় ভিত্তিক কমিউনিটি রেডিও চালু, সাংবাদিক হত্যার দ্রুত বিচার ও শাস্তি, সাংবাদিক নির্যাতন এবং তাঁদের প্রতি ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন বন্ধ, সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন বিতরণে বৈষম্যমূলক নীতি ও দলীয়করণ বন্ধ এবং সংবাদপত্রকে শিল্প হিসেবে বিবেচনা করে এর বিকাশে সহায়তা করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়ে এই নীতিগত অবস্থানে সরকার অবিচল থাকবে এবং নির্বাচনী ইশতেহারে বর্ণিত অঙ্গীকার পূরণে বদ্ধপরিকর হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। দেশের অর্থনীতি, সমাজের অগ্রগতি ও গণতন্ত্রের বিকাশে গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
সংবাদপত্রের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে আমাদের কিছু দাবি ছিল। সরকারি বিজ্ঞাপনের হার ও অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো। বিজ্ঞাপনের হার বাড়ানো হলেও বরাদ্দ বাড়েনি। বিল পরিশোধের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা আজও করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, পত্রিকার জন্য বিদেশ থেকে নিউজপ্রিন্ট আমদানি করতে হয়। বিদেশি নিউজপ্রিন্টের দাম ক্রমেই বাড়ছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় তিনি বলেছিলেন, ভবিষ্যতে যদি দাম বাড়তে থাকে, তখন সরকার বিষয়টি বিবেচনা করবে। আগে নিউজপ্রিন্ট শুল্কমুক্ত ছিল। বর্তমান সরকার আসার পর তিন শতাংশ শুল্ক ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। নিউজপ্রিন্ট আমদানির ওপর এখনো শুল্ক-ভ্যাট মিলিয়ে ১৮ শতাংশ দিতে হয়। আরও কিছু আছে। সব মিলিয়ে প্রায় ২৫ শতাংশের কাছাকাছি চলে যায়। ভ্যাট-শুল্কের হার শূন্য না করলে পত্রিকার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে এবং হচ্ছে। তাই নিউজপ্রিন্টের ক্রমশ মূল্যবৃদ্ধির দিকে তথ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
রেডিও ও টেলিভিশনের যাঁরা উপস্থিত আছেন, তাঁরা তাঁদের সমস্যা তুলে ধরবেন আজকের আলোচনায়। পরিশেষে আমরা বলব যে গণমাধ্যম মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও প্রগতিতে বিশ্বাসী। আমরা চাই দেশে নির্বাচিত সরকার থাকবে, নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করবে। এসব বিষয়ে আমরা সব সময় দৃঢ় আছি এবং থাকব—এই আশ্বাস আমরা দিতে পারি।
আলোচনার শুরুতে আজকের গোলটেবিল বৈঠকের প্রধান অতিথি তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদকে অনুরোধ করব বলার জন্য।
আবুল কালাম আজাদ
বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা। প্রথম আলোকে ধন্যবাদ জানাতে চাই এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করার জন্য। আজকের আলোচনায় দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনের সম্পাদক এবং নেতৃস্থানীয় বিশিষ্ট সাংবাদিকেরা উপস্থিত হয়েছেন। এ বিষয়ে আলোচনার ব্যবস্থা করার জন্য সবাইকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। গণমাধ্যমের জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, দায়িত্বশীলতার বিষয়গুলোর পাশাপাশি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসবে।
বর্তমান সময়ে গণমাধ্যমের বিভিন্ন সমস্যা ও দাবিগুলো আপনারা আলোচনায় উত্থাপন করবেন। এসব বিষয়ে সরকারের অবস্থান ও বক্তব্য আমি আপনাদের সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে ভাগ করতে পারব বলে আশা করছি। শুধু সরকারের একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে নয়, দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, দেশের উন্নয়নের জন্য, অগ্রগতির জন্য গণমাধ্যমের ভূমিকা সব সময়ই অনস্বীকার্য। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য গণমাধ্যম সব সময়ই সহযোগিতা করে আসছে এবং এর কোনো বিকল্প নেই। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এমনকি বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও গণমাধ্যমের যদি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও বক্তব্য না থাকত, তবে বর্তমানে গণতন্ত্র যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা কখনো সম্ভব হতো না বলে আমার বিশ্বাস। গণমাধ্যমের ভূমিকা সব সময়ই গৌরবোজ্জ্বল। স্বাধীন সাংবাদিকতা দেশের গণতন্ত্র ও উন্নয়নে অবদান রেখে যাচ্ছে।
বর্তমান সরকার গণমাধ্যমের অবাধ তথ্যপ্রবাহে বিশ্বাস করে। বর্তমান সরকারের প্রথম অধিবেশনেই তথ্য অধিকার আইন পাস করেছি। গণমাধ্যম যাতে স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে, সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে সরকার বদ্ধপরিকর এবং কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি সরকারও গণমাধ্যমের কাছে প্রত্যাশা করে, গণমাধ্যম তাদের দায়বদ্ধতা অবশ্যই নিশ্চিত করবে। সরকার যেমন নিজের দায়িত্ব পালন করবে, তেমনি গণমাধ্যমেরও উচিত বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে তার দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা। তবে কিছু কিছু গণমাধ্যম তাদের দায়বদ্ধতার অবস্থান থেকে সরে এসে সরকারকে বিপাকে ফেলার জন্য অসত্য ও ভিত্তিহীন সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই গণমাধ্যমকে সচেতন হতে হবে। বর্তমানে অনেক তরুণ গণমাধ্যমে যুক্ত হচ্ছেন। এটি গণমাধ্যম ও সরকার উভয়ের জন্যই ভালো। কিন্তু এই তরুণ সাংবাদিকদের শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি তাঁরা প্রশিক্ষিত কি না, সেই বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, একসঙ্গে চার-পাঁচটি সংবাদের মধ্যে কোনটি প্রাধান্য পাবে বা কোনটি আগে যাবে—এসব বিষয়ে অসতর্কতার কারণে সংবাদের গুরুত্ব কমে যায়। এসব বিষয়ে গণমাধ্যমের সতর্ক দৃষ্টি দেওয়া উচিত।
বিশেষ করে বিগত ১০-১২ বছরে বাংলাদেশের গণমাধ্যম অনেক অগ্রসর হয়েছে। গণমাধ্যমের প্রধানদের বলব, যেসব সংবাদ পরিবেশন করা হচ্ছে তা বস্তুনিষ্ঠ ও সত্য কি না, সে বিষয়ে আরও সতর্ক হওয়া উচিত। অনেক সংবাদে এমন কিছু ভুল তথ্য প্রকাশ করা হয়, যা গণমাধ্যম, দেশের উন্নয়ন, সরকার ও জনগণ; কারও না কারও জন্য নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই বলতে চাই, গণমাধ্যমে অবশ্যই বস্তুনিষ্ঠ ও সত্য সংবাদ প্রকাশ করতে হবে, যা দেশের উন্নয়নে তথা জনগণের জন্য উপকারে লাগবে। সরকারের সবচেয়ে ভালো বন্ধু হতে পারে গণমাধ্যম, যদি স্বাধীনভাবে ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী একসময় বলেছেন, তিনি অনেক তথ্য গণমাধ্যম থেকে পান। অনেক তথ্য যেগুলো পাওয়া যায় না, সেগুলো গণমাধ্যম থেকে পাওয়ার পর সরকার সেসব সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে পারে।
ইকবাল সোবহান চৌধুরী
সম্প্রতি গণমাধ্যমকে নিয়ে অনেক আলোচনা, সমালোচনা, বিতর্ক এবং কিছুটা উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছে। ঠিক সেই মুহূর্তে আজকের এই গোলটেবিল আয়োজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা ব্যক্ত করছি। সাধারণত সংবাদপত্রে শুধু লিখে থাকি; কিন্তু মতামত সৃষ্টি করার কাজটি করি না।
প্রথম আলো মতামত সৃষ্টির জন্য আজকে যে আয়োজনটি করল, তার জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও অধিকারের বিষয়ে মাননীয় তথ্যমন্ত্রী সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করেছেন তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে। পাশাপাশি গণমাধ্যমের কিছু আশঙ্কার কথাও বলতে চাই। ওয়ান-ইলেভেনের পর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসে আমাদের ডেকে নিয়ে বলল, যেহেতু এখন পার্লামেন্ট নেই, সেহেতু গণমাধ্যমই হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পার্লামেন্ট। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাদের বর্ণিত সেই পার্লামেন্টের ওপর কীভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল, সেটি কিন্তু আমরা দেখেছি। গণমাধ্যমের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা, তথ্য অধিকার আইন পাস করা। বর্তমান সরকার তার পার্লামেন্টে প্রথম অধিবেশনে সেই আইন পাস করেছে।
বর্তমান সরকারের নেতারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা একসময় রাজপথে বলেছিলেন; কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ব্যত্যয় ঘটছে না, তা কিন্তু নয়। আমরা বিশ্বাস করি, গণমাধ্যম তার ভূমিকা পালন করবে। সরকারও তার দায়িত্ব পালন করবে। রাজনীতিবিদেরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করবেন। সংসদ তার নিজের দায়িত্ব পালন করবে। আর আমরা যদি যার যার নিজের দায়িত্ব নিজে পালন করি এবং একে অন্যের ওপর যদি হস্তক্ষেপ না করি, তাহলে আমরা অনেক বেশি সক্রিয়ভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারব।
কিছুদিন আগে সংসদে গণমাধ্যমকে নিয়ে তিক্ত আলোচনা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সংসদের যেমন অধিকার আছে গণমাধ্যমকে নিয়ে আলোচনা করার, তেমনি গণমাধ্যমের অধিকার আছে সংসদের কার্যক্রমে যদি বিচ্যুতি থাকে, তা নিয়ে সমালোচনা করার। গণমাধ্যমকে সরকারের একটি সহযোগী শক্তি হিসেবে নেওয়া উচিত। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ভোগ করতে হলে আমাদের নিজেদের দায়বদ্ধতার জায়গায় আরও দৃঢ় হতে হবে। কারণ গণমাধ্যম সব সময় ওয়াচডগ হিসেবে কাজ করে। তাই যদি গণমাধ্যমের নিজস্ব দায়বদ্ধতা ও বস্তুনিষ্ঠতা রক্ষা করতে না পারি, তাহলে প্রকারান্তরে যারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে চায়, তারা কিন্তু সুযোগ পেয়ে যাবে।
গণমাধ্যমে দায়িত্ব পালনকালে আমরা নিজেদের দায়বদ্ধতা ও বস্তুনিষ্ঠতা নিশ্চিত করব। কিন্তু কখনো কারও কাছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে আমরা আত্মসমর্পণ করতে রাজি নই। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কোনো সরকারের বা ব্যক্তির দান নয়। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা দীর্ঘদিনের। আমাদের পূর্বসূরিরা যে স্বাধীনতার পতাকা আমাদের হাতে তুলে দিয়ে গেছেন, তাঁরা সাহসের সঙ্গে ভূমিকা পালন করে গেছেন। পাকিস্তান আমল থেকে বিভিন্ন সামরিক ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে, অগণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে গণমাধ্যম তার স্বাধীন ভূমিকা পালন করে গেছে। অতীতে আমাদের দেশে অনেক সময় গণতন্ত্র ব্যাহত হয়েছে কিন্তু গণমাধ্যম তার ভূমিকা চালিয়ে গেছে। দেশের যেকোনো সংকটময় মুহূর্তে জাতিকে উদ্ধার করতে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে; এমনকি রাজনীতিবিদদের ওপর আঘাত এসেছিল, বিরাজনৈতিকীকরণ ও হেয়প্রতিপন্ন করার একটি প্রয়াস যখন চলছিল, বিশেষ করে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়, তখনো কিন্তু গণমাধ্যম গণতন্ত্র ও রাজনীতিবিদদের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলেছে। দেশে সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ আনার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। গণমাধ্যম এ দেশের গণতন্ত্র, মানুষের অধিকার ও সার্বভৌমত্বের জন্য সাহস করে কথা বলছে। গণমাধ্যমগুলো যদি তাদের সঠিক ভূমিকা পালন না করত, তাহলে দেশের অবস্থা আরও খারাপ হতো। দেশে উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় দেশের মানুষের অধিকারের জন্য গণমাধ্যম তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। যেহেতু গণমাধ্যম সাহস করে তার দায়িত্ব পালন করছে, সেহেতু গণমাধ্যমের ওপর আঘাত আসবে না, তা কিন্তু নয়। তবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আঘাত এলে সরকার ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো সেই আঘাত প্রতিহত করা।
সাংবাদিকতা পেশাটি বিশ্বব্যাপী ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো সাংবাদিকদের নির্যাতন ও হত্যার ঘটনাগুলো উদ্ঘাটন করা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান করা। আমাদের প্রায় ১৫-১৬ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন; কিন্তু আজ পর্যন্ত একটি হত্যাকাণ্ডেরও সুষ্ঠু তদন্ত ও ঘটনা উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি। সরকারের উচিত, এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত, দল-মতনির্বিশেষে তাদের চিহ্নিত করে বিচারের সম্মুখীন করা। যে দেশে সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের সুষ্ঠু তদন্ত হয় না, সে দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কিংবা নিরাপদে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত থাকা অসম্ভব। বর্তমান সরকার যেহেতু অতীতের অনেক বিতর্কিত ঘটনা উদ্ঘাটন করছে, তাই সরকারের প্রতি অনুরোধ, তারা যেন সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারকাজ নতুন করে শুরু করে।
সরকারের কাছে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের কিছু দাবির কথা বলে আসছি। সেটি হলো জাতীয় সংবাদপত্রের নীতি ও সম্প্রচারনীতি। নীতিমালার কথা বললে আমাদের মনে অনেক সময়ই একটি প্রশ্ন আসে, সেই নীতিটি চাপিয়ে দেওয়া কোনো নীতি যেন না হয়। চাপিয়ে দেওয়া কোনো নীতি অবশ্যই গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। আমরা বলতে চাই, নীতিমালাটি হতে হবে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে। বিশেষ করে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের মাধ্যমে। আলোচনা করে নীতিমালা তৈরি করতে হবে। নীতিমালা তৈরির ক্ষেত্রে বলতে চাই, সংবাদপত্রের মালিক একজন পুঁজিপতি হতে পারেন, কিন্তু কখনোই অপেশাদার পুঁজিপতি সংবাদপত্রের সম্পাদক হতে পারেন না। নীতিমালায় অবশ্যই থাকা উচিত, কেবল একজন পেশাদার সাংবাদিকই হতে পারেন পত্রিকার সম্পাদক। ইতিমধ্যেই মাননীয় তথ্যমন্ত্রী আমাদের অবহিত করেছেন, সম্প্রচার নীতিমালাটি প্রায় শেষ পর্যায়ে। কিন্তু সেটি যত দ্রুত সম্ভব শেষ করে আলোর মুখ দেখাতে হবে। সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন নীতিমালা, নিউজপ্রিন্টের মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা সমাধান ও সংবাদকর্মীদের ওয়েজ বোর্ডের বিষয়টি যেন বাস্তবায়িত হয়, সে ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সরকারের সঠিক নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। সাম্প্রতিককালের সরকারগুলো গণমাধ্যমের যে নতুন লাইসেন্স দিচ্ছে, সে ক্ষেত্রে বলতে চাই, বেসরকারি চ্যানেলগুলোর বেশির ভাগই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেওয়া হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে অন্য সরকার এসে এসব চ্যানেল বন্ধ করে দিচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারের আরও সচেতন হওয়া উচিত, কাদের লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে অনেক পুঁজির বিনিয়োগ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আশঙ্কা হচ্ছে, হঠাৎ করে বুদ্বুদের মতো ওসব বিনিয়োগ যদি চলে যায়, তবে অনেক সংবাদকর্মী ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন জীবিকার ক্ষেত্রে। আমি মনে করি, গণমাধ্যমে একটি সুস্থ পরিবেশ ফিরে আসবে, সরকার তার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করবে। পাশাপাশি গণমাধ্যম যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, সে রকম পরিবেশ সৃষ্টিতে সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি। একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম
নিউজ টুডের সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমেদকে অনুরোধ করব বলার জন্য।
রিয়াজউদ্দিন আহমেদ
আজকের এই আলোচনা একদিকে যেমন সময়োপযোগী, অন্যদিকে সাংবাদিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। দায়বদ্ধতার যে কথাটি আসছে, সেটি নিয়ে আমি শঙ্কিত। বর্তমানে সংবাদ ও সংবাদপত্র বন্ধের কোনো আইন নেই। একটা সময় ছিল, যখন টেলিফোনেও সংবাদপত্র বন্ধ করা যেত। কিন্তু বর্তমানে সেই পরিস্থিতি আর নেই। বর্তমানে সাংবাদিকেরা সত্যানুসন্ধানী দায়িত্ব পালন করছেন। অতীতে একটা সময় ছিল, বিশেষ ক্ষমতা আইনে যেকোনো সময় দুই লাইনের একটি আদেশ জারি করে যেকোনো গণমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে কোনো আইনি প্রক্রিয়া নেই গণমাধ্যম বন্ধ করার। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে সাংবাদিকদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলে গণমাধ্যম বর্তমানে অনেকাংশে মুক্ত। সাংবাদিকতা পেশার গ্রহণযোগ্যতা আরও বেড়েছে। তবে এর মধ্যে অনেক বাধা-বিপত্তি আসে। সরকারের কাছ থেকে অভিনব অলিখিত পদ্ধতিতে বাধাগুলো আসে। যেমন—সম্প্রতি সরকার একটি পত্রিকা হঠাৎ বন্ধ করে দিল। যেটি আবার আদালত বাতিল করে দিয়েছে। কিন্তু পত্রিকাটি বন্ধ করার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অন্যান্য গণমাধ্যমের কাছে একটি বার্তা পৌঁছে গেল যে গণমাধ্যমের সাবধান হওয়া দরকার।
বেসরকারি টিভি চ্যানেল চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করা হলো এবং যমুনা টিভিকে সম্প্রচার করতে দেওয়া হলো না। এর ফলে অন্য বেসরকারি চ্যানেলগুলো সাবধান হয়ে গেল। এটি কিন্তু সরকারের একটি অলিখিত আইন। এতে গণমাধ্যমগুলো সেলফ (নিজস্ব) সেন্সরশিপ হয়ে পড়ে। অর্থাৎ সম্পাদকেরা একটু সাবধানতা অবলম্বন করে সংবাদ প্রকাশ করতে থাকেন। চ্যানেলগুলোয় টকশোতে যাঁরা আলোচক থাকেন, আয়োজকেরা তাঁদের একটু বুঝেশুনে কথা বলতে বলেন। এটি হলো গণমাধ্যমের একটি অলিখিত দিক, যা গণমাধ্যমের ভেতর আতঙ্কের সৃষ্টি করছে।
এখনো একটি আইন আছে, যেটি সিআরপিসির ৫০০ ও ৫০১ ধারা, যার মাধ্যমে মানহানির নামে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে একটি ক্রিমিনাল স্যুট করে যেকোনো সময় ওয়ারেন্ট ইস্যু করে সাংবাদিকদের থানা ও কোর্টে নেওয়া যায়। এই আইনের মাধ্যমে সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরীকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল গভীর রাতে। আমরা সাংবাদিকেরা দাবি করেছিলাম আইনটি বাতিল করার। বর্তমান সরকার বিষয়টি আমলে নিয়েছে। ইতিমধ্যে এই আইনের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, আইনটি থাকবে কিন্তু গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়াটি থাকবে না। সমন জারির প্রক্রিয়াটি চালু করা হবে। পরপর তিনবার সমন জারির পর যদি সাড়া না পাওয়া যায়, তখন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা যাবে। আমরা এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। এটি মন্ত্রিপরিষদে সিদ্ধান্ত হয়ে আছে, কিন্তু এখনো আইনে পরিণত হয়নি।
সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, এই আইন যদি বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে এটি একটি গণমাধ্যমবান্ধব সিদ্ধান্ত বলে বিবেচিত হবে। সাংবাদিকদের ওপর বিভিন্ন মহল থেকে চাপ সৃষ্টি করা হয়। বিশেষ করে মফস্বল এলাকায় প্রশাসন, পুলিশ, রাজনৈতিক নেতাসহ বিভিন্ন মহল থেকে চাপ সৃষ্টি হয় সংবাদ প্রকাশের পর। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ব্যাপারে সরকারের একটি নীতিমালা তৈরির কথা শুনে আসছি। নীতিমালাটি তৈরি অত্যন্ত জরুরি। কারণ টিভি চ্যানেল ও রেডিও লাইসেন্স আসলে কারা পাবে, তার নির্দিষ্ট কোনো নীতি নেই। সম্পূর্ণই সরকারের ওপর নির্ভরশীল। যখন কোনো আইনের তোয়াক্কা বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো থাকে না বা সরকার নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সেখানে স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তের অবকাশ থেকে যায়।
বর্তমান সরকার ও আগের সরকার যেভাবে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্য লাইসেন্সিং ব্যবস্থা করেছে, সেটি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাচারিতা হয়েছে। সংবাদপত্র প্রকাশের জন্য প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশন আইনটি রয়েছে। সেখানে উল্লেখ আছে, কী কী নিয়ম বা শর্ত মানলে কোনো ব্যক্তি সংবাদপত্র বের করতে পারবেন। ফলে এখানে স্বেচ্ছাচারী হওয়ার সুযোগ কম; যদিও অন্যভাবে স্বেচ্ছাচারিতা দেখা যায়। বর্তমানে একটি সংবাদপত্র বের করতে চাইলে পুলিশ ভেরিফিকেশন, ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিসহ সরকারের বিভিন্ন মহলে যেতে হয়। কিন্তু ১৯৯০ সালে একটি আইন করা হয়েছিল, যেখানে বলা ছিল, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট যদি ৬০ দিনের মধ্যে কোনো সিদ্ধান্ত না দিতে পারেন, তবে প্রেস কাউন্সিলে আপিল করলে সংবাদপত্র প্রকাশের ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে, তা চূড়ান্ত বলে গৃহীত হবে। তার বিরুদ্ধে কোনো আপিল করার সুযোগ থাকবে না। এই আইনের মাধ্যমে নিউ নেশন, বাংলার বাণী পত্রিকাগুলো ডিক্লারেশন নিয়েছিল। আইনটি আছে, কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। সংবাদপত্রের নীতিমালার আদলে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্য একটি সম্প্রচার নীতিমালা করা অত্যন্ত জরুরি। গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতার কথা উঠে আসছে। গালাগাল করে কখনো দায়বদ্ধতা আদায় করা যায় না। যেমন—কিছুদিন আগে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যে ঘটনাটি ঘটল, এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী খুশি হননি বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
গণমাধ্যম নিয়ে সাংসদ ও সংসদের স্পিকার যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা করেছেন, তা ঠিক হয়নি। সাপ যেমন জিহ্বার আগায় বিষ নিয়ে ঘোরে কিন্তু এর স্বাদ গ্রহণ করে না; তেমনি ক্ষমতায় যাঁরা থাকেন, তাঁদের জিহ্বার আগায় অনেক বিষ থাকে, যা তাঁরা গ্রহণ করতে চান না। এ ধরনের কাজ করতে গেলে অবশ্যই সাংসদ ও রাজনৈতিক নেতারা সংবাদপত্রের সমালোচনার সম্মুখীন হবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অন্যদিকে যা খুশি লিখে গণমাধ্যম পার পেয়ে যাবে, তাও ঠিক নয়। এটি নিয়ন্ত্রণের জন্য অবশ্যই ইনস্টিটিউশনাল মেকানিজমের ওপর নির্ভর করা উচিত; তা কখনো কোনো ব্যক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত এমন ছিল যে কোনো গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে সরকার অভিযোগ করলে তা বন্ধ করে দেওয়া হতো। কিন্তু বর্তমানে সেই প্রক্রিয়া আর নেই। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে প্রেস কাউন্সিল আছে, যা হচ্ছে মরাল বা এথিক্যাল কোর্ট, যার অধীনে থাকে সব দায়দায়িত্ব। যে দেশে লিগ্যাল বাইন্ডিং ফেল করে, সে দেশে মরাল বাইন্ডিং বলে কিছু থাকে না। ব্রিটেনে কমপ্লেইন্ট কমিশন রয়েছে। অন্যান্য জায়গায় অম্বুডজম্যান। ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়ার নিজস্ব অম্বুডজম্যান আছে, যার ফলে কোনো ভুল সংবাদ প্রকাশ হলে সঙ্গে সঙ্গে তা সংশোধনের ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হয়। সম্পাদককে অবশ্যই একজন পেশাদার সাংবাদিক হতে হবে। এ ব্যাপারে অবশ্যই একটি আইন করতে হবে। যদি কোনো পেশাদার সাংবাদিক সম্পাদক হন, তবে গণমাধ্যমের অধিকাংশ দায়বদ্ধতা নিশ্চিত হয়ে যায়।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
যেসব নবীন সাংবাদিক গণমাধ্যমে যুক্ত হচ্ছেন, তাঁরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ, দায়বদ্ধতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষিত হয়ে যেন সাংবাদিকতা পেশায় আসতে পারেন, সে জন্য আমাদের কিছু দায়দায়িত্ব রয়েছে। বর্তমানে যাঁরা সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কর্মরত আছেন এবং নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁরা অনেকে দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতা করছেন অথবা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করে এসেছেন। তবু বর্তমানে সংবাদপত্রে নানা ভুলভ্রান্তি, দায়িত্বহীনতা, বস্তুনিষ্ঠতার অভাব আমরা দেখছি, এগুলো অনেকটা জ্ঞানপাপীর মতো। তাঁরা সবই জানেন, কিন্তু কেউ বলতে পারবেন না যে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে সেই প্রতিবেদনের সঙ্গে আলোচ্য ব্যক্তির মন্তব্য দিতে হয়, সেটা জানেন না তিনি।
তবু প্রতিবেদনের সঙ্গে এখনো অভিযুক্ত ব্যক্তির মন্তব্য নেওয়া হয় না, ভুল ছাপা হয় কিন্তু ক্ষমা প্রার্থনা করা হয় না। দিনের পর দিন ভুল তথ্য দিয়ে সংবাদ ছাপা হচ্ছে, কারও কোনো বিকার নেই। যাঁরা নতুন সাংবাদিক আসছেন, তাঁদের জন্য সরকারের কাছে দাবি করব, প্রেস ইনস্টিটিউট পুনর্গঠন করা দরকার। কার্যকর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আমি দীর্ঘদিন প্রেস ইনস্টিটিউটে চাকরির সুবাধে অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমাদের দেশে প্রশিক্ষণের সঙ্গে সেমিনারকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। প্রশিক্ষণ অনেক কঠিন কাজ, পাঁচটি কাজ করে এসে প্রশিক্ষণ নিয়ে গেলাম। তাই বলব, প্রেস ইনস্টিটিউটকে পুনর্গঠন করে কার্যকর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। পৃথিবীতে অনেক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট আছে, সেগুলোর মডেল অনুসরণ করে আমাদের দেশেও কার্যকর ট্রেনিং ইনস্টিটিউট তৈরি করা প্রয়োজন। প্রেস ইনস্টিটিউটে একটি জার্নাল আছে নিরীক্ষা নামে। যখন এটির প্রকাশনা শুরু হয়, তখন এর একটি লক্ষ্য ছিল, সাংবাদিকতার ভালো জিনিসগুলো সেখানে তুলে সাংবাদিকদের উৎসাহিত করা হবে, যাতে নবীন সাংবাদিকেরা এগুলো দেখে উৎসাহিত হন এবং তাঁরা তাঁদের দায়-দায়িত্ব কী হওয়া উচিত তা বুঝতে পারেন। আর সাংবাদিকতার দুর্বল দিকগুলো চিহ্নিত করা হবে, যাতে নবীন সাংবাদিকেরা বুঝতে পারেন তাঁদের এগুলো করা উচিত হবে না। সেই কাজগুলো থেকে বর্তমান নিরীক্ষা অনেক দূরে। তথ্যমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করব, তিনি যেন প্রেস ইনস্টিটিউটকে নির্দেশ দেন, নিরীক্ষা জার্নালটি যে উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, তা সঠিকভাবে প্রকাশ করার।
বর্তমান সংবাদপত্রে যে ভুলগুলো ছাপা হয়, সেগুলো সেখানে তুলে ধরলে নবীন সাংবাদিকেরা বুঝতে পারবেন আসলে কোথায় কোথায় আমাদের ঘাটতি আছে। প্রেস কাউন্সিলের পাশাপাশি একটি ইনস্টিটিউটের প্রেসটিজিয়াস জার্নালে যদি মাসের পর মাস কোনো পত্রিকার ভুল জিনিসগুলো ছাপা হতে থাকে, ভুল রিপোর্ট উদ্ধৃত থাকে, তবে সেটিও কিন্তু একটি লজ্জা ওই পত্রিকার জন্য। কারণ সেই পত্রিকা বুঝতে পারবে, বারবার তার ভুল সংবাদগুলো ওই জার্নালে ছাপা হচ্ছে। ওই ধরনের জার্নালে বিগত তিন মাসের ভালো রিপোর্ট হয়েছে। কোনগুলো ভালো ছবি, ছাপা হয়েছে এগুলো।
অপরদিকে তিন মাসের বস্তুনিষ্ঠহীন ও অসত্য সংবাদ ছাপা হয়েছে কোনগুলো, সেগুলো নির্বাচন করে ছাপা উচিত জার্নালে। প্রেস কাউন্সিলকে আরও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। কারণ দিনের পর দিন এসব ভুল সংবাদ ছাপা হওয়ার পর প্রেস কাউন্সিল কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না।
প্রেস কাউন্সিলের প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর রায় প্রকাশ করা উচিত, কোন পত্রিকাগুলোকে তারা তিরস্কার করছে এবং সেই তালিকা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা উচিত। পরিশেষে বলতে চাই, প্রেস কাউন্সিল ও প্রেস ইনস্টিটিউটকে আরও সক্রিয় ও শক্তিশালী করতে হবে সাংবাদিকতার দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে।
শাইখ সিরাজ
এতক্ষণ যে আলোচনা হলো, তা সবই মূলত সংবাদপত্রকেন্দ্রিক। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অবস্থান আরও নড়বড়ে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া বলা যায় নবীন। সংবাদপত্র যে পরিমাণ স্বাধীনতা পায়, ইলেকট্রনিক মিডিয়া সে পরিমাণ স্বাধীনতা পায় না বলে সন্দেহ রয়েছে। তারপর স্বল্প সময়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়া বর্তমানে যে অবস্থানে এসেছে, তাতে এর বিকাশ হয়েছে অনেকাংশে। স্বাধীনতা কেউ দেয় না, আদায় করে নিতে হয়। সংবাদপত্র যেমন তার স্বাধীনতা আদায় করেছে, তেমনি ইলেকট্রনিক মিডিয়া হাঁটি হাঁটি করে এগিয়ে যাচ্ছে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য। ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো সব সময়ই একটি শঙ্কার মধ্যে থাকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় একটি বিজ্ঞপ্তি এসেছিল, সেখানে উল্লেখ ছিল, কী কী কারণে সম্প্রচারযন্ত্রটি জব্দ করা যাবে। কী কী কারণে প্রিন্টিং প্রেস জব্দ করা যাবে। সে সময় হুমকিটি আমাদের ওপর প্রচণ্ডভাবে ছিল। বর্তমানে সেই অবস্থান থেকে উত্তরণ হয়েছে আমাদের। কিন্তু আমরা একেবারে শঙ্কামুক্ত নই। প্রতি মুহূর্তে মনে হয়, কোনটা ভুল হলো, কোনটার জন্য বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে হয়। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্য এখন পর্যন্ত কোনো সম্প্রচার নীতিমালা তৈরি হয়নি। আমি মনে করি, নীতিমালাটি জরুরি। কারণ ইলেকট্রনিক মিডিয়া যে স্বেচ্ছাচারিতা করে না, তা তো নয়। বাস্তব অবস্থা থেকে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচারের সময় অনেক ক্ষেত্রেই ভুলভ্রান্তি হয় না, তা তো নয়।
একেবারে নতুন একটি প্রতিষ্ঠান ইলেকট্রনিক মিডিয়া। যথেষ্ট লোকবলের অভাব রয়েছে। ইতিমধ্যে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় অনেক ছেলেমেয়ে তৈরি হচ্ছেন, যাঁরা ভালো কাজ করছেন। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার যে বিকাশ ঘটেছে, তা নিঃসন্দেহে উল্লেখ করার মতো। দু-চার, পাঁচ বছর আগেও আমরা দেখেছি, ঢাকায় হরতাল হলো কি না, রাতে বিবিসি রেডিওতে শুনতে হতো। এখন তাৎক্ষণিকভাবে দেখতে পারছি, হরতাল কোন অবস্থায় আছে। আগে টেলিভিশন বিক্রির শোরুমের সামনে রিকশাচালকেরা ও জনগণ দাঁড়িয়ে ছায়াছন্দ দেখত, এখন তারা সংবাদ দেখছে। এই যে একটি বিকাশ, এটি ইলেকট্রনিক মিডিয়া তথা সমগ্রিকভাবে গণমাধ্যমের একসঙ্গে পথচলার একটি ফসল। ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে সরকারের সহায়ক শক্তি ভাবা উচিত। কথাটি এসেছে সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ক্ষেত্রে আরও জোরালো। যেহেতু ইলেকট্রনিক মিডিয়া দৈনন্দিন জীবনে এত প্রভাব রাখে, যেটি সরকারের জন্য নিশ্চিয় বড় বিষয়। আজ সচিবালয়ে কী কী কার্যক্রম হলো তা সন্ধ্যায় টিভি খুললেই দেখতে পাই। দুই মাস আগে মাননীয় তথ্যমন্ত্রী বিটিভির সংবাদটি সম্প্রচারের জন্য বেসরকারি চ্যানেলগুলোর ওপর আবার চাপিয়ে দিলেন। সব কটি চ্যানেল দুপুর দুইটার সংবাদ রেকর্ড করে প্রচার করছে কিন্তু সম্প্রচারের মূল কারণ কী, তা এখনো আমরা বুঝতে পারিনি। এই সংবাদ প্রচারের ফলে সরকারের যে কী উপকার হচ্ছে, তা কেউ বুঝে উঠতে পাুরছি না। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যে সংবাদটি প্রচারিত হচ্ছে বস্তুনিষ্ঠভাবে, ঠিক সেই সংবাদটি বিটিভি থেকে প্রচারিত হচ্ছে অন্যভাবে। এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
নতুন একটি গণমাধ্যম হিসেবে ইলেকট্রনিক মিডিয়া দেশে সত্যিকার গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। পত্রিকায় যদি সরকার কোনো বিজ্ঞাপন দেয়, তাহলে সেখানে অর্থ বরাদ্দ থাকে। কিন্তু ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সরকার কোনো বিজ্ঞপ্তি বা বিজ্ঞাপন দিলে অর্থ দেয় না, বরং বারবার প্রশ্ন করা হয় কয়বার প্রচার করা হলো, কখন প্রচার করা হলো, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে প্রচার করা হয়েছে কি না ইত্যাদি। এসব বিষয় থেকে অব্যাহতি চাইছি।
আব্দুল কাইয়ুম
আলোচনার এই পর্যায়ে আমাদের সময় পত্রিকার সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খানকে অনুরোধ করব বলার জন্য।
নাঈমুল ইসলাম খান
গণমাধ্যম সরকারকে সহায়তা করবে—এ বিষয়টি বর্তমানে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে গেছে। আমরা নিজেরাও বলি। কিন্তু এর গোড়ায় একটি গলদ রয়েছে। এটি সাংবাদিকতাবিরোধী ধারণা। পত্রিকার কাজ সরকারকে সহায়তা করা নয়, সংবাদপত্রের কাজ শুধু সাংবাদিকতা করা। আমরা সাংবাদিকতা করব, কেউ চুরির জন্য ধরা পড়বে, আবার কেউ চুরির মাল উদ্ধার করবে—সব খবরই থাকবে।
এই যে সাংবাদিকেরা সহায়তা করবে—এ ধারণাটি আসলে মিষ্টি কথার মাধ্যমে বশে রাখার প্রক্রিয়া। রাজনৈতিক নেতা হলে বলতাম চক্রান্ত। আসলে আমরা মুখোমুখি কেউ কারও সঙ্গে খারাপ হতে চাই না, তাই এসব নিয়ে কোনো বিরোধিতা করি না। আমাদের এ ধারণা থেকে বের হতে হবে।
সরকারের কাছে গণমাধ্যমের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা মূলত জনগণের কাছে। আমরা গণমাধ্যমের যে স্বাধীনতার কথা বলি, এই স্বাধীনতা পত্রিকার সাংবাদিক, সম্পাদক কিংবা মালিকের নয়; এই স্বাধীনতার প্রকৃত মালিক হচ্ছে জনগণ।
গণমাধ্যমের যদি কোনো দায়বদ্ধতা থাকে, তা তার পাঠক, শ্রোতা ও দর্শক অর্থাৎ জনগণের কাছে। যদি গণমাধ্যম সরকারের আইনের বাইরে কিছু করে থাকে, তার জন্য অবশ্যই সরকার ব্যবস্থা নেবে। এর জন্য শাস্তি পেতে হতে পারে। সাংবাদিকতায় এই রেওয়াজও আছে যে আদালত যদি কোনো সংবাদের সূত্র কী জানতে চান, তাহলে সাংবাদিককে বাঁচিয়ে প্রয়োজনে শাস্তি মেনে নিতে হবে।
এরশাদ আমলের শেষ দিকে মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স অফিসে সাড়ে তিন ঘণ্টা একজন ব্রিগেডিয়ার বসিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন এই সংবাদের উৎস কী? তখন সম্পাদক হিসেবে আমার দায়িত্ব উৎসটা কী, তা না বলা, আর তাঁর দায়িত্ব ছিল উৎসটা কী, তা বের করা। এখানে আর্মি অফিসার ও আমার দায়িত্ব বিপরীত। শুধু সেখান থেকে বেঁচে ফিরে আসার জন্য আমি বলেছিলাম, যদি উৎস জানাতেই হয়, তবে আমাকে ফিরে যেতে হবে। রিপোর্টারের কাছ থেকে জেনে আপনাকে জানাব বলে চলে আসতে হয়। পরে আর তাঁকে উৎস কী, তা জানাইনি।
কোর্টেও যদি কোনো সংবাদের সূত্র বা উৎস জানতে চাওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে উৎসকে রক্ষা করে আমরা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করব। সে জন্য যদি আমার জেলও হয়, তা মেনে নিতে পারব। যেহেতু আমি সাংবাদিকতার ছাত্র হিসেবে পড়েছি ও জেনেছি প্রয়োজনে আমি শাস্তি নেব, তবু সংবাদের উৎস বা কোথা থেকে কথাটি পেয়েছি, তা বলব না।
সাংবাদিকতায় ডেভেলপমেন্ট একটি ধারণা দাঁড়িয়েছিল, ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম, আমি এর বিপক্ষে। আমি আরও বিপক্ষে তথাকথিত এনভায়রনমেন্ট জার্নালিজমের। আমি মনে করি, সাংবাদিকতা এক এবং অদ্বিতীয়। এর কোনো ইনভেসটিগেটিভ জার্নালিজম অথবা এনভায়রনমেন্ট জার্নালিজম বলে কিছু নেই। আমরা কোনো ঘটনাকে বলতে পারি মফস্বলের ঘটনা, কোনোটিকে অর্থনৈতিক ঘটনা—এ রকম নানাভাবে বলতে পারি। কিন্তু সাংবাদিকতা অবিভাজ্য।
যদি আমি সত্য, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করি, তবেই কেবল মনে করতে পারি যে আমি আমার দায়বদ্ধতা পালন করেছি। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, সবজি চাষে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছে। এখন আমি এটি প্রকাশ করব না। এতে দেশের ক্ষতি হবে, বিদেশে সবজি রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে এই ভেবে। আমি এর বিরোধিতা করছি। আমি মনে করি সংবাদটি প্রকাশ করা উচিত, যাতে সবজি চাষে দূষণীয় কীটনাশক আর ব্যবহার না করা হয়। এটিই আমার দায়বদ্ধতা। এতে আমার দায়বদ্ধতা পালন হবে, বিদেশিদের আস্থা বাড়বে। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তাদের নির্ভরশীলতা বাড়াবে। তারা বুঝতে পারবে, বাংলাদেশের গণমাধ্যম স্বাধীন এবং সত্য সংবাদ প্রকাশ করে।
ইদানীং বলা হচ্ছে, সংবিধানে যা আছে সব মানতে হবে। সবকিছু মেনে চলতে হলে এটিও আমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করতে পারি, বাংলাদেশ ইসলামিক আইন অনুসারে চলা উচিত। আমি যদি সংবিধানের কোনো ধারা লঙ্ঘন করি, তবে তার জন্য শাস্তি হতে পারে। কিন্তু আমি কেন বলতে পারব না, বাংলাদেশ ধর্ম দ্বারা পরিচালিত হোক? এতে যদি জনগণের সমর্থন থাকে, তবে একসময় হতে পারে। কিন্তু ধর্ম দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যদি এমন কোনো কাজ করি, যা সংবিধান ও আইনকে ভঙ্গ করে, সশস্ত্র সংঘাতের কথা বলে, তবে অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে। কিন্তু এ ধারণাটি কেন আমি ধারণ করতে পারব না কিংবা প্রয়োজনে প্রচার করতে পারব না, এটাও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ভেতরে পড়ে কি না, নাগরিক অধিকারের মধ্যে পড়ে কি না, এসব নিয়ে যথেষ্ট চিন্তার অবকাশ রয়েছে।
মনজুরুল আহসান বুলবুল
সম্প্রচার নীতিমালা হওয়া প্রয়োজন। তবে নীতিমালা হওয়া, বাস্তবায়ন ও পরিবর্তন—এই জায়গাগুলোতে পার্থক্য রয়েছে। কিছুদিন আগে বেসরকারি চ্যানেলগুলোর ওপর বিটিভির দুটি নিউজ চাপিয়ে দেওয়া হলো। ১৯৯৮ সালের যে নীতিমালার ভিত্তিতে টেলিভিশনগুলোকে লাইসেন্স দেওয়া হলো, তখন আমি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলাম, কারণ আমি একুশে টেলিভিশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। তখন নীতিমালায় উল্লেখ ছিল, একটি সংবাদ প্রচার করতে হবে। হঠাৎ করে সম্প্রতি শুনলাম, দুটি সংবাদ প্রচার করতে হবে, যা নীতিমালায় আছে। এই নীতিমালা কখন, কীভাবে, কারা পরিবর্তন করল, তা আমরা জানি না। তাই নীতিমালা হওয়া, প্রয়োগ, বাস্তবায়ন ও পরিবর্তন—সব জায়গায় স্বচ্ছতা থাকা উচিত। ভারতীয় লোকসভার স্পিকার সোমনাথ চ্যাটার্জির আত্মজীবনী কিপিং দ্য ফেইথ বের হয়েছে। সেখানে একটি অংশ আছে তিনি স্পিকার থাকা অবস্থায় তাঁর সঙ্গে গণমাধ্যমের সম্পর্ক বিষয়ে। সেই অধ্যায়ের নাম দেওয়া হয়েছে রোলার কোস্টার রাইডিং। সেখানে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন স্পিকার হিসেবে মিডিয়ার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা। গণমাধ্যম নিয়ে সারা বিশ্বেই আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের পরিধি দিন দিন বাড়ছে, স্বাধীনতা পাওয়ার চেষ্টা চলছে এবং যাদের দায়বদ্ধতা আছে, তারা স্বাভাবিকভাবেই বিকশিত হচ্ছে।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতাদের দায়বদ্ধতার মূল জায়গা হচ্ছে দলের প্রতি। আরও পরিষ্কার করলে, নেতাদের দায়বদ্ধতার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছেন তাঁদের শীর্ষ নেতা-নেত্রী। আর দায়িত্বশীল গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা হচ্ছে জনগণের কাছে। সুস্থ রাজনীতির যে দর্শন অর্থাৎ রাজনীতিবিদের দায়বদ্ধতা যদি জনগণের কাছে হতো, তবে গণমাধ্যম ও সরকারের মধ্যে দায়বদ্ধতা প্রশ্নে যে বিরোধ রয়েছে, তা বহুলাংশে কমে যেত। গণমাধ্যমে বিপুল পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগ হচ্ছে, যা গণমাধ্যমকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কলুষিত করছে। বর্তমানে সাংবাদিকদের অর্থের বিনিময়ে ভাড়ায় পাওয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে বলতে চাই, আন্তর্জাতিক কোনো এক সম্মেলনে একজন উপদেষ্টা ও একজন মন্ত্রী গেছেন। দুজনই দুই সাংবাদিক ভাড়া করেছেন। দুজন দুই রকম সংবাদ পাঠাচ্ছেন। একজন লিখেছেন, উপদেষ্টা কিছুই করছেন না, সব মন্ত্রী করছেন। অন্যজন লিখলেন তার ঠিক বিপরীত। সুতরাং পুঁজি ও ক্ষমতা গণমাধ্যমকে কলুষিত করছে।
ভারতের লোকসভার ১০ জন এবং রাজ্যসভার একজন সদস্যের সদস্যপদ চলে যায় টাকা খেয়ে সংসদের ফ্লোরে প্রশ্ন তোলার ও আলোচনার জন্য কিছু বিষয় উত্থাপনের জন্য। লোকসভার সাবেক স্পিকার সোমনাথ চ্যাটার্জি বলেছেন: টাকা খাওয়ার এই খবর তিনি প্রথম জেনেছিলেন গণমাধ্যমের রিপোর্ট থেকে। এ জন্য তিনি গণমাধ্যমের প্রশংসা করেন। বাংলাদেশের কোনো সংবাদমাধ্যমের জন্য এ ধরনের কোনো অনুসন্ধান করাই ঝুঁকিপূর্ণ, সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সংসদ বা সাংসদকে অবমাননার অভিযোগও আনা হতে পারে।
পুুঁজি কীভাবে গণমাধ্যম, সরকার ও রাষ্ট্রকে কুলষিত করছে, সে বিষয়টিও এখন দেখা উচিত। প্রেস কাউন্সিলে কোটাভিত্তিক সম্পাদক, ইউনিয়ন, মালিকপক্ষ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, সরকারি দলের সদস্য থেকে এমন কাউকে সরকার নিয়োগ দিচ্ছে, যাঁরা আসলে সঠিকভাবে মিডিয়া বোঝেন কি না, সে প্রশ্নও থেকে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, আমাদের এক বিচারপতি রায় দিলেন, সম্পাদক ও প্রকাশক খালাস কিন্তু রিপোর্টারের শাস্তি হবে। কারণ রিপোর্টার সেই সংবাদটি লাল বড় অক্ষরে শিরোনাম করেছেন। কিন্তু হাইকোর্ট যদি না বোঝেন, শিরোনাম লাল অক্ষরে কে ছাপে, তা হলে তো ভারি বিপদ। একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হবেন প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। এক সরকারের আমলে দেখা গেল, একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি চেয়ারম্যান হলেন কিন্তু তিনি নিজেই সরকারি দলের সাংসদ। যেমন আইনের হাত অনেক লম্বা, সেহেতু আইনের ফাঁকও থাকে বিশাল। শুধু সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে পাস করে এলেই ভালো সাংবাদিক হওয়া যায় না। বস্তুত, কর্মক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত ব্যক্তিরাই পারেন ভালো সাংবাদিকতা করতে। সে ক্ষেত্রে শিক্ষাগত কোর্স হিসেবে সাংবাদিকতা থাকতে পারে। সাংবাদিকতা শিক্ষার এই জায়গায় আমি বারবার প্রস্তাব করেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে প্রাতিষ্ঠানিক যাঁদের শিক্ষা দেওয়া হয়, তাঁদের প্রেস ইনস্টিটিউট ও নিমকো—এই দুটি প্রতিষ্ঠান পাশাপাশি পেশাদার সাংবাদিকদের দিয়ে যদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তাহলে ভালো পেশাদার সাংবাদিক পাওয়া সম্ভব। সরকারি দলের সঙ্গে গণমাধ্যমের বিপরীত সম্পর্ক দেখা যায় সব সময়। এর মূল কারণ, বিরোধী দলের যে কাজ করা উচিত বা সরকারের সমালোচনা করা দরকার জাতীয় ও জনগণের স্বার্থ আদায়ে, তারা তা না করে ব্যক্তি ও দলের স্বার্থ আদায়ে আন্দোলনে ব্যস্ত থাকে। জাতীয় ও জনগণের স্বার্থ আদায়ের জন্য গণমাধ্যমগুলো সব সময় দায়িত্ব পালন করে। কারণ তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি যথাযথ রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করে, তাহলে মিডিয়া রিয়্যাল ওয়াচডগের দায়িত্ব পালন করতে পারে। সুস্থ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সমাজব্যবস্থা যদি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়, তবেই কেবল মিডিয়া তার নিজস্ব দায়িত্ব পালনে অনেকাংশে এগিয়ে যেতে পারে। গণমাধ্যমের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্ক হবে সাংবাদিকতা পেশাদারির মাধ্যমে। সরকার, স্পিকার ও সাংসদদের উচিত গণমাধ্যমের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা। একটি গণমাধ্যমের ফেয়ারনেস নিয়ে ফ্রিডম ফোরামের সিইও একটি ফর্মুলা দিয়েছেন, কীভাবে একটি মিডিয়া ফেয়ার আচরণ করতে পারে। তার ফর্মুলাটি হচ্ছে a+b+c+d+e=f, Accuracy+balance+ completenes+ Detachment+Ethics= Fairness। আমার ধারণা, মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর এই ফর্মুলা মেনে চলা উচিত।
সৈয়দ আবুল মকসুদ
ঠিক এই মুহূর্তে সংবাদমাধ্যমের ওপর বিভিন্ন দিক থেকে উপদ্রব আসছে। সরকারের, বিরোধী দলের, সমাজবিরোধীদের দিক থেকে এই উপদ্রব গণমাধ্যমের ওপর আসছে সম্প্রতি। তাই আজকের এই আলোচনা অত্যন্ত সময়োপযোগী। একটি সংবাদপত্রের মাধ্যমে সম্পাদকের চারিত্রিক ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়। একদিন পল্টনের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় বাস থেকে নেমে এক ব্যক্তি আমার হাতে দুটি কাগজ দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, গতকাল ছাপতে পারেননি, তাই গতকাল ও আজকের দুটি কাগজের সংখ্যাই একসঙ্গে দিয়েছেন। তিনি ওই পত্রিকার সম্পাদক। ঢাকা থেকে ৭০-৮০টি পত্রিকা প্রকাশ হয় প্রতিদিন। এগুলো ঢাকা থেকে বললে ভুল হবে, বেশির ভাগই ফকিরাপুল থেকে বের হয়।
আর ঢাকার বাইরে প্রতিটি জেলা শহরে গেলে দেখা যায় স্থানীয় অনেক পত্রিকার সাইনবোর্ড ঝুলতে। বর্তমানে বাংলাদেশে গণমাধ্যম ও সম্পাদকদের অবস্থা কী, তা স্পষ্ট বোঝা যায়। গণমাধ্যমের যে স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, সেই স্বাধীনতারও একটা সীমা থাকা উচিত। আর পত্রিকার সম্পাদক কে হবেন, সে ক্ষেত্রে নীতিমালায় রিজনেবল শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলেই সম্পাদক হওয়া যাবে। বাংলাদেশে অন্তত দুই কোটি লোকের সেই যোগ্যতা রয়েছে। ৩২ বছর সাংবাদিকতা করার পর যখন আমার সম্পাদক হওয়ার জন্য অনুমোদন চাওয়া হলো, তখন কত রকমের তদন্ত করা হয়েছিল। জাতীয় সংবাদপত্রে নীতি করার জন্য দুটি সভার আয়োজন করা উচিত সরকারের। সারা দেশের এই যে প্রায় ৮০০ বিভিন্ন সংবাদপত্র, এগুলোর সম্পাদকদের ডেকে তাঁদের সঙ্গে বৈঠক করতে হবে, তাঁরা সম্পাদক হওয়ার যোগ্য কি না। আরেকটি সভার আয়োজন করতে হবে দেশের প্রধান দৈনিকগুলোর সম্পাদকদের নিয়ে। মাসে অন্তত একটি বৈঠক করা উচিত সরকারের পক্ষ থেকে। বলিষ্ঠ রাষ্ট্র গঠনে মিডিয়ার কাছ থেকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে। আমাদের গণমাধ্যমগুলো অনেক আধুনিক হয়ে উঠেছে। কিন্তু এখনো একটি পত্রিকার সম্পাদক জেলে রয়েছেন, আদালত অবমাননার দায়ে। তথ্যমন্ত্রী, আপনার কাছে অনুরোধ করব, আদালত অবমাননার শাস্তি এত বড় লাখ লাখ টাকার না দিয়ে সামর্থ্যের মধ্যে শাস্তির বিধান করুন। প্রেস কাউন্সিলকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার একটা সীমা থাকা উচিত। পত্রপত্রিকায় মাঝে মাঝে হঠাৎ দু-একটা ভুল সংবাদ প্রকাশিত হয়ে থাকে। এটা রাজা রামমোহন রায় যখন পত্রিকা বের করেছিলেন, তখনো ঘটেছে। কিন্তু বর্তমানে কিছু কিছু পত্রিকা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে ধারাবাহিকভাবে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করে আসছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নামে তাদের এ ধরনের আচরণ পরাধীনতার চেয়েও খারাপ। তথ্য মন্ত্রণালয়ে একটি মনিটরিং সেল থাকা উচিত, যাঁরা নিয়মিত মনিটরিং করবেন, কোনো পত্রিকা নিয়মিত মিথ্যা ও বানোয়াট সংবাদ ছাপছে কি না। সংবাদপত্রে স্বাধীনতার অপব্যবহার কেউ করছে কি না, সে বিষয়েও সরকারের নজর দেওয়া উচিত। নিয়মিত বিভিন্ন জাতীয় প্রধান দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকদের নিয়ে আলোচনার আয়োজন করা উচিত তথ্য মন্ত্রণালয়ের।
শ্যামল দত্ত
আজকের আলোচনায় যে দুটি প্রশ্ন উঠে এসেছে, তা হলো বাংলাদেশের গণমাধ্যম স্বাধীন কি না এবং গণমাধ্যম দায়বদ্ধ কি না। পাশাপাশি আরেকটি প্রশ্ন অত্যন্ত জরুরি, তা হলো, বাংলাদেশের গণমাধ্যমে পেশাদারি দৃষ্টিভঙ্গি আছে কি না। আমাদের গণমাধ্যম কতটুকু পেশাদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। গণমাধ্যমের পেশাদারির সঙ্গে আরেকটি প্রশ্ন জড়িয়ে যাচ্ছে, সেটি হলো, আসলে আমাদের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়েছে কি না। গণমাধ্যমের দায়িত্বহীনতা এখনো প্রকট। তিন দিন আগে একটি শিশুকে অপহরণ করা হয়েছিল, সেখানে অপহূত শিশুর ছবিসহ আরও (গ্রেপ্তার হওয়া) তিনজন কিশোরের ছবি সব কটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। কিন্তু ১৯৭৪ সালের শিশু আইন বলে, এ ধরনের ছবি ছাপা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এ ব্যাপারে হাইকোর্টের একটি রায়ও আছে। আমরা কতটুকু জানি এই আইন সম্পর্কে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এখন কালো টাকার প্রচুর ছড়াছড়ি। একটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে যিনি ৫০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন, তাঁকে আড়াই লাখ টাকার প্রস্তাব দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বর্তমানে গণমাধ্যমে যে অবাধ কালো টাকার ছড়াছড়ি, তা ভবিষ্যতের গণমাধ্যমের পেশাদারির জন্য হুমকি।
আমরা বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী ও কালো টাকার মালিকের কথা জানি, যাঁরা এখন নিজেরাই পত্রিকা বের করছেন এবং আরও কয়েকজন আসছেন। নিজেদের কালো টাকা রক্ষায় তাঁরা গণমাধ্যমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন। দেখা যায়, ঢাকা শহরে এক নম্বর সার্কুলেশন থাকার দাবিদার, সম্প্রতি প্রকাশিত, স্বল্পসংখ্যক পৃষ্ঠার পত্রিকাটি দিনের পর দিন মিথ্যা ও ভুল সংবাদ ছেপে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। তারা পাঠকের কাছে দায়বদ্ধ নয়। আমরা, পত্রিকাগুলো এখানে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছি। আমরা নিজেদের স্বার্থে প্রতিনিয়ত আপস করছি। এ ছাড়া আমরা কখনো করপোরেট হাউসগুলোর বিরুদ্ধে লিখি না—আমাদের বিজ্ঞাপন ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভেবে। তা হলে এখানে গণমাধ্যম কতটুকু দায়বদ্ধতা পালন করল।
সানাউল্লাহ
আমার দীর্ঘদিন সংবাদপত্রে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে রেডিওতে কাজ করছি। তাই সংবাদপত্র ও রেডিওতে কাজ করার মধ্যে তফাত কী, তা আমি বুঝি। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে। সংবাদপত্রে কাজ করতে গিয়ে আমি তেমন কোনো বাধার সম্মুখীন হইনি। কিন্তু রেডিও বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার লাইসেন্স নিতে হয় তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিবছর লাইসেন্স নবায়ন করতে হয়। এই লাইসেন্স বিভিন্ন সরকারের আমলে একেক দফায় বা এক চালানে ১০-১২টি লাইসেন্স দিয়ে থাকে। আর ফ্রিকোয়েন্সি নিতে হয় বিটিআরসি থেকে বা প্রতিবছর নবায়ন করতে হয়। এতে যেকোনো কারণে যেকোনো সময় ইলেকট্রনিক মিডিয়া বন্ধ করে দেওয়ার সুযোগ থেকে যায় সরকারের হাতে। এর বেশ কয়েকটি উদাহরণ আমরা আগে দেখেছি।
গণমাধ্যমের জন্য নীতিমালার কথা সবাই বলেছেন। বেসরকারি এফএম বেতারকেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনার একটি নীতিমালা হয়েছে ২০১০ সালে। এটি হওয়ার সময় আমাদের ডেকেছিল। সেই নীতিমালায় আমাদের কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। কিন্তু রেডিও পরিচালনার ক্ষেত্রে কী কী করা যাবে না বলে যে বিষয়গুলো আছে, তার অধিকাংশই হচ্ছে আদালতের এখতিয়ার। নীতিমালা তৈরি কমিটির বেশির ভাগ সদস্যই তথ্য মন্ত্রণালয় ও বেতারের কর্মকর্তা। আমাদের কাছ থেকে শুধু মতামত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারি মাসে হঠাৎ করে নীতিমালাটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। তাই আবার যখন নীতিমালা তৈরির কথা বলা হচ্ছে, তখন একটা শঙ্কা কাজ করছে যে নীতিমালার নামে আবার গণমাধ্যমের হাত-পা বেঁধে ফেলা হবে কি না। গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা হওয়া উচিত তার পাঠক, শ্রোতা ও দর্শকের কাছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমরা অনেক সাংবাদিকই ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছে দায়বদ্ধ হয়ে পড়ছি। আমরা সাংবাদিকেরাই বিনিয়োগকারী, অসাধু ব্যবসায়ী খুঁজি। বলি, আসুন পত্রিকা বের করি, আমি সম্পাদক হই। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের গণমাধ্যম কতটুকু স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে কিংবা তারা তাদের দায়বদ্ধতা কতটুকু নিশ্চিত করতে পারছে, তা নিয়ে শঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
জ ই মামুন
আমি যেহেতু টেলিভিশনে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি, তাই এ সম্পর্কে আমি বলতে চাই, আমি চ্যানেলে চাকরিজীবনের শুরুতে একুশে টেলিভিশনে কাজ শুরুর আগে দীর্ঘদিনের একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে বিশ্বের নামকরা টেলিভিশনের লোকজন রিপোর্টিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। তাঁরা আমাদের বলেছিলেন, টেলিভিশন হচ্ছে একে-৪৭ রাইফেলের মতো বা তার চেয়ে শক্তিশালী কোনো অস্ত্র। আমি এ জন্য কথাটি বললাম, টেলিভিশন বা গণমাধ্যম যদি একটি শক্তিশালী ধারালো অস্ত্র হয়, তাহলে এই অস্ত্র আমি কার হাতে তুলে দিচ্ছি—এ বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার লাইসেন্স তিনিই পাবেন, যিনি যখন যে দল ক্ষমতায় থাকবে তার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকবে; হয় রাজনৈতিক, নয় অর্থনৈতিক। এই লাইসেন্সটি আপনি ব্যবহার করবেন মূলত অর্থ আয়ের জন্য।
দ্বিতীয়ত, লাইসেন্সটি ব্যবহার করবেন আপনার যে কালো টাকা কিংবা দুর্নীতি আছে, সেগুলো ঢাকার জন্য। তৃতীয়ত হচ্ছে, সরকারকে বা ওই রাজনৈতিক দলকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য। আমাদের দেশের টেলিভিশনগুলো মূলত তিনটি উদ্দেশ্য নিয়ে চলে। কারণ, টেলিভিশনের লাইসেন্স কে বা কারা পাবে, তার জন্য নির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। এবং তা নির্ভর করে সরকার বা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ওপর। এর ফলে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দায়বদ্ধতা গিয়ে দাঁড়ায় হয় সরকারের প্রতি, নয়তো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রতি। সেই সঙ্গে দায়বদ্ধতাটি দাঁড়ায় করপোরেট হাউসের ওপর, যারা অর্থ দেয়, বিজ্ঞাপন দেয়। টেলিভিশনে আসলে কারা সাংবাদিকতার সঙ্গে কাজ করবেন, সে ব্যাপারে নীতিমালা নয়, গাইডলাইন থাকা উচিত। কয়েক দিন পর পর বিভিন্ন মহলের উচ্চপর্যায়ের লোকদের তদবির নিয়ে নতুন নতুন অযোগ্য লোক কাজে যোগ দিচ্ছেন। দু-তিন মাস পর তাঁরা রিপোর্টার টেলিভিশনে। সচিবালয়ে মন্ত্রীদের মুখের সামনে মাইক্রোফোন ধরলেন এবং সাংবাদিক হয়ে গেলেন। সর্বনিম্ন কোনো প্রশিক্ষণের ও জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। আমি যখন টেলিভিশনের এসব ভুলে ভরা রিপোর্টগুলো দেখি, তখন হতাশ হয়ে পড়ি। কারণ, আমি নিজেও একজন টেলিভিশন রিপোর্টার ভেবে।
উদাহরণ হিসেবে বলতে চাই, আমাদের টেলিভিশনে ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছেন যিনি, তিনি আইজি, এসপি এমনকি ওসির অর্থ জানেন না। টেলিভিশনে সাংবাদিকতায় যাঁরা জড়িত, তাঁদের সর্বনিম্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা প্রশিক্ষণের কোনো বালাই নেই। এই জায়গাটায় আরও কাজ করতে হবে। আবারও বলতে চাই, আসলে সরকার কাদের লাইসেন্স দেবে? তাদের অনুগত লোককে, নাকি নিরপেক্ষ লোককে? আমার মনে হয়, সরকার তাদের অনুগত লোককেই লাইসেন্স দেবে।
মুন্নী সাহা
কর্মরত সাংবাদিক হিসেবে বলতে চাই, বিভিন্ন ভবন থেকে আমাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও চাপ আসত। সেটি ছায়া সরকার ছিল কি না, তা জানি না। এখন আর সে রকম কোনো ভবনের নিষেধাজ্ঞা ও চাপ নেই। একটি নতুন টেলিভিশনের সঙ্গে কাজ করছি। এই স্বল্প সময়ে এখন পর্যন্ত তথ্য মন্ত্রণালয়ের ফোনের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা বা কোনো চাপ পাইনি। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের সরকারের আমন্ত্রণে একটি স্টাডি প্রোগ্রামে সেখানে গিয়েছিলাম। সেখানকার একটি মিডিয়া সুইস ইনফোর কাছে একটি প্রশ্ন করেছিলাম। প্রশ্নটি আমার কাছে স্বাভাবিক ছিল কিন্তু ওদের কাছে অদ্ভুত। আমরা জানি, সাংবাদিকদের মধ্যে বিভক্তি থাকবে। কেউ সরকারি দলের, কেউ বিরোধী দলের। তারপর কোনো একটি গণমাধ্যমে থাকবে, যেটা সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে। আমি তাঁদের এভাবে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনারা যে ইংরেজি মাধ্যমে তথ্য দিচ্ছেন, তার কোনো নীতিমালা আছে কি না, কিংবা সম্পাদকীয় পলিসিটা কী? তাঁরা বললেন, এটা অবাক কথা। এখানে ফ্রান্স ভারসন আর ইংরেজি ভারসনের মধ্যে পার্থক্য কেন থাকবে? তাঁরা বললেন, সুইস ইনফোতে এমন জিনিস থাকে, যা তাদের দেশের জন্য মঙ্গল। তা সারা বিশ্বকে আমরা দিতে চাই। তখন আমি আবার প্রশ্ন করলাম, কোনো মন্ত্রী বা কেউ যদি দুর্নীতি করেন, সেগুলো কি আপনারা প্রকাশ করেন? এর উত্তরে বললেন, খুব কম আমরা দিই। যদি সেটি বড় ধরনের হয় কিংবা বিবিসি প্রচার করে। এই যে তাঁরা তাঁদের নিজের দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করছেন। আমরা চাই, গণমাধ্যমগুলো নিজেদের দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করবে।
মোজাম্মেল হক
আমরা যে পেশায় নিয়োজিত, এর সঙ্গে আজকের আলোচনার বিষয়টি অত্যন্ত সম্পৃক্ত। আমরা যাঁরা সম্পাদক, তাঁদের সবারই একটি টার্গেট থাকে আগামীকাল সকালে পাঠককে কীভাবে আপ্যায়ন করব। সবারই প্রতিযোগিতা থাকে ভালো লিড, বস্তুনিষ্ঠ ও সত্য সংবাদ পাঠকের কাছে তুলে দেওয়ার জন্য। তবু অনেক সম্পাদকের দায়বদ্ধতা থাকে না পাঠকের কাছে কিংবা গণমাধ্যমের যে স্বাধীনতা, তা পালন করি না। যেহেতু আমার পত্রিকাটি বগুড়া থেকে বের হয়। ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ ছিল, তারা বলেছিল, এটি বিএনপির ট্যাবলয়েড পত্রিকা। আবার যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, তখন আওয়ামী লীগের পত্রিকা বলা হতো। আমরা বিরোধী দলের সংবাদগুলো বেশি দিই। কারণ তারা তখন মাঠপর্যায়ে সক্রিয় থাকে। তখন সরকারি দল মনে করে, তাদের সংবাদ কম ছাপা হচ্ছে। ঢাকার বাইরে এই সমস্যাগুলো বেশি হয়। জেনে খুশি হবেন যে উত্তরবঙ্গে বেশ কয়েকটি পত্রিকা দেশের ও দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। পত্রিকাগুলোর দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে কাজ করছি। যেমন ধর্ষিত মেয়ে কিংবা কিশোরীদের ছবি না ছেপে আমরা দায়বদ্ধতা পালন করছি। সরকার যখন বলে, এর জন্য আমাদের দেশের ক্ষতি হতে পারে, আমরা সেটি মানি। এই মানার সময় হয়তো অনেক সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে উনিশ-বিশ হতে পারে। কিন্তু কোনো প্লাটফর্ম বা মাঠপর্যায়ে যখন একটি পত্রিকা কিংবা সম্পাদককে অন্যভাবে সমালোচনা করা হয়, তখনই আমাদের সম্পাদকদের দায়বদ্ধতা থেকে যায়। অনেক সময় এসব সংবাদ আমরা দেশের মঙ্গলের জন্য করে থাকি। কিন্তু ভুল বোঝাবুঝির মধ্য দিয়ে এসব সমস্যা দেখা দেয়।
প্রেস ইনস্টিটিউটে ১৫ বছর আগে অনেকগুলো প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম, যা আমি আমার পত্রিকায় কাজে লাগিয়েছিলাম। আমার মতামত হবে, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে এ ধরনের আরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, যাতে নবীন সাংবাদিকেরা উপকৃত হতে পারেন। ঢাকার বাইরে প্রায় প্রতিটি জেলায় ১৫ থেকে ১৮টি পত্রিকা বের হয়, যেগুলোর কোনো ভিত্তিমূলক অবস্থান নেই। এসব পত্রিকার ভুল সংবাদের কারণে পাঠক বিভ্রান্ত হচ্ছেন। তাই কোন কোন পত্রিকা রাখা হবে, কী কী শর্ত পূরণ করবে, তার একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা উচিত।
নূরুল কবীর
সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ থেকেই গণমাধ্যম আক্রান্ত হয়েছে বা আক্রান্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। রাষ্ট্রের আইন বিভাগকে আমরা দেখেছি আইনের বাইরে গিয়ে সম্পাদককে শাস্তি দিতে। আদালত অবমাননার মামলায় যেটুকু শাস্তি পাওয়া আইনের বিধানসম্মত, তার বাইরে গিয়ে অনেক বেশি শাস্তি দেওয়া হয়েছে। আমরা সংসদে দেখেছি, গণমাধ্যমের কোনো প্রতিনিধি না থাকা সত্ত্বেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করা হয়েছে। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগও বেশ কয়েক দিন ধরেই গণমাধ্যমের জন্য নীতিমালার কথা বলছে। কখনো গাইডলাইনের ভাষায়, কখনো নীতিমালার ভাষায়। কিছু দিন আগে আরেকটি বৈঠক তথ্যমন্ত্রীর কার্যালয়ে হয়েছিল, সেখানে একটি নীতিমালার প্রস্তাব করা হয়েছিল সরকারি প্রশাসনের দিক থেকে। সেটি এতই অগণতান্ত্রিক ছিল যে মন্ত্রী নিজেই বলেছিলেন, তিনি এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, এ রকম নীতিমালা হতে পারে না। কারণ মন্ত্রী নিজেই দীর্ঘদিন সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত থাকার ফলে কতগুলো অগণতান্ত্রিক বিষয় ওই প্রস্তাবের মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন। স্পষ্টতই, এমন একটি জায়গায় আমরা আছি, যখন রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগই অন্যায়ভাবে গণমাধ্যমের ওপর মনস্তাত্ত্বিক ও নিপীড়নমূলক অবস্থান গ্রহণ করেছে। সরকার কিন্তু জানে যে ফকিরাপুলের একটি বিল্ডিং থেকে একসঙ্গে ৭০-৮০টি পত্রিকা বের হচ্ছে। সরকার তার পরও কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। ইতিপূর্বে একজন বলেছেন, এক একটি টিভি চ্যানেল এক একটি একে-৪৭-এর মতো শক্তিশালী, সরকার কিন্তু অলিখিত নীতিমালার ভিত্তিতে ঠিকই এসব একে-৪৭-এর মতো মারাত্মক অস্ত্র, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার লাইসেন্স, তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য নিজেদের পছন্দের লোকদের হাতে তুলে দিচ্ছে। সব সরকারই এসব কাজ করছে—অলিখিত, সুচিন্তিত নীতিমালার ভিত্তিতে। এগুলো বেআইনি, অসাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পরিপন্থী।
গণতান্ত্রিক মিডিয়ার কাজ হচ্ছে নির্বাহী বিভাগকে মনিটরিং করা। নির্বাহী বিভাগ কী কী অগণতান্ত্রিক আচরণ করছে, তা মনিটরিং করে মানুষের সামনে তুলে ধরা। নির্বাহী বিভাগকে সংবাদমাধ্যমের ওপর খবরদারি করতে দেওয়া নয়। সেই মনিটরিং করতে গিয়ে আমাদের অনেক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এ ধরনের সমস্যা প্রায় সমাজেই রয়েছে, সারা পৃথিবীতে রয়েছে। আমাদের দেশের গণমাধ্যমের প্রশ্নে বলতে পারি, বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ ধারায় যা উল্লেখ আছে, তার বাইরে আর কোনো নীতিমালার প্রয়োজন নেই। সেটি হচ্ছে বিবেকের স্বাধীনতা থাকবে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকবে এবং রিজনেবল রেসট্রিকশন, যা আইনের মাধ্যমে আরোপিত, সেটির পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বিধিনিষেধ থাকবে। অবশ্য এই রিজনেবল শব্দটিকে বিভিন্ন সরকার আনরিজনেবলভাবে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছে। তাই রিজনেবল শব্দটির ব্যাখ্যার প্রয়োজন ও আলোচনা হতে পারে। নতুন করে নীতিমালার কোনো প্রয়োজন নেই। সংবিধানের অনেক কিছুতেই গোঁজামিল আছে। আওয়ামী লীগ বলতে পারে, আমি সংবিধান এ রকমই চাই। বিএনপি তাদের মতো চায়। আমি নিজে তো এই দুটির একটিও চাই না। ফলে আমি যা চাই, তা আমি বলব। আমাকে গ্রেপ্তার করলেও, দেশ থেকে বের করে দিলেও, সবখান থেকে আমি একই কথা বলব। আমি যা বিশ্বাস করি, তা সততার সঙ্গে বলি এবং তা অবশ্যই আমি বলব। প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সরকারের ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের অগণতান্ত্রিক তৎপরতার বিরুদ্ধে বলব। আমি যদি অযৌক্তিক কথা বলি, তবে সেটা কেউ শুনবে না।
সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতার কথা উঠেছে। জরুরি অবস্থার সময় বহু পত্রিকা, যার মধ্যে প্রথম আলোও একটি, অনেক রাজনীতিকের নানা অপরাধ সম্পর্কে ডিজিএফআইয়ের সরবরাহ করা খবর, অভিযুক্তদের সঙ্গে কথা না বলে মাসের পর মাস ছেপেছে। সেদিন আপনাদের জন্য পুরো মিডিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আপনারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আজকে গণমাধ্যমের যে বিশ্বাসযোগ্যতার কথা ওঠে, কাগজগুলো ওই কাজটা না করলে হয়তো আজ এভাবে উঠত না। জাতীয় সংসদে সম্পাদকদের অনুপস্থিতিতে, তাঁদের ডিফেন্ড করতে সুযোগ না দিয়ে, সাংসদেরা গালাগাল করতে পারতেন না। জরুরি অবস্থার সময় সেটি করার পেছনে হয়তো আপনাদের কোনো রাজনৈতিক মহৎ উদ্দেশ্য ছিল। আমি নিজেও আওয়ামী-বিএনপির রাজনৈতিক ব্যবস্থা চাই না। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য ইতিহাসসিদ্ধ যে পথ ও পন্থা আছে, যে সাড়ে তিন হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাস আছে, সেভাবে ছাড়া, জনগণকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বাইরে রেখে যেকোনো রাজনৈতিক পরিবর্তন দেশের জন্য, গণমাধ্যমের জন্য ক্ষতিকর বলে আমি মনে করি। আমি যদি কাউকে অভিযুক্ত করি, তবে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। এটা ছাড়া কোনো দায়িত্বশীল সংবাদপত্র হতে পারে না। এটি যদি না করি, তাহলে মানুষ আমাদের খারাপ বলবেই। সেটি ওই দিনও যেমন সত্য ছিল, আজকেও সত্য, ভবিষ্যতেও সত্য থাকব।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে সরকারি নীতিমালা ও কার্যক্রম নিরীক্ষা করার জন্য উন্নততর পেশাদার সংবাদকর্মী তৈরি করা প্রয়োজন। আর তার জন্য গণতন্ত্রপরায়ণ সাংবাদিক প্রতিষ্ঠানের দরকার রয়েছে। তা করার জন্য আমাদের সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করতে হবে। তাহলে আমাদের গণমাধ্যমে নিজেদের যে দুর্বলতা আছে, তা কাটিয়ে উঠতে পারব। গণমাধ্যমের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, এ কথা সত্য। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের নৈতিকতার অবস্থান থেকে গণমাধ্যমের কর্মীদের নৈতিকতার অবস্থান এখনো অনেক ওপরে। যাঁরা জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন, তাঁদের মনিটরিং করা, তাঁদের সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে বলা সংবাদপত্রের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালন করা গণমাধ্যমের গণতান্ত্রিক কর্তব্য। আমাদের নিজস্ব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারলে, কর্তব্যটি আমরা আরও ভালোভাবে পালন করতে পারব। সবাইকে ধন্যবাদ।
গোলাম সারওয়ার
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অবিরত থাকা উচিত। কিন্তু তার দায়বদ্ধতা শুধু পাঠকের কাছে, অন্য কারও কাছে নয়। সংসদে কিছুদিন আগে গণমাধ্যমকে যে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নাস্তানাবুদ করা হয়েছে, তা অত্যন্ত মর্মান্তিক ও ভয়াবহ। আমার দীর্ঘ পেশাজীবনে এ ধরনের কোনো ঘটনা দেখিনি। বাংলাদেশে টেলিভিশন ও বেতারের কল্যাণে দর্শক সরাসরি দেখেছেন ও শুনেছেন। পরদিন পত্রিকায় পাঠক পড়েছেন। আত্মপক্ষ সমর্থনের যেখানে কোনো সুযোগ ছিল না, সেখানে সাংসদেরা যে ভাষায় গণমাধ্যমকে গালাগাল করেছেন, তাতে সভ্য সমাজের ইতিহাসে এর চেয়ে লজ্জার আর কিছু হতে পারে না।
আমাদের উচিত ছিল সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এর প্রতিবাদ করা। কিন্তু আমরা তা করতে পারিনি। আমরা মুখ বুজে সহ্য করে গিয়েছি। আমাদের উচিত ছিল আরও বড় আকারে আলাপ-আলোচনা করে এর প্রতিবাদে পরবর্তী দিনের কার্যক্রম কী হবে, তা নির্ধারণ করা এবং উদ্যোগ নেওয়া। এই বিপদ শুধু প্রথম আলো, সমকালসহ কয়েকটি পত্রিকার নয়, এটা সব গণমাধ্যমের জন্য হুমকিস্বরূপ। ওই দিন সাংসদদের সঙ্গে স্পিকার নিজে যেভাবে যোগ দিয়েছেন, তাতে আমার কাছে মনে হয়েছে, পূর্বপরিকল্পিতভাবে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে সমালোচনা করেছেন। সাংসদদের পূর্বপ্রস্তুতি দেখে তা স্পষ্ট। জানি না, স্পিকার নিজেও এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কি না। স্পিকার হচ্ছেন সংসদের অভিভাবক, কিন্তু তিনি যে ভাষায় কথা বলেছেন, তা কারও কাছেই কাম্য ছিল না।
সংসদে বিরোধী দল অনুপস্থিত থাকার একটি প্রথা তৈরি হয়েছে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। যেহেতু তারা সংসদে যায় না, তাই জনগণের পক্ষে যে দাবি তা গণমাধ্যকেই তুলে ধরতে হয়। ফলে সংসদ বা সরকারি দল ও গণমাধ্যমের মধ্যে বিপরীত সম্পর্ক দেখা যায়।
আরেকটা বিষয়, গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে প্রায়ই আদালত অবমাননার অভিযোগ দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে আমি বলতে চাই, মতিউর রহমান ও মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে বিচারপতি আজিজ স্বপ্রণোদিত হয়ে মানহানির মামলা করেছিলেন। সেখানে আদালতে দাঁড়িয়ে যে অকথ্য ভাষায় আচরণ করছিলেন, তা বিরল। সেখানে যুগান্তর-এর প্রকাশককে ১০ হাজার টাকা জরিমানা এবং আমাকে তিন মাসের জেল দেওয়া হলো। তখন সব বড় বড় আইনজীবী এসে আমাদের ক্ষমা চাইতে বললেন। কারণ, আদালত অবমাননার মামলা হলে বড় বড় আইনজীবী একটু ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার কথা বলেন। সেখানে উপস্থিত যাঁরা ছিলেন তাঁরা, এমনকি সরকারপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল পর্যন্ত অনুরোধ করেছিলেন এবং বললেন, এ রায় যদি হয়, তবে জুডিশিয়ারি ও গণমাধ্যম বিপরীত অবস্থান হয়ে যাবে। পরে সেখানে সেই রায় স্থগিত করা হয়। পরে যুগান্তর-এ একটি লেখা লিখেছিলাম ‘সম্পাদকের জবানবন্দি’। সেখানে সেদিন যা ঘটেছিল তা সুবিস্তৃত আকারে ছিল। আমার মনে হয়, আদালত অবমাননা বলতে কী বোঝায়, তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা দরকার। কী কী করলে আদালত অবমাননা হবে, তা নিয়ে বিশদভাবে আলাপ-আলোচনা করতে হবে।
বেসরকারি চ্যানেলের ওপর বিটিভির সংবাদ চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। কারণ বিশ্বের উন্নত দেশ, এমনকি আমেরিকায় পর্যন্ত এ ধরনের কোনো নীতি নেই। বারবার বিটিভি ও বেতারের স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। বিটিভি ও বেতারে যে সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে তা কতটুকু মানসম্মত—এ নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। বিশ্বের কোথাও নেই পত্রিকা প্রকাশের জন্য ডিক্লারেশন নিতে হবে। যদি কোনো পত্রিকা আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়, যদি তারা তাদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করে, তবে ডিক্লারেশনের কোনো দরকার নেই। আর যদি তারা কোনো অন্যায় করে থাকে, তবে তা প্রচলিত আইনের মাধ্যমে বিচার হবে।
গণমাধ্যম যে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না, তার জন্য একটি সম্মিলিত ফোরাম করা উচিত। সংবাদপত্রের ইতিহাসে বর্তমানে আমরা যে ভয়াবহ সংকটময় সময় পার করছি, তা থেকে মুক্তির জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব। সংবাদপত্র যে ভুলে ভারাক্রান্ত, তা অস্বীকার করছি না। একটি সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে নিজ নিজ পত্রিকায়, যারা প্রতিদিন কী ভুল হচ্ছে তা দেখবে। আরেকটি দিক, সম্প্রতি গণমাধ্যমে যে পরিমাণ টাকার ছড়াছড়ি হচ্ছে, তাতে সাংবাদিকেরা অর্থ ও স্বার্থের কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছেন। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ভুলের পরিমাণ আরও বেশি। সাংবাদিকেরা বেশি টাকার চাকরির লোভে এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যাচ্ছেন। কালো টাকার মালিকেরা এসে বেশি বেতনে সাংবাদিকদের নিয়ে যাচ্ছেন। ইদানীং প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো হচ্ছে খুবই নোংরাভাবে। দুটি পত্রিকা অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে দিনের পর দিন মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সম্মিলিতভাবে এর প্রতিবাদ করা উচিত। সংবাদপত্রের যে সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, তার ঐতিহ্য রক্ষায় আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
শাহ আলমগীর
আমি গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতার ওপর জোর দিতে চাই। তাই কিছু পত্রিকার দায়িত্বহীনতার কথা আগে বলতে চাই। একটি পত্রিকা প্রথম পাতায় ড. কামাল হোসেনের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি বৈঠকের সংবাদ প্রকাশ করেছিল। অথচ সেদিন তিনি দেশেই ছিলেন না। সেই রিপোর্টার একজন প্রভাবশালী এবং দাপটের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কথা বলতে গেলে তা আরও ভয়াবহ। উদাহরণ হিসেবে, বিডিআর বিদ্রোহের সময় যখন সেনা কর্মকর্তাদের আত্মীয়স্বজন বের হয়ে আসছেন, তখন একজন রিপোর্টার মেজরের স্ত্রীকে প্রশ্ন করেছেন, ‘আপনি কি ধর্ষিত হয়েছেন?’ এগুলো হচ্ছে গণমাধ্যমের দায়িত্বহীনতার উদাহরণ। দায়িত্বহীনতার আরেকটি উদাহরণ বলতে চাই, ইরাকযুদ্ধের পর বিবিসি একটি সংবাদে বলেছে, ইরাকে পারমাণবিক অস্ত্র ছিল না, তা ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রধানমন্ত্রী নিজেও জানতেন। এটি যখন প্রকাশ করা হয়, ব্রিটেনে এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। সেখানে এও বলা হয়, জনগণকে যুদ্ধের পক্ষে আনার জন্য এই রিপোর্ট করা হয়েছিল। এরপর একজন বিজ্ঞানী ডেভিড কেলিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরদিন তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়। মৃত্যুর আগে তিনি লিখে যান, এই সংবাদের তিনিই ছিলেন উৎস। পরে বুলেটিনে প্রধানমন্ত্রী নিজেও জানতেন বিষয়টি তুলে দেওয়া হয়েছিল, কারণ সাংবাদিক মিলিগান নিজেও জানতেন যে এর যথেষ্ট প্রমাণ তাঁর কাছে নেই। পরদিন তিনি তাঁর সাংবাদিকতা পেশা থেকে অব্যাহতি নিয়েছিলেন। এই যে গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা, তা বলে-কয়ে আদায় করা যায় না। আমরা যদি গণমাধ্যমের কর্মীরা নিজেরা দায়বদ্ধ না হই, তবে নীতিমালা তৈরি করে কখনো তা আদায় করা যাবে না। সাংসদেরা নিজেরা নিজেদের দায়িত্বে কতটুকু দায়বদ্ধ? তাঁরা কীভাবে গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েই যাচ্ছে। গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে দীর্ঘদিন ধরে একসঙ্গে সবাইকে কাজ করে যেতে হবে।
আলমগীর মহিউদ্দিন
সরকার এবং সব পক্ষের মধ্যে সহনশীলতার মনোভাব থাকা দরকার। সরকার ও গণমাধ্যমের মধ্যে যদি সাংঘর্ষিক সম্পর্ক থাকে, তবে কখনো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পাওয়া সম্ভব নয়। বিল ময়ার্সের উদ্ধৃতি থেকে বলতে চাই, ‘দেয়ার ইজ নো মোর ইমপরট্যান্ট স্ট্রাগল ফর ডেমোক্রেসি, দ্যান এনসিউরিং এ ডাইভার্স, ইনডিপেনডেন্ট অ্যান্ড ফ্রি মিডিয়া, ফ্রি প্রেস ইজ দ্য হার্ট অব দ্যাট স্ট্রাগল।’ আর থমাস জেফারসনের আরেকটি উদ্ধৃতি হলো, ‘দি ওনলি সিকিউরিটি অব অল ইজ ইন ফ্রি প্রেস।’ তাই বলতে চাই, গণমাধ্যমকে যদি স্বাধীনতা না দেওয়া হয়, তবে গণতন্ত্রের উত্তরণ হবে না। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ করব, যাতে গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করার জন্য।
বাংলাদেশের ঊষালগ্নে যখন মনোরঞ্জন ধর আইনমন্ত্রী ছিলেন, তখন তাঁর একটি সাক্ষাৎকার আমি নিয়েছিলাম। তখন আইনে পাকিস্তান কেটে বাংলাদেশ করা হচ্ছে। এক ফাঁকে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশে এত আইন আছে যে আগামী ১০০ বছরে আর কোনো আইন করতে হবে না। কারণ একটি বিষয়ের ওপর চার-পাঁচটি আইন আছে। তাই বলতে চাই, বাংলাদেশে এত আইন আছে যে নতুন করে কোনো নীতিমালা করার প্রয়োজন নেই। যে আইনগুলো দিয়ে মানুষের অধিকার রক্ষা করা যায়, সেগুলো যদি বাস্তবায়ন করা হয়, তবে আর নতুন করে আইন করার প্রয়োজন নেই। গণমাধ্যমে যদি স্বাধীনতা না থাকে, তবে সেই গণমাধ্যমের কোনো প্রয়োজন নেই। স্বাধীন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
মাহফুজ আনাম
আমি মনে করি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আমাদেরই রক্ষা করতে হবে এবং এর দায়বদ্ধতা আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে গণমাধ্যম কখনো দায়বদ্ধ নয়। সংবাদপত্রের ইতিহাস বহুদিনের। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আমরাই অর্জন করেছি, এটি রক্ষার দায়িত্বও আমাদের। স্বল্প সময়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের যে প্রসার ও বিকাশ ঘটেছে এবং যে স্বাধীনতা ভোগ করছি, আমি মনে করি, আমরা অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছি।
আমরা সম্পাদকেরা নিজেরা যদি নিজেদের দায়বদ্ধতা নিয়ে আত্মসমালোচনা করি, যদি সম্পাদকেরা পাঠকের তথা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন, তবে আমি মনে করি, গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত হবে। আমি একটি প্রস্তাব করতে চাই, আমরা সম্পাদকেরা যদি নিজেরা একটি ফোরাম করি, যেখানে পেশাদারি নিয়ে আলোচনা হবে; আমাদের মতামত, রাজনৈতিক মত-দর্শন ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু সাংবাদিকতা পেশাদারির যে মূল কাঠামোগুলো আছে, সেগুলো মানছি কি না, তা নিয়ে এই এডিটরিয়াল ফোরামে আলোচনা হতে পারে।
আরেকটি বিষয়, সম্প্রতি সরকার যে নীতিমালা করতে যাচ্ছে, আমার অনুরোধ থাকবে, এটি করবেন না। আর যদি এটি করতেই চান, তবে এটি এখনই ওয়েবসাইটে দিয়ে দেন। এটির বিষয়ে জনগণ, সম্পাদক ও সাংবাদিকদের মতামত নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে করতে হবে। আর আমাদের দেশের নির্বাচিত সরকারগুলো সত্যিকার অর্থে স্বাধীন সাংবাদিকতার মূল্য কত, কতটা তাদের স্বার্থে, তা বুঝতে পারে না। আজকে প্রমাণিত হয়েছে, স্বাধীন সাংবাদিকতা গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য। আপনারা যদি গণমাধ্যমকে হেয়প্রতিপন্ন করেন, তবে গণতন্ত্রেরই ক্ষতি হবে।
মাহবুবুল আলম
আমি দুটি বিষয়ে বেশি জোর দেব। প্রথমত, গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারটিতে বেশি জোর দেব। সম্প্রতি গণমাধ্যমের আকার অনেক বড় হয়েছে। সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও বেতারের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। তাই সাংবাদিকের প্রয়োজনীতাও বেড়েছে। রাতারাতি তো আর সাংবাদিক তৈরি করা যায় না। তাই এডিটরিয়াল ফোরামের যে প্রস্তাব এসেছে, তা যদি করা যায়, যেখানে পেশাদারির জায়গায় কাজ করা যাবে। আমাদের নবীন সাংবাদিকদের জন্য বেশি বেশি প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অনেক পত্রিকায় নিজস্ব ব্যবস্থায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের দেশের গণমাধ্যমগুলোর উচিত, নিজস্ব ব্যবস্থায় নিজেদের নবীন সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। আবার গণমাধ্যমের সব সাংবাদিককে নিয়ে সম্মিলিতভাবে প্রশিক্ষণের আয়োজন করা যেতে পারে।
আমাদের দেশে গণতন্ত্র রয়েছে, নির্বাচিত সরকার আছে। কিন্তু সব সরকার গণমাধ্যমের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনেনি। আমি মনে করি, সংবাদপত্রগুলোকে সংবাদপত্র হিসেবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে, তাদের নিজস্ব মত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে দিতে হবে। পাকিস্তান শাসনামলে কালাবাগের আমির, পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নরও ছিলেন যিনি, তিনি লন্ডনে যাবেন চিকিৎসা করাতে। সংবাদটি সত্যি ছিল। কিন্তু তা প্রকাশ করার দায়ে পত্রিকার সাংবাদিক ও সম্পাদককে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। অন্যদিকে, ইন্দিরা গান্ধী সম্ভবত ঠান্ডার জন্য কাঁপছিলেন, একটি পত্রিকা লিখল তাঁর ঠোঁটে ক্যানসার হয়েছে। ভারতীয় সরকার কিন্তু সেই পত্রিকার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এটি গণতান্ত্রিক দেশের গণমাধ্যমের প্রতি আরেক ধরনের আচরণ। গণমাধ্যমেরও অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তা সত্ত্বেও সংবাদপত্র কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশে যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তার পেছনে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। সংবাদপত্র যদি নির্ভয়ে সংবাদ প্রকাশ করতে না পারত, তবে আজ আমরা এ অবস্থায় আসতে পারতাম না। গণমাধ্যমকে যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হয়, তবে আমরা গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় আরও ভূমিকা পালন করতে পারতাম। বর্তমান সরকার যে তথ্য অধিকার আইনটি করেছে, তার জন্য ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু এ ব্যাপারে আমার কিছু ভিন্নমত রয়েছে। আমি মনে করি, তথ্য অধিকার আইনটির আরও প্রচার বাড়াতে হবে জনগণের মধ্যে। এ আইন সংশোধনের মাধ্যমে মানুষের আরও তথ্য জানার অধিকার বাড়াতে হবে। আমি একটি কবিতার দুটি লাইন বলতে চাই, ‘অসত্যের কাছে নত নাহি হবে শির, ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ, লড়ে যায় বীর’। অর্থাৎ ভয়কে উপেক্ষা করে আমরা সবাই একসঙ্গে সামনে এগিয়ে যাব।
ড. গীতি আরা নাসরীন
বর্তমানে গণমাধ্যম রমরমা অবস্থার মধ্যে রয়েছে। খুব সহজে চট করে সাংবাদিকতার চাকরি পাওয়া যায়। শিক্ষার্থীদের ঠিকমতো শেখানোর আগেই তাঁরা সাংবাদিক হয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা মিডিয়া হাউসে এসে শেখেন যে তাঁদের আর শেখার কিছু নেই। যা শেখার তাঁরা তা কাজ করেই নাকি শিখবেন। লেখাপড়া করার আর দরকার নেই। এই যে মিডিয়ার রমরমা ব্যবসা, এর ফলে মিডিয়ার কথা মানুষের যেভাবে শোনার কথা ছিল, তা কিন্তু শুনছে না। কারণ মিডিয়া কেনা যায়, যেকোনো বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে সব ধরনের কথাবার্তা বলানো যায়।
এমনকি আপনি চাইলে একটি মিডিয়া তৈরি করে আপনার নিজের কথা বলতে পারবেন। গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা কিংবা স্বাধীনতার কথা বলতে পারি কিংবা ইতিহাস থেকে উদাহরণ দিতে পারি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এসব বড় বড় কথার কোনো ভিত্তি নেই। বাস্তব কথা হচ্ছে, মিডিয়া যে জায়গায় থাকার কথা, সেখানে নেই। আসল কথা হচ্ছে, জনগণ মিডিয়ার সঙ্গে নেই। জনগণ নেই, কারণ জনগণকে মিডিয়া কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করে না। সংবাদপত্রে কী লিখবেন, কী ছাপবেন—সবকিছুই গণমাধ্যমকর্মীরা সিদ্ধান্ত নেন, জনগণের মতামত নেওয়া হয় না। জনগণ আসলে কী চাইছে, তা কিন্তু মিডিয়া জানার চেষ্টা করে না। বাংলাদেশের বেশির ভাগ গণমাধ্যমের নিজস্ব কোনো গবেষণা সেল নেই। সারা বিশ্বে মিডিয়াগুলোর নিজস্ব গবেষণা সেল আছে এবং থাকা আবশ্যকীয়। এই গবেষণা ক্রমাগত জানাতে থাকবে জনগণ আসলে কী চাইছে, তাদের চাহিদা কী; জনগণের পছন্দ-অপছন্দ জানার জন্য কাজ করে যাবে। জনগণকে বোঝাতে হবে যে মিডিয়া তাদের সঙ্গে আছে। প্রশিক্ষণ ছাড়া কখনো পেশাদার সাংবাদিক পাওয়া সম্ভব নয়। যেকোনো একাডেমিক প্রতিষ্ঠান তাঁদের মূল বিষয়গুলো শেখাবে। আর বাকি বিষয়গুলো তিনি মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে শিখতে পারবেন। মিডিয়া হাউসগুলোর দায়িত্ব এই কাজগুলো নিজেদের কর্মীদের শেখানো। মিডিয়া হাউসগুলোর নিজস্ব প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত তাদের কর্মীদের জন্য। আর নীতিমালা বিষয়ে বলতে চাই, এটি কারোরই পছন্দ হবে না, যখন সেটি জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হবে।
আমাদের নিজেদের উচিত, যে ভুলগুলো হচ্ছে তা সংশোধনের জন্য নীতিমালা তৈরি করা। আমাদের গণমাধ্যমের উচিত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের নীতিমালা নিজেরাই তৈরি করা। সেটিই তথ্য মন্ত্রণালয়কে দিয়ে বলতে পারি, আমরা আমাদের নিজেদের নীতিমালা তৈরি করেছি, আপনাদের দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে।
এবিএম মূসা
পঞ্চান্ন বছর আগে যখন সাংবাদিকতা শুরু করেছিলাম, তখনো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। এই দীর্ঘ সময় ধরে কেন একই আলোচনা আমাদের করতে হবে, সে বিষয়ে আমি বিস্মিত। আজকের এই আয়োজনের মাধ্যমে এটি পরিষ্কার হচ্ছে যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো নেই। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ব্যাপারে আমাদের সবার মনে সংশয় ও আশঙ্কা রয়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বলতে বোঝায়, আমার যতটুকু প্রয়োগ করব, করার সাহস আছে তা-ই স্বাধীনতা। আমি কারও কাছে স্বাধীনতা চাইও না। আমি যে মতটি মনে করি স্বাধীনভাবে প্রকাশ করা উচিত, সেটিই আমার স্বাধীনতা। আমি সম্পাদক হিসেবে যা বিশ্বাস করি, তা অবশ্যই প্রকাশ করব। সরকার যতই নীতিমালা করুক না কেন, আমি আমার মত প্রকাশে পিছপা হব না, এটিই আমার স্বাধীনতা। এর ফলে যদি আমার শাস্তি হয়ও, যদি জেল-ফাঁসি এমনকি মৃত্যুও হয়, তাও আমি আমার মত প্রকাশ করব। এটিই আমার স্বাধীনতা।
আর দায়বদ্ধতা কার কাছে? আমি মনে করি, আমার দায়বদ্ধতা নিজের বিবেকের কাছে। আমার বিবেক আমাকে যা বলে, আমি তা-ই লিখি। আমরা যখন সংবাদ প্রকাশ করি, তখন একটি প্রশ্ন আসে, আসলে সংবাদ বলতে কী বোঝায়। এ প্রশ্ন বহুদিন ধরে। জনগণকে যে সংবাদটি আকৃষ্ট করে, আসলে সেটিই সংবাদ। জ্ঞান লাভের জন্য বই পড়তে হয়, এর জন্য সংবাদ পড়তে হয় না। আমরা যখন সংবাদপত্র প্রকাশ করেছি, তখন তা করেছি জনমত গঠনের জন্য। এখন সংবাদপত্র প্রকাশ করা হয় জনমতের প্রতিফলন ঘটানোর জন্য। আমাদের সময় পাঠকদের বাধ্য করতাম সংবাদ পড়তে।
সংসদে যেভাবে গণমাধ্যমকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেছেন সাংসদেরা, আমি আমার সম্পাদকীয় লেখার মাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। কিন্তু আমার দুঃখ, আমাদের সম্পাদকেরা সংযত থেকে লিখেছেন। তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ জানাতে পারেননি বলে আমি হতাশ হয়েছি। এক-এগারোর পরে যখন সাংবাদিকদের ও বার্তাপ্রধানদের ধরে নিয়ে যাওয়া হতো, তখন আমি ডিজিএফআইয়ের কাছে ফোন করে জানতে চাইতাম, কেন সাংবাদিকদের ও বার্তাপ্রধানদের ধরে এনেছেন? কারণ, যখন কোনো সংবাদ ছাপা হয়, তখন তার দায়দায়িত্ব সম্পাদকের ওপরই বর্তায়। কেন সম্পাদককে ধরে আনেননি এমন ঘটনায়? ডিজিএফআই থেকে উত্তর এসেছিল, ‘আমি সম্পাদকের কাছে রিপোর্টারকে নিয়ে গিয়েছিলাম, সম্পাদক বলেছেন তিনি কিছু জানেন না।’ এই যদি হয় সম্পাদকীয় অবস্থা, তবে সেখানে দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
মতিউর রহমান
আমাকে ও আমাদের প্রতিষ্ঠান নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। আপনারা অনেকেই আমাদের সমালোচনা করেছেন। আমাকে এত শক্তিশালী করে তোলা হচ্ছে যে আমিই নাকি এক-এগারো সৃষ্টি করেছিলাম। আপনাদের বলতে চাই, আমাদের প্রথম আলো পত্রিকা ২০০৬ সালের আগস্ট থেকে ২০০৭ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সব সেনা সদরে, ক্যাম্পে, ক্যান্টনমেন্টে বেআইনি ছিল। পত্রিকা এসব জায়গায় প্রবেশ করতে দেওয়া হতো না। সে সময় আমাদের ১৪ জন সাংবাদিককে ক্যাম্পে নিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠীকে আমাদের বিরুদ্ধে উসকে দেওয়া হয়েছে। আমাদের সাত বছরের হিসাবের সবখাতা এক বছর ধরে তন্নতন্ন করে দেখা হয়েছে, কিছু পায়নি। আমরা অনেক কিছু সে সময় ছেপেছি। যেহেতু আমাদের এতই শক্তিশালী বলা হচ্ছে, তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তখন আমার যত লেখা ছেপেছিলাম এবংগোলটেবিলবৈঠকের সবলেখা দুটি বই আকারে ছেপে দেব।
আমাদের মূল কথা ছিল, আমরা কখনো সামরিক শাসন চাই না। আমরা নির্বাচন চাই, আমরা নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার চাই। নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করবে, এটিই ছিল আমাদের মূল লক্ষ্য। হ্যাঁ, হয়তো আমরা ভুল করেছি। আমরা অনেক সংবাদ প্রকাশ করেছি হয়তো পুরো সত্য নয়, কিংবা ভুল। আবার অনেক রিপোর্ট আমরা ছাপিনি। অনেক রিপোর্ট ছাপার আগে মতামত নেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমরা এত শক্তিশালী কখনো হইনি যে, কোনো ব্যক্তি বা একটি পত্রিকার পক্ষে দেশের এত বড় একটি পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। সংবাদপত্রে প্রতিদিনই অনেক ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকে। আমরা সেগুলোর জন্য পাঠকের কাছে ভুল স্বীকার করি। আমরা সব সময় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চাই। আমাদের দেশের জন্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই বলে আমরা বিশ্বাস করি।
আবুল কালাম আজাদ
আজকের যাঁরা বক্তা ছিলেন, তাঁরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন। সাংবাদিকদের নিরাপত্তার প্রশ্নে আমি বলতে চাই, যেখানে সাংবাদিক নির্যাতনের বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটে, সেখানেই সরকার প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ নিচ্ছে। কয়েকজন সাংসদের মন্তব্যই যে সরকারের মনোভাব, তা কিন্তু নয়। সরকার সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। আপনারা সাংবাদিকদের ওয়েজবোর্ডের কথা বলেছেন, এ ব্যাপারে সরকার কাজ করছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের সঙ্গে ইতিমধ্যে আমরা সরকারের পক্ষ থেকে আলাপ-আলোচনা করেছি। বর্তমান সরকার জনগণের কাছে নির্বাচনী ইশতেহারে কিছু অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় এসেছে। আমরা সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে কাজ করছি। আমাদের নির্বাচনী অঙ্গীকারের ১৯ অনুচ্ছেদে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করার কথাটিও ছিল। আমরা এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।
আমি বলতে চাই, বিগত দুই বছরের মধ্যে তথ্য মন্ত্রণালয় কিংবা সরকারের কোনো মহল থেকে কোনো গণমাধ্যমের কাছে কোনো বিষয়ে চাপ বা ফোন এসেছে, কেউ বলতে পারবেন না। বর্তমানে গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করে যাচ্ছে বলে আমার বিশ্বাস। যদি কারও কাছে কোনো প্রমাণ থাকে, তা অবশ্যই আমার কাছে দেবেন। নীতিমালার প্রশ্নে আপনাদের মধ্যেই দ্বিমত আছে। আমরা প্রাথমিকভাবে একটি খসড়া আপনাদের কাছে দিয়েছিলাম, আলোচনা করেছিলাম। সরকার প্রয়োজনে আরও অনেকবার আপনাদের নিয়ে বসবে, আলোচনার মাধ্যমে সবাই মতৈক্যে পৌঁছেই কেবল নীতি তৈরি করা হবে।
প্রেস ইনস্টিটিউট ও প্রেস কাউন্সিলকে আরও শক্তিশালী করার জন্য আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি। বিগত দিনে শুধু ইলেকট্রনিক মিডিয়ার একজনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আপনারা যে সংবাদ পরিবেশন করেন, সেখানে কোন সংবাদ আগে যাবে, সে ব্যাপারে কোনো নীতিমালা আছে কি না। তখন আমি সংবাদ দেখছিলাম। কারণ প্রধানমন্ত্রীর সংবাদটি চার নম্বরে ছিল। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদের আগে দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অন্য সংবাদ যেতে পারে। কিন্তু সেখানে যে তিনটি সংবাদ আগে প্রচার করা হয়েছিল, তা প্রধানমন্ত্রীর সংবাদটির চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই কোন সংবাদটি কখন যাবে, সে জন্য একটি নিয়মনীতি থাকা দরকার। আর গণমাধ্যমকে সহায়ক শক্তি হিসেবে সব সময় মনে করে বর্তমান সরকার। সরকারকে গণমাধ্যমের সম্পাদকদের নিয়ে নিয়মিত যে বৈঠকের প্রস্তাব আপনারা করেছেন, আমি মনে করি, এটি একটি ভালো উদ্যোগ। এর ফলে গণমাধ্যম ও সরকারের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব। এ ধরনের আলাপ-আলোচনার আয়োজন তথ্য মন্ত্রণালয় অবশ্যই করবে। বিটিভির সংবাদ যাতে আরও বস্তুনিষ্ঠ ও সংক্ষিপ্ত হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবে তথ্য মন্ত্রণালয়।
বর্তমানে আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিকসহ সব ক্ষেত্রে সহনশীলতা অনেক কমে গেছে। আমাদের সবাইকে আরও সহনশীল হতে হবে। বর্তমান সরকার, এমনকি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত গণমাধ্যমের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখছেন। বর্তমান সরকার গণমাধ্যমবান্ধব এবং এর স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। সারা দেশের সব সম্পাদককে একসঙ্গে নিয়ে বৈঠকের প্রস্তাব করা হয়েছে। আপনারা যদি চান, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়ে দিনব্যাপী আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
গণমাধ্যমেই শুধু নয়, সমাজের সব ক্ষেত্রে এখন ব্যাপকভাবে কালো টাকার ব্যবহার হচ্ছে। অনেক সাংবাদিকই কালো টাকার মালিকদের উৎসাহিত করছেন গণমাধ্যমে বিনিয়োগ করার জন্য। ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ আরও সব মিডিয়ায় যে নবীন সাংবাদিকেরা আসছেন, তাঁদের ন্যূনতম একটি শিক্ষাগত যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু কয়েকজন সাংসদের বক্তব্যই যে সরকারের বক্তব্য, তা কিন্তু নয়। সরকার ও দলের বক্তব্য দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট মুখপাত্র রয়েছেন। সংসদে যে ঘটনা ঘটেছে, সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী সেই সব সাংসদকে ডেকে ব্যবস্থা নিয়েছেন, যাকে যা বলা দরকার তিনি বলেছেন। সেদিনের ঘটনাটি অনির্ধারিতভাবে হঠাৎ করে ঘটেছে। সেদিন আমি বারবার সংসদের হুইপের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি, যাতে আলোচনাটি বেশিক্ষণ চলতে না থাকে। আমি সেদিন খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ছিলাম। সংবাদপত্র যদি তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন না করত, তবে আজ আমরা যে গণতান্ত্রিক অবস্থায় পৌঁছেছি, তা সম্ভব হতো না।
আর দায়বদ্ধতার কথা বললে, সবাইকে কারও না কারও কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হয়। যেমন আমি চারজনের কাছে দায়বদ্ধ—প্রথমত, সাংসদ হিসেবে সংসদের কাছে; দ্বিতীয়ত, মন্ত্রী হিসেবে কেবিনেটের কাছে; তৃতীয়ত, দলের সদস্য হিসেবে আওয়ামী লীগের কাছে এবং চতুর্থত, আমি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। জনগণের কাছে আমার দায়বদ্ধতা হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই সরকার ও গণমাধ্যমের সবার দায়বদ্ধতা হচ্ছে জনগণের কাছে।
সংবাদের প্রতিবাদ ছাপার বিষয়ে বলতে চাই, সে ক্ষেত্রে দেখা যায় সংবাদ ছাপা হয়েছে প্রথম পাতায়, আর প্রতিবাদ ছাপা হয় ছোট আকারে ভেতরের পাতায়। যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, তাঁর যা ক্ষতি হওয়ার তা তো হয়েই গেল। এ ক্ষেত্রে বলতে চাই, সংবাদ যেখানে ছাপা হবে, এর প্রতিবাদ অবশ্যই সেখানে কিংবা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ছাপা উচিত এবং সেখানে লেখকের মতও থাকা দরকার। বর্তমানে মিডিয়াকে কেনা যায়। এ ব্যাপারে ষাট-সত্তরের দশকে যখন সাংবাদিকতা পেশায় আসি, তখন মিডিয়া কেনার চিন্তাও করা যেত না। গণমাধ্যমের উচিত গবেষণার মাধ্যমে বের করা যে জনগণ কতটা মিডিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, নীতিমালা চাপিয়ে দেওয়ার কোনো চিন্তা সরকারের মাথায় নেই। সরকার কখনো মনে করে না যে গণমাধ্যম ও সরকার কেউ কারও প্রতিপক্ষ। সরকারের সঙ্গে গণমাধ্যমের আস্থার পরিবেশ অবশ্যই নিশ্চিত করা হবে। আস্থার পরিবেশ সৃষ্টিতে উভয় পক্ষকে আরও সহনশীল হতে হবে। আমরা চাই সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করুক গণমাধ্যম। নিউজপ্রিন্টের মূল্যবৃদ্ধিসহ আপনাদের দাবির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমরা আলোচনা করব। বর্তমান সরকার ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চাইছে, সেখানে গণমাধ্যমের ভূমিকা অতি জরুরি।
আব্দুল কাইয়ুম
আজকের আলোচনার মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতার অনেক দিক উঠে এসেছে।
বিভিন্ন সমস্যা এবং তা সমাধানে কী করণীয়, সেগুলো নিয়ে আলোচনা হলো। আজকের গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত দেওয়ার জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
আবুল কালাম আজাদ
তথ্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
এবিএম মূসা
প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক
মাহবুবুল আলম
সম্পাদক, দ্য ইনডিপেন্ডেন্ট
গোলাম সারওয়ার
সম্পাদক, সমকাল
সৈয়দ আবুল মকসুদ
সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
রিয়াজউদ্দিন আহমেদ
সম্পাদক, দ্য নিউজ টুডে
মাহফুজ আনাম
সম্পাদক, দ্য ডেইলি স্টার
ইকবাল সোবহান চৌধুরী
সভাপতি
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন
শাইখ সিরাজ
পরিচালক (বার্তা), চ্যানেল আই
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব
আলমগীর মহিউদ্দিন
সম্পাদক, নয়া দিগন্ত
ড. গীতি আরা নাসরীন
চেয়ারপারসন
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নাঈমুল ইসলাম খান
সম্পাদক, আমাদের সময়
মনজুরুল আহসান বুলবুল
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
বৈশাখী টেলিভিশন
সানাউল্লাহ
বার্তা ও অনুষ্ঠানপ্রধান, এবিসি রেডিও
শ্যামল দত্ত
সম্পাদক, ভোরের কাগজ
নূরুল কবীর
সম্পাদক, নিউ এইজ
মোজাম্মেল হক
সম্পাদক, দৈনিক করতোয়া
শাহ আলমগীর,
বার্তাপ্রধান, মাছরাঙা টেলিভিশন
সভাপতি, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন
জ ই মামুন
বার্তাপ্রধান, এটিএন বাংলা
মুন্নী সাহা
বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ
মতিউর রহমান
সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম
যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
মতিউর রহমান
আপনারা শত ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের গোলটেবিল বৈঠকে এসেছেন। তাই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। আজকের আলোচনার বিষয় স্থির করার সময় আমরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সঙ্গে দায়বদ্ধতার কথাটাও সমগুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেছি। গণমাধ্যমের প্রধান কাজ বস্তুনিষ্ঠভাবে সংবাদ পরিবেশন, নির্ভয়ে সত্য প্রকাশ করা। পাশাপাশি এটাও নিশ্চিত করা, যেন সেসব সংবাদ বস্তুনিষ্ঠ হয়, উদ্দেশ্যমূলক না হয়।
সংবাদপত্র বা ব্যাপক অর্থে গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। তার মানে, দায়িত্বশীল গণমাধ্যমের কাজ হলো সরকারের জবাবদিহির ব্যবস্থা করা আর সরকারের দায়িত্ব হলো তাকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া। আমি এখানে ‘দায়িত্বশীল গণমাধ্যমের’ কথা বলছি। দায়িত্বশীলতা থেকে বিচ্যুত হলে গণমাধ্যম পত্রিকা তার পাঠক হারাবে আর রেডিও তার শ্রোতা, টেলিভিশন তার দর্শক হারাবে। যেহেতু পাঠক টাকা দিয়ে পত্রিকা কিনে পড়েন, তাই পত্রিকার দায়বদ্ধতা অনেক বেশি। কারণ পাঠক আগেই স্থির করে রাখেন, কোন পত্রিকাটি তিনি পড়বেন। গণমাধ্যমকে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে পাঠকের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। তাই সত্যিকার গণমাধ্যম কখনো উদ্দেশ্যমূলক, ভিত্তিহীন, দায়িত্বহীন সংবাদ পরিবেশন করতে পারে না, করা উচিতও নয়।
বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতাসংগ্রামের সময়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে সংবাদ পরিবেশনে কখনো ভুল হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ভুল স্বীকার করা আমাদের কর্তব্য। এটি সর্বজনস্বীকৃত পদ্ধতি। বাংলাদেশে গণমাধ্যম নানা ভুলত্রুটি শুধরে নিয়ে এগিয়ে চলেছে।
রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে বিভিন্ন অঙ্গীকার করে থাকে। সরকার বিভিন্ন সময়ে অনেক অঙ্গীকার করে, অনেক কথা বলে, যেগুলো শেষ পর্যন্ত কাজে পরিণত করে না বা করতে পারে না। গণমাধ্যমে সেসব কথা তুলে ধরে আমরা সরকারের জবাবদিহির উদ্যোগ নিই। এখানে কোনো বিভ্রান্তির সুযোগ নেই। আমাদের আসল উদ্দেশ্য সরকারকে তার ভুলভ্রান্তি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করা।
আমাদের সব কাজের কেন্দ্রবিন্দু মানুষ। মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, দেশের অগ্রগতি চাই, অর্থনীতির বিকাশ চাই। সরকারেরও সব কাজের মূল কথা হলো মানুষের কল্যাণ। তাই সরকার ও গণমাধ্যম পরস্পরের পরিপূরক, প্রতিপক্ষ নয়।
সরকারের বিশেষভাবে দেখা দরকার, যেন গণমাধ্যম, সম্পাদক ও সাংবাদিকেরা সরকার বা কারও তরফ থেকে হুমকির মুখে না পড়েন। প্রায় এক দশক ধরে বেসরকারি টিভি চ্যানেল কাজ করছে। অনেক তরুণ টিভি সাংবাদিকতায় এসেছেন। অনেক নতুন পত্রিকাও এসেছে। পত্রিকা ও বেসরকারি রেডিওতে অনেক তরুণ সাংবাদিক আসছেন। তরুণ সাংবাদিকদের কাজে ভুলত্রুটি যাতে না হয়, সে ব্যাপারে আমরা সচেতন থাকার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিই। আমরা এসব তরুণকে সঙ্গে নিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছি। সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ভবিষ্যতে গণমাধ্যমের ভূমিকা আরও বাড়বে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি।
সরকার গণমাধ্যমের জন্য নীতিমালা করার উদ্যোগ নিয়েছে। কাগজে-কলমে অনেক আইন-কানুন করা যেতে পারে। কিন্তু সবার মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ ও আস্থার পরিবেশ গড়ে তোলা না হলে কোনো নীতিমালাই ঈপ্সিত ফল দেবে না। আর এই আস্থার সম্পর্ক সৃষ্টিতে সরকার ও গণমাধ্যমের পারস্পরিক সহযোগিতা দরকার।
বর্তমান সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী বলেবারবার বলছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের ১৯ অনুচ্ছেদে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও অবাধ তথ্যপ্রবাহের অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে। সব ধরনের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, তথ্যপ্রবাহের অবাধ চলাচল সুনিশ্চিত ও সংরক্ষণ করা, স্থানীয় ভিত্তিক কমিউনিটি রেডিও চালু, সাংবাদিক হত্যার দ্রুত বিচার ও শাস্তি, সাংবাদিক নির্যাতন এবং তাঁদের প্রতি ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন বন্ধ, সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন বিতরণে বৈষম্যমূলক নীতি ও দলীয়করণ বন্ধ এবং সংবাদপত্রকে শিল্প হিসেবে বিবেচনা করে এর বিকাশে সহায়তা করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়ে এই নীতিগত অবস্থানে সরকার অবিচল থাকবে এবং নির্বাচনী ইশতেহারে বর্ণিত অঙ্গীকার পূরণে বদ্ধপরিকর হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। দেশের অর্থনীতি, সমাজের অগ্রগতি ও গণতন্ত্রের বিকাশে গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
সংবাদপত্রের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে আমাদের কিছু দাবি ছিল। সরকারি বিজ্ঞাপনের হার ও অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো। বিজ্ঞাপনের হার বাড়ানো হলেও বরাদ্দ বাড়েনি। বিল পরিশোধের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা আজও করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, পত্রিকার জন্য বিদেশ থেকে নিউজপ্রিন্ট আমদানি করতে হয়। বিদেশি নিউজপ্রিন্টের দাম ক্রমেই বাড়ছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় তিনি বলেছিলেন, ভবিষ্যতে যদি দাম বাড়তে থাকে, তখন সরকার বিষয়টি বিবেচনা করবে। আগে নিউজপ্রিন্ট শুল্কমুক্ত ছিল। বর্তমান সরকার আসার পর তিন শতাংশ শুল্ক ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। নিউজপ্রিন্ট আমদানির ওপর এখনো শুল্ক-ভ্যাট মিলিয়ে ১৮ শতাংশ দিতে হয়। আরও কিছু আছে। সব মিলিয়ে প্রায় ২৫ শতাংশের কাছাকাছি চলে যায়। ভ্যাট-শুল্কের হার শূন্য না করলে পত্রিকার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে এবং হচ্ছে। তাই নিউজপ্রিন্টের ক্রমশ মূল্যবৃদ্ধির দিকে তথ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
রেডিও ও টেলিভিশনের যাঁরা উপস্থিত আছেন, তাঁরা তাঁদের সমস্যা তুলে ধরবেন আজকের আলোচনায়। পরিশেষে আমরা বলব যে গণমাধ্যম মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও প্রগতিতে বিশ্বাসী। আমরা চাই দেশে নির্বাচিত সরকার থাকবে, নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করবে। এসব বিষয়ে আমরা সব সময় দৃঢ় আছি এবং থাকব—এই আশ্বাস আমরা দিতে পারি।
আলোচনার শুরুতে আজকের গোলটেবিল বৈঠকের প্রধান অতিথি তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদকে অনুরোধ করব বলার জন্য।
আবুল কালাম আজাদ
বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা। প্রথম আলোকে ধন্যবাদ জানাতে চাই এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করার জন্য। আজকের আলোচনায় দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনের সম্পাদক এবং নেতৃস্থানীয় বিশিষ্ট সাংবাদিকেরা উপস্থিত হয়েছেন। এ বিষয়ে আলোচনার ব্যবস্থা করার জন্য সবাইকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। গণমাধ্যমের জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, দায়িত্বশীলতার বিষয়গুলোর পাশাপাশি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসবে।
বর্তমান সময়ে গণমাধ্যমের বিভিন্ন সমস্যা ও দাবিগুলো আপনারা আলোচনায় উত্থাপন করবেন। এসব বিষয়ে সরকারের অবস্থান ও বক্তব্য আমি আপনাদের সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে ভাগ করতে পারব বলে আশা করছি। শুধু সরকারের একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে নয়, দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, দেশের উন্নয়নের জন্য, অগ্রগতির জন্য গণমাধ্যমের ভূমিকা সব সময়ই অনস্বীকার্য। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য গণমাধ্যম সব সময়ই সহযোগিতা করে আসছে এবং এর কোনো বিকল্প নেই। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এমনকি বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও গণমাধ্যমের যদি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও বক্তব্য না থাকত, তবে বর্তমানে গণতন্ত্র যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা কখনো সম্ভব হতো না বলে আমার বিশ্বাস। গণমাধ্যমের ভূমিকা সব সময়ই গৌরবোজ্জ্বল। স্বাধীন সাংবাদিকতা দেশের গণতন্ত্র ও উন্নয়নে অবদান রেখে যাচ্ছে।
বর্তমান সরকার গণমাধ্যমের অবাধ তথ্যপ্রবাহে বিশ্বাস করে। বর্তমান সরকারের প্রথম অধিবেশনেই তথ্য অধিকার আইন পাস করেছি। গণমাধ্যম যাতে স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে, সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে সরকার বদ্ধপরিকর এবং কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি সরকারও গণমাধ্যমের কাছে প্রত্যাশা করে, গণমাধ্যম তাদের দায়বদ্ধতা অবশ্যই নিশ্চিত করবে। সরকার যেমন নিজের দায়িত্ব পালন করবে, তেমনি গণমাধ্যমেরও উচিত বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে তার দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা। তবে কিছু কিছু গণমাধ্যম তাদের দায়বদ্ধতার অবস্থান থেকে সরে এসে সরকারকে বিপাকে ফেলার জন্য অসত্য ও ভিত্তিহীন সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই গণমাধ্যমকে সচেতন হতে হবে। বর্তমানে অনেক তরুণ গণমাধ্যমে যুক্ত হচ্ছেন। এটি গণমাধ্যম ও সরকার উভয়ের জন্যই ভালো। কিন্তু এই তরুণ সাংবাদিকদের শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি তাঁরা প্রশিক্ষিত কি না, সেই বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, একসঙ্গে চার-পাঁচটি সংবাদের মধ্যে কোনটি প্রাধান্য পাবে বা কোনটি আগে যাবে—এসব বিষয়ে অসতর্কতার কারণে সংবাদের গুরুত্ব কমে যায়। এসব বিষয়ে গণমাধ্যমের সতর্ক দৃষ্টি দেওয়া উচিত।
বিশেষ করে বিগত ১০-১২ বছরে বাংলাদেশের গণমাধ্যম অনেক অগ্রসর হয়েছে। গণমাধ্যমের প্রধানদের বলব, যেসব সংবাদ পরিবেশন করা হচ্ছে তা বস্তুনিষ্ঠ ও সত্য কি না, সে বিষয়ে আরও সতর্ক হওয়া উচিত। অনেক সংবাদে এমন কিছু ভুল তথ্য প্রকাশ করা হয়, যা গণমাধ্যম, দেশের উন্নয়ন, সরকার ও জনগণ; কারও না কারও জন্য নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই বলতে চাই, গণমাধ্যমে অবশ্যই বস্তুনিষ্ঠ ও সত্য সংবাদ প্রকাশ করতে হবে, যা দেশের উন্নয়নে তথা জনগণের জন্য উপকারে লাগবে। সরকারের সবচেয়ে ভালো বন্ধু হতে পারে গণমাধ্যম, যদি স্বাধীনভাবে ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী একসময় বলেছেন, তিনি অনেক তথ্য গণমাধ্যম থেকে পান। অনেক তথ্য যেগুলো পাওয়া যায় না, সেগুলো গণমাধ্যম থেকে পাওয়ার পর সরকার সেসব সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে পারে।
ইকবাল সোবহান চৌধুরী
সম্প্রতি গণমাধ্যমকে নিয়ে অনেক আলোচনা, সমালোচনা, বিতর্ক এবং কিছুটা উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছে। ঠিক সেই মুহূর্তে আজকের এই গোলটেবিল আয়োজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা ব্যক্ত করছি। সাধারণত সংবাদপত্রে শুধু লিখে থাকি; কিন্তু মতামত সৃষ্টি করার কাজটি করি না।
প্রথম আলো মতামত সৃষ্টির জন্য আজকে যে আয়োজনটি করল, তার জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও অধিকারের বিষয়ে মাননীয় তথ্যমন্ত্রী সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করেছেন তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে। পাশাপাশি গণমাধ্যমের কিছু আশঙ্কার কথাও বলতে চাই। ওয়ান-ইলেভেনের পর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসে আমাদের ডেকে নিয়ে বলল, যেহেতু এখন পার্লামেন্ট নেই, সেহেতু গণমাধ্যমই হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পার্লামেন্ট। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাদের বর্ণিত সেই পার্লামেন্টের ওপর কীভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল, সেটি কিন্তু আমরা দেখেছি। গণমাধ্যমের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা, তথ্য অধিকার আইন পাস করা। বর্তমান সরকার তার পার্লামেন্টে প্রথম অধিবেশনে সেই আইন পাস করেছে।
বর্তমান সরকারের নেতারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা একসময় রাজপথে বলেছিলেন; কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ব্যত্যয় ঘটছে না, তা কিন্তু নয়। আমরা বিশ্বাস করি, গণমাধ্যম তার ভূমিকা পালন করবে। সরকারও তার দায়িত্ব পালন করবে। রাজনীতিবিদেরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করবেন। সংসদ তার নিজের দায়িত্ব পালন করবে। আর আমরা যদি যার যার নিজের দায়িত্ব নিজে পালন করি এবং একে অন্যের ওপর যদি হস্তক্ষেপ না করি, তাহলে আমরা অনেক বেশি সক্রিয়ভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারব।
কিছুদিন আগে সংসদে গণমাধ্যমকে নিয়ে তিক্ত আলোচনা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সংসদের যেমন অধিকার আছে গণমাধ্যমকে নিয়ে আলোচনা করার, তেমনি গণমাধ্যমের অধিকার আছে সংসদের কার্যক্রমে যদি বিচ্যুতি থাকে, তা নিয়ে সমালোচনা করার। গণমাধ্যমকে সরকারের একটি সহযোগী শক্তি হিসেবে নেওয়া উচিত। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ভোগ করতে হলে আমাদের নিজেদের দায়বদ্ধতার জায়গায় আরও দৃঢ় হতে হবে। কারণ গণমাধ্যম সব সময় ওয়াচডগ হিসেবে কাজ করে। তাই যদি গণমাধ্যমের নিজস্ব দায়বদ্ধতা ও বস্তুনিষ্ঠতা রক্ষা করতে না পারি, তাহলে প্রকারান্তরে যারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে চায়, তারা কিন্তু সুযোগ পেয়ে যাবে।
গণমাধ্যমে দায়িত্ব পালনকালে আমরা নিজেদের দায়বদ্ধতা ও বস্তুনিষ্ঠতা নিশ্চিত করব। কিন্তু কখনো কারও কাছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে আমরা আত্মসমর্পণ করতে রাজি নই। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কোনো সরকারের বা ব্যক্তির দান নয়। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা দীর্ঘদিনের। আমাদের পূর্বসূরিরা যে স্বাধীনতার পতাকা আমাদের হাতে তুলে দিয়ে গেছেন, তাঁরা সাহসের সঙ্গে ভূমিকা পালন করে গেছেন। পাকিস্তান আমল থেকে বিভিন্ন সামরিক ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে, অগণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে গণমাধ্যম তার স্বাধীন ভূমিকা পালন করে গেছে। অতীতে আমাদের দেশে অনেক সময় গণতন্ত্র ব্যাহত হয়েছে কিন্তু গণমাধ্যম তার ভূমিকা চালিয়ে গেছে। দেশের যেকোনো সংকটময় মুহূর্তে জাতিকে উদ্ধার করতে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে; এমনকি রাজনীতিবিদদের ওপর আঘাত এসেছিল, বিরাজনৈতিকীকরণ ও হেয়প্রতিপন্ন করার একটি প্রয়াস যখন চলছিল, বিশেষ করে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়, তখনো কিন্তু গণমাধ্যম গণতন্ত্র ও রাজনীতিবিদদের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলেছে। দেশে সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ আনার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। গণমাধ্যম এ দেশের গণতন্ত্র, মানুষের অধিকার ও সার্বভৌমত্বের জন্য সাহস করে কথা বলছে। গণমাধ্যমগুলো যদি তাদের সঠিক ভূমিকা পালন না করত, তাহলে দেশের অবস্থা আরও খারাপ হতো। দেশে উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় দেশের মানুষের অধিকারের জন্য গণমাধ্যম তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। যেহেতু গণমাধ্যম সাহস করে তার দায়িত্ব পালন করছে, সেহেতু গণমাধ্যমের ওপর আঘাত আসবে না, তা কিন্তু নয়। তবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আঘাত এলে সরকার ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো সেই আঘাত প্রতিহত করা।
সাংবাদিকতা পেশাটি বিশ্বব্যাপী ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো সাংবাদিকদের নির্যাতন ও হত্যার ঘটনাগুলো উদ্ঘাটন করা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান করা। আমাদের প্রায় ১৫-১৬ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন; কিন্তু আজ পর্যন্ত একটি হত্যাকাণ্ডেরও সুষ্ঠু তদন্ত ও ঘটনা উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি। সরকারের উচিত, এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত, দল-মতনির্বিশেষে তাদের চিহ্নিত করে বিচারের সম্মুখীন করা। যে দেশে সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের সুষ্ঠু তদন্ত হয় না, সে দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কিংবা নিরাপদে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত থাকা অসম্ভব। বর্তমান সরকার যেহেতু অতীতের অনেক বিতর্কিত ঘটনা উদ্ঘাটন করছে, তাই সরকারের প্রতি অনুরোধ, তারা যেন সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারকাজ নতুন করে শুরু করে।
সরকারের কাছে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের কিছু দাবির কথা বলে আসছি। সেটি হলো জাতীয় সংবাদপত্রের নীতি ও সম্প্রচারনীতি। নীতিমালার কথা বললে আমাদের মনে অনেক সময়ই একটি প্রশ্ন আসে, সেই নীতিটি চাপিয়ে দেওয়া কোনো নীতি যেন না হয়। চাপিয়ে দেওয়া কোনো নীতি অবশ্যই গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। আমরা বলতে চাই, নীতিমালাটি হতে হবে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে। বিশেষ করে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের মাধ্যমে। আলোচনা করে নীতিমালা তৈরি করতে হবে। নীতিমালা তৈরির ক্ষেত্রে বলতে চাই, সংবাদপত্রের মালিক একজন পুঁজিপতি হতে পারেন, কিন্তু কখনোই অপেশাদার পুঁজিপতি সংবাদপত্রের সম্পাদক হতে পারেন না। নীতিমালায় অবশ্যই থাকা উচিত, কেবল একজন পেশাদার সাংবাদিকই হতে পারেন পত্রিকার সম্পাদক। ইতিমধ্যেই মাননীয় তথ্যমন্ত্রী আমাদের অবহিত করেছেন, সম্প্রচার নীতিমালাটি প্রায় শেষ পর্যায়ে। কিন্তু সেটি যত দ্রুত সম্ভব শেষ করে আলোর মুখ দেখাতে হবে। সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন নীতিমালা, নিউজপ্রিন্টের মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা সমাধান ও সংবাদকর্মীদের ওয়েজ বোর্ডের বিষয়টি যেন বাস্তবায়িত হয়, সে ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সরকারের সঠিক নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। সাম্প্রতিককালের সরকারগুলো গণমাধ্যমের যে নতুন লাইসেন্স দিচ্ছে, সে ক্ষেত্রে বলতে চাই, বেসরকারি চ্যানেলগুলোর বেশির ভাগই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেওয়া হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে অন্য সরকার এসে এসব চ্যানেল বন্ধ করে দিচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারের আরও সচেতন হওয়া উচিত, কাদের লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে অনেক পুঁজির বিনিয়োগ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আশঙ্কা হচ্ছে, হঠাৎ করে বুদ্বুদের মতো ওসব বিনিয়োগ যদি চলে যায়, তবে অনেক সংবাদকর্মী ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন জীবিকার ক্ষেত্রে। আমি মনে করি, গণমাধ্যমে একটি সুস্থ পরিবেশ ফিরে আসবে, সরকার তার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করবে। পাশাপাশি গণমাধ্যম যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, সে রকম পরিবেশ সৃষ্টিতে সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি। একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম
নিউজ টুডের সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমেদকে অনুরোধ করব বলার জন্য।
রিয়াজউদ্দিন আহমেদ
আজকের এই আলোচনা একদিকে যেমন সময়োপযোগী, অন্যদিকে সাংবাদিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। দায়বদ্ধতার যে কথাটি আসছে, সেটি নিয়ে আমি শঙ্কিত। বর্তমানে সংবাদ ও সংবাদপত্র বন্ধের কোনো আইন নেই। একটা সময় ছিল, যখন টেলিফোনেও সংবাদপত্র বন্ধ করা যেত। কিন্তু বর্তমানে সেই পরিস্থিতি আর নেই। বর্তমানে সাংবাদিকেরা সত্যানুসন্ধানী দায়িত্ব পালন করছেন। অতীতে একটা সময় ছিল, বিশেষ ক্ষমতা আইনে যেকোনো সময় দুই লাইনের একটি আদেশ জারি করে যেকোনো গণমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে কোনো আইনি প্রক্রিয়া নেই গণমাধ্যম বন্ধ করার। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে সাংবাদিকদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলে গণমাধ্যম বর্তমানে অনেকাংশে মুক্ত। সাংবাদিকতা পেশার গ্রহণযোগ্যতা আরও বেড়েছে। তবে এর মধ্যে অনেক বাধা-বিপত্তি আসে। সরকারের কাছ থেকে অভিনব অলিখিত পদ্ধতিতে বাধাগুলো আসে। যেমন—সম্প্রতি সরকার একটি পত্রিকা হঠাৎ বন্ধ করে দিল। যেটি আবার আদালত বাতিল করে দিয়েছে। কিন্তু পত্রিকাটি বন্ধ করার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অন্যান্য গণমাধ্যমের কাছে একটি বার্তা পৌঁছে গেল যে গণমাধ্যমের সাবধান হওয়া দরকার।
বেসরকারি টিভি চ্যানেল চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করা হলো এবং যমুনা টিভিকে সম্প্রচার করতে দেওয়া হলো না। এর ফলে অন্য বেসরকারি চ্যানেলগুলো সাবধান হয়ে গেল। এটি কিন্তু সরকারের একটি অলিখিত আইন। এতে গণমাধ্যমগুলো সেলফ (নিজস্ব) সেন্সরশিপ হয়ে পড়ে। অর্থাৎ সম্পাদকেরা একটু সাবধানতা অবলম্বন করে সংবাদ প্রকাশ করতে থাকেন। চ্যানেলগুলোয় টকশোতে যাঁরা আলোচক থাকেন, আয়োজকেরা তাঁদের একটু বুঝেশুনে কথা বলতে বলেন। এটি হলো গণমাধ্যমের একটি অলিখিত দিক, যা গণমাধ্যমের ভেতর আতঙ্কের সৃষ্টি করছে।
এখনো একটি আইন আছে, যেটি সিআরপিসির ৫০০ ও ৫০১ ধারা, যার মাধ্যমে মানহানির নামে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে একটি ক্রিমিনাল স্যুট করে যেকোনো সময় ওয়ারেন্ট ইস্যু করে সাংবাদিকদের থানা ও কোর্টে নেওয়া যায়। এই আইনের মাধ্যমে সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরীকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল গভীর রাতে। আমরা সাংবাদিকেরা দাবি করেছিলাম আইনটি বাতিল করার। বর্তমান সরকার বিষয়টি আমলে নিয়েছে। ইতিমধ্যে এই আইনের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, আইনটি থাকবে কিন্তু গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়াটি থাকবে না। সমন জারির প্রক্রিয়াটি চালু করা হবে। পরপর তিনবার সমন জারির পর যদি সাড়া না পাওয়া যায়, তখন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা যাবে। আমরা এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। এটি মন্ত্রিপরিষদে সিদ্ধান্ত হয়ে আছে, কিন্তু এখনো আইনে পরিণত হয়নি।
সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, এই আইন যদি বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে এটি একটি গণমাধ্যমবান্ধব সিদ্ধান্ত বলে বিবেচিত হবে। সাংবাদিকদের ওপর বিভিন্ন মহল থেকে চাপ সৃষ্টি করা হয়। বিশেষ করে মফস্বল এলাকায় প্রশাসন, পুলিশ, রাজনৈতিক নেতাসহ বিভিন্ন মহল থেকে চাপ সৃষ্টি হয় সংবাদ প্রকাশের পর। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ব্যাপারে সরকারের একটি নীতিমালা তৈরির কথা শুনে আসছি। নীতিমালাটি তৈরি অত্যন্ত জরুরি। কারণ টিভি চ্যানেল ও রেডিও লাইসেন্স আসলে কারা পাবে, তার নির্দিষ্ট কোনো নীতি নেই। সম্পূর্ণই সরকারের ওপর নির্ভরশীল। যখন কোনো আইনের তোয়াক্কা বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো থাকে না বা সরকার নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সেখানে স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তের অবকাশ থেকে যায়।
বর্তমান সরকার ও আগের সরকার যেভাবে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্য লাইসেন্সিং ব্যবস্থা করেছে, সেটি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাচারিতা হয়েছে। সংবাদপত্র প্রকাশের জন্য প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশন আইনটি রয়েছে। সেখানে উল্লেখ আছে, কী কী নিয়ম বা শর্ত মানলে কোনো ব্যক্তি সংবাদপত্র বের করতে পারবেন। ফলে এখানে স্বেচ্ছাচারী হওয়ার সুযোগ কম; যদিও অন্যভাবে স্বেচ্ছাচারিতা দেখা যায়। বর্তমানে একটি সংবাদপত্র বের করতে চাইলে পুলিশ ভেরিফিকেশন, ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিসহ সরকারের বিভিন্ন মহলে যেতে হয়। কিন্তু ১৯৯০ সালে একটি আইন করা হয়েছিল, যেখানে বলা ছিল, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট যদি ৬০ দিনের মধ্যে কোনো সিদ্ধান্ত না দিতে পারেন, তবে প্রেস কাউন্সিলে আপিল করলে সংবাদপত্র প্রকাশের ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে, তা চূড়ান্ত বলে গৃহীত হবে। তার বিরুদ্ধে কোনো আপিল করার সুযোগ থাকবে না। এই আইনের মাধ্যমে নিউ নেশন, বাংলার বাণী পত্রিকাগুলো ডিক্লারেশন নিয়েছিল। আইনটি আছে, কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। সংবাদপত্রের নীতিমালার আদলে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্য একটি সম্প্রচার নীতিমালা করা অত্যন্ত জরুরি। গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতার কথা উঠে আসছে। গালাগাল করে কখনো দায়বদ্ধতা আদায় করা যায় না। যেমন—কিছুদিন আগে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যে ঘটনাটি ঘটল, এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী খুশি হননি বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
গণমাধ্যম নিয়ে সাংসদ ও সংসদের স্পিকার যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা করেছেন, তা ঠিক হয়নি। সাপ যেমন জিহ্বার আগায় বিষ নিয়ে ঘোরে কিন্তু এর স্বাদ গ্রহণ করে না; তেমনি ক্ষমতায় যাঁরা থাকেন, তাঁদের জিহ্বার আগায় অনেক বিষ থাকে, যা তাঁরা গ্রহণ করতে চান না। এ ধরনের কাজ করতে গেলে অবশ্যই সাংসদ ও রাজনৈতিক নেতারা সংবাদপত্রের সমালোচনার সম্মুখীন হবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অন্যদিকে যা খুশি লিখে গণমাধ্যম পার পেয়ে যাবে, তাও ঠিক নয়। এটি নিয়ন্ত্রণের জন্য অবশ্যই ইনস্টিটিউশনাল মেকানিজমের ওপর নির্ভর করা উচিত; তা কখনো কোনো ব্যক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত এমন ছিল যে কোনো গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে সরকার অভিযোগ করলে তা বন্ধ করে দেওয়া হতো। কিন্তু বর্তমানে সেই প্রক্রিয়া আর নেই। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে প্রেস কাউন্সিল আছে, যা হচ্ছে মরাল বা এথিক্যাল কোর্ট, যার অধীনে থাকে সব দায়দায়িত্ব। যে দেশে লিগ্যাল বাইন্ডিং ফেল করে, সে দেশে মরাল বাইন্ডিং বলে কিছু থাকে না। ব্রিটেনে কমপ্লেইন্ট কমিশন রয়েছে। অন্যান্য জায়গায় অম্বুডজম্যান। ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়ার নিজস্ব অম্বুডজম্যান আছে, যার ফলে কোনো ভুল সংবাদ প্রকাশ হলে সঙ্গে সঙ্গে তা সংশোধনের ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হয়। সম্পাদককে অবশ্যই একজন পেশাদার সাংবাদিক হতে হবে। এ ব্যাপারে অবশ্যই একটি আইন করতে হবে। যদি কোনো পেশাদার সাংবাদিক সম্পাদক হন, তবে গণমাধ্যমের অধিকাংশ দায়বদ্ধতা নিশ্চিত হয়ে যায়।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
যেসব নবীন সাংবাদিক গণমাধ্যমে যুক্ত হচ্ছেন, তাঁরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ, দায়বদ্ধতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষিত হয়ে যেন সাংবাদিকতা পেশায় আসতে পারেন, সে জন্য আমাদের কিছু দায়দায়িত্ব রয়েছে। বর্তমানে যাঁরা সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কর্মরত আছেন এবং নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁরা অনেকে দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতা করছেন অথবা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করে এসেছেন। তবু বর্তমানে সংবাদপত্রে নানা ভুলভ্রান্তি, দায়িত্বহীনতা, বস্তুনিষ্ঠতার অভাব আমরা দেখছি, এগুলো অনেকটা জ্ঞানপাপীর মতো। তাঁরা সবই জানেন, কিন্তু কেউ বলতে পারবেন না যে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে সেই প্রতিবেদনের সঙ্গে আলোচ্য ব্যক্তির মন্তব্য দিতে হয়, সেটা জানেন না তিনি।
তবু প্রতিবেদনের সঙ্গে এখনো অভিযুক্ত ব্যক্তির মন্তব্য নেওয়া হয় না, ভুল ছাপা হয় কিন্তু ক্ষমা প্রার্থনা করা হয় না। দিনের পর দিন ভুল তথ্য দিয়ে সংবাদ ছাপা হচ্ছে, কারও কোনো বিকার নেই। যাঁরা নতুন সাংবাদিক আসছেন, তাঁদের জন্য সরকারের কাছে দাবি করব, প্রেস ইনস্টিটিউট পুনর্গঠন করা দরকার। কার্যকর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আমি দীর্ঘদিন প্রেস ইনস্টিটিউটে চাকরির সুবাধে অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমাদের দেশে প্রশিক্ষণের সঙ্গে সেমিনারকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। প্রশিক্ষণ অনেক কঠিন কাজ, পাঁচটি কাজ করে এসে প্রশিক্ষণ নিয়ে গেলাম। তাই বলব, প্রেস ইনস্টিটিউটকে পুনর্গঠন করে কার্যকর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। পৃথিবীতে অনেক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট আছে, সেগুলোর মডেল অনুসরণ করে আমাদের দেশেও কার্যকর ট্রেনিং ইনস্টিটিউট তৈরি করা প্রয়োজন। প্রেস ইনস্টিটিউটে একটি জার্নাল আছে নিরীক্ষা নামে। যখন এটির প্রকাশনা শুরু হয়, তখন এর একটি লক্ষ্য ছিল, সাংবাদিকতার ভালো জিনিসগুলো সেখানে তুলে সাংবাদিকদের উৎসাহিত করা হবে, যাতে নবীন সাংবাদিকেরা এগুলো দেখে উৎসাহিত হন এবং তাঁরা তাঁদের দায়-দায়িত্ব কী হওয়া উচিত তা বুঝতে পারেন। আর সাংবাদিকতার দুর্বল দিকগুলো চিহ্নিত করা হবে, যাতে নবীন সাংবাদিকেরা বুঝতে পারেন তাঁদের এগুলো করা উচিত হবে না। সেই কাজগুলো থেকে বর্তমান নিরীক্ষা অনেক দূরে। তথ্যমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করব, তিনি যেন প্রেস ইনস্টিটিউটকে নির্দেশ দেন, নিরীক্ষা জার্নালটি যে উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, তা সঠিকভাবে প্রকাশ করার।
বর্তমান সংবাদপত্রে যে ভুলগুলো ছাপা হয়, সেগুলো সেখানে তুলে ধরলে নবীন সাংবাদিকেরা বুঝতে পারবেন আসলে কোথায় কোথায় আমাদের ঘাটতি আছে। প্রেস কাউন্সিলের পাশাপাশি একটি ইনস্টিটিউটের প্রেসটিজিয়াস জার্নালে যদি মাসের পর মাস কোনো পত্রিকার ভুল জিনিসগুলো ছাপা হতে থাকে, ভুল রিপোর্ট উদ্ধৃত থাকে, তবে সেটিও কিন্তু একটি লজ্জা ওই পত্রিকার জন্য। কারণ সেই পত্রিকা বুঝতে পারবে, বারবার তার ভুল সংবাদগুলো ওই জার্নালে ছাপা হচ্ছে। ওই ধরনের জার্নালে বিগত তিন মাসের ভালো রিপোর্ট হয়েছে। কোনগুলো ভালো ছবি, ছাপা হয়েছে এগুলো।
অপরদিকে তিন মাসের বস্তুনিষ্ঠহীন ও অসত্য সংবাদ ছাপা হয়েছে কোনগুলো, সেগুলো নির্বাচন করে ছাপা উচিত জার্নালে। প্রেস কাউন্সিলকে আরও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। কারণ দিনের পর দিন এসব ভুল সংবাদ ছাপা হওয়ার পর প্রেস কাউন্সিল কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না।
প্রেস কাউন্সিলের প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর রায় প্রকাশ করা উচিত, কোন পত্রিকাগুলোকে তারা তিরস্কার করছে এবং সেই তালিকা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা উচিত। পরিশেষে বলতে চাই, প্রেস কাউন্সিল ও প্রেস ইনস্টিটিউটকে আরও সক্রিয় ও শক্তিশালী করতে হবে সাংবাদিকতার দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে।
শাইখ সিরাজ
এতক্ষণ যে আলোচনা হলো, তা সবই মূলত সংবাদপত্রকেন্দ্রিক। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অবস্থান আরও নড়বড়ে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া বলা যায় নবীন। সংবাদপত্র যে পরিমাণ স্বাধীনতা পায়, ইলেকট্রনিক মিডিয়া সে পরিমাণ স্বাধীনতা পায় না বলে সন্দেহ রয়েছে। তারপর স্বল্প সময়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়া বর্তমানে যে অবস্থানে এসেছে, তাতে এর বিকাশ হয়েছে অনেকাংশে। স্বাধীনতা কেউ দেয় না, আদায় করে নিতে হয়। সংবাদপত্র যেমন তার স্বাধীনতা আদায় করেছে, তেমনি ইলেকট্রনিক মিডিয়া হাঁটি হাঁটি করে এগিয়ে যাচ্ছে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য। ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো সব সময়ই একটি শঙ্কার মধ্যে থাকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় একটি বিজ্ঞপ্তি এসেছিল, সেখানে উল্লেখ ছিল, কী কী কারণে সম্প্রচারযন্ত্রটি জব্দ করা যাবে। কী কী কারণে প্রিন্টিং প্রেস জব্দ করা যাবে। সে সময় হুমকিটি আমাদের ওপর প্রচণ্ডভাবে ছিল। বর্তমানে সেই অবস্থান থেকে উত্তরণ হয়েছে আমাদের। কিন্তু আমরা একেবারে শঙ্কামুক্ত নই। প্রতি মুহূর্তে মনে হয়, কোনটা ভুল হলো, কোনটার জন্য বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে হয়। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্য এখন পর্যন্ত কোনো সম্প্রচার নীতিমালা তৈরি হয়নি। আমি মনে করি, নীতিমালাটি জরুরি। কারণ ইলেকট্রনিক মিডিয়া যে স্বেচ্ছাচারিতা করে না, তা তো নয়। বাস্তব অবস্থা থেকে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচারের সময় অনেক ক্ষেত্রেই ভুলভ্রান্তি হয় না, তা তো নয়।
একেবারে নতুন একটি প্রতিষ্ঠান ইলেকট্রনিক মিডিয়া। যথেষ্ট লোকবলের অভাব রয়েছে। ইতিমধ্যে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় অনেক ছেলেমেয়ে তৈরি হচ্ছেন, যাঁরা ভালো কাজ করছেন। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার যে বিকাশ ঘটেছে, তা নিঃসন্দেহে উল্লেখ করার মতো। দু-চার, পাঁচ বছর আগেও আমরা দেখেছি, ঢাকায় হরতাল হলো কি না, রাতে বিবিসি রেডিওতে শুনতে হতো। এখন তাৎক্ষণিকভাবে দেখতে পারছি, হরতাল কোন অবস্থায় আছে। আগে টেলিভিশন বিক্রির শোরুমের সামনে রিকশাচালকেরা ও জনগণ দাঁড়িয়ে ছায়াছন্দ দেখত, এখন তারা সংবাদ দেখছে। এই যে একটি বিকাশ, এটি ইলেকট্রনিক মিডিয়া তথা সমগ্রিকভাবে গণমাধ্যমের একসঙ্গে পথচলার একটি ফসল। ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে সরকারের সহায়ক শক্তি ভাবা উচিত। কথাটি এসেছে সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ক্ষেত্রে আরও জোরালো। যেহেতু ইলেকট্রনিক মিডিয়া দৈনন্দিন জীবনে এত প্রভাব রাখে, যেটি সরকারের জন্য নিশ্চিয় বড় বিষয়। আজ সচিবালয়ে কী কী কার্যক্রম হলো তা সন্ধ্যায় টিভি খুললেই দেখতে পাই। দুই মাস আগে মাননীয় তথ্যমন্ত্রী বিটিভির সংবাদটি সম্প্রচারের জন্য বেসরকারি চ্যানেলগুলোর ওপর আবার চাপিয়ে দিলেন। সব কটি চ্যানেল দুপুর দুইটার সংবাদ রেকর্ড করে প্রচার করছে কিন্তু সম্প্রচারের মূল কারণ কী, তা এখনো আমরা বুঝতে পারিনি। এই সংবাদ প্রচারের ফলে সরকারের যে কী উপকার হচ্ছে, তা কেউ বুঝে উঠতে পাুরছি না। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যে সংবাদটি প্রচারিত হচ্ছে বস্তুনিষ্ঠভাবে, ঠিক সেই সংবাদটি বিটিভি থেকে প্রচারিত হচ্ছে অন্যভাবে। এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
নতুন একটি গণমাধ্যম হিসেবে ইলেকট্রনিক মিডিয়া দেশে সত্যিকার গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। পত্রিকায় যদি সরকার কোনো বিজ্ঞাপন দেয়, তাহলে সেখানে অর্থ বরাদ্দ থাকে। কিন্তু ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সরকার কোনো বিজ্ঞপ্তি বা বিজ্ঞাপন দিলে অর্থ দেয় না, বরং বারবার প্রশ্ন করা হয় কয়বার প্রচার করা হলো, কখন প্রচার করা হলো, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে প্রচার করা হয়েছে কি না ইত্যাদি। এসব বিষয় থেকে অব্যাহতি চাইছি।
আব্দুল কাইয়ুম
আলোচনার এই পর্যায়ে আমাদের সময় পত্রিকার সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খানকে অনুরোধ করব বলার জন্য।
নাঈমুল ইসলাম খান
গণমাধ্যম সরকারকে সহায়তা করবে—এ বিষয়টি বর্তমানে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে গেছে। আমরা নিজেরাও বলি। কিন্তু এর গোড়ায় একটি গলদ রয়েছে। এটি সাংবাদিকতাবিরোধী ধারণা। পত্রিকার কাজ সরকারকে সহায়তা করা নয়, সংবাদপত্রের কাজ শুধু সাংবাদিকতা করা। আমরা সাংবাদিকতা করব, কেউ চুরির জন্য ধরা পড়বে, আবার কেউ চুরির মাল উদ্ধার করবে—সব খবরই থাকবে।
এই যে সাংবাদিকেরা সহায়তা করবে—এ ধারণাটি আসলে মিষ্টি কথার মাধ্যমে বশে রাখার প্রক্রিয়া। রাজনৈতিক নেতা হলে বলতাম চক্রান্ত। আসলে আমরা মুখোমুখি কেউ কারও সঙ্গে খারাপ হতে চাই না, তাই এসব নিয়ে কোনো বিরোধিতা করি না। আমাদের এ ধারণা থেকে বের হতে হবে।
সরকারের কাছে গণমাধ্যমের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা মূলত জনগণের কাছে। আমরা গণমাধ্যমের যে স্বাধীনতার কথা বলি, এই স্বাধীনতা পত্রিকার সাংবাদিক, সম্পাদক কিংবা মালিকের নয়; এই স্বাধীনতার প্রকৃত মালিক হচ্ছে জনগণ।
গণমাধ্যমের যদি কোনো দায়বদ্ধতা থাকে, তা তার পাঠক, শ্রোতা ও দর্শক অর্থাৎ জনগণের কাছে। যদি গণমাধ্যম সরকারের আইনের বাইরে কিছু করে থাকে, তার জন্য অবশ্যই সরকার ব্যবস্থা নেবে। এর জন্য শাস্তি পেতে হতে পারে। সাংবাদিকতায় এই রেওয়াজও আছে যে আদালত যদি কোনো সংবাদের সূত্র কী জানতে চান, তাহলে সাংবাদিককে বাঁচিয়ে প্রয়োজনে শাস্তি মেনে নিতে হবে।
এরশাদ আমলের শেষ দিকে মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স অফিসে সাড়ে তিন ঘণ্টা একজন ব্রিগেডিয়ার বসিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন এই সংবাদের উৎস কী? তখন সম্পাদক হিসেবে আমার দায়িত্ব উৎসটা কী, তা না বলা, আর তাঁর দায়িত্ব ছিল উৎসটা কী, তা বের করা। এখানে আর্মি অফিসার ও আমার দায়িত্ব বিপরীত। শুধু সেখান থেকে বেঁচে ফিরে আসার জন্য আমি বলেছিলাম, যদি উৎস জানাতেই হয়, তবে আমাকে ফিরে যেতে হবে। রিপোর্টারের কাছ থেকে জেনে আপনাকে জানাব বলে চলে আসতে হয়। পরে আর তাঁকে উৎস কী, তা জানাইনি।
কোর্টেও যদি কোনো সংবাদের সূত্র বা উৎস জানতে চাওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে উৎসকে রক্ষা করে আমরা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করব। সে জন্য যদি আমার জেলও হয়, তা মেনে নিতে পারব। যেহেতু আমি সাংবাদিকতার ছাত্র হিসেবে পড়েছি ও জেনেছি প্রয়োজনে আমি শাস্তি নেব, তবু সংবাদের উৎস বা কোথা থেকে কথাটি পেয়েছি, তা বলব না।
সাংবাদিকতায় ডেভেলপমেন্ট একটি ধারণা দাঁড়িয়েছিল, ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম, আমি এর বিপক্ষে। আমি আরও বিপক্ষে তথাকথিত এনভায়রনমেন্ট জার্নালিজমের। আমি মনে করি, সাংবাদিকতা এক এবং অদ্বিতীয়। এর কোনো ইনভেসটিগেটিভ জার্নালিজম অথবা এনভায়রনমেন্ট জার্নালিজম বলে কিছু নেই। আমরা কোনো ঘটনাকে বলতে পারি মফস্বলের ঘটনা, কোনোটিকে অর্থনৈতিক ঘটনা—এ রকম নানাভাবে বলতে পারি। কিন্তু সাংবাদিকতা অবিভাজ্য।
যদি আমি সত্য, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করি, তবেই কেবল মনে করতে পারি যে আমি আমার দায়বদ্ধতা পালন করেছি। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, সবজি চাষে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছে। এখন আমি এটি প্রকাশ করব না। এতে দেশের ক্ষতি হবে, বিদেশে সবজি রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে এই ভেবে। আমি এর বিরোধিতা করছি। আমি মনে করি সংবাদটি প্রকাশ করা উচিত, যাতে সবজি চাষে দূষণীয় কীটনাশক আর ব্যবহার না করা হয়। এটিই আমার দায়বদ্ধতা। এতে আমার দায়বদ্ধতা পালন হবে, বিদেশিদের আস্থা বাড়বে। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তাদের নির্ভরশীলতা বাড়াবে। তারা বুঝতে পারবে, বাংলাদেশের গণমাধ্যম স্বাধীন এবং সত্য সংবাদ প্রকাশ করে।
ইদানীং বলা হচ্ছে, সংবিধানে যা আছে সব মানতে হবে। সবকিছু মেনে চলতে হলে এটিও আমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করতে পারি, বাংলাদেশ ইসলামিক আইন অনুসারে চলা উচিত। আমি যদি সংবিধানের কোনো ধারা লঙ্ঘন করি, তবে তার জন্য শাস্তি হতে পারে। কিন্তু আমি কেন বলতে পারব না, বাংলাদেশ ধর্ম দ্বারা পরিচালিত হোক? এতে যদি জনগণের সমর্থন থাকে, তবে একসময় হতে পারে। কিন্তু ধর্ম দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যদি এমন কোনো কাজ করি, যা সংবিধান ও আইনকে ভঙ্গ করে, সশস্ত্র সংঘাতের কথা বলে, তবে অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে। কিন্তু এ ধারণাটি কেন আমি ধারণ করতে পারব না কিংবা প্রয়োজনে প্রচার করতে পারব না, এটাও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ভেতরে পড়ে কি না, নাগরিক অধিকারের মধ্যে পড়ে কি না, এসব নিয়ে যথেষ্ট চিন্তার অবকাশ রয়েছে।
মনজুরুল আহসান বুলবুল
সম্প্রচার নীতিমালা হওয়া প্রয়োজন। তবে নীতিমালা হওয়া, বাস্তবায়ন ও পরিবর্তন—এই জায়গাগুলোতে পার্থক্য রয়েছে। কিছুদিন আগে বেসরকারি চ্যানেলগুলোর ওপর বিটিভির দুটি নিউজ চাপিয়ে দেওয়া হলো। ১৯৯৮ সালের যে নীতিমালার ভিত্তিতে টেলিভিশনগুলোকে লাইসেন্স দেওয়া হলো, তখন আমি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলাম, কারণ আমি একুশে টেলিভিশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। তখন নীতিমালায় উল্লেখ ছিল, একটি সংবাদ প্রচার করতে হবে। হঠাৎ করে সম্প্রতি শুনলাম, দুটি সংবাদ প্রচার করতে হবে, যা নীতিমালায় আছে। এই নীতিমালা কখন, কীভাবে, কারা পরিবর্তন করল, তা আমরা জানি না। তাই নীতিমালা হওয়া, প্রয়োগ, বাস্তবায়ন ও পরিবর্তন—সব জায়গায় স্বচ্ছতা থাকা উচিত। ভারতীয় লোকসভার স্পিকার সোমনাথ চ্যাটার্জির আত্মজীবনী কিপিং দ্য ফেইথ বের হয়েছে। সেখানে একটি অংশ আছে তিনি স্পিকার থাকা অবস্থায় তাঁর সঙ্গে গণমাধ্যমের সম্পর্ক বিষয়ে। সেই অধ্যায়ের নাম দেওয়া হয়েছে রোলার কোস্টার রাইডিং। সেখানে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন স্পিকার হিসেবে মিডিয়ার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা। গণমাধ্যম নিয়ে সারা বিশ্বেই আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের পরিধি দিন দিন বাড়ছে, স্বাধীনতা পাওয়ার চেষ্টা চলছে এবং যাদের দায়বদ্ধতা আছে, তারা স্বাভাবিকভাবেই বিকশিত হচ্ছে।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতাদের দায়বদ্ধতার মূল জায়গা হচ্ছে দলের প্রতি। আরও পরিষ্কার করলে, নেতাদের দায়বদ্ধতার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছেন তাঁদের শীর্ষ নেতা-নেত্রী। আর দায়িত্বশীল গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা হচ্ছে জনগণের কাছে। সুস্থ রাজনীতির যে দর্শন অর্থাৎ রাজনীতিবিদের দায়বদ্ধতা যদি জনগণের কাছে হতো, তবে গণমাধ্যম ও সরকারের মধ্যে দায়বদ্ধতা প্রশ্নে যে বিরোধ রয়েছে, তা বহুলাংশে কমে যেত। গণমাধ্যমে বিপুল পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগ হচ্ছে, যা গণমাধ্যমকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কলুষিত করছে। বর্তমানে সাংবাদিকদের অর্থের বিনিময়ে ভাড়ায় পাওয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে বলতে চাই, আন্তর্জাতিক কোনো এক সম্মেলনে একজন উপদেষ্টা ও একজন মন্ত্রী গেছেন। দুজনই দুই সাংবাদিক ভাড়া করেছেন। দুজন দুই রকম সংবাদ পাঠাচ্ছেন। একজন লিখেছেন, উপদেষ্টা কিছুই করছেন না, সব মন্ত্রী করছেন। অন্যজন লিখলেন তার ঠিক বিপরীত। সুতরাং পুঁজি ও ক্ষমতা গণমাধ্যমকে কলুষিত করছে।
ভারতের লোকসভার ১০ জন এবং রাজ্যসভার একজন সদস্যের সদস্যপদ চলে যায় টাকা খেয়ে সংসদের ফ্লোরে প্রশ্ন তোলার ও আলোচনার জন্য কিছু বিষয় উত্থাপনের জন্য। লোকসভার সাবেক স্পিকার সোমনাথ চ্যাটার্জি বলেছেন: টাকা খাওয়ার এই খবর তিনি প্রথম জেনেছিলেন গণমাধ্যমের রিপোর্ট থেকে। এ জন্য তিনি গণমাধ্যমের প্রশংসা করেন। বাংলাদেশের কোনো সংবাদমাধ্যমের জন্য এ ধরনের কোনো অনুসন্ধান করাই ঝুঁকিপূর্ণ, সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সংসদ বা সাংসদকে অবমাননার অভিযোগও আনা হতে পারে।
পুুঁজি কীভাবে গণমাধ্যম, সরকার ও রাষ্ট্রকে কুলষিত করছে, সে বিষয়টিও এখন দেখা উচিত। প্রেস কাউন্সিলে কোটাভিত্তিক সম্পাদক, ইউনিয়ন, মালিকপক্ষ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, সরকারি দলের সদস্য থেকে এমন কাউকে সরকার নিয়োগ দিচ্ছে, যাঁরা আসলে সঠিকভাবে মিডিয়া বোঝেন কি না, সে প্রশ্নও থেকে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, আমাদের এক বিচারপতি রায় দিলেন, সম্পাদক ও প্রকাশক খালাস কিন্তু রিপোর্টারের শাস্তি হবে। কারণ রিপোর্টার সেই সংবাদটি লাল বড় অক্ষরে শিরোনাম করেছেন। কিন্তু হাইকোর্ট যদি না বোঝেন, শিরোনাম লাল অক্ষরে কে ছাপে, তা হলে তো ভারি বিপদ। একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হবেন প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। এক সরকারের আমলে দেখা গেল, একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি চেয়ারম্যান হলেন কিন্তু তিনি নিজেই সরকারি দলের সাংসদ। যেমন আইনের হাত অনেক লম্বা, সেহেতু আইনের ফাঁকও থাকে বিশাল। শুধু সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে পাস করে এলেই ভালো সাংবাদিক হওয়া যায় না। বস্তুত, কর্মক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত ব্যক্তিরাই পারেন ভালো সাংবাদিকতা করতে। সে ক্ষেত্রে শিক্ষাগত কোর্স হিসেবে সাংবাদিকতা থাকতে পারে। সাংবাদিকতা শিক্ষার এই জায়গায় আমি বারবার প্রস্তাব করেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে প্রাতিষ্ঠানিক যাঁদের শিক্ষা দেওয়া হয়, তাঁদের প্রেস ইনস্টিটিউট ও নিমকো—এই দুটি প্রতিষ্ঠান পাশাপাশি পেশাদার সাংবাদিকদের দিয়ে যদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তাহলে ভালো পেশাদার সাংবাদিক পাওয়া সম্ভব। সরকারি দলের সঙ্গে গণমাধ্যমের বিপরীত সম্পর্ক দেখা যায় সব সময়। এর মূল কারণ, বিরোধী দলের যে কাজ করা উচিত বা সরকারের সমালোচনা করা দরকার জাতীয় ও জনগণের স্বার্থ আদায়ে, তারা তা না করে ব্যক্তি ও দলের স্বার্থ আদায়ে আন্দোলনে ব্যস্ত থাকে। জাতীয় ও জনগণের স্বার্থ আদায়ের জন্য গণমাধ্যমগুলো সব সময় দায়িত্ব পালন করে। কারণ তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি যথাযথ রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করে, তাহলে মিডিয়া রিয়্যাল ওয়াচডগের দায়িত্ব পালন করতে পারে। সুস্থ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সমাজব্যবস্থা যদি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়, তবেই কেবল মিডিয়া তার নিজস্ব দায়িত্ব পালনে অনেকাংশে এগিয়ে যেতে পারে। গণমাধ্যমের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্ক হবে সাংবাদিকতা পেশাদারির মাধ্যমে। সরকার, স্পিকার ও সাংসদদের উচিত গণমাধ্যমের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা। একটি গণমাধ্যমের ফেয়ারনেস নিয়ে ফ্রিডম ফোরামের সিইও একটি ফর্মুলা দিয়েছেন, কীভাবে একটি মিডিয়া ফেয়ার আচরণ করতে পারে। তার ফর্মুলাটি হচ্ছে a+b+c+d+e=f, Accuracy+balance+ completenes+ Detachment+Ethics= Fairness। আমার ধারণা, মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর এই ফর্মুলা মেনে চলা উচিত।
সৈয়দ আবুল মকসুদ
ঠিক এই মুহূর্তে সংবাদমাধ্যমের ওপর বিভিন্ন দিক থেকে উপদ্রব আসছে। সরকারের, বিরোধী দলের, সমাজবিরোধীদের দিক থেকে এই উপদ্রব গণমাধ্যমের ওপর আসছে সম্প্রতি। তাই আজকের এই আলোচনা অত্যন্ত সময়োপযোগী। একটি সংবাদপত্রের মাধ্যমে সম্পাদকের চারিত্রিক ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়। একদিন পল্টনের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় বাস থেকে নেমে এক ব্যক্তি আমার হাতে দুটি কাগজ দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, গতকাল ছাপতে পারেননি, তাই গতকাল ও আজকের দুটি কাগজের সংখ্যাই একসঙ্গে দিয়েছেন। তিনি ওই পত্রিকার সম্পাদক। ঢাকা থেকে ৭০-৮০টি পত্রিকা প্রকাশ হয় প্রতিদিন। এগুলো ঢাকা থেকে বললে ভুল হবে, বেশির ভাগই ফকিরাপুল থেকে বের হয়।
আর ঢাকার বাইরে প্রতিটি জেলা শহরে গেলে দেখা যায় স্থানীয় অনেক পত্রিকার সাইনবোর্ড ঝুলতে। বর্তমানে বাংলাদেশে গণমাধ্যম ও সম্পাদকদের অবস্থা কী, তা স্পষ্ট বোঝা যায়। গণমাধ্যমের যে স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, সেই স্বাধীনতারও একটা সীমা থাকা উচিত। আর পত্রিকার সম্পাদক কে হবেন, সে ক্ষেত্রে নীতিমালায় রিজনেবল শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলেই সম্পাদক হওয়া যাবে। বাংলাদেশে অন্তত দুই কোটি লোকের সেই যোগ্যতা রয়েছে। ৩২ বছর সাংবাদিকতা করার পর যখন আমার সম্পাদক হওয়ার জন্য অনুমোদন চাওয়া হলো, তখন কত রকমের তদন্ত করা হয়েছিল। জাতীয় সংবাদপত্রে নীতি করার জন্য দুটি সভার আয়োজন করা উচিত সরকারের। সারা দেশের এই যে প্রায় ৮০০ বিভিন্ন সংবাদপত্র, এগুলোর সম্পাদকদের ডেকে তাঁদের সঙ্গে বৈঠক করতে হবে, তাঁরা সম্পাদক হওয়ার যোগ্য কি না। আরেকটি সভার আয়োজন করতে হবে দেশের প্রধান দৈনিকগুলোর সম্পাদকদের নিয়ে। মাসে অন্তত একটি বৈঠক করা উচিত সরকারের পক্ষ থেকে। বলিষ্ঠ রাষ্ট্র গঠনে মিডিয়ার কাছ থেকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে। আমাদের গণমাধ্যমগুলো অনেক আধুনিক হয়ে উঠেছে। কিন্তু এখনো একটি পত্রিকার সম্পাদক জেলে রয়েছেন, আদালত অবমাননার দায়ে। তথ্যমন্ত্রী, আপনার কাছে অনুরোধ করব, আদালত অবমাননার শাস্তি এত বড় লাখ লাখ টাকার না দিয়ে সামর্থ্যের মধ্যে শাস্তির বিধান করুন। প্রেস কাউন্সিলকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার একটা সীমা থাকা উচিত। পত্রপত্রিকায় মাঝে মাঝে হঠাৎ দু-একটা ভুল সংবাদ প্রকাশিত হয়ে থাকে। এটা রাজা রামমোহন রায় যখন পত্রিকা বের করেছিলেন, তখনো ঘটেছে। কিন্তু বর্তমানে কিছু কিছু পত্রিকা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে ধারাবাহিকভাবে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করে আসছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নামে তাদের এ ধরনের আচরণ পরাধীনতার চেয়েও খারাপ। তথ্য মন্ত্রণালয়ে একটি মনিটরিং সেল থাকা উচিত, যাঁরা নিয়মিত মনিটরিং করবেন, কোনো পত্রিকা নিয়মিত মিথ্যা ও বানোয়াট সংবাদ ছাপছে কি না। সংবাদপত্রে স্বাধীনতার অপব্যবহার কেউ করছে কি না, সে বিষয়েও সরকারের নজর দেওয়া উচিত। নিয়মিত বিভিন্ন জাতীয় প্রধান দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকদের নিয়ে আলোচনার আয়োজন করা উচিত তথ্য মন্ত্রণালয়ের।
শ্যামল দত্ত
আজকের আলোচনায় যে দুটি প্রশ্ন উঠে এসেছে, তা হলো বাংলাদেশের গণমাধ্যম স্বাধীন কি না এবং গণমাধ্যম দায়বদ্ধ কি না। পাশাপাশি আরেকটি প্রশ্ন অত্যন্ত জরুরি, তা হলো, বাংলাদেশের গণমাধ্যমে পেশাদারি দৃষ্টিভঙ্গি আছে কি না। আমাদের গণমাধ্যম কতটুকু পেশাদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। গণমাধ্যমের পেশাদারির সঙ্গে আরেকটি প্রশ্ন জড়িয়ে যাচ্ছে, সেটি হলো, আসলে আমাদের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়েছে কি না। গণমাধ্যমের দায়িত্বহীনতা এখনো প্রকট। তিন দিন আগে একটি শিশুকে অপহরণ করা হয়েছিল, সেখানে অপহূত শিশুর ছবিসহ আরও (গ্রেপ্তার হওয়া) তিনজন কিশোরের ছবি সব কটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। কিন্তু ১৯৭৪ সালের শিশু আইন বলে, এ ধরনের ছবি ছাপা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এ ব্যাপারে হাইকোর্টের একটি রায়ও আছে। আমরা কতটুকু জানি এই আইন সম্পর্কে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এখন কালো টাকার প্রচুর ছড়াছড়ি। একটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে যিনি ৫০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন, তাঁকে আড়াই লাখ টাকার প্রস্তাব দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বর্তমানে গণমাধ্যমে যে অবাধ কালো টাকার ছড়াছড়ি, তা ভবিষ্যতের গণমাধ্যমের পেশাদারির জন্য হুমকি।
আমরা বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী ও কালো টাকার মালিকের কথা জানি, যাঁরা এখন নিজেরাই পত্রিকা বের করছেন এবং আরও কয়েকজন আসছেন। নিজেদের কালো টাকা রক্ষায় তাঁরা গণমাধ্যমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন। দেখা যায়, ঢাকা শহরে এক নম্বর সার্কুলেশন থাকার দাবিদার, সম্প্রতি প্রকাশিত, স্বল্পসংখ্যক পৃষ্ঠার পত্রিকাটি দিনের পর দিন মিথ্যা ও ভুল সংবাদ ছেপে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। তারা পাঠকের কাছে দায়বদ্ধ নয়। আমরা, পত্রিকাগুলো এখানে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছি। আমরা নিজেদের স্বার্থে প্রতিনিয়ত আপস করছি। এ ছাড়া আমরা কখনো করপোরেট হাউসগুলোর বিরুদ্ধে লিখি না—আমাদের বিজ্ঞাপন ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভেবে। তা হলে এখানে গণমাধ্যম কতটুকু দায়বদ্ধতা পালন করল।
সানাউল্লাহ
আমার দীর্ঘদিন সংবাদপত্রে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে রেডিওতে কাজ করছি। তাই সংবাদপত্র ও রেডিওতে কাজ করার মধ্যে তফাত কী, তা আমি বুঝি। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে। সংবাদপত্রে কাজ করতে গিয়ে আমি তেমন কোনো বাধার সম্মুখীন হইনি। কিন্তু রেডিও বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার লাইসেন্স নিতে হয় তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিবছর লাইসেন্স নবায়ন করতে হয়। এই লাইসেন্স বিভিন্ন সরকারের আমলে একেক দফায় বা এক চালানে ১০-১২টি লাইসেন্স দিয়ে থাকে। আর ফ্রিকোয়েন্সি নিতে হয় বিটিআরসি থেকে বা প্রতিবছর নবায়ন করতে হয়। এতে যেকোনো কারণে যেকোনো সময় ইলেকট্রনিক মিডিয়া বন্ধ করে দেওয়ার সুযোগ থেকে যায় সরকারের হাতে। এর বেশ কয়েকটি উদাহরণ আমরা আগে দেখেছি।
গণমাধ্যমের জন্য নীতিমালার কথা সবাই বলেছেন। বেসরকারি এফএম বেতারকেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনার একটি নীতিমালা হয়েছে ২০১০ সালে। এটি হওয়ার সময় আমাদের ডেকেছিল। সেই নীতিমালায় আমাদের কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। কিন্তু রেডিও পরিচালনার ক্ষেত্রে কী কী করা যাবে না বলে যে বিষয়গুলো আছে, তার অধিকাংশই হচ্ছে আদালতের এখতিয়ার। নীতিমালা তৈরি কমিটির বেশির ভাগ সদস্যই তথ্য মন্ত্রণালয় ও বেতারের কর্মকর্তা। আমাদের কাছ থেকে শুধু মতামত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারি মাসে হঠাৎ করে নীতিমালাটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। তাই আবার যখন নীতিমালা তৈরির কথা বলা হচ্ছে, তখন একটা শঙ্কা কাজ করছে যে নীতিমালার নামে আবার গণমাধ্যমের হাত-পা বেঁধে ফেলা হবে কি না। গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা হওয়া উচিত তার পাঠক, শ্রোতা ও দর্শকের কাছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমরা অনেক সাংবাদিকই ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছে দায়বদ্ধ হয়ে পড়ছি। আমরা সাংবাদিকেরাই বিনিয়োগকারী, অসাধু ব্যবসায়ী খুঁজি। বলি, আসুন পত্রিকা বের করি, আমি সম্পাদক হই। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের গণমাধ্যম কতটুকু স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে কিংবা তারা তাদের দায়বদ্ধতা কতটুকু নিশ্চিত করতে পারছে, তা নিয়ে শঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
জ ই মামুন
আমি যেহেতু টেলিভিশনে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি, তাই এ সম্পর্কে আমি বলতে চাই, আমি চ্যানেলে চাকরিজীবনের শুরুতে একুশে টেলিভিশনে কাজ শুরুর আগে দীর্ঘদিনের একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে বিশ্বের নামকরা টেলিভিশনের লোকজন রিপোর্টিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। তাঁরা আমাদের বলেছিলেন, টেলিভিশন হচ্ছে একে-৪৭ রাইফেলের মতো বা তার চেয়ে শক্তিশালী কোনো অস্ত্র। আমি এ জন্য কথাটি বললাম, টেলিভিশন বা গণমাধ্যম যদি একটি শক্তিশালী ধারালো অস্ত্র হয়, তাহলে এই অস্ত্র আমি কার হাতে তুলে দিচ্ছি—এ বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার লাইসেন্স তিনিই পাবেন, যিনি যখন যে দল ক্ষমতায় থাকবে তার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকবে; হয় রাজনৈতিক, নয় অর্থনৈতিক। এই লাইসেন্সটি আপনি ব্যবহার করবেন মূলত অর্থ আয়ের জন্য।
দ্বিতীয়ত, লাইসেন্সটি ব্যবহার করবেন আপনার যে কালো টাকা কিংবা দুর্নীতি আছে, সেগুলো ঢাকার জন্য। তৃতীয়ত হচ্ছে, সরকারকে বা ওই রাজনৈতিক দলকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য। আমাদের দেশের টেলিভিশনগুলো মূলত তিনটি উদ্দেশ্য নিয়ে চলে। কারণ, টেলিভিশনের লাইসেন্স কে বা কারা পাবে, তার জন্য নির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। এবং তা নির্ভর করে সরকার বা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ওপর। এর ফলে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দায়বদ্ধতা গিয়ে দাঁড়ায় হয় সরকারের প্রতি, নয়তো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রতি। সেই সঙ্গে দায়বদ্ধতাটি দাঁড়ায় করপোরেট হাউসের ওপর, যারা অর্থ দেয়, বিজ্ঞাপন দেয়। টেলিভিশনে আসলে কারা সাংবাদিকতার সঙ্গে কাজ করবেন, সে ব্যাপারে নীতিমালা নয়, গাইডলাইন থাকা উচিত। কয়েক দিন পর পর বিভিন্ন মহলের উচ্চপর্যায়ের লোকদের তদবির নিয়ে নতুন নতুন অযোগ্য লোক কাজে যোগ দিচ্ছেন। দু-তিন মাস পর তাঁরা রিপোর্টার টেলিভিশনে। সচিবালয়ে মন্ত্রীদের মুখের সামনে মাইক্রোফোন ধরলেন এবং সাংবাদিক হয়ে গেলেন। সর্বনিম্ন কোনো প্রশিক্ষণের ও জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। আমি যখন টেলিভিশনের এসব ভুলে ভরা রিপোর্টগুলো দেখি, তখন হতাশ হয়ে পড়ি। কারণ, আমি নিজেও একজন টেলিভিশন রিপোর্টার ভেবে।
উদাহরণ হিসেবে বলতে চাই, আমাদের টেলিভিশনে ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছেন যিনি, তিনি আইজি, এসপি এমনকি ওসির অর্থ জানেন না। টেলিভিশনে সাংবাদিকতায় যাঁরা জড়িত, তাঁদের সর্বনিম্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা প্রশিক্ষণের কোনো বালাই নেই। এই জায়গাটায় আরও কাজ করতে হবে। আবারও বলতে চাই, আসলে সরকার কাদের লাইসেন্স দেবে? তাদের অনুগত লোককে, নাকি নিরপেক্ষ লোককে? আমার মনে হয়, সরকার তাদের অনুগত লোককেই লাইসেন্স দেবে।
মুন্নী সাহা
কর্মরত সাংবাদিক হিসেবে বলতে চাই, বিভিন্ন ভবন থেকে আমাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও চাপ আসত। সেটি ছায়া সরকার ছিল কি না, তা জানি না। এখন আর সে রকম কোনো ভবনের নিষেধাজ্ঞা ও চাপ নেই। একটি নতুন টেলিভিশনের সঙ্গে কাজ করছি। এই স্বল্প সময়ে এখন পর্যন্ত তথ্য মন্ত্রণালয়ের ফোনের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা বা কোনো চাপ পাইনি। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের সরকারের আমন্ত্রণে একটি স্টাডি প্রোগ্রামে সেখানে গিয়েছিলাম। সেখানকার একটি মিডিয়া সুইস ইনফোর কাছে একটি প্রশ্ন করেছিলাম। প্রশ্নটি আমার কাছে স্বাভাবিক ছিল কিন্তু ওদের কাছে অদ্ভুত। আমরা জানি, সাংবাদিকদের মধ্যে বিভক্তি থাকবে। কেউ সরকারি দলের, কেউ বিরোধী দলের। তারপর কোনো একটি গণমাধ্যমে থাকবে, যেটা সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে। আমি তাঁদের এভাবে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনারা যে ইংরেজি মাধ্যমে তথ্য দিচ্ছেন, তার কোনো নীতিমালা আছে কি না, কিংবা সম্পাদকীয় পলিসিটা কী? তাঁরা বললেন, এটা অবাক কথা। এখানে ফ্রান্স ভারসন আর ইংরেজি ভারসনের মধ্যে পার্থক্য কেন থাকবে? তাঁরা বললেন, সুইস ইনফোতে এমন জিনিস থাকে, যা তাদের দেশের জন্য মঙ্গল। তা সারা বিশ্বকে আমরা দিতে চাই। তখন আমি আবার প্রশ্ন করলাম, কোনো মন্ত্রী বা কেউ যদি দুর্নীতি করেন, সেগুলো কি আপনারা প্রকাশ করেন? এর উত্তরে বললেন, খুব কম আমরা দিই। যদি সেটি বড় ধরনের হয় কিংবা বিবিসি প্রচার করে। এই যে তাঁরা তাঁদের নিজের দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করছেন। আমরা চাই, গণমাধ্যমগুলো নিজেদের দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করবে।
মোজাম্মেল হক
আমরা যে পেশায় নিয়োজিত, এর সঙ্গে আজকের আলোচনার বিষয়টি অত্যন্ত সম্পৃক্ত। আমরা যাঁরা সম্পাদক, তাঁদের সবারই একটি টার্গেট থাকে আগামীকাল সকালে পাঠককে কীভাবে আপ্যায়ন করব। সবারই প্রতিযোগিতা থাকে ভালো লিড, বস্তুনিষ্ঠ ও সত্য সংবাদ পাঠকের কাছে তুলে দেওয়ার জন্য। তবু অনেক সম্পাদকের দায়বদ্ধতা থাকে না পাঠকের কাছে কিংবা গণমাধ্যমের যে স্বাধীনতা, তা পালন করি না। যেহেতু আমার পত্রিকাটি বগুড়া থেকে বের হয়। ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ ছিল, তারা বলেছিল, এটি বিএনপির ট্যাবলয়েড পত্রিকা। আবার যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, তখন আওয়ামী লীগের পত্রিকা বলা হতো। আমরা বিরোধী দলের সংবাদগুলো বেশি দিই। কারণ তারা তখন মাঠপর্যায়ে সক্রিয় থাকে। তখন সরকারি দল মনে করে, তাদের সংবাদ কম ছাপা হচ্ছে। ঢাকার বাইরে এই সমস্যাগুলো বেশি হয়। জেনে খুশি হবেন যে উত্তরবঙ্গে বেশ কয়েকটি পত্রিকা দেশের ও দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। পত্রিকাগুলোর দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে কাজ করছি। যেমন ধর্ষিত মেয়ে কিংবা কিশোরীদের ছবি না ছেপে আমরা দায়বদ্ধতা পালন করছি। সরকার যখন বলে, এর জন্য আমাদের দেশের ক্ষতি হতে পারে, আমরা সেটি মানি। এই মানার সময় হয়তো অনেক সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে উনিশ-বিশ হতে পারে। কিন্তু কোনো প্লাটফর্ম বা মাঠপর্যায়ে যখন একটি পত্রিকা কিংবা সম্পাদককে অন্যভাবে সমালোচনা করা হয়, তখনই আমাদের সম্পাদকদের দায়বদ্ধতা থেকে যায়। অনেক সময় এসব সংবাদ আমরা দেশের মঙ্গলের জন্য করে থাকি। কিন্তু ভুল বোঝাবুঝির মধ্য দিয়ে এসব সমস্যা দেখা দেয়।
প্রেস ইনস্টিটিউটে ১৫ বছর আগে অনেকগুলো প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম, যা আমি আমার পত্রিকায় কাজে লাগিয়েছিলাম। আমার মতামত হবে, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে এ ধরনের আরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, যাতে নবীন সাংবাদিকেরা উপকৃত হতে পারেন। ঢাকার বাইরে প্রায় প্রতিটি জেলায় ১৫ থেকে ১৮টি পত্রিকা বের হয়, যেগুলোর কোনো ভিত্তিমূলক অবস্থান নেই। এসব পত্রিকার ভুল সংবাদের কারণে পাঠক বিভ্রান্ত হচ্ছেন। তাই কোন কোন পত্রিকা রাখা হবে, কী কী শর্ত পূরণ করবে, তার একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা উচিত।
নূরুল কবীর
সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ থেকেই গণমাধ্যম আক্রান্ত হয়েছে বা আক্রান্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। রাষ্ট্রের আইন বিভাগকে আমরা দেখেছি আইনের বাইরে গিয়ে সম্পাদককে শাস্তি দিতে। আদালত অবমাননার মামলায় যেটুকু শাস্তি পাওয়া আইনের বিধানসম্মত, তার বাইরে গিয়ে অনেক বেশি শাস্তি দেওয়া হয়েছে। আমরা সংসদে দেখেছি, গণমাধ্যমের কোনো প্রতিনিধি না থাকা সত্ত্বেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করা হয়েছে। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগও বেশ কয়েক দিন ধরেই গণমাধ্যমের জন্য নীতিমালার কথা বলছে। কখনো গাইডলাইনের ভাষায়, কখনো নীতিমালার ভাষায়। কিছু দিন আগে আরেকটি বৈঠক তথ্যমন্ত্রীর কার্যালয়ে হয়েছিল, সেখানে একটি নীতিমালার প্রস্তাব করা হয়েছিল সরকারি প্রশাসনের দিক থেকে। সেটি এতই অগণতান্ত্রিক ছিল যে মন্ত্রী নিজেই বলেছিলেন, তিনি এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, এ রকম নীতিমালা হতে পারে না। কারণ মন্ত্রী নিজেই দীর্ঘদিন সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত থাকার ফলে কতগুলো অগণতান্ত্রিক বিষয় ওই প্রস্তাবের মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন। স্পষ্টতই, এমন একটি জায়গায় আমরা আছি, যখন রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগই অন্যায়ভাবে গণমাধ্যমের ওপর মনস্তাত্ত্বিক ও নিপীড়নমূলক অবস্থান গ্রহণ করেছে। সরকার কিন্তু জানে যে ফকিরাপুলের একটি বিল্ডিং থেকে একসঙ্গে ৭০-৮০টি পত্রিকা বের হচ্ছে। সরকার তার পরও কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। ইতিপূর্বে একজন বলেছেন, এক একটি টিভি চ্যানেল এক একটি একে-৪৭-এর মতো শক্তিশালী, সরকার কিন্তু অলিখিত নীতিমালার ভিত্তিতে ঠিকই এসব একে-৪৭-এর মতো মারাত্মক অস্ত্র, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার লাইসেন্স, তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য নিজেদের পছন্দের লোকদের হাতে তুলে দিচ্ছে। সব সরকারই এসব কাজ করছে—অলিখিত, সুচিন্তিত নীতিমালার ভিত্তিতে। এগুলো বেআইনি, অসাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পরিপন্থী।
গণতান্ত্রিক মিডিয়ার কাজ হচ্ছে নির্বাহী বিভাগকে মনিটরিং করা। নির্বাহী বিভাগ কী কী অগণতান্ত্রিক আচরণ করছে, তা মনিটরিং করে মানুষের সামনে তুলে ধরা। নির্বাহী বিভাগকে সংবাদমাধ্যমের ওপর খবরদারি করতে দেওয়া নয়। সেই মনিটরিং করতে গিয়ে আমাদের অনেক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এ ধরনের সমস্যা প্রায় সমাজেই রয়েছে, সারা পৃথিবীতে রয়েছে। আমাদের দেশের গণমাধ্যমের প্রশ্নে বলতে পারি, বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ ধারায় যা উল্লেখ আছে, তার বাইরে আর কোনো নীতিমালার প্রয়োজন নেই। সেটি হচ্ছে বিবেকের স্বাধীনতা থাকবে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকবে এবং রিজনেবল রেসট্রিকশন, যা আইনের মাধ্যমে আরোপিত, সেটির পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বিধিনিষেধ থাকবে। অবশ্য এই রিজনেবল শব্দটিকে বিভিন্ন সরকার আনরিজনেবলভাবে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছে। তাই রিজনেবল শব্দটির ব্যাখ্যার প্রয়োজন ও আলোচনা হতে পারে। নতুন করে নীতিমালার কোনো প্রয়োজন নেই। সংবিধানের অনেক কিছুতেই গোঁজামিল আছে। আওয়ামী লীগ বলতে পারে, আমি সংবিধান এ রকমই চাই। বিএনপি তাদের মতো চায়। আমি নিজে তো এই দুটির একটিও চাই না। ফলে আমি যা চাই, তা আমি বলব। আমাকে গ্রেপ্তার করলেও, দেশ থেকে বের করে দিলেও, সবখান থেকে আমি একই কথা বলব। আমি যা বিশ্বাস করি, তা সততার সঙ্গে বলি এবং তা অবশ্যই আমি বলব। প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সরকারের ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের অগণতান্ত্রিক তৎপরতার বিরুদ্ধে বলব। আমি যদি অযৌক্তিক কথা বলি, তবে সেটা কেউ শুনবে না।
সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতার কথা উঠেছে। জরুরি অবস্থার সময় বহু পত্রিকা, যার মধ্যে প্রথম আলোও একটি, অনেক রাজনীতিকের নানা অপরাধ সম্পর্কে ডিজিএফআইয়ের সরবরাহ করা খবর, অভিযুক্তদের সঙ্গে কথা না বলে মাসের পর মাস ছেপেছে। সেদিন আপনাদের জন্য পুরো মিডিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আপনারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আজকে গণমাধ্যমের যে বিশ্বাসযোগ্যতার কথা ওঠে, কাগজগুলো ওই কাজটা না করলে হয়তো আজ এভাবে উঠত না। জাতীয় সংসদে সম্পাদকদের অনুপস্থিতিতে, তাঁদের ডিফেন্ড করতে সুযোগ না দিয়ে, সাংসদেরা গালাগাল করতে পারতেন না। জরুরি অবস্থার সময় সেটি করার পেছনে হয়তো আপনাদের কোনো রাজনৈতিক মহৎ উদ্দেশ্য ছিল। আমি নিজেও আওয়ামী-বিএনপির রাজনৈতিক ব্যবস্থা চাই না। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য ইতিহাসসিদ্ধ যে পথ ও পন্থা আছে, যে সাড়ে তিন হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাস আছে, সেভাবে ছাড়া, জনগণকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বাইরে রেখে যেকোনো রাজনৈতিক পরিবর্তন দেশের জন্য, গণমাধ্যমের জন্য ক্ষতিকর বলে আমি মনে করি। আমি যদি কাউকে অভিযুক্ত করি, তবে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। এটা ছাড়া কোনো দায়িত্বশীল সংবাদপত্র হতে পারে না। এটি যদি না করি, তাহলে মানুষ আমাদের খারাপ বলবেই। সেটি ওই দিনও যেমন সত্য ছিল, আজকেও সত্য, ভবিষ্যতেও সত্য থাকব।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে সরকারি নীতিমালা ও কার্যক্রম নিরীক্ষা করার জন্য উন্নততর পেশাদার সংবাদকর্মী তৈরি করা প্রয়োজন। আর তার জন্য গণতন্ত্রপরায়ণ সাংবাদিক প্রতিষ্ঠানের দরকার রয়েছে। তা করার জন্য আমাদের সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করতে হবে। তাহলে আমাদের গণমাধ্যমে নিজেদের যে দুর্বলতা আছে, তা কাটিয়ে উঠতে পারব। গণমাধ্যমের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, এ কথা সত্য। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের নৈতিকতার অবস্থান থেকে গণমাধ্যমের কর্মীদের নৈতিকতার অবস্থান এখনো অনেক ওপরে। যাঁরা জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন, তাঁদের মনিটরিং করা, তাঁদের সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে বলা সংবাদপত্রের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালন করা গণমাধ্যমের গণতান্ত্রিক কর্তব্য। আমাদের নিজস্ব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারলে, কর্তব্যটি আমরা আরও ভালোভাবে পালন করতে পারব। সবাইকে ধন্যবাদ।
গোলাম সারওয়ার
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অবিরত থাকা উচিত। কিন্তু তার দায়বদ্ধতা শুধু পাঠকের কাছে, অন্য কারও কাছে নয়। সংসদে কিছুদিন আগে গণমাধ্যমকে যে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নাস্তানাবুদ করা হয়েছে, তা অত্যন্ত মর্মান্তিক ও ভয়াবহ। আমার দীর্ঘ পেশাজীবনে এ ধরনের কোনো ঘটনা দেখিনি। বাংলাদেশে টেলিভিশন ও বেতারের কল্যাণে দর্শক সরাসরি দেখেছেন ও শুনেছেন। পরদিন পত্রিকায় পাঠক পড়েছেন। আত্মপক্ষ সমর্থনের যেখানে কোনো সুযোগ ছিল না, সেখানে সাংসদেরা যে ভাষায় গণমাধ্যমকে গালাগাল করেছেন, তাতে সভ্য সমাজের ইতিহাসে এর চেয়ে লজ্জার আর কিছু হতে পারে না।
আমাদের উচিত ছিল সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এর প্রতিবাদ করা। কিন্তু আমরা তা করতে পারিনি। আমরা মুখ বুজে সহ্য করে গিয়েছি। আমাদের উচিত ছিল আরও বড় আকারে আলাপ-আলোচনা করে এর প্রতিবাদে পরবর্তী দিনের কার্যক্রম কী হবে, তা নির্ধারণ করা এবং উদ্যোগ নেওয়া। এই বিপদ শুধু প্রথম আলো, সমকালসহ কয়েকটি পত্রিকার নয়, এটা সব গণমাধ্যমের জন্য হুমকিস্বরূপ। ওই দিন সাংসদদের সঙ্গে স্পিকার নিজে যেভাবে যোগ দিয়েছেন, তাতে আমার কাছে মনে হয়েছে, পূর্বপরিকল্পিতভাবে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে সমালোচনা করেছেন। সাংসদদের পূর্বপ্রস্তুতি দেখে তা স্পষ্ট। জানি না, স্পিকার নিজেও এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কি না। স্পিকার হচ্ছেন সংসদের অভিভাবক, কিন্তু তিনি যে ভাষায় কথা বলেছেন, তা কারও কাছেই কাম্য ছিল না।
সংসদে বিরোধী দল অনুপস্থিত থাকার একটি প্রথা তৈরি হয়েছে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। যেহেতু তারা সংসদে যায় না, তাই জনগণের পক্ষে যে দাবি তা গণমাধ্যকেই তুলে ধরতে হয়। ফলে সংসদ বা সরকারি দল ও গণমাধ্যমের মধ্যে বিপরীত সম্পর্ক দেখা যায়।
আরেকটা বিষয়, গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে প্রায়ই আদালত অবমাননার অভিযোগ দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে আমি বলতে চাই, মতিউর রহমান ও মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে বিচারপতি আজিজ স্বপ্রণোদিত হয়ে মানহানির মামলা করেছিলেন। সেখানে আদালতে দাঁড়িয়ে যে অকথ্য ভাষায় আচরণ করছিলেন, তা বিরল। সেখানে যুগান্তর-এর প্রকাশককে ১০ হাজার টাকা জরিমানা এবং আমাকে তিন মাসের জেল দেওয়া হলো। তখন সব বড় বড় আইনজীবী এসে আমাদের ক্ষমা চাইতে বললেন। কারণ, আদালত অবমাননার মামলা হলে বড় বড় আইনজীবী একটু ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার কথা বলেন। সেখানে উপস্থিত যাঁরা ছিলেন তাঁরা, এমনকি সরকারপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল পর্যন্ত অনুরোধ করেছিলেন এবং বললেন, এ রায় যদি হয়, তবে জুডিশিয়ারি ও গণমাধ্যম বিপরীত অবস্থান হয়ে যাবে। পরে সেখানে সেই রায় স্থগিত করা হয়। পরে যুগান্তর-এ একটি লেখা লিখেছিলাম ‘সম্পাদকের জবানবন্দি’। সেখানে সেদিন যা ঘটেছিল তা সুবিস্তৃত আকারে ছিল। আমার মনে হয়, আদালত অবমাননা বলতে কী বোঝায়, তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা দরকার। কী কী করলে আদালত অবমাননা হবে, তা নিয়ে বিশদভাবে আলাপ-আলোচনা করতে হবে।
বেসরকারি চ্যানেলের ওপর বিটিভির সংবাদ চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। কারণ বিশ্বের উন্নত দেশ, এমনকি আমেরিকায় পর্যন্ত এ ধরনের কোনো নীতি নেই। বারবার বিটিভি ও বেতারের স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। বিটিভি ও বেতারে যে সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে তা কতটুকু মানসম্মত—এ নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। বিশ্বের কোথাও নেই পত্রিকা প্রকাশের জন্য ডিক্লারেশন নিতে হবে। যদি কোনো পত্রিকা আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়, যদি তারা তাদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করে, তবে ডিক্লারেশনের কোনো দরকার নেই। আর যদি তারা কোনো অন্যায় করে থাকে, তবে তা প্রচলিত আইনের মাধ্যমে বিচার হবে।
গণমাধ্যম যে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না, তার জন্য একটি সম্মিলিত ফোরাম করা উচিত। সংবাদপত্রের ইতিহাসে বর্তমানে আমরা যে ভয়াবহ সংকটময় সময় পার করছি, তা থেকে মুক্তির জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব। সংবাদপত্র যে ভুলে ভারাক্রান্ত, তা অস্বীকার করছি না। একটি সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে নিজ নিজ পত্রিকায়, যারা প্রতিদিন কী ভুল হচ্ছে তা দেখবে। আরেকটি দিক, সম্প্রতি গণমাধ্যমে যে পরিমাণ টাকার ছড়াছড়ি হচ্ছে, তাতে সাংবাদিকেরা অর্থ ও স্বার্থের কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছেন। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ভুলের পরিমাণ আরও বেশি। সাংবাদিকেরা বেশি টাকার চাকরির লোভে এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যাচ্ছেন। কালো টাকার মালিকেরা এসে বেশি বেতনে সাংবাদিকদের নিয়ে যাচ্ছেন। ইদানীং প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো হচ্ছে খুবই নোংরাভাবে। দুটি পত্রিকা অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে দিনের পর দিন মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সম্মিলিতভাবে এর প্রতিবাদ করা উচিত। সংবাদপত্রের যে সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, তার ঐতিহ্য রক্ষায় আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
শাহ আলমগীর
আমি গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতার ওপর জোর দিতে চাই। তাই কিছু পত্রিকার দায়িত্বহীনতার কথা আগে বলতে চাই। একটি পত্রিকা প্রথম পাতায় ড. কামাল হোসেনের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি বৈঠকের সংবাদ প্রকাশ করেছিল। অথচ সেদিন তিনি দেশেই ছিলেন না। সেই রিপোর্টার একজন প্রভাবশালী এবং দাপটের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কথা বলতে গেলে তা আরও ভয়াবহ। উদাহরণ হিসেবে, বিডিআর বিদ্রোহের সময় যখন সেনা কর্মকর্তাদের আত্মীয়স্বজন বের হয়ে আসছেন, তখন একজন রিপোর্টার মেজরের স্ত্রীকে প্রশ্ন করেছেন, ‘আপনি কি ধর্ষিত হয়েছেন?’ এগুলো হচ্ছে গণমাধ্যমের দায়িত্বহীনতার উদাহরণ। দায়িত্বহীনতার আরেকটি উদাহরণ বলতে চাই, ইরাকযুদ্ধের পর বিবিসি একটি সংবাদে বলেছে, ইরাকে পারমাণবিক অস্ত্র ছিল না, তা ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রধানমন্ত্রী নিজেও জানতেন। এটি যখন প্রকাশ করা হয়, ব্রিটেনে এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। সেখানে এও বলা হয়, জনগণকে যুদ্ধের পক্ষে আনার জন্য এই রিপোর্ট করা হয়েছিল। এরপর একজন বিজ্ঞানী ডেভিড কেলিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরদিন তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়। মৃত্যুর আগে তিনি লিখে যান, এই সংবাদের তিনিই ছিলেন উৎস। পরে বুলেটিনে প্রধানমন্ত্রী নিজেও জানতেন বিষয়টি তুলে দেওয়া হয়েছিল, কারণ সাংবাদিক মিলিগান নিজেও জানতেন যে এর যথেষ্ট প্রমাণ তাঁর কাছে নেই। পরদিন তিনি তাঁর সাংবাদিকতা পেশা থেকে অব্যাহতি নিয়েছিলেন। এই যে গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা, তা বলে-কয়ে আদায় করা যায় না। আমরা যদি গণমাধ্যমের কর্মীরা নিজেরা দায়বদ্ধ না হই, তবে নীতিমালা তৈরি করে কখনো তা আদায় করা যাবে না। সাংসদেরা নিজেরা নিজেদের দায়িত্বে কতটুকু দায়বদ্ধ? তাঁরা কীভাবে গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েই যাচ্ছে। গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে দীর্ঘদিন ধরে একসঙ্গে সবাইকে কাজ করে যেতে হবে।
আলমগীর মহিউদ্দিন
সরকার এবং সব পক্ষের মধ্যে সহনশীলতার মনোভাব থাকা দরকার। সরকার ও গণমাধ্যমের মধ্যে যদি সাংঘর্ষিক সম্পর্ক থাকে, তবে কখনো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পাওয়া সম্ভব নয়। বিল ময়ার্সের উদ্ধৃতি থেকে বলতে চাই, ‘দেয়ার ইজ নো মোর ইমপরট্যান্ট স্ট্রাগল ফর ডেমোক্রেসি, দ্যান এনসিউরিং এ ডাইভার্স, ইনডিপেনডেন্ট অ্যান্ড ফ্রি মিডিয়া, ফ্রি প্রেস ইজ দ্য হার্ট অব দ্যাট স্ট্রাগল।’ আর থমাস জেফারসনের আরেকটি উদ্ধৃতি হলো, ‘দি ওনলি সিকিউরিটি অব অল ইজ ইন ফ্রি প্রেস।’ তাই বলতে চাই, গণমাধ্যমকে যদি স্বাধীনতা না দেওয়া হয়, তবে গণতন্ত্রের উত্তরণ হবে না। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ করব, যাতে গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করার জন্য।
বাংলাদেশের ঊষালগ্নে যখন মনোরঞ্জন ধর আইনমন্ত্রী ছিলেন, তখন তাঁর একটি সাক্ষাৎকার আমি নিয়েছিলাম। তখন আইনে পাকিস্তান কেটে বাংলাদেশ করা হচ্ছে। এক ফাঁকে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশে এত আইন আছে যে আগামী ১০০ বছরে আর কোনো আইন করতে হবে না। কারণ একটি বিষয়ের ওপর চার-পাঁচটি আইন আছে। তাই বলতে চাই, বাংলাদেশে এত আইন আছে যে নতুন করে কোনো নীতিমালা করার প্রয়োজন নেই। যে আইনগুলো দিয়ে মানুষের অধিকার রক্ষা করা যায়, সেগুলো যদি বাস্তবায়ন করা হয়, তবে আর নতুন করে আইন করার প্রয়োজন নেই। গণমাধ্যমে যদি স্বাধীনতা না থাকে, তবে সেই গণমাধ্যমের কোনো প্রয়োজন নেই। স্বাধীন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
মাহফুজ আনাম
আমি মনে করি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আমাদেরই রক্ষা করতে হবে এবং এর দায়বদ্ধতা আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে গণমাধ্যম কখনো দায়বদ্ধ নয়। সংবাদপত্রের ইতিহাস বহুদিনের। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আমরাই অর্জন করেছি, এটি রক্ষার দায়িত্বও আমাদের। স্বল্প সময়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের যে প্রসার ও বিকাশ ঘটেছে এবং যে স্বাধীনতা ভোগ করছি, আমি মনে করি, আমরা অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছি।
আমরা সম্পাদকেরা নিজেরা যদি নিজেদের দায়বদ্ধতা নিয়ে আত্মসমালোচনা করি, যদি সম্পাদকেরা পাঠকের তথা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন, তবে আমি মনে করি, গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত হবে। আমি একটি প্রস্তাব করতে চাই, আমরা সম্পাদকেরা যদি নিজেরা একটি ফোরাম করি, যেখানে পেশাদারি নিয়ে আলোচনা হবে; আমাদের মতামত, রাজনৈতিক মত-দর্শন ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু সাংবাদিকতা পেশাদারির যে মূল কাঠামোগুলো আছে, সেগুলো মানছি কি না, তা নিয়ে এই এডিটরিয়াল ফোরামে আলোচনা হতে পারে।
আরেকটি বিষয়, সম্প্রতি সরকার যে নীতিমালা করতে যাচ্ছে, আমার অনুরোধ থাকবে, এটি করবেন না। আর যদি এটি করতেই চান, তবে এটি এখনই ওয়েবসাইটে দিয়ে দেন। এটির বিষয়ে জনগণ, সম্পাদক ও সাংবাদিকদের মতামত নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে করতে হবে। আর আমাদের দেশের নির্বাচিত সরকারগুলো সত্যিকার অর্থে স্বাধীন সাংবাদিকতার মূল্য কত, কতটা তাদের স্বার্থে, তা বুঝতে পারে না। আজকে প্রমাণিত হয়েছে, স্বাধীন সাংবাদিকতা গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য। আপনারা যদি গণমাধ্যমকে হেয়প্রতিপন্ন করেন, তবে গণতন্ত্রেরই ক্ষতি হবে।
মাহবুবুল আলম
আমি দুটি বিষয়ে বেশি জোর দেব। প্রথমত, গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারটিতে বেশি জোর দেব। সম্প্রতি গণমাধ্যমের আকার অনেক বড় হয়েছে। সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও বেতারের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। তাই সাংবাদিকের প্রয়োজনীতাও বেড়েছে। রাতারাতি তো আর সাংবাদিক তৈরি করা যায় না। তাই এডিটরিয়াল ফোরামের যে প্রস্তাব এসেছে, তা যদি করা যায়, যেখানে পেশাদারির জায়গায় কাজ করা যাবে। আমাদের নবীন সাংবাদিকদের জন্য বেশি বেশি প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অনেক পত্রিকায় নিজস্ব ব্যবস্থায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের দেশের গণমাধ্যমগুলোর উচিত, নিজস্ব ব্যবস্থায় নিজেদের নবীন সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। আবার গণমাধ্যমের সব সাংবাদিককে নিয়ে সম্মিলিতভাবে প্রশিক্ষণের আয়োজন করা যেতে পারে।
আমাদের দেশে গণতন্ত্র রয়েছে, নির্বাচিত সরকার আছে। কিন্তু সব সরকার গণমাধ্যমের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনেনি। আমি মনে করি, সংবাদপত্রগুলোকে সংবাদপত্র হিসেবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে, তাদের নিজস্ব মত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে দিতে হবে। পাকিস্তান শাসনামলে কালাবাগের আমির, পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নরও ছিলেন যিনি, তিনি লন্ডনে যাবেন চিকিৎসা করাতে। সংবাদটি সত্যি ছিল। কিন্তু তা প্রকাশ করার দায়ে পত্রিকার সাংবাদিক ও সম্পাদককে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। অন্যদিকে, ইন্দিরা গান্ধী সম্ভবত ঠান্ডার জন্য কাঁপছিলেন, একটি পত্রিকা লিখল তাঁর ঠোঁটে ক্যানসার হয়েছে। ভারতীয় সরকার কিন্তু সেই পত্রিকার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এটি গণতান্ত্রিক দেশের গণমাধ্যমের প্রতি আরেক ধরনের আচরণ। গণমাধ্যমেরও অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তা সত্ত্বেও সংবাদপত্র কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশে যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তার পেছনে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। সংবাদপত্র যদি নির্ভয়ে সংবাদ প্রকাশ করতে না পারত, তবে আজ আমরা এ অবস্থায় আসতে পারতাম না। গণমাধ্যমকে যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হয়, তবে আমরা গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় আরও ভূমিকা পালন করতে পারতাম। বর্তমান সরকার যে তথ্য অধিকার আইনটি করেছে, তার জন্য ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু এ ব্যাপারে আমার কিছু ভিন্নমত রয়েছে। আমি মনে করি, তথ্য অধিকার আইনটির আরও প্রচার বাড়াতে হবে জনগণের মধ্যে। এ আইন সংশোধনের মাধ্যমে মানুষের আরও তথ্য জানার অধিকার বাড়াতে হবে। আমি একটি কবিতার দুটি লাইন বলতে চাই, ‘অসত্যের কাছে নত নাহি হবে শির, ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ, লড়ে যায় বীর’। অর্থাৎ ভয়কে উপেক্ষা করে আমরা সবাই একসঙ্গে সামনে এগিয়ে যাব।
ড. গীতি আরা নাসরীন
বর্তমানে গণমাধ্যম রমরমা অবস্থার মধ্যে রয়েছে। খুব সহজে চট করে সাংবাদিকতার চাকরি পাওয়া যায়। শিক্ষার্থীদের ঠিকমতো শেখানোর আগেই তাঁরা সাংবাদিক হয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা মিডিয়া হাউসে এসে শেখেন যে তাঁদের আর শেখার কিছু নেই। যা শেখার তাঁরা তা কাজ করেই নাকি শিখবেন। লেখাপড়া করার আর দরকার নেই। এই যে মিডিয়ার রমরমা ব্যবসা, এর ফলে মিডিয়ার কথা মানুষের যেভাবে শোনার কথা ছিল, তা কিন্তু শুনছে না। কারণ মিডিয়া কেনা যায়, যেকোনো বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে সব ধরনের কথাবার্তা বলানো যায়।
এমনকি আপনি চাইলে একটি মিডিয়া তৈরি করে আপনার নিজের কথা বলতে পারবেন। গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা কিংবা স্বাধীনতার কথা বলতে পারি কিংবা ইতিহাস থেকে উদাহরণ দিতে পারি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এসব বড় বড় কথার কোনো ভিত্তি নেই। বাস্তব কথা হচ্ছে, মিডিয়া যে জায়গায় থাকার কথা, সেখানে নেই। আসল কথা হচ্ছে, জনগণ মিডিয়ার সঙ্গে নেই। জনগণ নেই, কারণ জনগণকে মিডিয়া কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করে না। সংবাদপত্রে কী লিখবেন, কী ছাপবেন—সবকিছুই গণমাধ্যমকর্মীরা সিদ্ধান্ত নেন, জনগণের মতামত নেওয়া হয় না। জনগণ আসলে কী চাইছে, তা কিন্তু মিডিয়া জানার চেষ্টা করে না। বাংলাদেশের বেশির ভাগ গণমাধ্যমের নিজস্ব কোনো গবেষণা সেল নেই। সারা বিশ্বে মিডিয়াগুলোর নিজস্ব গবেষণা সেল আছে এবং থাকা আবশ্যকীয়। এই গবেষণা ক্রমাগত জানাতে থাকবে জনগণ আসলে কী চাইছে, তাদের চাহিদা কী; জনগণের পছন্দ-অপছন্দ জানার জন্য কাজ করে যাবে। জনগণকে বোঝাতে হবে যে মিডিয়া তাদের সঙ্গে আছে। প্রশিক্ষণ ছাড়া কখনো পেশাদার সাংবাদিক পাওয়া সম্ভব নয়। যেকোনো একাডেমিক প্রতিষ্ঠান তাঁদের মূল বিষয়গুলো শেখাবে। আর বাকি বিষয়গুলো তিনি মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে শিখতে পারবেন। মিডিয়া হাউসগুলোর দায়িত্ব এই কাজগুলো নিজেদের কর্মীদের শেখানো। মিডিয়া হাউসগুলোর নিজস্ব প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত তাদের কর্মীদের জন্য। আর নীতিমালা বিষয়ে বলতে চাই, এটি কারোরই পছন্দ হবে না, যখন সেটি জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হবে।
আমাদের নিজেদের উচিত, যে ভুলগুলো হচ্ছে তা সংশোধনের জন্য নীতিমালা তৈরি করা। আমাদের গণমাধ্যমের উচিত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের নীতিমালা নিজেরাই তৈরি করা। সেটিই তথ্য মন্ত্রণালয়কে দিয়ে বলতে পারি, আমরা আমাদের নিজেদের নীতিমালা তৈরি করেছি, আপনাদের দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে।
এবিএম মূসা
পঞ্চান্ন বছর আগে যখন সাংবাদিকতা শুরু করেছিলাম, তখনো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। এই দীর্ঘ সময় ধরে কেন একই আলোচনা আমাদের করতে হবে, সে বিষয়ে আমি বিস্মিত। আজকের এই আয়োজনের মাধ্যমে এটি পরিষ্কার হচ্ছে যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো নেই। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ব্যাপারে আমাদের সবার মনে সংশয় ও আশঙ্কা রয়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বলতে বোঝায়, আমার যতটুকু প্রয়োগ করব, করার সাহস আছে তা-ই স্বাধীনতা। আমি কারও কাছে স্বাধীনতা চাইও না। আমি যে মতটি মনে করি স্বাধীনভাবে প্রকাশ করা উচিত, সেটিই আমার স্বাধীনতা। আমি সম্পাদক হিসেবে যা বিশ্বাস করি, তা অবশ্যই প্রকাশ করব। সরকার যতই নীতিমালা করুক না কেন, আমি আমার মত প্রকাশে পিছপা হব না, এটিই আমার স্বাধীনতা। এর ফলে যদি আমার শাস্তি হয়ও, যদি জেল-ফাঁসি এমনকি মৃত্যুও হয়, তাও আমি আমার মত প্রকাশ করব। এটিই আমার স্বাধীনতা।
আর দায়বদ্ধতা কার কাছে? আমি মনে করি, আমার দায়বদ্ধতা নিজের বিবেকের কাছে। আমার বিবেক আমাকে যা বলে, আমি তা-ই লিখি। আমরা যখন সংবাদ প্রকাশ করি, তখন একটি প্রশ্ন আসে, আসলে সংবাদ বলতে কী বোঝায়। এ প্রশ্ন বহুদিন ধরে। জনগণকে যে সংবাদটি আকৃষ্ট করে, আসলে সেটিই সংবাদ। জ্ঞান লাভের জন্য বই পড়তে হয়, এর জন্য সংবাদ পড়তে হয় না। আমরা যখন সংবাদপত্র প্রকাশ করেছি, তখন তা করেছি জনমত গঠনের জন্য। এখন সংবাদপত্র প্রকাশ করা হয় জনমতের প্রতিফলন ঘটানোর জন্য। আমাদের সময় পাঠকদের বাধ্য করতাম সংবাদ পড়তে।
সংসদে যেভাবে গণমাধ্যমকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেছেন সাংসদেরা, আমি আমার সম্পাদকীয় লেখার মাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। কিন্তু আমার দুঃখ, আমাদের সম্পাদকেরা সংযত থেকে লিখেছেন। তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ জানাতে পারেননি বলে আমি হতাশ হয়েছি। এক-এগারোর পরে যখন সাংবাদিকদের ও বার্তাপ্রধানদের ধরে নিয়ে যাওয়া হতো, তখন আমি ডিজিএফআইয়ের কাছে ফোন করে জানতে চাইতাম, কেন সাংবাদিকদের ও বার্তাপ্রধানদের ধরে এনেছেন? কারণ, যখন কোনো সংবাদ ছাপা হয়, তখন তার দায়দায়িত্ব সম্পাদকের ওপরই বর্তায়। কেন সম্পাদককে ধরে আনেননি এমন ঘটনায়? ডিজিএফআই থেকে উত্তর এসেছিল, ‘আমি সম্পাদকের কাছে রিপোর্টারকে নিয়ে গিয়েছিলাম, সম্পাদক বলেছেন তিনি কিছু জানেন না।’ এই যদি হয় সম্পাদকীয় অবস্থা, তবে সেখানে দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
মতিউর রহমান
আমাকে ও আমাদের প্রতিষ্ঠান নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। আপনারা অনেকেই আমাদের সমালোচনা করেছেন। আমাকে এত শক্তিশালী করে তোলা হচ্ছে যে আমিই নাকি এক-এগারো সৃষ্টি করেছিলাম। আপনাদের বলতে চাই, আমাদের প্রথম আলো পত্রিকা ২০০৬ সালের আগস্ট থেকে ২০০৭ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সব সেনা সদরে, ক্যাম্পে, ক্যান্টনমেন্টে বেআইনি ছিল। পত্রিকা এসব জায়গায় প্রবেশ করতে দেওয়া হতো না। সে সময় আমাদের ১৪ জন সাংবাদিককে ক্যাম্পে নিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠীকে আমাদের বিরুদ্ধে উসকে দেওয়া হয়েছে। আমাদের সাত বছরের হিসাবের সবখাতা এক বছর ধরে তন্নতন্ন করে দেখা হয়েছে, কিছু পায়নি। আমরা অনেক কিছু সে সময় ছেপেছি। যেহেতু আমাদের এতই শক্তিশালী বলা হচ্ছে, তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তখন আমার যত লেখা ছেপেছিলাম এবংগোলটেবিলবৈঠকের সবলেখা দুটি বই আকারে ছেপে দেব।
আমাদের মূল কথা ছিল, আমরা কখনো সামরিক শাসন চাই না। আমরা নির্বাচন চাই, আমরা নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার চাই। নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করবে, এটিই ছিল আমাদের মূল লক্ষ্য। হ্যাঁ, হয়তো আমরা ভুল করেছি। আমরা অনেক সংবাদ প্রকাশ করেছি হয়তো পুরো সত্য নয়, কিংবা ভুল। আবার অনেক রিপোর্ট আমরা ছাপিনি। অনেক রিপোর্ট ছাপার আগে মতামত নেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমরা এত শক্তিশালী কখনো হইনি যে, কোনো ব্যক্তি বা একটি পত্রিকার পক্ষে দেশের এত বড় একটি পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। সংবাদপত্রে প্রতিদিনই অনেক ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকে। আমরা সেগুলোর জন্য পাঠকের কাছে ভুল স্বীকার করি। আমরা সব সময় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চাই। আমাদের দেশের জন্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই বলে আমরা বিশ্বাস করি।
আবুল কালাম আজাদ
আজকের যাঁরা বক্তা ছিলেন, তাঁরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন। সাংবাদিকদের নিরাপত্তার প্রশ্নে আমি বলতে চাই, যেখানে সাংবাদিক নির্যাতনের বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটে, সেখানেই সরকার প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ নিচ্ছে। কয়েকজন সাংসদের মন্তব্যই যে সরকারের মনোভাব, তা কিন্তু নয়। সরকার সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। আপনারা সাংবাদিকদের ওয়েজবোর্ডের কথা বলেছেন, এ ব্যাপারে সরকার কাজ করছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের সঙ্গে ইতিমধ্যে আমরা সরকারের পক্ষ থেকে আলাপ-আলোচনা করেছি। বর্তমান সরকার জনগণের কাছে নির্বাচনী ইশতেহারে কিছু অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় এসেছে। আমরা সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে কাজ করছি। আমাদের নির্বাচনী অঙ্গীকারের ১৯ অনুচ্ছেদে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করার কথাটিও ছিল। আমরা এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।
আমি বলতে চাই, বিগত দুই বছরের মধ্যে তথ্য মন্ত্রণালয় কিংবা সরকারের কোনো মহল থেকে কোনো গণমাধ্যমের কাছে কোনো বিষয়ে চাপ বা ফোন এসেছে, কেউ বলতে পারবেন না। বর্তমানে গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করে যাচ্ছে বলে আমার বিশ্বাস। যদি কারও কাছে কোনো প্রমাণ থাকে, তা অবশ্যই আমার কাছে দেবেন। নীতিমালার প্রশ্নে আপনাদের মধ্যেই দ্বিমত আছে। আমরা প্রাথমিকভাবে একটি খসড়া আপনাদের কাছে দিয়েছিলাম, আলোচনা করেছিলাম। সরকার প্রয়োজনে আরও অনেকবার আপনাদের নিয়ে বসবে, আলোচনার মাধ্যমে সবাই মতৈক্যে পৌঁছেই কেবল নীতি তৈরি করা হবে।
প্রেস ইনস্টিটিউট ও প্রেস কাউন্সিলকে আরও শক্তিশালী করার জন্য আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি। বিগত দিনে শুধু ইলেকট্রনিক মিডিয়ার একজনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আপনারা যে সংবাদ পরিবেশন করেন, সেখানে কোন সংবাদ আগে যাবে, সে ব্যাপারে কোনো নীতিমালা আছে কি না। তখন আমি সংবাদ দেখছিলাম। কারণ প্রধানমন্ত্রীর সংবাদটি চার নম্বরে ছিল। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদের আগে দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অন্য সংবাদ যেতে পারে। কিন্তু সেখানে যে তিনটি সংবাদ আগে প্রচার করা হয়েছিল, তা প্রধানমন্ত্রীর সংবাদটির চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই কোন সংবাদটি কখন যাবে, সে জন্য একটি নিয়মনীতি থাকা দরকার। আর গণমাধ্যমকে সহায়ক শক্তি হিসেবে সব সময় মনে করে বর্তমান সরকার। সরকারকে গণমাধ্যমের সম্পাদকদের নিয়ে নিয়মিত যে বৈঠকের প্রস্তাব আপনারা করেছেন, আমি মনে করি, এটি একটি ভালো উদ্যোগ। এর ফলে গণমাধ্যম ও সরকারের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব। এ ধরনের আলাপ-আলোচনার আয়োজন তথ্য মন্ত্রণালয় অবশ্যই করবে। বিটিভির সংবাদ যাতে আরও বস্তুনিষ্ঠ ও সংক্ষিপ্ত হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবে তথ্য মন্ত্রণালয়।
বর্তমানে আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিকসহ সব ক্ষেত্রে সহনশীলতা অনেক কমে গেছে। আমাদের সবাইকে আরও সহনশীল হতে হবে। বর্তমান সরকার, এমনকি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত গণমাধ্যমের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখছেন। বর্তমান সরকার গণমাধ্যমবান্ধব এবং এর স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। সারা দেশের সব সম্পাদককে একসঙ্গে নিয়ে বৈঠকের প্রস্তাব করা হয়েছে। আপনারা যদি চান, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়ে দিনব্যাপী আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
গণমাধ্যমেই শুধু নয়, সমাজের সব ক্ষেত্রে এখন ব্যাপকভাবে কালো টাকার ব্যবহার হচ্ছে। অনেক সাংবাদিকই কালো টাকার মালিকদের উৎসাহিত করছেন গণমাধ্যমে বিনিয়োগ করার জন্য। ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ আরও সব মিডিয়ায় যে নবীন সাংবাদিকেরা আসছেন, তাঁদের ন্যূনতম একটি শিক্ষাগত যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু কয়েকজন সাংসদের বক্তব্যই যে সরকারের বক্তব্য, তা কিন্তু নয়। সরকার ও দলের বক্তব্য দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট মুখপাত্র রয়েছেন। সংসদে যে ঘটনা ঘটেছে, সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী সেই সব সাংসদকে ডেকে ব্যবস্থা নিয়েছেন, যাকে যা বলা দরকার তিনি বলেছেন। সেদিনের ঘটনাটি অনির্ধারিতভাবে হঠাৎ করে ঘটেছে। সেদিন আমি বারবার সংসদের হুইপের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি, যাতে আলোচনাটি বেশিক্ষণ চলতে না থাকে। আমি সেদিন খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ছিলাম। সংবাদপত্র যদি তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন না করত, তবে আজ আমরা যে গণতান্ত্রিক অবস্থায় পৌঁছেছি, তা সম্ভব হতো না।
আর দায়বদ্ধতার কথা বললে, সবাইকে কারও না কারও কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হয়। যেমন আমি চারজনের কাছে দায়বদ্ধ—প্রথমত, সাংসদ হিসেবে সংসদের কাছে; দ্বিতীয়ত, মন্ত্রী হিসেবে কেবিনেটের কাছে; তৃতীয়ত, দলের সদস্য হিসেবে আওয়ামী লীগের কাছে এবং চতুর্থত, আমি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। জনগণের কাছে আমার দায়বদ্ধতা হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই সরকার ও গণমাধ্যমের সবার দায়বদ্ধতা হচ্ছে জনগণের কাছে।
সংবাদের প্রতিবাদ ছাপার বিষয়ে বলতে চাই, সে ক্ষেত্রে দেখা যায় সংবাদ ছাপা হয়েছে প্রথম পাতায়, আর প্রতিবাদ ছাপা হয় ছোট আকারে ভেতরের পাতায়। যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, তাঁর যা ক্ষতি হওয়ার তা তো হয়েই গেল। এ ক্ষেত্রে বলতে চাই, সংবাদ যেখানে ছাপা হবে, এর প্রতিবাদ অবশ্যই সেখানে কিংবা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ছাপা উচিত এবং সেখানে লেখকের মতও থাকা দরকার। বর্তমানে মিডিয়াকে কেনা যায়। এ ব্যাপারে ষাট-সত্তরের দশকে যখন সাংবাদিকতা পেশায় আসি, তখন মিডিয়া কেনার চিন্তাও করা যেত না। গণমাধ্যমের উচিত গবেষণার মাধ্যমে বের করা যে জনগণ কতটা মিডিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, নীতিমালা চাপিয়ে দেওয়ার কোনো চিন্তা সরকারের মাথায় নেই। সরকার কখনো মনে করে না যে গণমাধ্যম ও সরকার কেউ কারও প্রতিপক্ষ। সরকারের সঙ্গে গণমাধ্যমের আস্থার পরিবেশ অবশ্যই নিশ্চিত করা হবে। আস্থার পরিবেশ সৃষ্টিতে উভয় পক্ষকে আরও সহনশীল হতে হবে। আমরা চাই সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করুক গণমাধ্যম। নিউজপ্রিন্টের মূল্যবৃদ্ধিসহ আপনাদের দাবির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমরা আলোচনা করব। বর্তমান সরকার ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চাইছে, সেখানে গণমাধ্যমের ভূমিকা অতি জরুরি।
আব্দুল কাইয়ুম
আজকের আলোচনার মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতার অনেক দিক উঠে এসেছে।
বিভিন্ন সমস্যা এবং তা সমাধানে কী করণীয়, সেগুলো নিয়ে আলোচনা হলো। আজকের গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত দেওয়ার জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
No comments