চারদিক-‘ছবিটা দিয়া যায়েন’ by ফারুখ আহমেদ
আষাঢ়ের প্রথম দিন। কোথায় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হবে, সেখানে বৃষ্টির কোনো নাম-গন্ধ নেই! তবে আষাঢ়ের কথা স্মরণ করেই কি না, দিনের আলো ফুটেছে গোমড়ামুখো হয়ে। মেঘলা আকাশ, সে আকাশে বৃষ্টির নাচন নেই। আছে চারুকলার লিচুতলা আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠান।
সে অনুষ্ঠানস্থলে না গিয়ে রমনা পার্কের দিকে মোটরবাইক ছোটাই।
ঘুম থেকে উঠে ফেসবুকে এক বন্ধুর স্ট্যাটাস দেখলাম, যার সারমর্ম হচ্ছে, ‘বর্ষামঙ্গল কদমতলায় না হয়ে লিচুতলায় কেন!’ বিষয়টি আমার মনকেও নাড়া দিয়ে যায়। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কদমগাছের কোনো অভাব নেই! পথ চলি এসব নানান কিছু ভাবতে ভাবতে। শুক্রবার বিধায় অন্য দিনের মতো যানজট নেই। একটানে রমনা পার্কের উত্তরায়ণ ফটকে এসে মোটরবাইক দাঁড় করিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা বের করে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করি। রমনায় প্রাতর্ভ্রমণকারীর সংখ্যা আজ অনেক বেশি। সবাই হাঁটছে, কেউ কেউ দল বেঁধে খাওয়া-দাওয়ায় মশগুল। প্রায় দিন শুক্রবার এখানে এলে প্রাতর্ভ্রমণকারীদের এমন খাওয়া-দাওয়ার ধুম দেখি। মনে হয়, যেন খাওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। হেঁটে-দৌড়ে শরীরের ওজন কমানোর সঙ্গে বিপুল খাওয়া-দাওয়ার যোগসূত্র খুঁজে কোনো কূলকিনারা পাই না।
আজ একটা বিষয়ের অভাববোধ করি। আষাঢ়ের প্রথম দিন, কারও হাতে কদম ফুল নেই, এমন দেখা যায়নি কখনো। অথচ আজ তাই দেখলাম। কারও হাতেই কদম নেই, রমণীর মাথার কেশ কদমশূন্য।
গ্রীষ্মের শুরুর অকালবর্ষণে গাছে কদম ফুল ফোটে। সেই কদম এখন শুকিয়ে কাঠ। মরা কদম অনেক গাছেই দেখে এলাম। তাজা কদম না দেখে মনে খচখচানি, কারণ বর্ষার দূতের পদটি যে কদমের একার!
আমি রূপসী বাংলা (সাবেক শেরাটন) হোটেলের পাশ ধরে হাঁটছি। এর মধ্যে স্বর্ণচাপা ছায়াতরু আর অস্তাচল ফটক পেরিয়ে বাওবাবগাছের কাছে চলে এসেছি। পাশেই বিশাল তেঁতুলগাছ, এখানে এক লোককে গাছের ডাল ভাঙতে দেখে চিৎকার করে তাকে গাছ থেকে নামাই। কাছেই লেকের ধারে একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে ছাতা মাথায় বসে থাকতে দেখি। তাঁর ছবি তুলে তাঁর সঙ্গে একটু কথা বলতে চেয়ে আবার মন পরিবর্তন করে আরও সামনে যাই। আষাঢ় কি আমাকেও আনমনা করে তুলল?
হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশেই দেখি, ছোট্ট একটি মেয়ে বকুল ফুলের মালা গাঁথছে। আমি কাছে গিয়ে নিবিড়ভাবে তার মালা গাঁথা পর্যবেক্ষণ করে অনেকক্ষণ পর বলি—
তোমার একটা ছবি তুলি?
না!
কেন, ছবি তুললে কী হইব?
কিচ্ছু না, আমি না কইছি, না!
আমি অবাক, কী বলে মেয়েটা!
তোমার নাম কী?
রোউসনা।
নাম কইলা ক্যান?
আমার ইচ্ছা।
তোমার বাড়ি কই?
জানি না।
তোমার বাপ-মা?
হেগোর কথা কইয়েন না!
তুমি কি সোজা কথা কইতে পারো না?
না, কী কইবেন কইয়া ফালান, মালা গাঁত্তাছি। এগুলা আবার বিক্রি করন লাগব, সময় নাই—বলে আবার মালা গাঁথায় মনোযোগী হয়। কিছুক্ষণ পর বলে, ‘একটা মালা কিনবেন?’
আমি ইশারায় বুঝিয়ে দিলাম, না!
শেষে ক্যামেরা তাক করলাম, মিষ্টি হাসিতে সে আমায় দেখতেই ক্যামেরা ক্লিক!
রওশন আরা তার নাম। সে বলেছে রোউসনা। রমনা পার্কে বকুল ফুলের মালা গেঁথে বিক্রি করে। এমনিতে সে উত্তরায়ণ ফটকের কাছে বসে মালা গাঁথে। আষাঢ়ের প্রথম দিন সে রমনা লেকের পাড়ে বসে মালা গাঁথছিল। অনেক কথা বলার পরও সে তার সম্পর্কে কিছুই বলেনি। শেষে যেই আমি চলে আসব, তখন সে আমার হাতে একটি বকুল ফুলের মালা ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ট্যাকা দিয়া তো মালা কিনলেন না, লন এই মালাডা আমি আফনেরে ফ্রি দিলাম। বলতে পারেন ঘুষ, মনে কইরা আমার ছবিটা দিয়া যায়েন!’
ফারুখ আহমেদ
farukh.ahmed@gmail.com
ঘুম থেকে উঠে ফেসবুকে এক বন্ধুর স্ট্যাটাস দেখলাম, যার সারমর্ম হচ্ছে, ‘বর্ষামঙ্গল কদমতলায় না হয়ে লিচুতলায় কেন!’ বিষয়টি আমার মনকেও নাড়া দিয়ে যায়। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কদমগাছের কোনো অভাব নেই! পথ চলি এসব নানান কিছু ভাবতে ভাবতে। শুক্রবার বিধায় অন্য দিনের মতো যানজট নেই। একটানে রমনা পার্কের উত্তরায়ণ ফটকে এসে মোটরবাইক দাঁড় করিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা বের করে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করি। রমনায় প্রাতর্ভ্রমণকারীর সংখ্যা আজ অনেক বেশি। সবাই হাঁটছে, কেউ কেউ দল বেঁধে খাওয়া-দাওয়ায় মশগুল। প্রায় দিন শুক্রবার এখানে এলে প্রাতর্ভ্রমণকারীদের এমন খাওয়া-দাওয়ার ধুম দেখি। মনে হয়, যেন খাওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। হেঁটে-দৌড়ে শরীরের ওজন কমানোর সঙ্গে বিপুল খাওয়া-দাওয়ার যোগসূত্র খুঁজে কোনো কূলকিনারা পাই না।
আজ একটা বিষয়ের অভাববোধ করি। আষাঢ়ের প্রথম দিন, কারও হাতে কদম ফুল নেই, এমন দেখা যায়নি কখনো। অথচ আজ তাই দেখলাম। কারও হাতেই কদম নেই, রমণীর মাথার কেশ কদমশূন্য।
গ্রীষ্মের শুরুর অকালবর্ষণে গাছে কদম ফুল ফোটে। সেই কদম এখন শুকিয়ে কাঠ। মরা কদম অনেক গাছেই দেখে এলাম। তাজা কদম না দেখে মনে খচখচানি, কারণ বর্ষার দূতের পদটি যে কদমের একার!
আমি রূপসী বাংলা (সাবেক শেরাটন) হোটেলের পাশ ধরে হাঁটছি। এর মধ্যে স্বর্ণচাপা ছায়াতরু আর অস্তাচল ফটক পেরিয়ে বাওবাবগাছের কাছে চলে এসেছি। পাশেই বিশাল তেঁতুলগাছ, এখানে এক লোককে গাছের ডাল ভাঙতে দেখে চিৎকার করে তাকে গাছ থেকে নামাই। কাছেই লেকের ধারে একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে ছাতা মাথায় বসে থাকতে দেখি। তাঁর ছবি তুলে তাঁর সঙ্গে একটু কথা বলতে চেয়ে আবার মন পরিবর্তন করে আরও সামনে যাই। আষাঢ় কি আমাকেও আনমনা করে তুলল?
হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশেই দেখি, ছোট্ট একটি মেয়ে বকুল ফুলের মালা গাঁথছে। আমি কাছে গিয়ে নিবিড়ভাবে তার মালা গাঁথা পর্যবেক্ষণ করে অনেকক্ষণ পর বলি—
তোমার একটা ছবি তুলি?
না!
কেন, ছবি তুললে কী হইব?
কিচ্ছু না, আমি না কইছি, না!
আমি অবাক, কী বলে মেয়েটা!
তোমার নাম কী?
রোউসনা।
নাম কইলা ক্যান?
আমার ইচ্ছা।
তোমার বাড়ি কই?
জানি না।
তোমার বাপ-মা?
হেগোর কথা কইয়েন না!
তুমি কি সোজা কথা কইতে পারো না?
না, কী কইবেন কইয়া ফালান, মালা গাঁত্তাছি। এগুলা আবার বিক্রি করন লাগব, সময় নাই—বলে আবার মালা গাঁথায় মনোযোগী হয়। কিছুক্ষণ পর বলে, ‘একটা মালা কিনবেন?’
আমি ইশারায় বুঝিয়ে দিলাম, না!
শেষে ক্যামেরা তাক করলাম, মিষ্টি হাসিতে সে আমায় দেখতেই ক্যামেরা ক্লিক!
রওশন আরা তার নাম। সে বলেছে রোউসনা। রমনা পার্কে বকুল ফুলের মালা গেঁথে বিক্রি করে। এমনিতে সে উত্তরায়ণ ফটকের কাছে বসে মালা গাঁথে। আষাঢ়ের প্রথম দিন সে রমনা লেকের পাড়ে বসে মালা গাঁথছিল। অনেক কথা বলার পরও সে তার সম্পর্কে কিছুই বলেনি। শেষে যেই আমি চলে আসব, তখন সে আমার হাতে একটি বকুল ফুলের মালা ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ট্যাকা দিয়া তো মালা কিনলেন না, লন এই মালাডা আমি আফনেরে ফ্রি দিলাম। বলতে পারেন ঘুষ, মনে কইরা আমার ছবিটা দিয়া যায়েন!’
ফারুখ আহমেদ
farukh.ahmed@gmail.com
No comments