বিব্রতকর প্রশ্নের’ জবাব না পেলে সংসদই বিব্রত হয়-সংসদে মন্ত্রীদের জবাবদিহি
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার তথা মন্ত্রীরা জাতীয় সংসদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। কেননা, সংবিধান অনুযায়ী জনগণই প্রজাতন্ত্রের মালিক, আর সংসদ সেই জনগণেরই প্রতিনিধিত্ব করে। সংসদ সরকারের যেকোনো কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জবাবদিহি চাইতে পারে।
কিন্তু নির্বাহী বিভাগের প্রতিনিধি মন্ত্রীরাই যদি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে না চান কিংবা কৌশলে এড়িয়ে যান, তা সংসদ তথা জনগণের সার্বভৌমত্বকে খর্ব করে।
গত রোববার প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, নবম জাতীয় সংসদে দুই হাজারের বেশি ‘বিব্রতকর প্রশ্ন’ মন্ত্রীরা স্থানান্তরের নামে এড়িয়ে গেছেন। আর এ ব্যাপারে শীর্ষে আছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে হত্যা, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা ও ভারতের সঙ্গে চুক্তি-সম্পর্কিত প্রশ্ন করা হয়েছিল। অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রীরাও বহু প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাচ্ছেন। এসব খারাপ দৃষ্টান্ত হিসেবেই বিবেচিত হবে।
কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী, সংসদের প্রতিটি বৈঠকের প্রথম এক ঘণ্টা প্রশ্ন ও উত্তরের জন্য নির্দিষ্ট থাকে। মন্ত্রী কোনো প্রশ্নের উত্তর তৈরি করতে না পারলে তাঁর অনুরোধে প্রশ্নটি পরের নির্ধারিত কার্যদিবসে স্থানান্তর করা যায়। এটা ব্যতিক্রম হিসেবেই বিবেচিত। কিন্তু সেই ব্যতিক্রমই যখন রেওয়াজে পরিণত হয়, তখন জবাবদিহি বলতে কিছু থাকে না।
রাষ্ট্রের বা জনগণের কাছে সরকারের জবাবদিহির উপযুক্ত জায়গা জাতীয় সংসদ। এই সত্য অনেক মন্ত্রীই মানতে চান না। অনেক সময় প্রশ্নোত্তরের নির্ধারিত সময়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে সংসদেও পাওয়া যায় না। সংসদীয় ব্যবস্থায় সবকিছুই জাতীয় সংসদে খোলামেলা আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। মন্ত্রীরা সব প্রশ্নের উত্তর দিলে সরকারের কাজের স্বচ্ছতা যেমন বাড়ে, তেমনি জনগণের প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতাও প্রকাশ পায়।
দুর্ভাগ্য যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জাতীয় সংসদকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু করতে পারেনি। বিরোধী দল অব্যাহতভাবে সংসদ বর্জন করে চলেছে। সরকারি দলও যে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে সংসদে আলোচনায় খুব আগ্রহী, তা প্রমাণ করতে পারেনি। সেক্ষেত্রে সংসদে প্রশ্নোত্তরই ছিল জনগণের শেষ ভরসা। এ অবস্থায় মন্ত্রীরা ‘বিব্রতকর’ ও ‘স্পর্শকাতর’ প্রশ্নের জবাব না দিলে সংসদের কার্যকারিতা বহুলাংশে কমে যায়।
বর্তমান জাতীয় সংসদের মেয়াদ প্রায় সাড়ে তিন বছর পার হয়েছে। মন্ত্রীদের অনাগ্রহের কারণে বিভিন্ন অধিবেশন ও সংসদীয় কমিটির বৈঠকে অনেক প্রশ্নেরই জবাব মেলেনি। সংসদীয় কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নেও মন্ত্রণালয়গুলোর সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। বাকি সময়টা মন্ত্রীরা তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ থাকবেন, আশা করি। অন্যথায় একটি জবরদখলকারী সরকারের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারের কোনোই পার্থক্য থাকে না। মন্ত্রীরা ‘বিব্রতকর প্রশ্নের’ উত্তর এড়িয়ে গেলে জনগণের এই সার্বভৌম প্রতিষ্ঠানটিই যে বিব্রত হয়, সেই সত্যও কি অস্বীকার করা যাবে?
No comments