দূরদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের ‘মধ্যবর্তী নির্বাচন’ by আলী রীয়াজ

যুক্তরাষ্ট্রে আসন্ন মধ্যবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টি পরাজিত হতে চলেছে। ২ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় কংগ্রেসের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা যে ভালো ফল করবেন না, এটা এখন প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। তবে তাঁরা কতটা খারাপ করবেন, সেটাই এখন প্রশ্ন।


এই নির্বাচনকে ‘মধ্যবর্তী নির্বাচন’ বলা হলেও এটা প্রেসিডেন্ট পদের নির্বাচন নয়, নির্বাচন হবে কংগ্রেস অর্থাৎ উচ্চকক্ষ সিনেট ও নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের (প্রতিনিধি পরিষদ)। কিন্তু যেহেতু প্রেসিডেন্টের মেয়াদকালের ঠিক মাঝামাঝি সময়ে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাই একে ‘মধ্যবর্তী নির্বাচন’ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। শুধু তা-ই নয়, এই সময়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অঙ্গরাজ্যের গভর্নর পদেও নির্বাচন হবে।
সিনেটের মোট ১০০ আসনের এক-তৃতীয়াংশ আসনে প্রতি দুই বছর পর পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সিনেটের মেয়াদ হলো ছয় বছর। এই মুহূর্তে সিনেটে ডেমোক্র্যাট সদস্যসংখ্যা ৫৭। এ ছাড়া দুজন নির্দলীয় প্রার্থী তাঁদের সঙ্গেই থাকেন—সব মিলিয়ে ৫৯ জন। অন্যদিকে রিপাবলিকান পার্টির সদস্যসংখ্যা ৪১ জন। এ বছর মোট ৩৭টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই আসনগুলোর ১৯টি এখন ডেমোক্র্যাটদের হাতে, আর ১৮টি আছে রিপাবলিকানদের হাতে। ডেমোক্র্যাটদের ১৯টি আসনের সাতটিতে তাঁদের প্রার্থীরা একেবারে নতুন, অর্থাৎ এসব আসনে যাঁরা এখন সিনেটর, তাঁরা হয় অবসর নিচ্ছেন কিংবা দলের প্রাথমিক নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। অন্যদিকে রিপাবলিকানদের ১৮টি আসনের মধ্যে আটটিতে প্রার্থীরা নতুন। এখন পর্যন্ত জনমত জরিপ ও অন্যান্য বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, রিপাবলিকান পার্টির ১৮টি আসনের কোনোটিতেই দলীয় প্রার্থীর পরাজয়ের কোনো আশঙ্কা নেই। অন্যদিকে ডেমোক্র্যাটদের আসনগুলোর মধ্যে কমপক্ষে সাতটিতে হাতবদল হতে পারে। এই সাতটি আসনের প্রার্থীদের মধ্যে ডেমোক্রেটিক পার্টির শীর্ষস্থানীয় নেতারা রয়েছেন, রয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে টানা বিজয়ী সিনেটররা। সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হেরি রিড, যিনি নেভাডা অঙ্গরাজ্যে পুনর্নির্বাচনের প্রার্থী, এখন হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মুখোমুখি। ইলিনয় অঙ্গরাজ্যে প্রেসিডেন্ট ওবামা যে আসন থেকে ২০০৪ সালে সিনেটর নির্বাচিত হয়েছিলেন, তা এই নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা ধরে রাখতে পারবেন কি না, তা নিয়ে প্রবল সংশয় দেখা দিয়েছে। উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যে ডেমোক্রেটিকের প্রার্থী রাস ফাইনপোল্ড, উদার ও সাহসী ডেমোক্র্যাট হিসেবে যাঁর পরিচয় রয়েছে। তিনি এখন জনমত জরিপে পিছিয়ে আছেন। ডেমোক্র্যাটদের দুর্গ বলে পরিচিত ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে সিনেটর বারবারা বক্সার ১৯৯২ সাল থেকে সিনেটর। এই প্রথম তিনি বড় রকমের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হয়েছেন হিউলেট প্যাকার্ড কোম্পানির সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কার্লি ফিওরিনার কাছ থেকে। এসব তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের ফলাফল শেষাবধি ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে এলেও তুলনামূলকভাবে স্বল্প পরিচিত কিছু ডেমোক্র্যাট সিনেটর বা পদপ্রার্থী যে পরাজিত হবেন, তা সহজেই বলা যায়। তবে আশার বিষয়, কোনো জরিপই এই ইঙ্গিত দেয় না যে সিনেটে ডেমোক্র্যাটরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাতে চলেছেন।
প্রতিনিধি পরিষদের মোট আসনসংখ্যা ৪৩৫টি। প্রতি দুই বছরে সবগুলো আসনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এখন ডেমোক্র্যাটদের আসনসংখ্যা ২৫৫, অন্যদিকে রিপাবলিকানদের আসনসংখ্যা ১৭৮। দুটি আসন শূন্য রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য দরকার ২১৮ আসন। রিপাবলিকানদের লক্ষ্য হচ্ছে সেই সংখ্যায় পৌঁছানো। এখন পর্যন্ত পরিস্থিতির যা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তাতে মনে হয় না রিপাবলিকানরা এই লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হবেন।
এবার দেশের ৩৭টি অঙ্গরাজ্যে গভর্নর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই ৩৭টি গভর্নর পদের ১৯টি এখন ডেমোক্র্যাটদের হাতে এবং ১৭টি রিপাবলিকানদের হাতে। সব মিলিয়ে দেশের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের ২৬টিতে ডেমোক্র্যাট গভর্নর এবং ২৪টিতে রিপাবলিকান। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ২ নভেম্বরের পর ডেমোক্র্যাট গভর্নরের সংখ্যা বাড়ার বদলে কমেই যাবে।
সব মিলিয়ে নির্বাচনী পরিস্থিতি মোটেই ডেমোক্র্যাটদের অনুকূলে নয়। তবে এক হিসাবে ডেমোক্র্যাটদের জন্য প্রতিকূল পরিবেশ অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয়। ১৯৩৮ সাল থেকে এ যাবৎ অনুষ্ঠিত ১৮টি মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফলাফলের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে মাত্র দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া সব সময়ই প্রেসিডেন্টের দল মধ্যবর্তী নির্বাচনে খারাপ ফলাফল করেছে। এই দুটি ব্যতিক্রম হলো প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের দ্বিতীয় মেয়াদের মধ্যবর্তী নির্বাচন (১৯৯৮ সাল) এবং প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের প্রথম মেয়াদের নির্বাচন (২০০২ সাল)। প্রেসিডেন্টদের প্রথম মেয়াদের মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, জর্জ বুশ ছাড়া আর কোনো প্রেসিডেন্টই সাফল্য অর্জন করেননি। ২০০২ সালে জর্জ বুশের প্রেসিডেন্ট আমলে রিপাবলিকানদের সাফল্যের কারণ হিসেবে বিশ্লেষকেরা মনে করেন ‘সময়’। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলা এবং আফগানিস্তানে যুদ্ধের কারণে মর্কিন নাগরিকেরা ক্ষমতার হাতবদলে উৎসাহী ছিলেন না। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের দ্বিতীয় মেয়াদের মধ্যবর্তী নির্বাচনে তাঁর দল ভালো করলেও প্রথম মেয়াদের মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রতিনিধি সভায় ৫২টি আসন এবং সিনেটে আটটি আসন হারিয়ে সংখ্যালঘু দলে পরিণত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অন্য কোনো প্রেসিডেন্টের দল একই নির্বাচনে প্রতিনিধিসভায় এত আসন হারায়নি। শুধু তা-ই নয়, ১৯৯২ সালে ক্ষমতার এই হাতবদলের ঘটনা একটি বিরল ইতিহাস তৈরি করে। ১৯৪৬ সালে প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের সময় রিপাবলিকানরা দুই কক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিলেন, ১৯৫৪ সালে আইজেন হাওয়ারের সময় ডেমোক্র্যাটরা দুই কক্ষেই বিজয়ী হয়েছিলেন। অর্থাৎ গত ৬৪ বছরে মাত্র তিনবার মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রেসিডেন্টের দল প্রতিনিধি সভা ও সিনেটে একই সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। যদিও জনমত জরিপগুলো সিনেটে ডেমোক্র্যাটদের নয়টি আসন হারানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে না, অনেকে সে রকম আশঙ্কাকে একেবারে উড়িয়ে দিতেও রাজি নন।
ঐতিহাসিকভাবেই মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রেসিডেন্টের দল খারাপ ফলাফল করে বলেই যে ডেমোক্র্যাটরা এখন পরাজয়ের মুখে, তা নয়। ২০০৮ সালে বারাক ওবামার নির্বাচনের পর রিপাবলিকান পার্টি যে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল, পার্টি তা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে বলেও এই পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। অন্য আরেকটি তথ্যও মনে রাখা দরকার: ডেমোক্র্যাটরা ২০০৬ ও ২০০৮ সালে প্রতিনিধি সভার এমন সব আসনেও বিজয়ী হয়েছেন, যেগুলোতে তাঁদের দীর্ঘস্থায়ী সংগঠন ও সমর্থন নেই। এই নির্বাচনে ৪৭টি আসন রয়েছে, যেগুলো ডেমোক্র্যাটরা রক্ষার চেষ্টা করছেন, যেখানে ২০০৪ সালে বুশ ও ২০০৮ সালে ম্যাককেইন জয়ী হয়েছেন। অন্যদিকে কেরি ও ওবামা জিতেছেন এমন ছয়টি এলাকা, যেখানে রিপাবলিকান প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য। কোনো কোনো বিশ্লেষক প্রেসিডেন্ট ওবামার জনপ্রিয়তা হ্রাসকেও ডেমোক্র্যাটদের আসন্ন পরাজয়ের কারণ বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকালে এই দাবি হালে পানি পায় না। সেপ্টেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট ওবামার জনপ্রিয়তা ছিল ৪৫ শতাংশ। ১৯৯৪ সালে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের জনপ্রিয়তা ছিল ৪৫ শতাংশ, ১৯৮২ সালে প্রেসিডেন্ট রিগানের জনপ্রিয়তা ছিল ৪২ শতাংশ। প্রথম মেয়াদের ঠিক মাঝামাঝি সময়ে খুব জনপ্রিয় দুজন প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তা থেকে প্রেসিডেন্ট ওবামার জনপ্রিয়তা মোটেই ভিন্ন কিছু নয়। এবং ওই দুই প্রেসিডেন্টের আমলেও তাঁর দল ভালো করেনি। ফলে ওবামা এদিক থেকে দলের জন্য অতিরিক্ত কোনো মাথাব্যথার কারণ নন; বরং সব প্রেসিডেন্টের মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তার চেয়ে দেশের অর্থনীতি ফলাফলের বড় নিয়ামক। ২০১০ সালের নির্বাচনে সাধারণ জনগণ যে ডেমোক্র্যাটদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন, তার কারণ হলো বেকারত্ব, অর্থনৈতিক সংকট ও কংগ্রেসের সাফল্যে ঘাটতি। ২০০৬ সাল থেকে কংগ্রেসের দুই কক্ষ ডেমোক্র্যাটদের নিয়ন্ত্রণে, ফলে রিপাবলিকানরা এই প্রচারে সাফল্য পেয়েছেন যে এই অর্থনৈতিক সংকটের দায়ভার ডেমোক্র্যাটদের। যদিও জর্জ বুশের অনুসৃত অর্থনৈতিক নীতিমালা, বিশেষত উপর্যুপরি কর হ্রাস, দুটি যুদ্ধের ব্যয় এবং বাজেটে ভারসাম্য বিষয়ে কোনো উদ্যোগ না নেওয়াই সংকটের উৎস—ডেমোক্র্যাটরা তা যথাযথভাবে প্রচার করতে ব্যর্থ হয়েছেন। অর্থনৈতিক সংকট মোচনে সরকার যে কোটি কোটি ডলার ব্যয় করেছে, ব্যাংক ও গাড়িশিল্প খাতে বিনিয়োগ করেছে, তাকে রিপাবলিকানরা অপচয় এবং সরকারের আকার বৃদ্ধির প্রমাণ বলে প্রচার চালিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, ওবামা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া ঐতিহাসিক স্বাস্থ্যবিমা সংস্কারকে রিপাবলিকানরা কেবল সরকারের হস্তক্ষেপ বলেই হাজির করেননি, তাকে সাধারণ মানুষের স্বার্থবিরোধী বলেও চিহ্নিত করেছেন।
স্বাস্থ্যবিমা সংস্কারের এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে ওবামা প্রশাসন ও ডেমোক্র্যাটরা যথাযথভাবে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কংগ্রেস থেকে এই সংস্কারের বিল পাস করতে গিয়ে তাঁদের অনুসৃত কৌশল দেশের উদারপন্থীদের হতাশ করেছে। ক্ষেত্রবিশেষে উদারপন্থীদের প্রতি অবমাননাসূচক মন্তব্য করেছেন প্রশাসনের প্রতিনিধিরা। উদারপন্থী ও নির্দলীয় ব্যক্তিরা ওবামার কাছ থেকে যা আশা করেছিলেন, সাফল্যের পরিমাণ তার তুলনায় কম। ব্যাংক খাতের সংস্কারের মতো বড় ঘটনাকেও ওবামা প্রশাসন ও ডেমোক্র্যাটরা সাধারণ মানুষের স্বার্থানুকূল পদক্ষেপ বলে প্রচার করতে পারেননি। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র যে ভূমিকা নেবে বলে উদারপন্থী ও নির্দলীয় ব্যক্তিরা আশা করেছিলেন, তার কোনো ইঙ্গিত ওবামা প্রশাসন এখনো দেখায়নি। গুয়ানতানামোর বন্দিশিবির বন্ধের প্রতিশ্রুতি থেকেই কেবল ওবামা প্রশাসন সরে আসেনি, তারা নির্যাতনের জন্য গত প্রশাসনের কারও বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়নি। বুশ প্রশাসনের অনেক কার্যক্রম এখনো বহাল রয়েছে। এসব হতাশার কারণে উদার ডেমোক্র্যাটরা এখন আর উৎসাহের সঙ্গে ভোটকেন্দ্রে হাজির হবেন না বলেই বিশ্লেষকদের অনুমান। জনমত জরিপে দেখা যায়, ২০০৮ সালে ওবামাকে সমর্থন করেছিলেন—এমন নির্দলীয় ব্যক্তিদের এক-চতুর্থাংশ এখন রিপাবলিকানদের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। উদার ডেমোক্র্যাটরা যেমন ওবামার প্রশাসন নিয়ে উৎসাহী নন, তেমনি দলের রক্ষণশীলরাও ওবামার ওপর অসন্তুষ্ট। সিনেট ও প্রতিনিধিসভার দক্ষিণপন্থী সদস্যরা বিভিন্নভাবে ওবামার প্রতিশ্রুত সংস্কারের পথে বাধা তৈরি করেছেন। তাঁদের ধারণা, এসব পদক্ষেপ জনপ্রিয় নয়। এসব সংস্কারের বিরোধিতা করে তাঁরা নির্বাচনে সাফল্য পাবেন। কিন্তু তাঁরা সেই হিসাবে ভুল করেছেন বলে মনে হয়। ওই গোষ্ঠীর সবচেয়ে পরিচিত সিনেটররা জনমত জরিপে এতটাই পিছিয়ে আছেন যে পার্টি ওই সব আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আশাও ছেড়ে দিয়েছে।
প্রার্থী বারাক ওবামা যতটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন, পরিবর্তনের যে স্বপ্ন তিনি দেখিয়েছিলেন, তার সবটাই বাস্তববাদী ছিল—এমন মনে করার কারণ নেই। তাঁর সম্মোহনী বক্তৃতায় দেশের অধিকাংশ মানুষ সেই স্বপ্নের অংশীদার হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁরা এবং সম্ভবত বারাক ওবামাও বিস্মৃত হয়েছিলেন যে বর্তমান ব্যবস্থার সুফল যাঁরা ভোগ করছেন, তাঁরা প্রাণপণে পরিবর্তন ঠেকাতে চাইবেন। গত দুই বছরে প্রেসিডেন্ট ওবামা সেটা হয়তো পদে পদে বুঝেছেন, কিন্তু সাধারণ ভোটাররা তা বুঝতে পারছেন না। ফলে তাঁদের অনেকের কাছেই ওবামা ও ডেমোক্র্যাটদের সাফল্য আশার তুলনায় কম। এই নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির বিজয়ের ফলে এই পরিস্থিতি আরও কঠিন হবে। যেসব সংস্কারের সূচনা হয়েছে, সেগুলো বাধাগ্রস্ত হবে। এসব সংস্কার, যেমন স্বাস্থ্যবিমা সংস্কারের সব দিক এখনো কার্যকর হয়নি। কিন্তু রিপাবলিকানরা কেবল এর বিরোধীই নয়, সেগুলো পাল্টে দিতেও অঙ্গীকার করছেন। অন্য যেকোনো মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রেসিডেন্টের দল ব্যর্থ হলে যতটা ক্ষতি হয়, এবার তার চেয়ে বেশি ক্ষতিরই আশঙ্কা। ডেমোক্র্যাটদের এক অংশ বুঝতে পারছে, শেষ চেষ্টা হিসেবে প্রেসিডেন্ট ওবামা এখন সারা দেশে একজন প্রার্থীর মতো ঝটিকা সফরে বেরিয়েছেন; ডেমোক্র্যাটদের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন প্রার্থীদের সমর্থনে জনসভা, অর্থ সংগ্রহ, গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার—সবই করছেন।
এবারের মধ্যবর্তী নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য কেবল এখানেই নয় যে এর ফলাফলের ওপর ওবামা প্রশাসনের শুরু করা সংস্কারগুলোর ভাগ্য নির্ভর করছে; বরং এখানেও দেশের রাজনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এটা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত দেড় বছরে রিপাবলিকান পার্টির ভেতরে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে, তা হলো দলের ভেতরে উগ্র রক্ষণশীল অংশ তাদের প্রভাব বিস্তার করেছে। ২০০৮ সালের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী সারাহ পেলিনের নেতৃত্বে দলের দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠী এখন ‘টি-পার্টি’ নামের প্লাটফর্মে সমবেত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে এই গোষ্ঠী রিপাবলিকান পার্টির ভেতরেই শুধু নয়, দেশের রাজনীতিতেও এক ধরনের অসহিষ্ণু সংস্কৃতির প্রসার ঘটিয়েছে। এই গোষ্ঠীর কোনো ইতিবাচক কর্মসূচি নেই, রয়েছে নেতিবাচক বিরোধিতার রাজনীতি। স্বাস্থ্যবিমা সংস্কারের বিরোধিতার মাধ্যমে ২০০৯ সালের গ্রীষ্মকালে এদের উদ্ভব ঘটে। কিন্তু স্বল্প সময়ের মধ্যে দলের ভেতরে ও দেশে তারা এক ধরনের বর্ণবাদী, অভিবাসীবিরোধী মনোভাব চাঙা করে তুলেছে। তারা সরকারের আকার ছোট করার নামে সামাজিক কল্যাণমূলক সব ধরনের সরকারি কর্মসূচির বিরোধিতা করে। এদের পরিকল্পনার মধ্যে সোশ্যাল সিকিউরিটি বা নাগরিকদের পেনশনব্যবস্থাকে বেসরকারীকরণ অন্যতম। রিপাবলিকান পার্টির ভেতরে তারা আরও বেশি দক্ষিণপন্থী ব্যক্তিদের দলের মনোনয়নের জন্য আন্দোলন তৈরি করে এবং অনেকাংশেই তারা তাতে সফল হয়েছে। প্রথম দিকে অনেক বিশ্লেষকই এই প্রচেষ্টাকে আমলে নিতে চাননি এই বলে যে এটা রিপাবলিকানদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। কিন্তু দেড় বছরের মধ্যে তারা দল ও দেশের রাজনীতিতে একটি মুখ্য শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অনেকেই এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে টি-পার্টির সমর্থকেরা অনভিজ্ঞ, উগ্র ও মূলধারার বাইরে বলে তাঁরা রিপাবলিকানদের মনোনয়নই পাবেন না। কিন্তু সব মনোনয়ন-প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে যে সারা দেশে এই গোষ্ঠীর ১৩৮ জন মনোনয়ন পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৩৩ জন প্রার্থী রয়েছেন প্রতিনিধিসভার এমন সব আসনে, যেখানে তাঁদের বিজয়ের সম্ভাবনা রয়েছে—হয় সেগুলো রিপাবলিকানদের শক্ত ঘাঁটি অথবা ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরা বিজয়ী না-ও হতে পারেন। সিনেটে নয়জন প্রার্থী হচ্ছেন টি-পার্টির সমর্থনপুষ্ট বা তাদের প্রতিনিধি। তাঁদের মধ্যে আটজন প্রার্থী বিজয়ী হতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে এই নির্বাচনের পরে কংগ্রেসে টি-পার্টির সমর্থক ও সদস্যসংখ্যা হবে যথেষ্ট এবং তাঁদের প্রভাব থেকে রিপাবলিকান পার্টি মুক্ত হতে পারবে না। টি-পার্টির সমর্থকেরা যে কেবল ডেমোক্র্যাটদের ঘোর বিরোধী কোনো রকম সমঝোতার বিরুদ্ধে তা-ই নয়, তাঁরা প্রেসিডেন্ট ওবামার বিজয়কে মোটেই মেনে নিতে পারেননি।
প্রেসিডেন্ট ওবামার প্রতিশ্রুত ও সূচিত সংস্কারগুলো যাদের স্বার্থের প্রতিকূলে যাচ্ছে, তারা এর বিরোধিতায় নামবে—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের শক্তি এখন আগের তুলনায় বহুগুণে বেড়েছে। এই নির্বাচনে এই গোষ্ঠীগুলো কোটি কোটি ডলার ব্যয় করছে সিনেট ও হাউসে ডেমোক্র্যাটদের পরাজিত করতে। যুক্তরাষ্ট্রের অতীতের কোনো মধ্যবর্তী নির্বাচনে এত বেশি অর্থ ব্যয় হয়নি। সেন্টার ফর রেসপনসিভ পলিটিক্স নামের একটি সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, এই নির্বাচনে আড়াই বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করছেন প্রার্থীরা। কিন্তু এই ব্যয়ের একটা বড় অংশই আসছে কয়েকটি ‘অলাভজনক সংগঠন’ থেকে। এসব ‘অলাভজনক’ বা ‘সমাজকল্যাণ’ সংস্থা ব্যয় করছে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীদের পরাজিত করতে। সাবেক জর্জ বুশ প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি কার্লরোড এবং রিপাবলিকান পার্টির সাবেক এড গিলাপসির তৈরি করা দুটি সংস্থা আমেরিকান ক্রসরোডস ও আমেরিকান ক্রসরোডস জিপিএস ডেমোক্র্যাটদের পরাজিত করতে কোটি কোটি ডলার ব্যয় করেছে এবং করছে। একইভাবে ইউএস চেম্বার অব কমার্স নামের একটি সংস্থা অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ব্যয় করেছে ১৬ মিলিয়ন (এক কোটি ৬০ লাখ) ডলার। করপোরেশন ও এসব গোষ্ঠীকে অর্থ কারা জোগাচ্ছে, সেটা জনসাধারণের জানারও উপায় নেই। এ বছরের জানুয়ারি মাসে দেশের সুপ্রিম কোর্ট এক মামলার রায়ে করপোরেশনগুলোকে সাধারণ মানুষের সমান বলে বর্ণনা করেন এবং নির্বাচনে তাদের অবারিত ব্যয়ের পথ উন্মুক্ত করে দেন। এরই সুযোগে দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীগুলো কোটি কোটি ডলার ব্যয় করে টেলিভিশন ও রেডিওতে দিন-রাত ডেমোক্র্যাটদের কর্মসূচি ও ডেমোক্র্যাট প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছে। ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরা এ ধরনের প্রচারণার মুখে হিমশিম খাচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর বক্তৃতায় এই গোষ্ঠীগুলোর প্রচেষ্টাকে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু অর্থের এই দাপটের মোকাবিলায় যে তৃণমূল পর্যায়ের অংশগ্রহণ দরকার, যে ধরনের তৃণমূল আন্দোলন ওবামাকে বিজয়ী করেছিল, তা এবার অনুপস্থিত।
সব মিলিয়ে ২ নভেম্বরের নির্বাচন ডেমোক্র্যাটদের জন্য সুসংবাদ আনবে—এমন আশা করার কারণ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, ডেমোক্র্যাটরা ক্ষতির মাত্রা কতটা কমাতে পারবে।
ইলিনয়, যুক্তরাষ্ট্র
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভারসিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.