শ্রদ্ধাঞ্জলি-মুক্তিযুদ্ধের এক মহানায়ক চলে গেলেন by এম মুহিবুর রহমান

একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক, আক্ষরিক অর্থে সৎ, বিবেকবান, অকুতোভয়, স্পষ্টভাষী ও জনদরদি বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী বীর বিক্রম বুকে অনেক অভিমান নিয়ে ‘প্রিয় বাংলাদেশ’কে ছেড়ে হঠাৎ চিরবিদায় নিলেন।


অনেকেরই হয়তো মনে আছে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রায় এক সপ্তাহ আগে ১৭ বা ১৯ মার্চ তখনকার পাকিস্তান আর্মির তুখোড় মেজর মইন তাঁর ঊর্ধ্বতন জাঁদরেল পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার আরবাবের আদেশ অমান্য করেছিলেন। জয়দেবপুরে বাঙালি জনতার ওপর ঊর্ধ্বতন অফিসারের আদেশ অমান্য করে গুলি ছুড়তে অস্বীকার করেন। সে হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী বীর বিক্রম প্রথম বাঙালি সেনানায়ক, যিনি সেনাশৃঙ্খলা ভঙ্গ করে বিদ্রোহ করেন এবং আমরা মনে করি, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের মহানায়কদের অন্যতম তৎকালীন মেজর মইন।
পরে মেজর জেনারেল মইন তাঁর এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন, ‘আত্মসম্মান, স্বাধীনতা ও দেশের জন্য ১৯৭১ সালে জীবনের নয়টি মাস মুক্তিযুদ্ধে কাটিয়েছি। ওই সময় শত কষ্টের মধ্যে এক মুহূর্তও এর জন্য অনুশোচনা হয়নি। বরং আত্মত্যাগের মহান ভাবনা আর গর্ব নিয়ে এগিয়ে গেছি এক ধরনের মানসিক তৃপ্তির মধ্য দিয়ে। পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীতে ও ১৬ বছরের কূটনৈতিক জীবনে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু আর কখনো ফিরে পাইনি মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে অনুভূত সেই গর্ব, আত্মতৃপ্তি ও আনন্দ।’
জেনারেল মইনের লেখা দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রথমটি ২০০০ সালে এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য ও ২০০৭ সালে দেশটা কেমন করে এমন হল। তাঁর চিন্ত-চেতনা, মন-মানসিকতার সামান্য পরিচয় পাই বই দুটি উৎসর্গ করা থেকে। প্রথম বইয়ের উৎসর্গ এ রকম: ‘আমার মা...আমার মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের ফলে যাকে অবর্ণনীয় কষ্ট সইতে হয়েছে...এবং সে সব মায়েদের যাঁরা তাঁদের সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে উৎসাহিত করেছেন।’ দ্বিতীয় বইটি উৎসর্গ করেছেন, ‘প্রিয় বাংলাদেশ’কে। তাঁর আরও অনেক মূল্যবান লেখা প্রধান জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে, যা তিনি বই আকারে প্রকাশ করে যেতে পারেননি। বিভিন্ন গোলটেবিল বৈঠকে, টেলিভিশনে আলোচনায় ও ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তিনি যত বক্তব্য দিয়েছেন, তা অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। সেসব ছিল দেশের কথা, সাধারণ নাগরিকের বঞ্চনার কথা, সামাজিক ন্যায়বিচার, আইনের শাসন—এককথায় স্বাধীন সার্বভৌম দেশের মালিক নাগরিকদের অধিকারের কথা, বিশ্বসমাজে মাথা উঁচু করে মর্যাদা নিয়ে চলার কথা। ব্যক্তিস্বার্থ ও গোষ্ঠীস্বার্থকে তিনি ঘৃণা করতেন।
তাঁর দ্বিতীয় বই থেকে উদ্ধৃত করছি, ‘সাম্প্রতিক বাংলাদেশে দেশপ্রেমের অভাব, দেশ ও জনগণের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপ, সামাজিক-চারিত্রিক-মূল্যবোধের অধঃপতন এবং সুবিধাবাদীদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। দেশের এই পরিস্থিতির কারণে আমাকেও কিছুটা মূল্য দিতে হয়েছে। কিন্তু এর জন্য আমার কোনো আফসোস্ নেই কারণ আমি আমার বিবেকের স্ফুলিঙ্গকে নিভে যেতে দিইনি... নৈতিকতার মহাসংকটে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা কঠিন কাজ। আমি সেই কঠিন কাজটিও করার চেষ্টা করেছি। আর সে জন্য মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি, আমার তৃপ্তির জায়গাটা সেখানে। আমি আমার বিবেককে দূষিত ও হাতকে নোংরা করিনি।’
মাত্র ৩৭ বছর বয়সে মইনুল হোসেন চৌধুরী মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি পান। তিনি নিজেকে দলীয় রাজনীতি বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতিতে কখনো জড়াননি। তিনি সারা জীবন নিজেকে দেশপ্রেমিক ‘ক্যারিয়ার সোলজার’ হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করতেন। এটা সর্বজনবিদিত যে, মইন সেনাপ্রধান হওয়ার যোগ্যতা রাখতেন। কিন্তু তাঁর গভীর দেশপ্রেম, সততা ও নিরপেক্ষতা এ জন্য অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তিনি যা বিশ্বাস করতেন তা বলতেন এবং যা বলতেন তা করতেন। তিনি কোনো সিদ্ধান্ত থেকে নড়চড় হতেন না এবং পরবর্তী সময়ে তাঁর সিদ্ধান্তই সঠিক বলে প্রমাণিত হতো। তিনি নানা চাপ ও প্রলোভনের মুখেও সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যেতে রাজি হননি। তাই তাঁকে মূলধারার সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে প্রায় ১৬ বছর প্রেষণে পাঁচটি দেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব দেওয়া হয়। যেখানেই গেছেন, সেখানেই তিনি বাংলাদেশের জন্য সুনাম অর্জন করেছেন।
২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাননীয় উপদেষ্টা হিসেবে তিনি অত্যন্ত সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।
পরিশেষে বলতে চাই, এই দুর্ভাগা দেশে জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী বীর বিক্রমের মতো মেধাবী, সজ্জন, সাহসী, সর্বজনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের আরও অবদান রাখার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু হায়! অকালে তিনি চলে গেলেন।
লেখক গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিঃ-এর চেয়ারম্যান, বোর্ড অব ডাইরেক্টরস ও জেনারেল মইনের সহপাঠী।

No comments

Powered by Blogger.