চারদিক-আমরা তো ডুবে যাচ্ছি... by নেয়ামত উল্যাহ
দৃশ্য-১ ৭ অক্টোবর। রাত বাড়ছে। বাড়ছে জোয়ারের পানি। প্রচণ্ড বৃষ্টি। কোনো বিরাম নেই। এ বছর ভোলায় বৃষ্টি ছিল না বললেই চলে। তবে ঘন ঘন দুর্যোগ ছিল। উচ্চ জোয়ার, নদীভাঙন। ওই না হওয়া বৃষ্টি ভোলার আকাশে কোথাও জমা হয়েছিল। সে বৃষ্টির পানি আকাশ ৬ অক্টোবর থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত টানা উপুড় করে ঢেলেছে।
স্বমূর্তি ধারণ করেছে মেঘনা-তেঁতুলিয়া-ইলিশা আর সাগর মোহনা। ফুলে উঠেছে তাদের জলরাশি।
দৌলতখান উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নের জুনু চৌধুরী বাড়ির সামনের বাঁধ ভেঙে ঢুকে পড়ল জোয়ার। মুখের সামনে যে বাড়িটি পড়ল, সে বাড়ির মালিক রুহুল আমিন ঠিকাদার। টাকা-পয়সা, অর্থ-সম্পত্তির দাপট তাঁর মতো কারোর ছিল না এ তল্লাটে। অসুখ আর মেঘনার ভাঙন তাঁকে অনেক আগেই কাবু করে ফেলেছে। মুহূর্তেই জোয়ারের তোড় তাঁর পুরো বাড়িটি পানির তলায় নিয়ে যায়। অসুস্থ রুহুল আমিন পানি থেকে বের হতে গিয়ে তলিয়ে যান। সকালে পাওয়া যায় তাঁর লাশ। মুষলধারে বৃষ্টি। কবর দেওয়ার মাটি নেই। শেষে পৌরসভার কবরখানায় দাফন করা হয়।
দৃশ্য-২
সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়ন। শহরতলির ইউনিয়নগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দুর্যোগকবলিত। এ বছরের ১০ মাসজুড়ে এ ইউনিয়নের মানুষ দুর্যোগ মোকাবিলা করেছে। ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামের ফরাজী বাড়ির মানুষ ওই ১০ মাসই জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসের পানির মধ্যে বসবাস করেছে। পুরোনো আমলের কাঠের ঘর। খাটের পায়ার নিচে ১০-১২টি ইট। ক্ষতিগ্রস্ত ভিটে। যেকোনো মুহূর্তে একটি দমকা বাতাস দুমড়ে-মুচড়ে দিতে পারে তিন শতাধিক বছরের চিহ্ন। বাড়ির ৮০ বছর বয়সী বুড়ো-বুড়িরাও ওই পানির মধ্যেই বাস করছেন। বাড়ি-স্মৃতি-মায়া-মমতা ছেড়ে তাঁরা অন্য কোথাও যেতে চাইছেন না।
৬-১৩ অক্টোবর এ ইউনিয়নের বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের চার-পাঁচ জায়গা ভেঙে যায়। পানিবন্দী পরিবারগুলো রান্না করতে পারেনি, অনাহারে থেকেছে, পচা পানিতে অসুখ হয়েছে। সব পানিবাহিত রোগ। সবচেয়ে কষ্ট হলো, নিজের সন্তান ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা। ভাঙা বাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে ঘরবাড়ি ভাসিয়ে নিলেও মা বুকে শিশুটি চেপে রাখেন।
আবু তাহের হাওলাদার বাড়িতে পানিবন্দী ইয়ানুর বেগম। তাঁর দুই বছরের ছেলে সাকিল খাট থেকে পড়ে জলে ভেসে যায়। হাউমাউ করে চিৎকার করে। পরে এলাকাবাসী শিশুটিকে উদ্ধার করেন।
দৃশ্য-৩
৯ অক্টোবর। সদর উপজেলার বাপ্তা ইউনিয়ন পানির নিচে। লোকজন পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে, নয়তো মাচায় রাত কাটিয়েছে। সাড়ে আটটার দিকে ইউনিয়নের মুছাকান্দি গ্রামের তালুকদার বাড়ির তোফায়েল আহমেদ ডুবে যাওয়া ঘরের মাচার ওপর শোবার ব্যবস্থা করতে গিয়ে বিষধর সাপ কালীফণার ছোবলে মারা যায়।
দৃশ্য-৪
চারপাশে জল। তিন দিকে নদী। এক দিকে সাগর। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন। কোনো কর্মকর্তাকে ভোলায় পাঠানো হলে, তিনি উচ্চমূল্যে সে বদলি বাতিল করান। আর যাঁরা বাতিল করাতে পারেন না, তাঁদের স্বজনেরা সামান্য ঝড়-বৃষ্টি হলে খবর নেন। ঘন ঘন দুর্যোগের শিকার ভোলা। আজকে কোটিপতি, কাল ভাঙনে ভিখারি হচ্ছেন। কোনো কর্মকর্তা ভোলায় চাকরি করার পর ভোলা ছেড়ে যেতে চান না। একমাত্র চিকিৎসকসংকট ছাড়া ভোলা স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রচুর ধান হয়। মাছ হয়। গ্যাস আছে, তাই সব থাকতে পারে। বিস্তীর্ণ বন আছে। সব ঠিক আছে। শুধু ভোলা শহরে জন্ম নেওয়া একজন ৩০ বছরের যুবক বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন না, ভোলা শহরের পিচঢালা রাস্তায় কোমরপানি দেখেছেন। ১৯৭০ সালেও হয়নি। কিন্তু এবার তা দেখেছেন। শুধু ভোলা শহর নয়, ভোলার ৮০ শতাংশ এলাকা পানির নিচে ছিল। মেঘনার মধ্যে প্রায় ৩৬টি চরাঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ ছিল মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ৮ অক্টোবর দিবাগত রাত তিনটার সময় বিচ্ছিন্ন ইউনিয়ন মদনপুর থেকে জাহাঙ্গীর চৌকিদার মুঠোফোনে বলেন, ‘বাই গো...আমরা তো আর বাঁচুম না..., ঘরোর চালায় তো পানি উইটছে।’
এ বছরের মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত উচ্চ জোয়ার ভোলার বিভিন্ন এলাকায় ছয়বার আঘাত হেনেছে। বিস্তীর্ণ ফসলি জমি, ফসল, পুকুর আর মানুষকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারে এখন হাহাকার। কারণ বিলের পর বিল, মাঠের পরে মাঠ ও খেতের ফসল পচে গেছে। পুকুর ও ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। বাথানের পর বাথান গবাদিপশু ও খোপ খোপ হাঁস-মুরগি মারা গেছে। ভোলাবাসী দিন দিন আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে। সংসার চালানোর জন্য একজন খামারি মাছ চাষ, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু পালন এবং জমিতে ফসলের আবাদ করেন। সেই ফলন যদি নষ্ট হয়, মানুষ বাঁচবে কী করে! ভোলা সরকারি কলেজের ছাত্র ও আবহাওয়া অফিস রোডের বাসিন্দা জয়চন্দ্র একদিন এসে বলছেন, ‘দাদা! আমরা তো ডুবে যাচ্ছি, বিজ্ঞানীদের মন্তব্য তো সত্যি হয়ে যাচ্ছে। এখন তো আমাদের বাঁচার পথ খুঁজতে হবে।’
দৌলতখান উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নের জুনু চৌধুরী বাড়ির সামনের বাঁধ ভেঙে ঢুকে পড়ল জোয়ার। মুখের সামনে যে বাড়িটি পড়ল, সে বাড়ির মালিক রুহুল আমিন ঠিকাদার। টাকা-পয়সা, অর্থ-সম্পত্তির দাপট তাঁর মতো কারোর ছিল না এ তল্লাটে। অসুখ আর মেঘনার ভাঙন তাঁকে অনেক আগেই কাবু করে ফেলেছে। মুহূর্তেই জোয়ারের তোড় তাঁর পুরো বাড়িটি পানির তলায় নিয়ে যায়। অসুস্থ রুহুল আমিন পানি থেকে বের হতে গিয়ে তলিয়ে যান। সকালে পাওয়া যায় তাঁর লাশ। মুষলধারে বৃষ্টি। কবর দেওয়ার মাটি নেই। শেষে পৌরসভার কবরখানায় দাফন করা হয়।
দৃশ্য-২
সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়ন। শহরতলির ইউনিয়নগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দুর্যোগকবলিত। এ বছরের ১০ মাসজুড়ে এ ইউনিয়নের মানুষ দুর্যোগ মোকাবিলা করেছে। ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামের ফরাজী বাড়ির মানুষ ওই ১০ মাসই জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসের পানির মধ্যে বসবাস করেছে। পুরোনো আমলের কাঠের ঘর। খাটের পায়ার নিচে ১০-১২টি ইট। ক্ষতিগ্রস্ত ভিটে। যেকোনো মুহূর্তে একটি দমকা বাতাস দুমড়ে-মুচড়ে দিতে পারে তিন শতাধিক বছরের চিহ্ন। বাড়ির ৮০ বছর বয়সী বুড়ো-বুড়িরাও ওই পানির মধ্যেই বাস করছেন। বাড়ি-স্মৃতি-মায়া-মমতা ছেড়ে তাঁরা অন্য কোথাও যেতে চাইছেন না।
৬-১৩ অক্টোবর এ ইউনিয়নের বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের চার-পাঁচ জায়গা ভেঙে যায়। পানিবন্দী পরিবারগুলো রান্না করতে পারেনি, অনাহারে থেকেছে, পচা পানিতে অসুখ হয়েছে। সব পানিবাহিত রোগ। সবচেয়ে কষ্ট হলো, নিজের সন্তান ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা। ভাঙা বাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে ঘরবাড়ি ভাসিয়ে নিলেও মা বুকে শিশুটি চেপে রাখেন।
আবু তাহের হাওলাদার বাড়িতে পানিবন্দী ইয়ানুর বেগম। তাঁর দুই বছরের ছেলে সাকিল খাট থেকে পড়ে জলে ভেসে যায়। হাউমাউ করে চিৎকার করে। পরে এলাকাবাসী শিশুটিকে উদ্ধার করেন।
দৃশ্য-৩
৯ অক্টোবর। সদর উপজেলার বাপ্তা ইউনিয়ন পানির নিচে। লোকজন পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে, নয়তো মাচায় রাত কাটিয়েছে। সাড়ে আটটার দিকে ইউনিয়নের মুছাকান্দি গ্রামের তালুকদার বাড়ির তোফায়েল আহমেদ ডুবে যাওয়া ঘরের মাচার ওপর শোবার ব্যবস্থা করতে গিয়ে বিষধর সাপ কালীফণার ছোবলে মারা যায়।
দৃশ্য-৪
চারপাশে জল। তিন দিকে নদী। এক দিকে সাগর। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন। কোনো কর্মকর্তাকে ভোলায় পাঠানো হলে, তিনি উচ্চমূল্যে সে বদলি বাতিল করান। আর যাঁরা বাতিল করাতে পারেন না, তাঁদের স্বজনেরা সামান্য ঝড়-বৃষ্টি হলে খবর নেন। ঘন ঘন দুর্যোগের শিকার ভোলা। আজকে কোটিপতি, কাল ভাঙনে ভিখারি হচ্ছেন। কোনো কর্মকর্তা ভোলায় চাকরি করার পর ভোলা ছেড়ে যেতে চান না। একমাত্র চিকিৎসকসংকট ছাড়া ভোলা স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রচুর ধান হয়। মাছ হয়। গ্যাস আছে, তাই সব থাকতে পারে। বিস্তীর্ণ বন আছে। সব ঠিক আছে। শুধু ভোলা শহরে জন্ম নেওয়া একজন ৩০ বছরের যুবক বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন না, ভোলা শহরের পিচঢালা রাস্তায় কোমরপানি দেখেছেন। ১৯৭০ সালেও হয়নি। কিন্তু এবার তা দেখেছেন। শুধু ভোলা শহর নয়, ভোলার ৮০ শতাংশ এলাকা পানির নিচে ছিল। মেঘনার মধ্যে প্রায় ৩৬টি চরাঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ ছিল মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ৮ অক্টোবর দিবাগত রাত তিনটার সময় বিচ্ছিন্ন ইউনিয়ন মদনপুর থেকে জাহাঙ্গীর চৌকিদার মুঠোফোনে বলেন, ‘বাই গো...আমরা তো আর বাঁচুম না..., ঘরোর চালায় তো পানি উইটছে।’
এ বছরের মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত উচ্চ জোয়ার ভোলার বিভিন্ন এলাকায় ছয়বার আঘাত হেনেছে। বিস্তীর্ণ ফসলি জমি, ফসল, পুকুর আর মানুষকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারে এখন হাহাকার। কারণ বিলের পর বিল, মাঠের পরে মাঠ ও খেতের ফসল পচে গেছে। পুকুর ও ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। বাথানের পর বাথান গবাদিপশু ও খোপ খোপ হাঁস-মুরগি মারা গেছে। ভোলাবাসী দিন দিন আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে। সংসার চালানোর জন্য একজন খামারি মাছ চাষ, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু পালন এবং জমিতে ফসলের আবাদ করেন। সেই ফলন যদি নষ্ট হয়, মানুষ বাঁচবে কী করে! ভোলা সরকারি কলেজের ছাত্র ও আবহাওয়া অফিস রোডের বাসিন্দা জয়চন্দ্র একদিন এসে বলছেন, ‘দাদা! আমরা তো ডুবে যাচ্ছি, বিজ্ঞানীদের মন্তব্য তো সত্যি হয়ে যাচ্ছে। এখন তো আমাদের বাঁচার পথ খুঁজতে হবে।’
No comments