দেশহীন মানুষের কথা-পাহাড়ের মানুষকে আর কত দুঃখ দেবেন? by সঞ্জীব দ্রং
গত ২২ অক্টোবর পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে একটি খবর দেখলাম প্রথম আলোর প্রথম পাতায়। খবরের শিরোনাম, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে আগে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি, পরে জরিপ—প্রধানমন্ত্রী।’ সকালবেলা ছুটির দিনে প্রফুল্ল মনে খবরটি পড়লাম। কিন্তু মন ভালো হলো না। সভাটি হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে।
সভায় সবাই উপস্থিত ছিলেন, ছিলেন না শুধু জনসংহতি সমিতির কেউ, যাঁরা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি করেছিলেন, এক যুগ আগে বিশাল আশা ও স্বপ্ন নিয়ে, সরকারের কথায় বিশ্বাস রেখে, নতুন জীবনের খোঁজে ফিরে এসেছিলেন। আমি আশা করেছিলাম, এই সরকার সত্যি এবার আন্তরিকভাবে এ চুক্তি বাস্তবায়ন করবে, পাহাড়ি মানুষের বেদনা ও হতাশা আর বাড়তে দেবে না। এ রকম কথাই তো তারা বলেছিল দুই বছর আগে, ক্ষমতায় বসার আগে। দুই বছর পর আজ আমার কেন জানি মনে হয়, সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে না।
এখন প্রশ্ন হলো, পাহাড়ের এই মানুষদের কাউকে কি এই সভায় ডাকা হয়নি? কেন ডাকা হয়নি? হয়তো পরে ডাকা হবে। আমি জানি না। কিন্তু আমার মন ভালো নেই। যত দূর জেনেছি, রাঙামাটিতে পাহাড়ি বন্ধুদের ফোন করে, তাঁদের কাউকে ডাকা হয়নি। তাঁদের মনেও অনেক দুঃখ, কষ্ট।
কবি শামসুর রাহমানের কথা মনে পড়ল। তাঁকে নিয়ে রাঙামাটি গিয়েছিলাম ১৯৯৮ সালে। পার্বত্য চুক্তির কয়েক মাস পর। সুবলং পর্যন্ত গিয়েছিলাম নদীপথে হ্রদের জলে ভেসে। দুই ধারে অপরূপ দৃশ্য। পাহাড়ি মানুষের জমিজমা হ্রদের জলে ভাসিয়ে দিয়ে, কাপ্তাই বাঁধের কারণে বিদ্যুৎ এসেছে সত্যি, কিন্তু আদিবাসীদের জীবন ছারখার হয়ে গেল। রাষ্ট্র নিজে এ রকম নিষ্ঠুর কাজ করতে পারে, এ কথা বলেছিলেন রাঙামাটির গৌতম দেওয়ান, তানভীর মোকাম্মেলের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র কর্ণফুলীর কান্নায়। তিনি বলেছেন, এই আদিবাসীরা বাঙালি বা মুসলমান হলে এ রকমভাবে ডুবিয়ে দেওয়া রাষ্ট্রের পক্ষে নিশ্চয়ই সম্ভব হতো না।
শামসুর রাহমান সে সময় একটি কবিতা লিখেছিলেন, ‘পাহাড়ের বুকে বয়ে যাক শান্তির সুবাতাস।’ তিনি আর বেঁচে নেই আমাদের মাঝে। কিন্তু আজ দুঃখিত মনে কবির কবিতা শোনাতে ইচ্ছে করছে, ‘কবিকে দিও না দুঃখ, দুঃখ দিলে সে-ও জলে-স্থলে হাওয়ায় হাওয়ায় নীলিমায় গেঁথে দেবে দুঃখের অক্ষর/ ...তাকে দুঃখ দিও না, চৌকাঠ থেকে দূরে দিও না ফিরিয়ে/ ফেরালে নক্ষত্র, চাঁদ করবে ভীষণ হরতাল/...নিমেষেই সব ফুল হবে নিরুদ্দেশ।’
বৈঠক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সরকারের প্রতি আস্থা রেখে যাঁরা অস্ত্র সমর্পণ ও চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, আমরা তাঁদের বিশ্বাস ভঙ্গ করতে পারি না।’ কথাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কথা এ পর্যন্ত বহুবার বলেছেন। বাস্তবতা হলো, তাঁর বর্তমান শাসনামলেরও দুই বছর হতে চলল। আর চুক্তির পর দুই যুগের বেশি সময় পার হয়েছে। আমি যত দূর জানি, এবার ক্ষমতায় আসার দুই বছরেও চুক্তি বিষয়ে জনসংহতি সমিতির সঙ্গে সরকারপ্রধানের একান্ত কোনো বৈঠক হয়নি। এটি যত দ্রুত হয়, ততই মঙ্গল। পাহাড়ি মানুষের মনে আশাজাগানিয়া খবর ছড়িয়ে দিতে হবে। বিশ্বাস ভঙ্গ কি হয়নি এক যুগ অতিক্রম করার পরেও? গত ১৬ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো ‘পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে পার্বত্যবাসীর সংশয়’ শিরোনামে সরেজমিন প্রতিবেদন ছাপিয়েছে চার দিন ধরে। আমি প্রতিবেদনের প্রথম কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি, ‘পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন সম্পর্কে ওই অঞ্চলের পাহাড়ি-বাঙালি নির্বিশেষে প্রায় সবাই সন্দিহান। আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবাই মনে করেন, এ চুক্তি বাস্তবায়িত হবে না।’ কেন মানুষের মধ্যে এই হতাশা তৈরি হলো?
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির এক যুগ পূর্তি অনুষ্ঠানে গত বছর ২ ডিসেম্বর রাঙামাটিতে বিশাল জনসভা হয়েছিল। চুক্তির এক যুগ পূর্তি উপলক্ষে জনসংহতি সমিতি একটি পুস্তিকা বের করেছিল। সেখানে লেখা আছে, এক. পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাহাড়ি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকার করা হলেও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, দুই. আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদের কাছে সাধারণ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলার সমন্বয়, তত্ত্বাবধান, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় পুলিশ, বন ও পরিবেশ, মাধ্যমিক শিক্ষা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হস্তান্তর করা হয়নি, তিন. ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের চুক্তিবিরোধাত্মক ধারা সংশোধন করা হয়নি, চার. ২০ দফা প্যাকেজ চুক্তি মোতাবেক ভারত থেকে প্রত্যাগত নয় হাজার ৭৮০ শরণার্থী পরিবার তাদের জমি ফেরত পায়নি, তাদের ৪০টি গ্রাম এখনো বহিরাগতদের দখলে, পাঁচ. অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি শরণার্থীদের পুনর্বাসন করা হয়নি, ছয়. বহিরাগতদের কাছে দেওয়া লিজ জমি বাতিল হয়নি, সাত. পাহাড়িদের অগ্রাধিকার দিয়ে চাকরিতে নিয়োগের বিধান কার্যকর হয়নি।
আবার ২ ডিসেম্বর সামনে চলে আসছে। গত এক বছরে এসব দাবির সামান্যতমও পূরণ হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর ওই দিনের সভায় বলা হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা হবে। কোনো পাহাড়ি কি সরকারের কাছে এ মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজের দাবি করেছে? পাহাড়ের প্রায় সব মানুষ, বিশেষত যারা আদিবাসী এই মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজ চায় না। এসব হোক, তবে এখন নয়। পাহাড়ের মূল বাসিন্দারা এতে উপকৃতও হবে না। চাকরিও তারা পাবে না, যেমন করে তারা চাকরি পায়নি কাপ্তাই বিদ্যুৎ প্রকল্পের সময়। তাদের ধারণা, এতে করে বহিরাগতদের জন্য আবার দুয়ার খুলে দেওয়া হবে। তার চেয়ে পাহাড়ে যে স্কুলগুলো আছে, সেগুলো উন্নত করা হোক। সেখানে প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকেরা যান না, ‘বর্গা শিক্ষক’ বলে একটি কথা অদ্ভুতভাবে সেখানে চালু আছে। মাধ্যমিক স্কুলগুলোর মান কী, গভীর পাহাড়ে কেন কোনো স্কুল নেই, এমনকি সরকারের কোনো কর্মকাণ্ডই নেই—এসব দিকে সরকার মনোযোগ দিতে পারে। পাহাড়ি মানুষের সঙ্গে অর্থপূর্ণ ও শ্রদ্ধাপূর্ণ আলোচনা করেই সবকিছু করা উচিত।
জাতিসংঘের আদিবাসী অধিবেশনে গিয়ে দেখেছি, আদিবাসীরা ‘উন্নয়ন গণহত্যা’ বলে একটি শব্দ ব্যবহার করছে। তারা বলেছে, ‘ডেভেলপমেন্ট ক্যান কিল।’ পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করে সেখানে আবার যদি বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজ হয়, এটি হত্যাই করবে তাদের। সেখানে তারা উপাচার্য হবে না, শিক্ষক হবে না, রেজিস্ট্রার হবে না, এমনকি ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৫ শতাংশও হবে না। তত দিনে পাহাড়ের বুকে তাদের আর খোঁজেই পাওয়া যাবে না। সে অবস্থা এখন হয়েছে গারো পাহাড়, খাসি অঞ্চল বা উত্তরবঙ্গে। জীবনের সঙ্গে জীবন মেলাতে না পারলে আমরা ভরসা করব কী নিয়ে? পাহাড়িরা অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে একসময় বলেছিল, জীবন আমাদের নয়। এখনো এখানে জীবনের নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়নের নিয়ন্ত্রণ ওদের হাতে নেই।
আপনারা পাহাড়ের মানুষদের আর কত দুঃখ দেবেন?
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।
এখন প্রশ্ন হলো, পাহাড়ের এই মানুষদের কাউকে কি এই সভায় ডাকা হয়নি? কেন ডাকা হয়নি? হয়তো পরে ডাকা হবে। আমি জানি না। কিন্তু আমার মন ভালো নেই। যত দূর জেনেছি, রাঙামাটিতে পাহাড়ি বন্ধুদের ফোন করে, তাঁদের কাউকে ডাকা হয়নি। তাঁদের মনেও অনেক দুঃখ, কষ্ট।
কবি শামসুর রাহমানের কথা মনে পড়ল। তাঁকে নিয়ে রাঙামাটি গিয়েছিলাম ১৯৯৮ সালে। পার্বত্য চুক্তির কয়েক মাস পর। সুবলং পর্যন্ত গিয়েছিলাম নদীপথে হ্রদের জলে ভেসে। দুই ধারে অপরূপ দৃশ্য। পাহাড়ি মানুষের জমিজমা হ্রদের জলে ভাসিয়ে দিয়ে, কাপ্তাই বাঁধের কারণে বিদ্যুৎ এসেছে সত্যি, কিন্তু আদিবাসীদের জীবন ছারখার হয়ে গেল। রাষ্ট্র নিজে এ রকম নিষ্ঠুর কাজ করতে পারে, এ কথা বলেছিলেন রাঙামাটির গৌতম দেওয়ান, তানভীর মোকাম্মেলের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র কর্ণফুলীর কান্নায়। তিনি বলেছেন, এই আদিবাসীরা বাঙালি বা মুসলমান হলে এ রকমভাবে ডুবিয়ে দেওয়া রাষ্ট্রের পক্ষে নিশ্চয়ই সম্ভব হতো না।
শামসুর রাহমান সে সময় একটি কবিতা লিখেছিলেন, ‘পাহাড়ের বুকে বয়ে যাক শান্তির সুবাতাস।’ তিনি আর বেঁচে নেই আমাদের মাঝে। কিন্তু আজ দুঃখিত মনে কবির কবিতা শোনাতে ইচ্ছে করছে, ‘কবিকে দিও না দুঃখ, দুঃখ দিলে সে-ও জলে-স্থলে হাওয়ায় হাওয়ায় নীলিমায় গেঁথে দেবে দুঃখের অক্ষর/ ...তাকে দুঃখ দিও না, চৌকাঠ থেকে দূরে দিও না ফিরিয়ে/ ফেরালে নক্ষত্র, চাঁদ করবে ভীষণ হরতাল/...নিমেষেই সব ফুল হবে নিরুদ্দেশ।’
বৈঠক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সরকারের প্রতি আস্থা রেখে যাঁরা অস্ত্র সমর্পণ ও চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, আমরা তাঁদের বিশ্বাস ভঙ্গ করতে পারি না।’ কথাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কথা এ পর্যন্ত বহুবার বলেছেন। বাস্তবতা হলো, তাঁর বর্তমান শাসনামলেরও দুই বছর হতে চলল। আর চুক্তির পর দুই যুগের বেশি সময় পার হয়েছে। আমি যত দূর জানি, এবার ক্ষমতায় আসার দুই বছরেও চুক্তি বিষয়ে জনসংহতি সমিতির সঙ্গে সরকারপ্রধানের একান্ত কোনো বৈঠক হয়নি। এটি যত দ্রুত হয়, ততই মঙ্গল। পাহাড়ি মানুষের মনে আশাজাগানিয়া খবর ছড়িয়ে দিতে হবে। বিশ্বাস ভঙ্গ কি হয়নি এক যুগ অতিক্রম করার পরেও? গত ১৬ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো ‘পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে পার্বত্যবাসীর সংশয়’ শিরোনামে সরেজমিন প্রতিবেদন ছাপিয়েছে চার দিন ধরে। আমি প্রতিবেদনের প্রথম কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি, ‘পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন সম্পর্কে ওই অঞ্চলের পাহাড়ি-বাঙালি নির্বিশেষে প্রায় সবাই সন্দিহান। আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবাই মনে করেন, এ চুক্তি বাস্তবায়িত হবে না।’ কেন মানুষের মধ্যে এই হতাশা তৈরি হলো?
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির এক যুগ পূর্তি অনুষ্ঠানে গত বছর ২ ডিসেম্বর রাঙামাটিতে বিশাল জনসভা হয়েছিল। চুক্তির এক যুগ পূর্তি উপলক্ষে জনসংহতি সমিতি একটি পুস্তিকা বের করেছিল। সেখানে লেখা আছে, এক. পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাহাড়ি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকার করা হলেও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, দুই. আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদের কাছে সাধারণ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলার সমন্বয়, তত্ত্বাবধান, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় পুলিশ, বন ও পরিবেশ, মাধ্যমিক শিক্ষা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হস্তান্তর করা হয়নি, তিন. ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের চুক্তিবিরোধাত্মক ধারা সংশোধন করা হয়নি, চার. ২০ দফা প্যাকেজ চুক্তি মোতাবেক ভারত থেকে প্রত্যাগত নয় হাজার ৭৮০ শরণার্থী পরিবার তাদের জমি ফেরত পায়নি, তাদের ৪০টি গ্রাম এখনো বহিরাগতদের দখলে, পাঁচ. অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি শরণার্থীদের পুনর্বাসন করা হয়নি, ছয়. বহিরাগতদের কাছে দেওয়া লিজ জমি বাতিল হয়নি, সাত. পাহাড়িদের অগ্রাধিকার দিয়ে চাকরিতে নিয়োগের বিধান কার্যকর হয়নি।
আবার ২ ডিসেম্বর সামনে চলে আসছে। গত এক বছরে এসব দাবির সামান্যতমও পূরণ হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর ওই দিনের সভায় বলা হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা হবে। কোনো পাহাড়ি কি সরকারের কাছে এ মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজের দাবি করেছে? পাহাড়ের প্রায় সব মানুষ, বিশেষত যারা আদিবাসী এই মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজ চায় না। এসব হোক, তবে এখন নয়। পাহাড়ের মূল বাসিন্দারা এতে উপকৃতও হবে না। চাকরিও তারা পাবে না, যেমন করে তারা চাকরি পায়নি কাপ্তাই বিদ্যুৎ প্রকল্পের সময়। তাদের ধারণা, এতে করে বহিরাগতদের জন্য আবার দুয়ার খুলে দেওয়া হবে। তার চেয়ে পাহাড়ে যে স্কুলগুলো আছে, সেগুলো উন্নত করা হোক। সেখানে প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকেরা যান না, ‘বর্গা শিক্ষক’ বলে একটি কথা অদ্ভুতভাবে সেখানে চালু আছে। মাধ্যমিক স্কুলগুলোর মান কী, গভীর পাহাড়ে কেন কোনো স্কুল নেই, এমনকি সরকারের কোনো কর্মকাণ্ডই নেই—এসব দিকে সরকার মনোযোগ দিতে পারে। পাহাড়ি মানুষের সঙ্গে অর্থপূর্ণ ও শ্রদ্ধাপূর্ণ আলোচনা করেই সবকিছু করা উচিত।
জাতিসংঘের আদিবাসী অধিবেশনে গিয়ে দেখেছি, আদিবাসীরা ‘উন্নয়ন গণহত্যা’ বলে একটি শব্দ ব্যবহার করছে। তারা বলেছে, ‘ডেভেলপমেন্ট ক্যান কিল।’ পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করে সেখানে আবার যদি বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজ হয়, এটি হত্যাই করবে তাদের। সেখানে তারা উপাচার্য হবে না, শিক্ষক হবে না, রেজিস্ট্রার হবে না, এমনকি ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৫ শতাংশও হবে না। তত দিনে পাহাড়ের বুকে তাদের আর খোঁজেই পাওয়া যাবে না। সে অবস্থা এখন হয়েছে গারো পাহাড়, খাসি অঞ্চল বা উত্তরবঙ্গে। জীবনের সঙ্গে জীবন মেলাতে না পারলে আমরা ভরসা করব কী নিয়ে? পাহাড়িরা অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে একসময় বলেছিল, জীবন আমাদের নয়। এখনো এখানে জীবনের নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়নের নিয়ন্ত্রণ ওদের হাতে নেই।
আপনারা পাহাড়ের মানুষদের আর কত দুঃখ দেবেন?
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।
No comments