গদ্যকার্টুন-কত দূর উঠতে পারে একজন বাঙালি? by আনিসুল হক

আমার উচ্চতাভীতি আছে। আমি এমনকি সাত তলার জানালার কাছে যেতেও ভয় পাই। বিমানের জানালা দিয়ে তাকালে হূদযন্ত্র বন্ধ হয়ে আসে। আমি যে বেশি দূর উঠতে পারব না, সে তো সহজবোধ্য। কিন্তু বাঙালি কত দূর উঠতে পারে, তা খানিকটা আঁচ তো করতেই হবে।


যে কারণে মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট বিজয়ের খবর সংগ্রহ করতে কাঠমান্ডু গিয়ে বিশেষ বিমানে চড়ে এভারেস্টসহ হিমালয়ের চূড়া দূর থেকে নিরীক্ষণ করার মতো মহাদুঃসাহসিক অভিযানে অংশ নিয়েছি। এ বিষয়ে এই ক্ষুদ্র লেখকের একটি সামান্য রম্যরচনা প্রথম আলোর বিশেষ ঈদ উপহার ২০১০ (্ঈদুল ফিতর সংখ্যা)-এ সচিত্র প্রকাশিত হয়েছে।
এবার পড়লাম আরেকটা বিপদে। আমেরিকার শিকাগো শহরে এসেছি। এই শহরেই মেঘ ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে সিয়ারস টাওয়ার (অধুনা এর নাম মালিকানা বদলের কারণে হয়েছে উইলিস টাওয়ার)। এটা আমেরিকার সবচেয়ে উঁচু ভবন। বহুদিন এটাই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ভবন। ১১০ তলা (ফ্লোর ১১৩টা)। আর এই ভবন তৈরির পেছনে যে প্রকৌশলীর অবদান সবচেয়ে বেশি, তাঁর নাম ফজলুর রহমান খান, যাঁর কিনা জন্ম হয়েছিল ঢাকায়, আর যিনি কিনা ঢাকা প্রকৌশল মহাবিদ্যালয়েরই ছাত্র ছিলেন, এখন যেটাকে আমরা বুয়েট বলে থাকি। যাঁর বাবা ছিলেন জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ। এখন এই শিকাগো শহরে এসে আমি কি সিয়ারস টাওয়ারে না উঠেই ফিরে যাব? এক বাঙালি ১১০ তলা ভবন নির্মাণের প্রকৌশল নকশা উদ্ভাবন ও রচনা করতে পারলেন, আর এক বাঙালি সেই ১১০ তলা পর্যন্ত লিফটে করে উঠতে পারবে না? ওরে ভীরু ...
যা থাকে কপালে। আজ উঠতেই হবে। পারব পারব। আগের রাতে তরুণ গল্পকার প্রকৌশলী তানিম হুমায়ূন সহযোগে আরেকটা আকাশচুম্বী অট্টালিকার ছাদে উঠে মহড়া দিয়ে এসেছি। যাকে বলে ড্রেসড রিহার্সাল। ওটা ১০০ তলা, ওটার নাম জন হ্যানকক টাওয়ার, ওটারও প্রকৌশলী ফজলুর রহমান খান। লিফটে কানের মধ্যে একটু শব্দ করে, এ ছাড়া আর কোনো অসুবিধা হয়নি। রাতের শিকাগো দেখা হলো অনেক ওপর থেকে। কিন্তু মনকে বুঝতেই দিইনি যে অত ওপরে উঠেছি। কাচের জানালার কাছাকাছিই হইনি। তাকিয়েছি দূর থেকে...সাহস ছিল না কোনো ঝরনাজলে লুণ্ঠিত হওয়ার। না, জলে আমি ভয় পাই না। সাহস ছিল না কোনো উঁচু ভবনের রেলিংয়ের কাছাকাছি হওয়ার।
সিয়ারস টাওয়ারের (উইলিস টাওয়ার) নিচে এসেছি। আমার সঙ্গে আছেন বুয়েটের আরেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী প্রবাসী প্রকৌশলী মাহমুদ হাসান চৌধুরী। টিকিট কেটে ভবনের নিচে হাঁটছি। প্রথমেই বিভিন্ন ভাষায় স্বাগত লেখা, তাতে বাংলাও আছে। যদিও এরা ‘স’ আর ‘ব’ একত্র করতে পারেনি। তবুও ওটা যে ‘বাংলা’ আর ‘স্বাগত’, তাতে কোনো ভুল নেই। তারপর একটা প্রেক্ষাগৃহ চোখে পড়ল, যেখানে এই ভবনের পরিচিতি প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে দেখানো হচ্ছে।
আমরা গ্যালারিতে বসে পড়তেই বলা শুরু হলো, ‘এফ আর খান ১৯৫৫ সালে এই কোম্পানিতে এসে যোগ দেন। তাঁকে বলা হয় স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আইনস্টাইন।’ ফজলুর রহমান খানের ছবি দেখানো হচ্ছে। তিনি যে এ ধরনের উঁচু ভবন তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করে একে সম্ভবপর করে তুলেছিলেন, সে ব্যাপারে এরা বিস্তারিত করে বলছে।
আমার বুক ফুলে-ফেঁপে উঠতে লাগল। আমি তো শিকাগোতে আমাদের গাড়ি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আকাশরেখায় সিয়ারস টাওয়ার দেখেই বলে উঠেছি, ওইটা তো মনে হচ্ছে সিয়ারস টাওয়ার, তাই না? তোমরা জানো, এর প্রকৌশলী কে? ফজলুর রহমান খান। আমাদের আন্তর্জাতিক লেখকেরা কেউ জানতেন না, এখন জানতে বাধ্য হলেন।
প্রামাণ্যচিত্রটা বেশি বড় নয়। শেষ হলে প্রথম অংশ দেখার জন্য আরেকটুক্ষণ বসে রইলাম। প্রথম থেকে দেখা শুরু করে সেই ফজলুর রহমান খানের বন্দনা অংশটা পুনঃ দর্শন করলাম। এসব জিনিস বারবার দেখা যায়। যেমন বারবার দেখেও সাধ মেটে না নিউজিল্যান্ড বনাম বাংলাদেশ সর্বশেষ একদিনের ম্যাচগুলোর শেষ ওভার। তামিম ইকবাল এখন উইজডেনের চোখে পৃথিবীর বর্ষসেরা টেস্ট খেলোয়াড়। সাকিব আল হাসান এই গ্রহের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন, যিনি কিনা এর আগে উইজডেনের ওই স্বীকৃতির মালাটা গলায় ঝুলিয়েছেন। বাঙালি অনেক উঁচুতেই তো উঠতে পারে। আরোহণ করতে পারে শীর্ষবিন্দুতে।
ফজলুর রহমান খান (১৯২৯-১৯৮২) টিউব স্ট্রাকচারাল পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। যেটা প্রয়োগ করে গগনচুম্বী ভবন বানানো সম্ভব হয়। এমনকি এখন দুবাইয়ে যে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ভবন বুর্জ খলিফা তৈরি হয়েছে, সেটার পেছনে আছে ফজলুর রহমান খানের পদ্ধতিটি। ২০১০ সালের ৫ জানুয়ারি ডেইলি টেলিগ্রাফ-এ স্টিফেন বেইলি লিখেছেন, ‘খান ভবনকে উঁচু বানানোর নতুন পথ আবিষ্কার করেন। ইস্পাতের কাঠামোর যুক্তিকে তিনি উল্টে দিয়ে বলেন, ভবনের বাইরের দেয়ালটাকে যদি উপযুক্তভাবে মজবুত করা হয়, সে নিজেই একটা কাঠামো হতে পারে...তার এই আশ্চর্য দৃষ্টিভঙ্গি গগনচুম্বী ভবন নির্মাণের অর্থনীতি ও গঠন বদলে দেয়। গত বছর ওবামার বিখ্যাত কায়রো বক্তৃতায়ও এফ আর খানের নাম নেওয়া হয়েছে। তাঁর কারণেই বুর্জ খলিফায় সম্ভবত এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের অর্ধেক ইস্পাত লেগেছে এবং এটা সম্ভবপর হয়েছে।’
ফজলুর রহমান খান অনেক স্বীকৃতি পেয়েছেন। ১৯৭২ সালের কনস্ট্রাকশন ম্যান অব দি ইয়ার হয়েছেন। এই তালিকা অনেক দীর্ঘ। সেসব মনে করতে করতে আমরা গিয়ে লিফটের লাইনে দাঁড়াই।
লিফট উঠতে সময় নেবে এক মিনিট। এটা খুবই দ্রুতগামী। আমাদের প্রথম আলোর লিফট পঞ্চম তলায় উঠতে মোটামুটি মিনিট তিনেক সময় নেয়। আর এই লিফট ১১০ তলা উঠবে এক মিনিটে! দেখতে দেখতেই পার হয়ে যাবে এক মিনিট, নিজেকে সান্ত্বনা দিই। কিন্তু এক মিনিটে যে ৬০ সেকেন্ড, সেটা এখন টের পাচ্ছি। আর লিফটটা দুলছে। উফ ছিঁড়ে পড়বে না তো?
আর কতক্ষণ লাগবে? কত দূর আর কত দূর বলো মা?
না এসে গেছি। আমরা ছাদের ওপরের কাচঘেরা প্রদর্শনীতলায় ঢুকে পড়লাম। শিকাগো শহর দেখতে লাগলাম কাচের ভেতরে থেকে। ওই যে লেক মিশিগান। একটা জায়গা আছে, যেখানে পায়ের নিচে কংক্রিট নয়, সম্পূর্ণ স্বচ্ছ কাচ। আর তার ১৭০০ ফুট নিচে সরাসরি নিচতলার রাস্তাঘাট ফুটপাত। আর কোনো ফ্লোর নেই। মাহমুদ ভাই সেই কাচের মেঝের ওপরে গেলেন। আমাকে বলেন, আসেন আসেন ছবি তুলি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কি ওই কাচের স্বচ্ছ মেঝের ওপরে উঠেছিলাম, কি উঠিনি!
আমি যখন বেঁচে আছি, আর এই লেখাটা লিখছি, তখন নিশ্চিন্ত থাকুন, ওই কাচের ওপরে আমি উঠিনি। উঠলে আমি ওখানেই অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে যেতাম। তবে কাচটার খুব কাছে গিয়ে সরাসরি নিচে তাকিয়েছি, আমার পায়ের তলা এখনো সে কথা ভাবতেই শিরশির করে উঠছে।
লিফটে করে নিচে নেমে এলাম। এইবার আসা গেল সেই বিখ্যাত ফজলুর রহমান খান ওয়েতে। তাঁর নামে একটা পথের নামকরণ করা হয়েছে। আর সেখানেই ফজলুর রহমান খানের একটা চমৎকার ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে, যেখানে ধাতব-অক্ষরে খোদিত আছে, ইলিনয়ের কাঠামো প্রকৌশলী অ্যাসোসিয়েশন ফজলুর রহমান খানকে আমাদের সময়ের অন্যতম সেরা কাঠামো প্রকৌশলীর স্বীকৃতি দিচ্ছে। তাঁর পরিচিতি হিসেবে খোদিত আছে, ‘কাঠামো প্রকৌশলী, মানবতাবাদী, শিক্ষাবিদ।’
সেই ফজলুর রহমান খান ওয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে ভাবি, সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে উঠেও এই মানুষটি তাঁর দেশকে ও মানুষকে ভোলেননি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, সংগঠন গড়ে তুলেছেন প্রবাসে, অর্থ সংগ্রহ করেছেন। তিনি গান পছন্দ করতেন, রবীন্দ্রসংগীত ছিল তাঁর প্রিয়, আর তিনি নিজেও রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারতেন। তাঁর আরেকটা উক্তি ধাতব অক্ষরে বাঁধাই করে রাখা আছে, ‘প্রযুক্তিবিদের অবশ্যই তার প্রযুক্তির মধ্যে হারিয়ে যাওয়া উচিত নয়, তাকে অবশ্যই জীবনকে তারিফ করতে পারতে হবে। আর জীবন হচ্ছে শিল্প, নাটক, সংগীত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ...মানুষ।’
খোলা আকাশের নিচে এসে দাঁড়াই। সিয়ারস টাওয়ারের চূূড়ার দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাই। উরে বাপস! চূড়া কি দেখা যায়? শিল্প, নাটক, সংগীত আর মানুষের পূজারি বাঙালি লোকটা কী কাণ্ডটাই না করে রেখেছেন? বাঙালি কত উঁচুতে উঠতে পারে, কত উঁচুতে...
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.