চারদিক-বাইশ্যা নাচ by মৃত্যুঞ্জয় রায়

সকাল ১০টার সূর্যও প্রখর তাপ ছড়াচ্ছে। আকাশে দলা দলা কালো-সাদা মেঘও জমছে। সেসব মেঘের মধ্যে সকালের সূর্যটা লুকোচুরি খেলছে। বোশেখের এই মেঘ দেখে আমারও বুক কাঁপছে। আজই সেই বিশাল বিশাল সব নদী পেরিয়ে মনপুরা থেকে ঢাকায় ফিরতে হবে। ঝড়-বাতাস হলেই বিপদ। একবার লঞ্চ ডুবলে ভবলীলা সাঙ্গ হবে।


তাই দ্রুত সোনারচর চৌধুরীর বাংলোবাড়ি থেকে বেরিয়ে পুবের রাস্তা ধরলাম। মোটরবাইকে খানিকটা গিয়েই একটা ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের পাশে থামলাম। সোনারচর থেকে পুবদিকে বলে গ্রামের নাম পূর্ব সোনারচর। গ্রামটা হিন্দু অধ্যুষিত। মনপুরায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন খুব কমই আছে। যারা আছে, তারা সমগ্র মনপুরা দ্বীপে শরৎকালে মাত্র ছয়খানা দুর্গাপূজা করে। চারখানা পূজা মনপুরা ইউনিয়নেই হয়, একখানা হয় হাজিরহাট ইউনিয়নে এবং অন্যখানা হয় সাকুচিয়া ইউনিয়নে। মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনও উৎসাহ- উদ্দীপনার সঙ্গে দুই ঈদ উদ্যাপন করে। প্রায় প্রতিটি গ্রামেই ঈদের জামায়াত হয়। মনপুরায় কোনো আদিবাসী বা উপজাতি নেই। অথচ রাখাইনদের থাকাটা বিচিত্র ছিল না।
পূর্ব সোনারচর ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র পেরিয়ে সবিতা রানীর বাড়ির উঠানে গিয়ে বসলাম। উঠানে একটা চেয়ার নিয়ে বসে মনে মনে ঢাকায় ফেরার ছক আঁকছি। এমন সময় টুম টুম করে কী যেন বেজে উঠল। বাদ্যির আওয়াজ। কীসের বাদ্যি? সবিতা বললেন, ‘বাইশ্যা নাচের দল আসছে।’ ঠিকই দেখলাম পরক্ষণে একদল ছোকরা-ছুকরি রং মেখে সঙ সেজে সবিতা দিদির উঠানে এসে নাচতে শুরু করেছে। ছোকরা-ছুকরিদের বয়স আট-দশ বছর হবে, বারোর বেশি কারোরই বয়স হবে না। তারা প্রথমে দুটি দলে ভাগ হয়ে গেল। এক দলে শিব ও তাঁর দুই পত্নী গৌরী ও গঙ্গা। অন্য দলে বাইশ্যা, পাগলি ও তার বাদক দল। বাইশ্যার হাতে কালি মাখা এক খণ্ড বাঁশ। পাগলি নাচতে নাচতে গান গাইছে—
নমঃ নমঃ নমঃ শিবরে
সদাই শিব মহাদেবরে
নমঃ অধিকারীরে
খাইতে খাইতে মিষ্ট লাগে
আরো আনো দইরে
গইরা লাগে শিবের বাপও নাইরে...।

সত্যিই তো, শিবের বাপ কে? গান গাইতে গাইতে বেঢপ নাচ নাচছে সবাই। গানও বেসুরো। ওদের সঙ্গে একটা ঝাঁকা ও থলে। শিব দুই পাশে তাঁর দুই পত্নীকে নিয়ে উঠানে বসে আছেন। শিবের সামনে একটা গ্লাসের ভেতর ফুল ও জল, মনে হয় ওটা ঘটের প্রতিরূপ। বাইশ্যার হাতের বাঁশ নাচ ও গানের ছন্দে ছন্দে ঘুরছে। সবিতা দিদি বললেন, ‘ওরা প্রতিবছরই এ সময় বাড়ি বাড়ি ঘুরে এ কাণ্ড করে বেড়ায়। ওরা এ গ্রামেরই ছেলেমেয়ে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে নাচ দেখায়, শিবের গান গায় আর প্রতিটি বাড়ি থেকে যে যা দেয়, তা ওই থলেয় পুরে নেয়। কেউ নারকেল দেয়, কেউ চাল দেয়, কেউ দেয় কলা। টাকা-পয়সাও কেউ কেউ দেয়। লোকজনের কাছ থেকে এটা-ওটা নেওয়াকে ওরা বলে মাগন মাঙা। সারা দিনের মাগন নিয়ে ওরা শিব ঠাকুরের কাছে যায়, সেখানে দেবতার ভোগ দেয়, খিচুড়ি রেঁধে সবাই খায়, বাড়ি বাড়ি বিলায়। গাঁয়ের শিশুরা সেসব খেয়ে খুব ফুর্তি করে। কী করবে গ্রামের শিশুরা? ওদের তো আনন্দ করার মতো তেমন কিছু নেই, তাই এটা-ওটা করে আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করে। এখন আমাদের ছোটবেলার মতো দাড়িয়াবান্ধাও কেউ খেলে না। এখন খেলে ক্রিকেট।’
সবিতা দিদি কথা বলছেন আর সোনামুগের শুঁটি রোদে দিচ্ছেন। সেই ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজে কোনো বিশ্রাম নেই। বারান্দায় লাউয়ের শাক পড়ে আছে। হয়তো কিছুক্ষণ পরই ওগুলো কাটতে বসবেন। সবিতা দিদিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর কী কী অনুষ্ঠান হয় এ গ্রামে? কী কী পূজা করেন?’ বললেন, ‘গ্রামে আমরা প্রায় সব পূজাই করি। দুর্গা আর কালীপূজা করি সবাই মিলে। ঘরোয়াভাবে করি লক্ষ্মীপূজা, সরস্বতীপূজা, শনি ঠাকুরের পূজা, দোলপূজা, জন্মাষ্টমী ইত্যাদি। বোশেখ মাসে নানা রকম ব্রতও পালন করি।’
বাইশ্যা দলের নাচ দেখে মনে হলো, এ গ্রামে নিশ্চয়ই চৈত্রসংক্রান্তিতে শিবের গাজন গান হয়, নীলপূজাও হয়। বড়রা হর-পার্বতী সেজে সন্ন্যাসীদের নিয়ে শিবের গাজন গান ও নৃত্য করেন। ওদের দেখাদেখি গ্রামের শিশুরা শেখে এবং মজা করার জন্য ওদের মতো রং-সঙ সেজে বাড়ি বাড়ি নাচতে বের হয়। ভুল কথা, ভুল সুর আর বেঢপ নাচে অনেককে মজা দেয়, নিজেরাও মজা পায়। মনে পড়ল ভারতের মালদা-বীরভূমের গয়রা নাচের কথা। সেই নাচই কি মনপুরায় এসে হয়ে গেছে গরয়া? দেবতাদের মুখোশের বদলে গাতকদের মুখে উঠেছে রং-কালির প্রলেপ? ভাবলাম, থাক, সংস্কৃতির জনরূপান্তরে না গিয়ে বরং শিশুদের নির্মল আনন্দটুকু উপভোগ করি। দেখতে দেখতে নাচ শেষ হলো। উঠব। কিন্তু শিব এসে আমার পথ আগলে দাঁড়াল, কিছু চাই। বাব্বা! এ যুগের শিবেরও তাহলে কিছু দরকার? হেসে ১০টা টাকা শিবের হাতে তুলে দিলাম। ওতেই যেন ওদের খুশি দশ দিকে ছড়িয়ে পড়ল।

No comments

Powered by Blogger.