চারদিক-‘থপ দো ভতিউ, থপ দো সু’ by শিখ্তী সানী
‘থপ দো ভতিউ, থপ দো সু।’ শুনেই কান খাড়া হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখি, ঠিক ১১-১২ বছরের একটা ছেলে ভিড় ঠেলে এক বিদেশিকে নিয়ে চলছে, আর অনবরত কী যেন বলে চলেছে। বেলা দুইটা। আজিজ সুপার মার্কেটের সামনে অসংখ্য যাওয়া-আসা মানুষের ভিড়ে কাউকে চোখে চোখে রাখা কঠিন।
হঠাৎ আবার আক্কেলগুড়ুম—‘ম্যঁসিয় ম্যাগাস, সে সা?’ ব্যস, অল্পবিস্তর ফরাসি ভাষা জানা আছে। ছেলেটা কি ফরাসি ভাষাতেই কথা বলছে, না আমার মতিভ্রম! খুঁজে খুঁজে বিদেশি পর্যটকের দেখা মিলল। পাশে তাঁর উচ্চতার তিন ভাগের এক ভাগ সমান ছেলেটাকে। সে তখনো কথা বলে যাচ্ছে। পরিষ্কার শোনা গেল এবার। ছেলেটা আসলেই ফরাসি আর ইংরেজি ভাষা মিলিয়ে গাইড হয়েছে বিদেশির। অবাক চাহনি দেখে হয়তো মজা নিতেই বলে উঠল, ‘বিয়াভনু মাদমোয়াজেল’ অর্থাৎ স্বাগত। ব্যস্ততা দেখে কথাই হচ্ছিল না। তবুও পেছনে পেছনে অনুসরণ করছিলাম ওদের। দোকানে সদাইপত্র পছন্দ হলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে দরদামে ব্যস্ত ইসহাক নামের ছোট ছেলেটি। ফাঁকে ফাঁকেই রহস্য ভাঙল। জেমস লোফার্ত নামের সাহেবটি এসেছেন ফ্রান্সের তুলো শহর থেকে। ইসহাকের সঙ্গে পরিচয় তাঁর এক বাংলাদেশি বন্ধুর মাধ্যমে। তিন দিন হলো ইসহাককে নিয়েই ঢাকা ভ্রমণ আর সদাইপাতি। আর ইসহাক—লিখতে পারে না, পড়তে পারে না, কিন্তু গড়গড় করে ইংরেজি, হিন্দি, ফরাসি আর আরবি বলতে পারে, তবে ভাঙা ভাঙা।
‘শিখলে কোথা থেকে?’
হেসে উড়িয়ে দেয়। ‘এই থেকে সেই থেকে।’ বেশিক্ষণ আর ধরে রাখা গেল না ওকে, ওরাও বেশি আগ্রহী নয়। বারবার ‘মেগজি, আভনতিউ’ বলে চলে গেল। মানে ‘ধন্যবাদ, আবার দেখা হবে।’
খোঁজ করে ইসহাককে আর পাওয়া গেল না ঠিকই, কিন্তু এমন অভিনব এই পেশার একটা দলকে পাওয়া গেল বঙ্গবাজার মার্কেটের সামনে। ওরা সংখ্যায় ২০-এর বেশি। মেরাজ, রোকসানা, সুজন, এরশাদ, বেবি, ইসমাইল, পারভীন, রিনা, শিল্পী, কলি, আকলিমাসহ অনেককে। শেষ বিকেলে ওরা সব অলস সময় কাটাচ্ছিল। মেরাজুল আলম মেরাজ, বয়স ১৭। মেরাজ বলতে পারে ইংরেজি, মালয়েশীয় ভাষা, ফরাসি, ইয়েমেন, কুয়েতের ভাষা ও আরবি। বিদেশি ক্রেতা এ বাজারে এলে ডাক পড়ে যায় তাদের। ওরা সাহেব-আপাদের সঙ্গে কেনাকাটা করায় সাহায্য করে। গাইডের কাজ করে দেয়। যাওয়ার আগে খুশি হয়ে যা দেয় তাতেই ওরা সন্তুষ্ট। ৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। কখনো আবার ছোটখাটো উপহার—চকলেট, শ্যাম্পু, ক্রিম, মেকআপ-সামগ্রী। সাহেব-আপারা নিজেরাই ওদের খুঁজে নেয়। বঙ্গবাজারের পাশাপাশি শহরের বড় বিপণিগুলোতেও সঙ্গে গাইড হিসেবে ওদের নিয়ে যায়। দোকানদারদের সঙ্গে দরদাম করা, কেনা পণ্যটির সমস্যা খুঁজে বের করা, অলিগলি চিনিয়ে ঠিক জায়গায় নিয়ে যাওয়া—সব তাদের দায়িত্ব। কখনো কখনো দোকানদারদের সঙ্গে ঝগড়াও লেগে যায়। অনেকে ওদের দেখে বিরক্তও হয়। কারণ, তারা অনেকে এখনো পর্যটকদের সঙ্গে সৎ ব্যবহার করা শিখতে পারেনি। নিজেদের আতিথেয়তা ঠিকভাবে রক্ষা করা সম্ভব হয় না। গাইড হিসেবে এগুলোও দেখতে হয় তাদের। মুখে সব সময় হাসি লেগেই আছে ওদের। মজা করা, হাসাহাসি করতে করতেই দিন চলে যায়। মাসে মোট কত টাকা কামাই হয় এর হিসাব থাকে না। পরিমাণটা অবশ্য খুব বেশিও নয়। তাই টাকা জমানো নয়। সপ্তাহে চার-পাঁচজন পর্যটকের খোঁজ পাওয়া যায়। কখনো আরও কম। শীতের মৌসুমে সংখ্যাটা বেশ বেড়ে দাঁড়ায়। অনেকের সঙ্গে খুব ভাব হয়ে যায় ওদের। তারাই এসে ওদের খুঁজে নেয়। এখানে সবাই আট-নয়টা ভাষায় কথা বলতে পারে। অথচ পড়তে বা লিখতে পারে না কেউই। তাই বলছিল, ‘লেখতে-পড়তে পারলে তো লন্ডনেই চইলা যাইতাম।’
কীভাবে বলে এত ভাষা? হেসে নিজেদের মধ্যে আরবি ভাষায় আড্ডা মাতিয়ে দিল। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ওদের দিকে। এ ছাড়া উপায় কী! আরবি তো জানি না। ওদের এত দ্রুত আলাপে একটা বর্ণও উদ্ধার হলো না আমার। হেসে একজন বলল—‘সা ভা বিয়া?’ ফরাসিতে এর মানে হলো ‘ভালো আছ?’
অভিনব এ দোভাষী আর গাইডরা এ পেশায় অনেক দিন। কীভাবে শিখলে এ ভাষা? জীবিকার দায়ে ঘুরতে ঘুরতে অভিনব এ পেশায় আগ্রহ থেকে ভাষা শেখা। তারপর পর্যটকদের কাছ থেকেও নতুন শব্দভান্ডার এসে যোগ হয়। এভাবেই শেখা হয়। আর জীবিকার প্রয়োজন মানুষকে সব কাজেই পারদর্শী করে তোলে। তবে আক্ষেপ আর কষ্টের তালিকাটিও বড়। অনেকেই ওদের কথা শোনে, ওদের খবর নিয়ে ছাপায়, কিন্তু কী বদলেছে ওদের? সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কার্ড নেই ওদের। কার্ড না থাকলে প্রতিনিয়ত বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় এ পেশাজীবীদের। অনেক বিদেশি পর্যবেক্ষক মানতেই চায় না। কার্ড দেখতে চায়।
তবুও পেটের দায়ে ওরা এই কাজ করে, করতেই থাকে।
‘শিখলে কোথা থেকে?’
হেসে উড়িয়ে দেয়। ‘এই থেকে সেই থেকে।’ বেশিক্ষণ আর ধরে রাখা গেল না ওকে, ওরাও বেশি আগ্রহী নয়। বারবার ‘মেগজি, আভনতিউ’ বলে চলে গেল। মানে ‘ধন্যবাদ, আবার দেখা হবে।’
খোঁজ করে ইসহাককে আর পাওয়া গেল না ঠিকই, কিন্তু এমন অভিনব এই পেশার একটা দলকে পাওয়া গেল বঙ্গবাজার মার্কেটের সামনে। ওরা সংখ্যায় ২০-এর বেশি। মেরাজ, রোকসানা, সুজন, এরশাদ, বেবি, ইসমাইল, পারভীন, রিনা, শিল্পী, কলি, আকলিমাসহ অনেককে। শেষ বিকেলে ওরা সব অলস সময় কাটাচ্ছিল। মেরাজুল আলম মেরাজ, বয়স ১৭। মেরাজ বলতে পারে ইংরেজি, মালয়েশীয় ভাষা, ফরাসি, ইয়েমেন, কুয়েতের ভাষা ও আরবি। বিদেশি ক্রেতা এ বাজারে এলে ডাক পড়ে যায় তাদের। ওরা সাহেব-আপাদের সঙ্গে কেনাকাটা করায় সাহায্য করে। গাইডের কাজ করে দেয়। যাওয়ার আগে খুশি হয়ে যা দেয় তাতেই ওরা সন্তুষ্ট। ৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। কখনো আবার ছোটখাটো উপহার—চকলেট, শ্যাম্পু, ক্রিম, মেকআপ-সামগ্রী। সাহেব-আপারা নিজেরাই ওদের খুঁজে নেয়। বঙ্গবাজারের পাশাপাশি শহরের বড় বিপণিগুলোতেও সঙ্গে গাইড হিসেবে ওদের নিয়ে যায়। দোকানদারদের সঙ্গে দরদাম করা, কেনা পণ্যটির সমস্যা খুঁজে বের করা, অলিগলি চিনিয়ে ঠিক জায়গায় নিয়ে যাওয়া—সব তাদের দায়িত্ব। কখনো কখনো দোকানদারদের সঙ্গে ঝগড়াও লেগে যায়। অনেকে ওদের দেখে বিরক্তও হয়। কারণ, তারা অনেকে এখনো পর্যটকদের সঙ্গে সৎ ব্যবহার করা শিখতে পারেনি। নিজেদের আতিথেয়তা ঠিকভাবে রক্ষা করা সম্ভব হয় না। গাইড হিসেবে এগুলোও দেখতে হয় তাদের। মুখে সব সময় হাসি লেগেই আছে ওদের। মজা করা, হাসাহাসি করতে করতেই দিন চলে যায়। মাসে মোট কত টাকা কামাই হয় এর হিসাব থাকে না। পরিমাণটা অবশ্য খুব বেশিও নয়। তাই টাকা জমানো নয়। সপ্তাহে চার-পাঁচজন পর্যটকের খোঁজ পাওয়া যায়। কখনো আরও কম। শীতের মৌসুমে সংখ্যাটা বেশ বেড়ে দাঁড়ায়। অনেকের সঙ্গে খুব ভাব হয়ে যায় ওদের। তারাই এসে ওদের খুঁজে নেয়। এখানে সবাই আট-নয়টা ভাষায় কথা বলতে পারে। অথচ পড়তে বা লিখতে পারে না কেউই। তাই বলছিল, ‘লেখতে-পড়তে পারলে তো লন্ডনেই চইলা যাইতাম।’
কীভাবে বলে এত ভাষা? হেসে নিজেদের মধ্যে আরবি ভাষায় আড্ডা মাতিয়ে দিল। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ওদের দিকে। এ ছাড়া উপায় কী! আরবি তো জানি না। ওদের এত দ্রুত আলাপে একটা বর্ণও উদ্ধার হলো না আমার। হেসে একজন বলল—‘সা ভা বিয়া?’ ফরাসিতে এর মানে হলো ‘ভালো আছ?’
অভিনব এ দোভাষী আর গাইডরা এ পেশায় অনেক দিন। কীভাবে শিখলে এ ভাষা? জীবিকার দায়ে ঘুরতে ঘুরতে অভিনব এ পেশায় আগ্রহ থেকে ভাষা শেখা। তারপর পর্যটকদের কাছ থেকেও নতুন শব্দভান্ডার এসে যোগ হয়। এভাবেই শেখা হয়। আর জীবিকার প্রয়োজন মানুষকে সব কাজেই পারদর্শী করে তোলে। তবে আক্ষেপ আর কষ্টের তালিকাটিও বড়। অনেকেই ওদের কথা শোনে, ওদের খবর নিয়ে ছাপায়, কিন্তু কী বদলেছে ওদের? সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কার্ড নেই ওদের। কার্ড না থাকলে প্রতিনিয়ত বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় এ পেশাজীবীদের। অনেক বিদেশি পর্যবেক্ষক মানতেই চায় না। কার্ড দেখতে চায়।
তবুও পেটের দায়ে ওরা এই কাজ করে, করতেই থাকে।
No comments