কালের পুরাণ-দল চলছে, রাজনীতি চলছে, দেশটা চলছে তো! by সোহরাব হাসান
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নবনির্বাচিত কর্মকর্তাদের অভিষেক ও শপথ অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। তাঁর এ আশ্বাসবাণী সব না হলেও অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্বস্ত করবে।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নিশ্চয়ই জানা আছে, একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা অভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে যুদ্ধ করলেও স্বাধীনতার পর তাঁদের অনেকেরই মত ও পথ আলাদা হয়ে গেছে। দেশের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের অপরিসীম ত্যাগ ও অবদান স্বীকার করেও বলছি, তাঁদের জীবনযাপনের সচ্ছলতা কিন্তু বৃহত্তর জনগণের সচ্ছলতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশে পূর্বাপর সরকারগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক সুবিধা দিতে কার্পণ্য করেনি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন, কর্মসংস্থান ও কল্যাণে ৩৩টি লাভজনক শিল্প ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান দিয়েছিল, যার আয় দিয়ে তাঁদের সচ্ছল জীবনযাপন নিশ্চিত করা যেত। কিন্তু কয়েক বছর না যেতেই আমরা দেখলাম, প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমাগত লোকসান গুনছে, অনেকগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। জমি, সম্পত্তি এমনকি আসবাবও বিক্রি করে দিতে হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারাই এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন; তার পরও এই লোকসান কেন হলো, সেটি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এই যে জাতীয় সম্পদ ও অর্থের অপচয়, এ জন্য আমরা কাকে কাকে দুষব?
নতুন সরকার এলেই মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নানা সাইনবোর্ড দেখা যায়, কমিটি গঠন নিয়ে মারামারি হয়, মধ্যরাতে কার্যালয় দখল হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন তালিকা তৈরি করা হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বলা হয়, বিএনপি সরকার তাদের সমর্থক মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করেছে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে বলা হয়, আওয়ামী লীগ তাদের পছন্দসই মুক্তিযোদ্ধাদের নাম তালিকাভুক্ত করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েও এই দলীয় রাজনীতি কত দিন চলবে?
মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, সে বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। দুস্থ ও দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আর্থিক সহায়তার ব্যাপারে কারও আপত্তি নেই। কিন্তু স্বাধীনতার ৩৯ বছর পরও যেভাবে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের চাকরির কোটা নির্ধারণ করা হচ্ছে, তা নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন আছে। বেকন মিজান নামের একজন পাঠক ২৮ অক্টোবর পাঠানো ই-মেইল বার্তায় লিখেছেন, ‘আপনার কি কখনো মনে হয়েছে যে, দেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, মানুষ কি কিছু পাওয়ার আশায় যুদ্ধ করেছিল? পরে কিছু আলাদাভাবে পাবে সে জন্য? না, তাঁরা সবাই দেশটা পাওয়ার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন?...যাঁরা যুদ্ধ করতে পারেননি তাদের কী অপরাধ? তাঁরা কি বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেননি? মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দুই লাখের মতো হবে। কিন্তু ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ যুদ্ধে জীবন দিয়েছেন। দুই লাখ মা-বোন নির্যাতিত হয়েছেন, তাদের কি কেউ খোঁজ নিয়েছেন? কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যেভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটায় তাঁদের নাতি-নাতনিদেরও সরকারি চাকরির কোটা দিচ্ছেন, তা কতটা যুক্তিসংগত?’
দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে দেড় লাখই (অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ভাতাভোগীর সংখ্যা এক লাখ ২৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে দেড় লাখ করার কথা বলেছেন, প্রথম আলো, ২৮ অক্টোবর) যদি সরকারের কাছ থেকে ভাতা পেয়ে থাকেন, তাহলে ৩০ লাখ শহীদ পরিবার কেন পাবে না? মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করে দেশ স্বাধীন করেছেন এবং বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে এসেছেন। তাঁদের অবদান জাতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে। পরবর্তীকালে অনেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু বেশির ভাগ শহীদ পরিবার প্রিয়জনের সঙ্গে তাদের সহায়সম্পত্তি সবই হারিয়েছে। স্বাধীনতার জন্য, দেশের জন্য যাঁরা জীবন দিয়েছেন তাঁদের অবদানকেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। মুক্তিযোদ্ধারা ভাতা পেলে শহীদ পরিবারগুলো কেন পাবে না? সবশেষে তিনি যে বিবেকজাগানিয়া কথাটি বলেছেন সেটি হলো, একাত্তরে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তাঁরা দেশ থেকে কিছু পাওয়ার জন্য করেননি, দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম থেকেই করেছেন। বেকন মিজানকে ধন্যবাদ জানাই। একই সঙ্গে তাঁর কথাটি সরকারকে ভেবে দেখতে বলব। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের কোটা বেঁধে দেওয়ায় যদি প্রকৃত মেধাবীরা সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হন, সেটিও দেশের ক্ষতি। অন্যভাবেও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে সহায়তা করা যায়।
২.
সরকারপ্রধান, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, ক্ষমতাসীন দলের নেতা—সবাই বলছেন, দেশ ঠিকমতো চলছে। বিরোধী দল ষড়যন্ত্র না করলে আরও ভালোভাবে চলত। তাঁদের এই কথার সঙ্গে বাস্তবের মিল থাকলে খুশি হতাম। সরকারকে প্রাণঢালা অভিবাদন জানাতাম। কিন্তু দুঃখিত। অভিবাদন জানাতে পারছি না। সরকারের মেয়াদ যেহেতু অর্ধেক পার হয়নি, সে জন্য পুরোপুরি নাকচও করছি না। এখনো অপেক্ষায় আছি সরকার ভালো কিছু করবে। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কিছুটা হলেও পূরণ করে প্রমাণ করবে, আওয়ামী লীগ বিএনপি থেকে ভালো শাসক। শোষক নয়, সেবক, অপদার্থ নয়, পদার্থ। তবে যতই দিন যাচ্ছে, আশা ফিকে হয়ে যাচ্ছে। তার পরও বলব, চূড়ান্ত রায় দেওয়ার জন্য আমাদের আরও তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে।
তবে এই মুহূর্তে দেশের পরিস্থিতিটা মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। বৃহস্পতিবারের পত্রিকায় অন্তত তিনটি উদ্বেগজনক খবর ছাপা হয়েছে। একই সঙ্গে দেশের জন্য লজ্জাজনকও।
প্রথম খবরটি বিমান নিয়ে। বৈমানিকদের কর্মবিরতিতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। দুই দিনের সব ফ্লাইট বাতিল। বিমান পরিচালনা বোর্ড বৈঠক করে জানিয়ে দিয়েছে, যেসব পাইলট কর্মসূচি পালন করছেন, তাঁদের স্বাভাবিক কর্মস্থলে যোগ দিতে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে যোগ না দিলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অন্যদিকে পাইলটরা বলেছেন, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত তাঁরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন না। কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন। বৈমানিকদের অবসরের বয়স ৫৭ থেকে বাড়িয়ে ৬২ বছর করার প্রতিবাদে এবং বিদেশি পাইলট নিয়োগ বাতিলের দাবিতে তাঁরা কর্মসূচি পালন করেন। বিমানের ১৬৬ জন বৈমানিকের পদের বিপরীতে ১১৭ জন কর্মরত আছেন। তাঁদেরও বেশির ভাগ কর্মবিরতি পালন করছেন। এ অবস্থায় হজ ফ্লাইট ছাড়া সব ফ্লাইট স্থগিত বা বাতিল করতে হচ্ছে।
দ্বিতীয় খবরটি রাজধানীর বস্তিবাসী ও নিম্নবিত্তদের জন্য নেওয়া ভাষানটেক পুনর্বাসন প্রকল্পসংক্রান্ত। ভূমি মন্ত্রণালয় ২০০৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর নর্থ সাউথ প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের (এনএসপিডিএল) সঙ্গে চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী পাঁচ বছরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা, তারা সাত বছরেও শেষ করতে পারেনি। ফলে ভাষানটেক বস্তি এলাকা থেকে উচ্ছেদকৃত লোকজনকে পুনর্বাসন করা যায়নি। সেখানে দরিদ্র জনগণের জন্য স্বল্প দামে ফ্ল্যাট নির্মাণ করার কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি জিমনেসিয়াম, সাইবার ক্যাফে, ওয়াশিং প্লান্ট, এনএসপিডিএল ক্যাটারিং স্থাপন করেছে। তিনতারা হোটেলের সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গৃহীত এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছিল মিরপুরে অবস্থিত একটি এনজিও। কিন্তু সরকার তাদের প্রস্তাব নাকচ করে এনএসপিডিএলের সঙ্গে চুক্তি করে। প্রক্রিয়া আওয়ামী লীগের আমলে শুরু হলেও চুক্তি হয় বিএনপির আমলে। এখন চুক্তি বাতিল হলো ফের আওয়ামী লীগের আমলে। প্রতিষ্ঠানটি মামলা-মোকদ্দমা করলে আরও কয়েক বছরের জন্য এটি ঝুলে থাকবে। সেখানে ফ্ল্যাট হবে না, বস্তিবাসীদের আশ্রয় হবে না, কিন্তু দুর্বৃত্তরা ঠিকই অর্থ কামিয়ে নেবে।
তৃতীয় খবরটি চট্টগ্রাম বন্দরের। বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে বন্দরের বড় বড় প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায়। কর্ণফুলী নদী খননের দরপত্র আহ্বান করা যায়নি গত দুই বছরেও। বন্দরে রয়েছে দুর্বল নিরাপত্তাব্যবস্থা এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও কেনা হচ্ছ না। কারণ অত্যন্ত পরিষ্কার। কমিশনে না মিললে প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে না। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, মাল ওঠানো-নামানোয় অযথা বিলম্ব। শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী নামিয়ে বন্দর চালাতে হচ্ছে। তাহলে মন্ত্রী কী করছেন? সচিব কী করছেন? বোর্ড কী করছে?
আকাশ, নৌ, স্থল, বিমান, সমুদ্রবন্দর ও ভাষানটেক—বাংলাদেশে সরকারি কাজে অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, দুর্নীতি ও অনিয়মের তিনটি নমুনামাত্র। সরকারের এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে সময়মতো কাজ হয়, ফাইল নড়ে, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়। বিমান এক সময় ছিল আকাশে শান্তির নীড়। এখন আকাশে তো উড়ছেই না, মাটিতেও অশান্তি সৃষ্টি করে চলেছে। একসময় বিদেশি যাত্রীরাও বাংলাদেশ বিমানে চড়তে উৎসাহী হতেন। নব্বইয়ের দশকেও দেখেছি, ইউরোপীয় যাত্রীরা আশপাশের দেশে এলেও বিমানে আসতেন। ঢাকা হয়ে যেতেন কলকাতা, দিল্লি বা কাঠমান্ডু। এখন বিদেশি যাত্রী তো দূরের কথা, দেশীয় যাত্রীদেরও তাড়ানো হচ্ছে। যেখানে তিন-চারটি প্রাইভেট এয়ারলাইনস চুটিয়ে ব্যবসা করছে, যাত্রীদের মাত্রাতিরিক্ত ভিড়, সেখানে বিমান ক্রমাগত লোকসান দিচ্ছে। কেবল দুর্নীতির কারণে এটি ঘটছে না। চুরি, দুর্নীতি সব দেশেই আছে। তার চেয়েও বড় কারণ অদক্ষতা, অযোগ্যতা ও অব্যবস্থাপনা। বহু বছর ধরেই বিমান বেহাল অবস্থায় আছে। একেক সরকার এসে তুঘলকি সিদ্ধান্ত নেয়, নড়বড়ে পুরোনো উড়োজাহাজ কেনে। কেননা, পুরোনো জাহাজে কমিশন বেশি। ফাঁকি বেশি। মেরামতের নামে টাকা মেরে দেওয়া যায়। নিখরচায় বিদেশেও ঘুরে আসা যায়।
বাংলাদেশে কোনো ভালো কাজই যে ভালোভাবে শেষ করা যায় না, ভাষানটেক প্রকল্প তার অন্যতম উদাহরণ। আমাদের সরকারগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণে যতটা ত্বরিত, বাস্তবায়নে ততটাই অদক্ষ, অপটু। সরকার উড়াল ট্রেন, পাতাল ট্রেনের মস্তবড় পরিকল্পনা নিচ্ছে, ঢাকা-চট্টগ্রামেও নাকি চার লেন সড়ক হবে, দ্রুতগামী ট্রেন চলবে। এসব স্বপ্নের কথা, গল্পের কথা। জনগণকে খোয়াব দেখাতে পয়সা লাগে না। কিন্তু বাস্তবে যে তারা কিছুই করতে পারে না, তার প্রমাণ যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভার। কয়েক কিলোমিটার পথ। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে শুরু হয়েছে, তারপর দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল, এখন নির্বাচিত ও গণতান্ত্রিক সরকার। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানটিকেই কাজ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ-বিএনপিতে কোনো ফারাক নেই।
সরকার দাবি করছে, সবকিছু নাকি ঠিকমতো চলছে। হ্যাঁ রাজনীতি চলছে। নেতা-নেত্রীদের ভাষণ চলছে। দেশব্যাপী কর্মী-ক্যাডারদের মাস্তানি চলছে। পাল্টাপাল্টি সভা-সমাবেশ চলছে। কিন্তু দেশটা চলছে না, দেশের সাধারণ সীমিত আয়ের মানুষ চলতে পারছে না। এই যে ঢাকা শহরে অসহনীয় যানজট, সেশনজট। সাধারণ মানুষ সরকারের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা চায়। আইনের সুরক্ষা চায়। অন্যায়ের প্রতিকার চায়। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা দখলমুক্ত ও দূষণমুক্ত করা কিংবা রাজধানীর খালগুলো দখলমুক্ত করার কথা শুনে আসছি ‘৯০ সাল বা তারও আগে থেকে। কিছুদিন তৎপরতা চলে। মন্ত্রী-সচিবসহ বাঘা বাঘা কর্মকর্তার হুমকি-ধমকি শুনি। পত্রিকায়-টিভিতে ছবি দেখি। তার পরই সব আগের মতো চলতে থাকে।
আসলে সরকারি দল চলছে, বিরোধী দল চলছে। দেশে রাজনীতি চলছে। গণতন্ত্র থাকলে চলতেই হবে। আমাদেরও কান পেতে ও মুখ বুজে নেতা-নেত্রীদের মুখে উন্নয়নের ফিরিস্তি শুনতে হবে। কিন্তু ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই দেশটা যে চলছে না, সে কথাটি বোঝার মতো জ্ঞানবুদ্ধিও কি তাঁদের নেই?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
নতুন সরকার এলেই মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নানা সাইনবোর্ড দেখা যায়, কমিটি গঠন নিয়ে মারামারি হয়, মধ্যরাতে কার্যালয় দখল হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন তালিকা তৈরি করা হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বলা হয়, বিএনপি সরকার তাদের সমর্থক মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করেছে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে বলা হয়, আওয়ামী লীগ তাদের পছন্দসই মুক্তিযোদ্ধাদের নাম তালিকাভুক্ত করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েও এই দলীয় রাজনীতি কত দিন চলবে?
মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, সে বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। দুস্থ ও দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আর্থিক সহায়তার ব্যাপারে কারও আপত্তি নেই। কিন্তু স্বাধীনতার ৩৯ বছর পরও যেভাবে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের চাকরির কোটা নির্ধারণ করা হচ্ছে, তা নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন আছে। বেকন মিজান নামের একজন পাঠক ২৮ অক্টোবর পাঠানো ই-মেইল বার্তায় লিখেছেন, ‘আপনার কি কখনো মনে হয়েছে যে, দেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, মানুষ কি কিছু পাওয়ার আশায় যুদ্ধ করেছিল? পরে কিছু আলাদাভাবে পাবে সে জন্য? না, তাঁরা সবাই দেশটা পাওয়ার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন?...যাঁরা যুদ্ধ করতে পারেননি তাদের কী অপরাধ? তাঁরা কি বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেননি? মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দুই লাখের মতো হবে। কিন্তু ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ যুদ্ধে জীবন দিয়েছেন। দুই লাখ মা-বোন নির্যাতিত হয়েছেন, তাদের কি কেউ খোঁজ নিয়েছেন? কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যেভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটায় তাঁদের নাতি-নাতনিদেরও সরকারি চাকরির কোটা দিচ্ছেন, তা কতটা যুক্তিসংগত?’
দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে দেড় লাখই (অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ভাতাভোগীর সংখ্যা এক লাখ ২৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে দেড় লাখ করার কথা বলেছেন, প্রথম আলো, ২৮ অক্টোবর) যদি সরকারের কাছ থেকে ভাতা পেয়ে থাকেন, তাহলে ৩০ লাখ শহীদ পরিবার কেন পাবে না? মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করে দেশ স্বাধীন করেছেন এবং বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে এসেছেন। তাঁদের অবদান জাতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে। পরবর্তীকালে অনেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু বেশির ভাগ শহীদ পরিবার প্রিয়জনের সঙ্গে তাদের সহায়সম্পত্তি সবই হারিয়েছে। স্বাধীনতার জন্য, দেশের জন্য যাঁরা জীবন দিয়েছেন তাঁদের অবদানকেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। মুক্তিযোদ্ধারা ভাতা পেলে শহীদ পরিবারগুলো কেন পাবে না? সবশেষে তিনি যে বিবেকজাগানিয়া কথাটি বলেছেন সেটি হলো, একাত্তরে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তাঁরা দেশ থেকে কিছু পাওয়ার জন্য করেননি, দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম থেকেই করেছেন। বেকন মিজানকে ধন্যবাদ জানাই। একই সঙ্গে তাঁর কথাটি সরকারকে ভেবে দেখতে বলব। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের কোটা বেঁধে দেওয়ায় যদি প্রকৃত মেধাবীরা সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হন, সেটিও দেশের ক্ষতি। অন্যভাবেও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে সহায়তা করা যায়।
২.
সরকারপ্রধান, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, ক্ষমতাসীন দলের নেতা—সবাই বলছেন, দেশ ঠিকমতো চলছে। বিরোধী দল ষড়যন্ত্র না করলে আরও ভালোভাবে চলত। তাঁদের এই কথার সঙ্গে বাস্তবের মিল থাকলে খুশি হতাম। সরকারকে প্রাণঢালা অভিবাদন জানাতাম। কিন্তু দুঃখিত। অভিবাদন জানাতে পারছি না। সরকারের মেয়াদ যেহেতু অর্ধেক পার হয়নি, সে জন্য পুরোপুরি নাকচও করছি না। এখনো অপেক্ষায় আছি সরকার ভালো কিছু করবে। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কিছুটা হলেও পূরণ করে প্রমাণ করবে, আওয়ামী লীগ বিএনপি থেকে ভালো শাসক। শোষক নয়, সেবক, অপদার্থ নয়, পদার্থ। তবে যতই দিন যাচ্ছে, আশা ফিকে হয়ে যাচ্ছে। তার পরও বলব, চূড়ান্ত রায় দেওয়ার জন্য আমাদের আরও তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে।
তবে এই মুহূর্তে দেশের পরিস্থিতিটা মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। বৃহস্পতিবারের পত্রিকায় অন্তত তিনটি উদ্বেগজনক খবর ছাপা হয়েছে। একই সঙ্গে দেশের জন্য লজ্জাজনকও।
প্রথম খবরটি বিমান নিয়ে। বৈমানিকদের কর্মবিরতিতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। দুই দিনের সব ফ্লাইট বাতিল। বিমান পরিচালনা বোর্ড বৈঠক করে জানিয়ে দিয়েছে, যেসব পাইলট কর্মসূচি পালন করছেন, তাঁদের স্বাভাবিক কর্মস্থলে যোগ দিতে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে যোগ না দিলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অন্যদিকে পাইলটরা বলেছেন, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত তাঁরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন না। কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন। বৈমানিকদের অবসরের বয়স ৫৭ থেকে বাড়িয়ে ৬২ বছর করার প্রতিবাদে এবং বিদেশি পাইলট নিয়োগ বাতিলের দাবিতে তাঁরা কর্মসূচি পালন করেন। বিমানের ১৬৬ জন বৈমানিকের পদের বিপরীতে ১১৭ জন কর্মরত আছেন। তাঁদেরও বেশির ভাগ কর্মবিরতি পালন করছেন। এ অবস্থায় হজ ফ্লাইট ছাড়া সব ফ্লাইট স্থগিত বা বাতিল করতে হচ্ছে।
দ্বিতীয় খবরটি রাজধানীর বস্তিবাসী ও নিম্নবিত্তদের জন্য নেওয়া ভাষানটেক পুনর্বাসন প্রকল্পসংক্রান্ত। ভূমি মন্ত্রণালয় ২০০৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর নর্থ সাউথ প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের (এনএসপিডিএল) সঙ্গে চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী পাঁচ বছরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা, তারা সাত বছরেও শেষ করতে পারেনি। ফলে ভাষানটেক বস্তি এলাকা থেকে উচ্ছেদকৃত লোকজনকে পুনর্বাসন করা যায়নি। সেখানে দরিদ্র জনগণের জন্য স্বল্প দামে ফ্ল্যাট নির্মাণ করার কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি জিমনেসিয়াম, সাইবার ক্যাফে, ওয়াশিং প্লান্ট, এনএসপিডিএল ক্যাটারিং স্থাপন করেছে। তিনতারা হোটেলের সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গৃহীত এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছিল মিরপুরে অবস্থিত একটি এনজিও। কিন্তু সরকার তাদের প্রস্তাব নাকচ করে এনএসপিডিএলের সঙ্গে চুক্তি করে। প্রক্রিয়া আওয়ামী লীগের আমলে শুরু হলেও চুক্তি হয় বিএনপির আমলে। এখন চুক্তি বাতিল হলো ফের আওয়ামী লীগের আমলে। প্রতিষ্ঠানটি মামলা-মোকদ্দমা করলে আরও কয়েক বছরের জন্য এটি ঝুলে থাকবে। সেখানে ফ্ল্যাট হবে না, বস্তিবাসীদের আশ্রয় হবে না, কিন্তু দুর্বৃত্তরা ঠিকই অর্থ কামিয়ে নেবে।
তৃতীয় খবরটি চট্টগ্রাম বন্দরের। বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে বন্দরের বড় বড় প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায়। কর্ণফুলী নদী খননের দরপত্র আহ্বান করা যায়নি গত দুই বছরেও। বন্দরে রয়েছে দুর্বল নিরাপত্তাব্যবস্থা এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও কেনা হচ্ছ না। কারণ অত্যন্ত পরিষ্কার। কমিশনে না মিললে প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে না। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, মাল ওঠানো-নামানোয় অযথা বিলম্ব। শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী নামিয়ে বন্দর চালাতে হচ্ছে। তাহলে মন্ত্রী কী করছেন? সচিব কী করছেন? বোর্ড কী করছে?
আকাশ, নৌ, স্থল, বিমান, সমুদ্রবন্দর ও ভাষানটেক—বাংলাদেশে সরকারি কাজে অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, দুর্নীতি ও অনিয়মের তিনটি নমুনামাত্র। সরকারের এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে সময়মতো কাজ হয়, ফাইল নড়ে, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়। বিমান এক সময় ছিল আকাশে শান্তির নীড়। এখন আকাশে তো উড়ছেই না, মাটিতেও অশান্তি সৃষ্টি করে চলেছে। একসময় বিদেশি যাত্রীরাও বাংলাদেশ বিমানে চড়তে উৎসাহী হতেন। নব্বইয়ের দশকেও দেখেছি, ইউরোপীয় যাত্রীরা আশপাশের দেশে এলেও বিমানে আসতেন। ঢাকা হয়ে যেতেন কলকাতা, দিল্লি বা কাঠমান্ডু। এখন বিদেশি যাত্রী তো দূরের কথা, দেশীয় যাত্রীদেরও তাড়ানো হচ্ছে। যেখানে তিন-চারটি প্রাইভেট এয়ারলাইনস চুটিয়ে ব্যবসা করছে, যাত্রীদের মাত্রাতিরিক্ত ভিড়, সেখানে বিমান ক্রমাগত লোকসান দিচ্ছে। কেবল দুর্নীতির কারণে এটি ঘটছে না। চুরি, দুর্নীতি সব দেশেই আছে। তার চেয়েও বড় কারণ অদক্ষতা, অযোগ্যতা ও অব্যবস্থাপনা। বহু বছর ধরেই বিমান বেহাল অবস্থায় আছে। একেক সরকার এসে তুঘলকি সিদ্ধান্ত নেয়, নড়বড়ে পুরোনো উড়োজাহাজ কেনে। কেননা, পুরোনো জাহাজে কমিশন বেশি। ফাঁকি বেশি। মেরামতের নামে টাকা মেরে দেওয়া যায়। নিখরচায় বিদেশেও ঘুরে আসা যায়।
বাংলাদেশে কোনো ভালো কাজই যে ভালোভাবে শেষ করা যায় না, ভাষানটেক প্রকল্প তার অন্যতম উদাহরণ। আমাদের সরকারগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণে যতটা ত্বরিত, বাস্তবায়নে ততটাই অদক্ষ, অপটু। সরকার উড়াল ট্রেন, পাতাল ট্রেনের মস্তবড় পরিকল্পনা নিচ্ছে, ঢাকা-চট্টগ্রামেও নাকি চার লেন সড়ক হবে, দ্রুতগামী ট্রেন চলবে। এসব স্বপ্নের কথা, গল্পের কথা। জনগণকে খোয়াব দেখাতে পয়সা লাগে না। কিন্তু বাস্তবে যে তারা কিছুই করতে পারে না, তার প্রমাণ যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভার। কয়েক কিলোমিটার পথ। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে শুরু হয়েছে, তারপর দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল, এখন নির্বাচিত ও গণতান্ত্রিক সরকার। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানটিকেই কাজ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ-বিএনপিতে কোনো ফারাক নেই।
সরকার দাবি করছে, সবকিছু নাকি ঠিকমতো চলছে। হ্যাঁ রাজনীতি চলছে। নেতা-নেত্রীদের ভাষণ চলছে। দেশব্যাপী কর্মী-ক্যাডারদের মাস্তানি চলছে। পাল্টাপাল্টি সভা-সমাবেশ চলছে। কিন্তু দেশটা চলছে না, দেশের সাধারণ সীমিত আয়ের মানুষ চলতে পারছে না। এই যে ঢাকা শহরে অসহনীয় যানজট, সেশনজট। সাধারণ মানুষ সরকারের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা চায়। আইনের সুরক্ষা চায়। অন্যায়ের প্রতিকার চায়। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা দখলমুক্ত ও দূষণমুক্ত করা কিংবা রাজধানীর খালগুলো দখলমুক্ত করার কথা শুনে আসছি ‘৯০ সাল বা তারও আগে থেকে। কিছুদিন তৎপরতা চলে। মন্ত্রী-সচিবসহ বাঘা বাঘা কর্মকর্তার হুমকি-ধমকি শুনি। পত্রিকায়-টিভিতে ছবি দেখি। তার পরই সব আগের মতো চলতে থাকে।
আসলে সরকারি দল চলছে, বিরোধী দল চলছে। দেশে রাজনীতি চলছে। গণতন্ত্র থাকলে চলতেই হবে। আমাদেরও কান পেতে ও মুখ বুজে নেতা-নেত্রীদের মুখে উন্নয়নের ফিরিস্তি শুনতে হবে। কিন্তু ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই দেশটা যে চলছে না, সে কথাটি বোঝার মতো জ্ঞানবুদ্ধিও কি তাঁদের নেই?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments