যুক্তি তর্ক গল্প-হতাশার বিষচক্র থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হবে by আবুল মোমেন
বাংলাদেশে দৈনন্দিন জীবনে ইদানীং যেসব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে থাকি আমরা, তা সাধারণত সুখকর নয়। দৈনিক পত্রিকার পাতায় প্রতিদিন দেশের যে সমাজচিত্র ফুটে ওঠে, তাতেও নেতিবাচক খবরই থাকে বেশি। এ ঘটনাগুলোকে এক জায়গায় এনে বিচার করলে দেখা যাবে, এসবের পেছনে ইন্ধন হিসেবে কাজ করছে কোনো কোনো
ব্যক্তির অপরিমিত লোভ, যে লোভ তাকে বেপরোয়া হওয়ার দিকে ঠেলে দেয়। এই বেপরোয়া উচ্চাভিলাষী মানুষ কাজ হাসিল এবং সেই সঙ্গে আত্মরক্ষা করতে দুটি কাজ করে—সম্পদ গড়ে তোলে, বৈধ-অবৈধ বাছবিচার বাদ দিয়ে এবং দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করে, এ ক্ষেত্রে নীতি-আদর্শের বিবেচনা থাকে গৌণ কিংবা সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। এভাবে সমাজে অনেক ক্ষমতাবান ধনীর সৃষ্টি হয়েছে, যাঁরা বৈধ-অবৈধ এবং নীতি-আদর্শের বিবেচনা সম্পূর্ণ বাদ দিয়েছেন। তাঁরা যেহেতু রাজনৈতিক দলে ও রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন এবং তাঁরা ক্ষমতার অঙ্গনে শক্তিশালী লবি হিসেবে কাজ করেন, তাই রাজনীতিতে নীতি-আদর্শ ও বৈধ-অবৈধের বাছবিচার কমে এসেছে। এটাই বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতির বাস্তবতা।
সংক্রমণ শরীরের এক জায়গায় শুরু হলেও সঠিক চিকিৎসার অভাবে তা সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনহানি ঘটাতে পারে। সমাজের ক্ষেত্রেও যেমন একই ঘটনা ঘটতে পারে, তেমনি পারে রাজনীতির ক্ষেত্রেও। আমরা আজ সহজেই বলতে পারি, এ কালে এ দেশে নীতি-আদর্শের রাজনীতির মৃত্যুদশা চলছে। কেউ কেউ অবশ্য এ কথা মানতে চাইবেন না। কারণ তাঁদের মনে হয়, নীতি-আদর্শের রাজনীতির মৃত্যু অনেক আগেই হয়ে গেছে। সম্ভবত এ সংখ্যা জনসংখ্যার অর্ধেকের চেয়ে বেশি বই কম হবে না।
যেভাবে প্রতিদিন ব্যক্তিস্বার্থ-প্রণোদিত হয়ে বীভৎস হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, উচ্ছেদ, জখম, দখল, অপমানসহ অন্যান্য নিগ্রহ চালানোর খবর মানুষ জানতে পায়, তাতে সে বোঝে, এ সমাজ কী নিদারুণভাবে ব্যাধিগ্রস্ত। একইভাবে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেও নীতি-আদর্শের সংকট কত চরম, সেটাও সচেতন মানুষের বুঝতে অসুবিধা হয় না। সমাজের অন্যত্রও দূষণ ছড়িয়েছে—ব্যবসা, প্রশাসন, পুলিশ, শিক্ষা, সাংবাদিকতা, কোথায় নয়।
ব্যক্তিগত নানা তিক্ত অভিজ্ঞতার পর ভুক্তভোগী প্রায়ই দেশ, মানুষ, রাজনীতির ওপর ঝাল ঝাড়ে। তার আস্থা ও স্বপ্ন টলে যায়, ভেঙে পড়া মানুষ হতাশ হয়ে পড়ে, আর হতাশা থেকে সব বিষয়ে অভিযোগ জানায়, সমালোচনায় মুখর হয় এবং শেষ পর্যন্ত নেতিবাচক সিদ্ধান্ত জানিয়ে নিজের অদৃষ্টকে দুষতে থাকে, পারলে এ অবস্থার জন্য দায়ীদের অভিশাপ দিতে থাকে।
আমাদের দেশের মানুষ সরকারবিরোধী রাজনীতি ও মানস নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে বস্তুত ব্রিটিশ আমল থেকে। বাংলায় স্বদেশ চেতনার জোয়ার এসেছিল ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন থেকে। সে আন্দোলন প্রধানত শিক্ষিত বর্ণহিন্দুদের মধ্যে সীমিত থাকলেও তখনই বাঙালি জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমের রাজনীতির সূচনা হয়েছে, যা পরবর্তীকালে মুসলমান বাঙালির মানসেও ঠাঁই পেয়েছে। সেভাবে বলা যায়, শতাধিক বছর ধরেই বাঙালিরা সরকারবিরোধী, প্রজন্মের হিসাবে চার প্রজন্ম চলছে এখন।
রাজনৈতিক কারণেই ভাঙা-গড়াও হয়েছে অনেক—বাংলা ভাগ, হিন্দু-মুসলিমে দাঙ্গা, দেশত্যাগ তো আছেই। আবার এই ভূখণ্ডেই চলেছে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পাঞ্জাবি আক্রমণ, গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে সামরিক স্বৈরশাসন, গণ-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড ও জেলহত্যা এবং তার নায়কদের রাষ্ট্রীয় তোষণ, সামরিক স্বৈরশাসন, রাজনীতিতে অবৈধ অস্ত্র ও অর্থের ভূমিকা, ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় জঙ্গিবাদের উত্থান ইত্যাদি। এসবের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ ও সাফল্যের ইতিহাসও কম নয়—চুয়ান্নর নির্বাচনী বিজয়, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও স্বৈরশাসক আইয়ুবের পতন, মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন ইত্যাদি। এর মধ্যেও লক্ষ করলে দেখা যাবে, রাজনীতির নীতি-আদর্শের গ্রাফ যেমন ক্রমাগত নিম্নগামী হয়েছে, তেমনি সামাজিক মূল্যবোধ ও মানব সম্পর্কেও সেই নিম্নগামিতাই পরিলক্ষিত হবে। এসব দেখে পুরোনো মানুষ তো হতাশ হয়ই, নতুন প্রজন্মও সমালোচিত-ধিক্কৃত হতে হতে একধরনের হতাশা, এমনকি অপরাধবোধের শিকার হচ্ছে।
এই পরিস্থিতি আস্থাহীনতা ও স্বপ্নভঙ্গ এবং এসবের পুঞ্জীভূত প্রতিফল হিসেবে প্রাপ্ত তিক্ততা ও হতাশার এক বিষচক্র তৈরি করেছে। জাতি এই চক্র ভাঙতে পারছে না, এ চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। অথচ সামনে এগোতে হলে এককথায় বলি, হতাশা-তিক্ততার এই বিষচক্রটি ভাঙতেই হবে। কারণ এটি আসলে একটি ভয়ংকর পরিস্থিতি।
হতাশ ও তিক্ত মানুষের ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ভয়ানকভাবে হ্রাস পায়, এই মানসের স্বাভাবিক ঝোঁক নেতির দিকে এবং মনের গভীরে পরশ্রীকাতরতা শেকড় বিস্তার করে বসে। আরও ভয়ানক হচ্ছে, তার বিচারবোধ আক্রান্ত হয় বলে কোনো বিষয়কে যথাযথ প্রেক্ষাপটে বিচার করার ক্ষমতা হারিয়ে বসে। ফলে সবই বিচ্ছিন্ন এবং বিচ্ছিন্নভাবেই সম্পূর্ণ ঘটনা তার কাছে। প্রেক্ষাপটহীন বর্তমান নানা বিচ্ছিন্ন ভয়ংকর ঘটনার সমষ্টি। ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণের ক্ষমতা ও প্রবণতা হারিয়ে তারা আশ্রয় নেয় তীব্র প্রতিক্রিয়ার এবং কঠোর সমালোচনার। সবকিছুকে, সবকিছুকেই প্রত্যাখ্যান করে, ভাগাড়ে ছুড়ে ফেলে যে বিজয় অর্জিত হয়, তা মুহূর্তে একরাশ হতাশার অন্ধকারে, অক্ষম আক্রোশের মেঘে ঢাকা পড়ে যায়।
বিপুল মানুষ প্রেক্ষাপট হারিয়ে বসাতে এবং এর ফলে বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় বাংলাদেশে আজ রূপকথার এক অলীক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। যে বাস্তবতা বঙ্গবন্ধু এবং জিয়াউর রহমানকে এক কাতারের নেতা বানিয়ে বসে, যে বাস্তবতা বাংলাদেশের বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাজউদ্দীনের অনন্য ভূমিকা উপলব্ধি করতে দেয় না, যে বাস্তবতা পঁচাত্তরের খুনিদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাদানকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখতে শেখায়, যে বাস্তবতা স্বৈরাচার এরশাদের বিচারে নমনীয় হতে শেখায়, যে বাস্তবতা যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি সহানুভূতির রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেয়। তা যদি ইতিহাসসম্মত ও সত্য না হয়, তাহলে তা অলীকই, রূপকথারই বাস্তবতা। এমনকি এই বাস্তবতা বৈধতা-অবৈধতা, নীতি-অনীতির ফারাক করতে পারে না। এই বাস্তবতায় ভূমিদস্যুরাও সমাজের নৈতিকতাবাদীদের কাছ থেকে বৈধতার ছাপ পেয়ে যায় আর বৈধ ব্যবসায়ী পান ধিক্কার।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখব স্বাধীন সার্বভৌম নবীন এই রাষ্ট্রটিকে অস্থির ও বানচাল করে দেওয়ার জন্যও ভেতরে-বাইরে ষড়যন্ত্র ও শত্রুতা চলছিল। বুঝে হোক আর না বুঝে হোক, প্রথম পর্যায়ে এতে জাসদ জড়িয়ে ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের এই শক্তিকে ও তাদের আদর্শকে রাজনীতি, সমাজ, সরকার ও রাষ্ট্রে পুনর্বাসিত ও প্রতিষ্ঠিত করেছেন জিয়াউর রহমান। বেগম জিয়া আজ অবধি সেই একই রাজনীতিই আঁকড়ে ধরে আছেন। তাঁর জোটভুক্ত রয়েছে একাত্তরের ঘাতক-দালালদের দল, তাঁর দলে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছে যুদ্ধাপরাধী এবং তিনি আজ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে চলেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী এই সর্বনাশা দেশবিরোধী রাজনীতি চালিয়েও তিনি ও তাঁর দল দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ ভোটারের সমর্থন ভোগ করে চলেছেন। হতাশা-তিক্ততার বিষচক্রে খাবি খাওয়া জাতির এ ধরনের পরিণতি হওয়া বিচিত্র নয়। বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করার কাজ করেছে, যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার রাজনীতি করছে, পঁচাত্তরের খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে, ধর্মান্ধ জঙ্গিদের সহায়তা দিয়েছে, হত্যার রাজনীতি ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রকে লালন করেছে। এসবকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আইনের শাসন এবং এ দেশের হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে বৈরিতা ও বিশ্বাসঘাতকতা বলা যায়।
আওয়ামী লীগ বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলের মধ্যেও অবক্ষয় হয়েছে, দূষণ সংক্রমণ সবই ঘটেছে এবং দুর্ভাগ্যজনক হলো, তাতে হতাশার ও স্বপ্নভঙ্গের বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু একে তপ্ত তাওয়া ভেবে পরিত্রাণের জন্য জ্বলন্ত উনুনে লাফ দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ২০০১ সালে তেমন একটা লম্ফ দিয়েছিল জাতি; জাতির আশা, বিবেক এবং মর্যাদাবোধ ভালো মতো পুড়েছে। কিন্তু বিষচক্র তো বিষচক্রই। আওয়ামী লীগ যদি তপ্ত তাওয়ার মতো অসহনীয় হয়ে উঠতে থাকে, তাহলে আগের ভুল মানুষ আবার করবে।
কিন্তু আমার মনে হয়, চুলার ওপরে থাকা তাওয়াটা ঠান্ডা করার কাজ চলছে, এটুকু যদি মানুষ বুঝতে পারে এবং সত্যিই যদি তা ঘটে, তবেই সে ব্যাধিগ্রস্ত রাজনীতির আঁচ কিছুটা সহ্য করতে সম্মত হবে। একদিকে একটু ধৈর্য লাগবে আর অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলকেও খোলা গরম হয়ে ওঠার মতো কাজে বিরত থাকতে হবে। মানুষকে স্বস্তি দিতে হবে, তার আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে এবং এমনভাবে স্বপ্ন জাগাতে হবে, যা আশার আলোটিকে ধরে রাখবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিকে এই রগচটা খামখেয়ালিপনার মেজাজ থেকে বের করে আনতে হলে অপর বড় দল বিএনপিকে বাংলাদেশের ইতিহাস ও জাতির মানসযাত্রার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নীতি-কর্মসূচি নিতে হবে, ষড়যন্ত্র এবং জঙ্গি ও যুদ্ধাপরাধী তোষণের রাজনীতি থেকে সরে আসতে হবে। দ্রব্যমূল্য, শিল্পায়ন, বৈদেশিক শ্রমবাজার, নারী নির্যাতন, সামাজিক অপরাধ, দুর্নীতি ইত্যাদি অসংখ্য ইস্যু আছে, যা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এবং যেসব ইস্যুতে দুই প্রধান দল নিজ নিজ দক্ষতা, কৃতিত্ব ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে জনগণের দরবারে আসতে পারেন। এটাই হবে সুস্থধারার রাজনীতি। রাজনীতি সুস্থ হলে, দেশ ও জাতি হতাশা-নেতির বিষচক্র থেকে দ্রুতই বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
সংক্রমণ শরীরের এক জায়গায় শুরু হলেও সঠিক চিকিৎসার অভাবে তা সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনহানি ঘটাতে পারে। সমাজের ক্ষেত্রেও যেমন একই ঘটনা ঘটতে পারে, তেমনি পারে রাজনীতির ক্ষেত্রেও। আমরা আজ সহজেই বলতে পারি, এ কালে এ দেশে নীতি-আদর্শের রাজনীতির মৃত্যুদশা চলছে। কেউ কেউ অবশ্য এ কথা মানতে চাইবেন না। কারণ তাঁদের মনে হয়, নীতি-আদর্শের রাজনীতির মৃত্যু অনেক আগেই হয়ে গেছে। সম্ভবত এ সংখ্যা জনসংখ্যার অর্ধেকের চেয়ে বেশি বই কম হবে না।
যেভাবে প্রতিদিন ব্যক্তিস্বার্থ-প্রণোদিত হয়ে বীভৎস হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, উচ্ছেদ, জখম, দখল, অপমানসহ অন্যান্য নিগ্রহ চালানোর খবর মানুষ জানতে পায়, তাতে সে বোঝে, এ সমাজ কী নিদারুণভাবে ব্যাধিগ্রস্ত। একইভাবে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেও নীতি-আদর্শের সংকট কত চরম, সেটাও সচেতন মানুষের বুঝতে অসুবিধা হয় না। সমাজের অন্যত্রও দূষণ ছড়িয়েছে—ব্যবসা, প্রশাসন, পুলিশ, শিক্ষা, সাংবাদিকতা, কোথায় নয়।
ব্যক্তিগত নানা তিক্ত অভিজ্ঞতার পর ভুক্তভোগী প্রায়ই দেশ, মানুষ, রাজনীতির ওপর ঝাল ঝাড়ে। তার আস্থা ও স্বপ্ন টলে যায়, ভেঙে পড়া মানুষ হতাশ হয়ে পড়ে, আর হতাশা থেকে সব বিষয়ে অভিযোগ জানায়, সমালোচনায় মুখর হয় এবং শেষ পর্যন্ত নেতিবাচক সিদ্ধান্ত জানিয়ে নিজের অদৃষ্টকে দুষতে থাকে, পারলে এ অবস্থার জন্য দায়ীদের অভিশাপ দিতে থাকে।
আমাদের দেশের মানুষ সরকারবিরোধী রাজনীতি ও মানস নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে বস্তুত ব্রিটিশ আমল থেকে। বাংলায় স্বদেশ চেতনার জোয়ার এসেছিল ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন থেকে। সে আন্দোলন প্রধানত শিক্ষিত বর্ণহিন্দুদের মধ্যে সীমিত থাকলেও তখনই বাঙালি জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমের রাজনীতির সূচনা হয়েছে, যা পরবর্তীকালে মুসলমান বাঙালির মানসেও ঠাঁই পেয়েছে। সেভাবে বলা যায়, শতাধিক বছর ধরেই বাঙালিরা সরকারবিরোধী, প্রজন্মের হিসাবে চার প্রজন্ম চলছে এখন।
রাজনৈতিক কারণেই ভাঙা-গড়াও হয়েছে অনেক—বাংলা ভাগ, হিন্দু-মুসলিমে দাঙ্গা, দেশত্যাগ তো আছেই। আবার এই ভূখণ্ডেই চলেছে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পাঞ্জাবি আক্রমণ, গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে সামরিক স্বৈরশাসন, গণ-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড ও জেলহত্যা এবং তার নায়কদের রাষ্ট্রীয় তোষণ, সামরিক স্বৈরশাসন, রাজনীতিতে অবৈধ অস্ত্র ও অর্থের ভূমিকা, ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় জঙ্গিবাদের উত্থান ইত্যাদি। এসবের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ ও সাফল্যের ইতিহাসও কম নয়—চুয়ান্নর নির্বাচনী বিজয়, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও স্বৈরশাসক আইয়ুবের পতন, মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন ইত্যাদি। এর মধ্যেও লক্ষ করলে দেখা যাবে, রাজনীতির নীতি-আদর্শের গ্রাফ যেমন ক্রমাগত নিম্নগামী হয়েছে, তেমনি সামাজিক মূল্যবোধ ও মানব সম্পর্কেও সেই নিম্নগামিতাই পরিলক্ষিত হবে। এসব দেখে পুরোনো মানুষ তো হতাশ হয়ই, নতুন প্রজন্মও সমালোচিত-ধিক্কৃত হতে হতে একধরনের হতাশা, এমনকি অপরাধবোধের শিকার হচ্ছে।
এই পরিস্থিতি আস্থাহীনতা ও স্বপ্নভঙ্গ এবং এসবের পুঞ্জীভূত প্রতিফল হিসেবে প্রাপ্ত তিক্ততা ও হতাশার এক বিষচক্র তৈরি করেছে। জাতি এই চক্র ভাঙতে পারছে না, এ চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। অথচ সামনে এগোতে হলে এককথায় বলি, হতাশা-তিক্ততার এই বিষচক্রটি ভাঙতেই হবে। কারণ এটি আসলে একটি ভয়ংকর পরিস্থিতি।
হতাশ ও তিক্ত মানুষের ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ভয়ানকভাবে হ্রাস পায়, এই মানসের স্বাভাবিক ঝোঁক নেতির দিকে এবং মনের গভীরে পরশ্রীকাতরতা শেকড় বিস্তার করে বসে। আরও ভয়ানক হচ্ছে, তার বিচারবোধ আক্রান্ত হয় বলে কোনো বিষয়কে যথাযথ প্রেক্ষাপটে বিচার করার ক্ষমতা হারিয়ে বসে। ফলে সবই বিচ্ছিন্ন এবং বিচ্ছিন্নভাবেই সম্পূর্ণ ঘটনা তার কাছে। প্রেক্ষাপটহীন বর্তমান নানা বিচ্ছিন্ন ভয়ংকর ঘটনার সমষ্টি। ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণের ক্ষমতা ও প্রবণতা হারিয়ে তারা আশ্রয় নেয় তীব্র প্রতিক্রিয়ার এবং কঠোর সমালোচনার। সবকিছুকে, সবকিছুকেই প্রত্যাখ্যান করে, ভাগাড়ে ছুড়ে ফেলে যে বিজয় অর্জিত হয়, তা মুহূর্তে একরাশ হতাশার অন্ধকারে, অক্ষম আক্রোশের মেঘে ঢাকা পড়ে যায়।
বিপুল মানুষ প্রেক্ষাপট হারিয়ে বসাতে এবং এর ফলে বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় বাংলাদেশে আজ রূপকথার এক অলীক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। যে বাস্তবতা বঙ্গবন্ধু এবং জিয়াউর রহমানকে এক কাতারের নেতা বানিয়ে বসে, যে বাস্তবতা বাংলাদেশের বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাজউদ্দীনের অনন্য ভূমিকা উপলব্ধি করতে দেয় না, যে বাস্তবতা পঁচাত্তরের খুনিদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাদানকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখতে শেখায়, যে বাস্তবতা স্বৈরাচার এরশাদের বিচারে নমনীয় হতে শেখায়, যে বাস্তবতা যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি সহানুভূতির রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেয়। তা যদি ইতিহাসসম্মত ও সত্য না হয়, তাহলে তা অলীকই, রূপকথারই বাস্তবতা। এমনকি এই বাস্তবতা বৈধতা-অবৈধতা, নীতি-অনীতির ফারাক করতে পারে না। এই বাস্তবতায় ভূমিদস্যুরাও সমাজের নৈতিকতাবাদীদের কাছ থেকে বৈধতার ছাপ পেয়ে যায় আর বৈধ ব্যবসায়ী পান ধিক্কার।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখব স্বাধীন সার্বভৌম নবীন এই রাষ্ট্রটিকে অস্থির ও বানচাল করে দেওয়ার জন্যও ভেতরে-বাইরে ষড়যন্ত্র ও শত্রুতা চলছিল। বুঝে হোক আর না বুঝে হোক, প্রথম পর্যায়ে এতে জাসদ জড়িয়ে ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের এই শক্তিকে ও তাদের আদর্শকে রাজনীতি, সমাজ, সরকার ও রাষ্ট্রে পুনর্বাসিত ও প্রতিষ্ঠিত করেছেন জিয়াউর রহমান। বেগম জিয়া আজ অবধি সেই একই রাজনীতিই আঁকড়ে ধরে আছেন। তাঁর জোটভুক্ত রয়েছে একাত্তরের ঘাতক-দালালদের দল, তাঁর দলে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছে যুদ্ধাপরাধী এবং তিনি আজ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে চলেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী এই সর্বনাশা দেশবিরোধী রাজনীতি চালিয়েও তিনি ও তাঁর দল দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ ভোটারের সমর্থন ভোগ করে চলেছেন। হতাশা-তিক্ততার বিষচক্রে খাবি খাওয়া জাতির এ ধরনের পরিণতি হওয়া বিচিত্র নয়। বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করার কাজ করেছে, যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার রাজনীতি করছে, পঁচাত্তরের খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে, ধর্মান্ধ জঙ্গিদের সহায়তা দিয়েছে, হত্যার রাজনীতি ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রকে লালন করেছে। এসবকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আইনের শাসন এবং এ দেশের হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে বৈরিতা ও বিশ্বাসঘাতকতা বলা যায়।
আওয়ামী লীগ বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলের মধ্যেও অবক্ষয় হয়েছে, দূষণ সংক্রমণ সবই ঘটেছে এবং দুর্ভাগ্যজনক হলো, তাতে হতাশার ও স্বপ্নভঙ্গের বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু একে তপ্ত তাওয়া ভেবে পরিত্রাণের জন্য জ্বলন্ত উনুনে লাফ দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ২০০১ সালে তেমন একটা লম্ফ দিয়েছিল জাতি; জাতির আশা, বিবেক এবং মর্যাদাবোধ ভালো মতো পুড়েছে। কিন্তু বিষচক্র তো বিষচক্রই। আওয়ামী লীগ যদি তপ্ত তাওয়ার মতো অসহনীয় হয়ে উঠতে থাকে, তাহলে আগের ভুল মানুষ আবার করবে।
কিন্তু আমার মনে হয়, চুলার ওপরে থাকা তাওয়াটা ঠান্ডা করার কাজ চলছে, এটুকু যদি মানুষ বুঝতে পারে এবং সত্যিই যদি তা ঘটে, তবেই সে ব্যাধিগ্রস্ত রাজনীতির আঁচ কিছুটা সহ্য করতে সম্মত হবে। একদিকে একটু ধৈর্য লাগবে আর অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলকেও খোলা গরম হয়ে ওঠার মতো কাজে বিরত থাকতে হবে। মানুষকে স্বস্তি দিতে হবে, তার আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে এবং এমনভাবে স্বপ্ন জাগাতে হবে, যা আশার আলোটিকে ধরে রাখবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিকে এই রগচটা খামখেয়ালিপনার মেজাজ থেকে বের করে আনতে হলে অপর বড় দল বিএনপিকে বাংলাদেশের ইতিহাস ও জাতির মানসযাত্রার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নীতি-কর্মসূচি নিতে হবে, ষড়যন্ত্র এবং জঙ্গি ও যুদ্ধাপরাধী তোষণের রাজনীতি থেকে সরে আসতে হবে। দ্রব্যমূল্য, শিল্পায়ন, বৈদেশিক শ্রমবাজার, নারী নির্যাতন, সামাজিক অপরাধ, দুর্নীতি ইত্যাদি অসংখ্য ইস্যু আছে, যা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এবং যেসব ইস্যুতে দুই প্রধান দল নিজ নিজ দক্ষতা, কৃতিত্ব ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে জনগণের দরবারে আসতে পারেন। এটাই হবে সুস্থধারার রাজনীতি। রাজনীতি সুস্থ হলে, দেশ ও জাতি হতাশা-নেতির বিষচক্র থেকে দ্রুতই বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments