এখনই শিক্ষা নিতে হবে by এম এম আকাশ

রূপগঞ্জের প্রকল্পটি প্রথমে ছিল সেনা আবাসন প্রকল্প। সেনাবাহিনীতে কর্মরত কর্মকর্তাদের আবাসনের প্রকল্প। সেনাবাহিনীতে যাঁরা কর্মরত, তাঁদের থাকার জায়গার অভাব নেই। তার পরও প্রত্যেক মানুষেরই নিজস্ব বাড়ির আকাঙ্ক্ষা থাকা স্বাভাবিক। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদেরও সেই আকাঙ্ক্ষা ছিল।


এ রকম আকাঙ্ক্ষা তো সরকারের বিভিন্ন শাখার সব কর্মকর্তাসহ সব নাগরিকেরই আছে। আমাদের মতো স্বল্প জমির দেশে সবাইকে যদি এভাবে জমি দিতে হয়, তাহলে চাষাবাদ ও অন্যান্য প্রয়োজন মিটবে কীভাবে? কোত্থেকে আসবে সেই জমি। সেই জমি বরাদ্দের নীতিই বা কী হবে? ক্ষমতা ও অর্থের ভিত্তিতে কি তা হবে? এ সমস্যার কোনো মীমাংসা এখনো হয়নি।
রূপগঞ্জের ওই প্রকল্পে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারাই নন শুধু, বিমান, নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদেরও আবাসনের চিন্তা ছিল। ২৭ হাজার প্লট বা ছয় হাজার বিঘার এক বিশাল আবাসন প্রকল্প। এত বিশাল জায়গা তাঁরা কীভাবে দাবি করছেন? সরকার যদি সেটা দিতে না পারে, তাহলে তাঁরা কি ব্যক্তিগতভাবে সেটা নিতে পারেন? মুক্তবাজার অর্থনীতিতে জমির বাজারে গিয়ে অন্যদের মতো তাঁরাও জমি কিনতে পারেন। যাঁরা বিক্রি করতে ইচ্ছুক, তাঁরা চাইবেন সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে বিক্রি করতে।
আমাদের দেশে জমির বিশেষ প্রকৃতি বুঝতে হবে। স্বেচ্ছায় জমি ক্রয়-বিক্রয় হতে পারে। কিন্তু জমির বাজার যেহেতু সংকীর্ণ, সেহেতু ক্রেতাদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা থাকায় জমির দাম অনেক বেশি থাকবে। এ ছাড়া মধ্যস্বত্বভোগীরাও আছে। তারা বিক্রেতাকে কম দাম দিয়ে বেশি দামে বিক্রি করতে চাইবে। আবাসন কোম্পানিগুলোও এ রকম মধ্যস্বত্বভোগী। এখানে মুনাফার মাত্রা এত বেশি যে রিয়েল স্টেট কোম্পানির মধ্যে এই প্রতিযোগিতা এখন ভূমিদস্যুতায় পরিণত হয়েছে। এদের সামনে ছোট জমির মালিক বা কৃষিজমির মালিক, কৃষক পরিবারগুলো অসহায়। সেই বাজারে যখন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা প্রবেশ করবেন, তখন তাঁদের খুবই সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার ছিল। তাঁদের মনে রাখা উচিত ছিল, নিকট অতীতে কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে শিল্প নির্মাণ বিষয়ে বহু বিরোধ শুধু বাংলাদেশে নয়, পশ্চিমবঙ্গেও ঘটেছে। এবং সেটা রাজনৈতিক মাত্রাও পেয়েছে। কৃষিজমি নিয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়ি তৈরি নিয়েও সে রকম সংকট হতে পারে।
ঢাকার চারপাশে এ রকম অজস্র ধনাঢ্য ব্যক্তি নিজস্ব বাগানবাড়ি ও অবকাশযাপন কেন্দ্র তৈরি করে রেখেছেন। এতে জমির দামও যেমন অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি নানা রকম সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। এগুলো এতই তীব্র সংকট সৃষ্টি করতে পারে যে রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তনের মতো বড় সংকটও তৈরি হওয়া বিচিত্র নয়।
এ জন্যই সভ্য দেশগুলোয় একটা সমন্বিত ভূমি ব্যবহার আইন প্রণয়ন করা হয়। চীন, সিঙ্গাপুর ও জাপানের মতো জনঘনত্বপূর্ণ দেশে এ ধরনের আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশে যত দিন তা না হচ্ছে, তত দিন সরকারকে সাবধানতার সঙ্গে কতগুলো বিষয় দেখভাল করতে হবে। যেমন: ১. রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলোর ভূমিদস্যুতার মাধ্যমে যেখানে-সেখানে ভূমি দখল বন্ধ করতে হবে। ২. সরকারের যত খাস জমি আছে, সেগুলো চিহ্নিত করে জবরদখলকারীদের হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে। ৩. বাতিলের পথে পুরোনো শত্রু সম্পত্তি আইন ব্যবহার করে যেখানে যত ভূসম্পত্তি জবরদখলকারী আছেন, তাঁদের কাছ থেকে সেসব ভূসম্পদ উদ্ধার করতে হবে। ৪. এসবের পর সরকারের হাতে যে জমি থাকবে, সেখানে সরকারিভাবে জমি বরাদ্দ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীরা ও সেনাসদস্যরাও তাঁদের আবাসগৃহ বা অন্য কোনো ব্যবহারের জন্য জমি ব্যবহারের অনুমতি পেতে পারেন। তবে সংবিধান ও হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসারে অগ্রাধিকার দিতে হবে ভূমিহীনদের। যাদের এইর মধ্যে বাড়ি বা জমি বা থাকার জায়গা আছে, নিশ্চয়ই এ ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া ইনসাফ হবে না।
রূপগঞ্জের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় সবচেয়ে বড় ভুল করেছে সেনাবাহিনী নিজেই। জমি কেনা বা জমি হস্তান্তরের বেলায় তারা নিজেরাই মাঠে নেমে সেনাক্যাম্প স্থাপন করেছে। অভিযোগ এসেছে, সেনাক্যাম্প থেকে সেনাসদস্যরা সাদা পোশাকে গিয়ে ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসে চাপ প্রয়োগ করেন, যাতে অন্য কেউ জমি কিনতে না পারেন। এতে অনেক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। নিম্নপর্যায়ের বিক্রেতারা ভেবেছেন, তাঁদের কম দামে জমি বিক্রিতে বাধ্য করা হচ্ছে এবং তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। দ্বিতীয় রিয়েল এস্টেট কোম্পানি ও অন্য মধ্যস্বত্বভোগীরাও বিক্ষুব্ধ হয়েছেন। কারণ, তাঁদের বাড়া ভাতে ছাই পড়েছে। স্বভাবতই এ রকম অবস্থায় প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠার কথা এবং গড়েও উঠেছিল। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, সেই আন্দোলনে গুলিবর্ষণ হয়েছে, একজন নিহত, দুজন নিখোঁজ এবং তিন-চার হাজার মানুষের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এই পুরো ট্র্যাজেডিই এড়ানো যেত, যদি সেনাবাহিনী নিজে উদ্যোগী হয়ে জমির বাজারে অংশ না নিত। এবং সরকার যদি তার ভূমি ব্যবহার নীতি অনুযায়ী জমি বরাদ্দের বিষয়টা খেয়াল রাখত।
সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুসারে, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই তারা এত দূর অগ্রসর হলো কীভাবে, তা ভেবে বিস্মিত হতে হয়। তবে আমাদের মতো দেশে জমি নিয়ে মারামারি যে হবে এবং ক্ষমতাবানেরা যে জমি দখল করে নেবে, সেটা তো জানা কথা। সেই চূড়ান্ত ট্র্যাজেডি থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে, একটি আমূল ভূমি সংস্কার নীতি প্রণয়ন করা। সেই নীতিতে শহুরে জমি, তিন ফসলি, দুই ফসলি, এক ফসলি ও পরিবেশগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ জমি ইত্যাদি ভেদে বিশেষ বিশেষ জমির বিশেষ বিশেষ মাথাপিছু মালিকানার সীমা বা সিলিং ঠিক করে দিতে হবে। এবং এই সিলিংয়ের উদ্বৃত্ত জমি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পরিকল্পিতভাবে সরকার বিতরণ করবে। এরই পরিপূরক হচ্ছে পরিকল্পিত ভূমি ব্যবহারবিষয়ক আইন। একজন চাইলেই বড় জমি নিয়ে বিশাল ছড়ানো একতলা বাড়ি করতে পারবেন না। গ্রামে বা শহরে গুচ্ছ আবাসস্থলের দিকে আমাদের অগ্রসর হতে হবে। আনুভূমিক বিস্তার নয়, উল্লম্বিক প্রবৃদ্ধির দিকে নজর দিতে হবে।
সম্প্রতি বিবিসি প্রচারিত ভাষ্য থেকে আমরা আরও দেখতে পাচ্ছি, আমাদের দেশে ফৌজি বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। আমাদের সামনে পাকিস্তানি সেনা-বাণিজ্য মডেলের ব্যর্থতা ও কুফলগুলো এরই মধ্যে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত ও প্রকাশিত হয়েছে। একই ভুলের পুনরাবৃত্তি আমাদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক হবে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি। একই ভুলের পুনরাবৃত্তি আমাদের দেশে মোটেই কাম্য নয়।
এম এম আকাশ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.