গোধূলির ছায়াপথে-রঙের সওদায় মিলেমিশে আছি by মুস্তাফা জামান আব্বাসী

জীবনকে যে যেভাবে দেখতে চায়—কারও সঙ্গে মিল নেই কারও। রঙের সওদায়, জিভের সওদায় আছি মিলেমিশে। এশীয় দ্বিবার্ষিক শিল্প প্রদর্শনীতে যে শিল্পীরা এসেছেন, তাঁদের সঙ্গে দুপুরের খাওয়া একসঙ্গে ঢাকা ক্লাবে। বঙ্গোপসাগরের নাতি-অতল গহ্বর থেকে আহরিত চিংড়ি, পদ্মার রুই, কামরাঙ্গীরচরের স্বাস্থ্যবান মোরগ, মুগের ডাল,


সরু চালের পোলাও, সাদা ভাত, পাঁচ ভ্যারাইটির তাজা সালাদ, ছয় রকমের ‘মুমিঠা’, সাত রকমের পানীয়ের সামনে মুগ্ধ বিদেশি শিল্পীরা। ভাষা, পোশাক, চেহারা আলাদা হলে কী হবে, বাঙালি খাবার মন কেড়ে নেয় সবার। ছিলেন জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনামের শিল্পীরাও। তাঁদের দেশের খাবারও জিভের অন্তর্লীনে অবস্থানরত পাতলা রস বের করে আনে বৈকি। নানা রেস্টুরেন্টে খেয়েছি যে, সেগুলো তো ভোলার নয়। ইউরোপের খাবার সে তুলনায় বার্লি। শুকনো ও রসবিহীন খাবারের টেবিল আরব দেশ থেকে যাঁরা এসেছেন তাঁদের কাছে বাঙালির খাওয়া, ঘ্রাণ-দর্শন-রসনার সমভিব্যহার, যাকে বলে ‘ঘ্রাণং অর্ধভোজনং’, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতমদের মধ্যে।
পাশে তিন চৌধুরী। ছবি আঁকিয়েদের গুরু কাইয়ুম, টেলিভিশনের গুরু জামিল ও চৌকস সিভিল সার্ভেন্ট-লেখক ইনাম আহমেদ।
প্রথম চৌধুরী কাইয়ুম বললেন, নতুন লেখা কী? বললাম, আপনার লেখা চিত্রা নদীর সঙ্গে তুলনীয় অবশ্যই নয়, তবু নদী নিয়ে লিখে চলেছি বৃহৎ ক্যানভাসে, ‘নদী-উপনদী’। কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচ্ছদ আছে বলেই জীবন নদীর উজানের তৃতীয় সংস্করণ চলছে। কাইয়ুম ভাই প্রতিবাদ করলেন। বললেন, ভেতরে জিনিস আছে।
দ্বিতীয় চৌধুরী জামিল বললেন, প্রথম যেদিন টেলিভিশন শুরু হলো, সেদিন আপনার বোন প্রথম গান গাইলেন। কত টাকা দিয়েছিলাম জানেন? ১০০ টাকা। সবাই বললেন, এত টাকা দিলেন? আমি বললাম, ক্ষতি কী? এতে কোম্পানির কোনো ক্ষতি হবে না। আমি জানালাম, হাইসন্সের আলো নামে যে বিজ্ঞাপনটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল সেটি আমার লেখা ও সুর। গেয়েছিলেন আবদুল জব্বার ও শাহনাজ বেগম [তখনো রহমতুল্লাহ হননি]। আর দিয়েছিলাম ১০০ টাকা করে। এমনি আরও পুরোনো দিনের কথা।
তৃতীয় চৌধুরী ইনাম আহমেদের পরনে স্মার্ট স্যুট, মুখে সব সময় প্রসন্নভাবটি লেগে থাকে। বললাম, ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত আপনার জীবনকাব্যের প্রচ্ছদ কে করেছেন? কাইয়ুম ভাইয়ের দিকে অঙ্গুলি।
কী পান করছেন, আব্বাসী ভাই? অনুসন্ধানী চোখ বরফ গলে যাওয়া আমার কমলা রঙের গ্লাসের দিকে, যেখান থেকে বেরোচ্ছে ময়মনসিংহের টমেটো বাগানের টাটকা সুবাস, সঙ্গে মেক্সিকান ট্যাবাস্কোর ঝাঁঝালো অনুষঙ্গ। জিজ্ঞেস করলেন একজন আর্কিটেক্ট, আপনি না সুফি, কেন শুধু টমেটোতে? বললাম, সুফি নই, কিছুই নই। আছি পেয়ালার সন্ধানে, যার মধ্যে আছে তুরবা। তিন জোড়া চোখই আমার দিকে জিজ্ঞাসু।
দুজন সুবেশী বাঙালি তরুণী পরিচয় করিয়ে দিলেন টার্কি থেকে আসা তিনজন মাঝবয়সী শিল্পীর সঙ্গে। পকেট থেকে বের করি দুই, পাঁচ ও দশ টাকার নোট, চিনিয়ে দিই বাংলার দোয়েল পাখি, শাপলা, বায়তুল মোকাররম মসজিদ, শহীদ মিনার, টাঙ্গাইলের সুপ্রাচীন মসজিদ ও বাংলা অক্ষরের সঙ্গে। অল্প খরচে সহজ পরিচয়। প্রফেসর ডক্টর ওগারক্যান আকউজ, তুরস্কের হাসেটেপে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বললেন, সমুদয় অর্থই তো আমাদের পেছনে ব্যয় করলেন। কীভাবে দেবেন এর প্রতিদান, বলে তুর্কি নোট খুঁজতে মানি ব্যাগ খুললেন। তুরস্ক নোটে শোভা পাচ্ছে মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক। বললাম, জানো, বড় ভাইয়ের নাম মুস্তাফা কামাল। নামটি দিয়েছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল। মুস্তাফা জামান আব্বাসী নামটিও টার্কিশ। গত বছর ইস্তাম্বুলে হোটেলের রিসেপশন কাউন্টারের তরুণী জানালেন, মিস্টার আব্বাসী, আপনি তো টার্কিশ, টুপিটি আজারবাইজানের।
সদ্য প্রয়াত নাট্যকার ও চিত্রশিল্পানুরাগী সাঈদ আহমেদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই দ্বিবার্ষিক শিল্পমেলার পত্তন। শিল্পীরা ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে এসেছেন, পরিচর্যার অভাবে সরে যান। এমনকি উদ্বোধনীতেও অনুপস্থিত অনেক চিত্রশিল্পী। কর্তাব্যক্তি ব্যস্ত ভজনে, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের বিশেষ অনুষ্ঠানেও প্রধান কাজ এটিই। সাঈদ আহমেদ তা চাননি, চেয়েছিলেন এই মেলাতে এশিয়ার চিত্রশিল্পীরা হবেন মিলিত, ছবি দেবেন, ছবি নিয়ে হবে আলোচনা। ভারতে, জাপানে, আমেরিকায় কর্তাব্যক্তিরা আসেন না, আসেন শিল্পী। শিল্পীদের অনুষ্ঠান, কর্তাব্যক্তিদের নয়।
টেবিলে কথাবার্তা অন্যদিকে প্রবাহিত। জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের কোন জিনিসটি মনে থাকবে?
বাংলার তরুণীরা, সহজ, সরল, সপ্রতিভ। নিভাঁজ কেশরাজি, শাড়ির বিস্তার, স্মার্ট, অ্যাট্রাক্টিভ। লাখো মানুষ পথে, শত গাড়ি, শত ভিক্ষুক, এমনটি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
কানে কানে ডি এল রায়ের গানটি শোনালাম—‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’। তিনজনই হা হা করে উঠলেন গান শোনার জন্য। বললাম, আরেক দিন।
বেরিয়ে এলাম আরেক সভায়। ওয়েটার, কর্মচারী মিলিয়ে জনাপাঁচেক। ভাবতেই পারিনি হামিদুর রহমান সিনহার লাউঞ্জে অপেক্ষারত লাঞ্চ, বন্ধুদের কলকাকলী ফেলে একজন চিত্রশিল্পী এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করবেন ঢাকা ক্লাবের পেছনের মসজিদে।
নামাজের পর আলাপচারিতায় বললেন, আল্লাহ্র সঙ্গে থাকবে যে, আল্লাহ্ তার সঙ্গে থাকবেন। যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে চাইব এবং নিজের দিকে মনোযোগ দেব, ততক্ষণ কাজ হবে রসকষহীন। নিজ ভাবনা ছেড়ে আল্লাহ্র ভাবনা প্রবেশ করলে, দেখা যাবে, ভেসে আসছে কোনো না-জানা অলিন্দ থেকে ঐশী বাতাস। ‘সবচেয়ে সুন্দর রং তো আল্লাহ্র।’ জীবন চলছে মিলেমিশে, রঙের সওদায়।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: গবেষক, সংগীতব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.