বিল কপালিয়ার জোয়ার-আধার প্রকল্প-আন্দোলন সাত দিনের জন্য স্থগিত, উসকানি দিচ্ছেন ঘের মালিকরা? by ফখরে আলম

'আগে অন্য দুটি বিলে এ ধরনের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই বিলের বেশির ভাগ জমির মালিক ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি। কাজেই আমরা কপালিয়া বিলে জোয়ার-আধার করতে দেব না।' কালের কণ্ঠকে বলছিলেন বিল কপালিয়ার পাশের গ্রাম পাচাকড়ির বাসিন্দা নূর আলম।


বালিদাহ গ্রামের ইউপি মেম্বার সিদ্দিকুর রহমান বলেন, 'অপরিকল্পিতভাবে জোয়ার-আধার প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে জলাবদ্ধতা আরো বাড়বে। নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি না করে এটি করা হলে এলাকাবাসীর কোনো কাজেই আসবে না।' তবে সবাই যে প্রকল্পবিরোধী অবস্থান থেকে আন্দোলন করছে এমনও নয়। মনোহরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বি এম মহিতুজ্জামান বলেন, 'আমরা জোয়ার-আধার চাই। হয়রানি, দালালি দূর করে এলাকাবাসীর মতামত নিয়ে জোয়ার-আধার করতে হবে।' তাঁর অভিযোগ, এত বড় একটি কাজে সাধারণ মানুষের মতামত নেওয়া হয়নি।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে শুরু করে ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির বক্তব্য হলো, 'এ সবই কথার কথা, খোঁড়া অজুহাত। বিলের খাসজমি হাতছাড়া হয়ে যাবে, এ কারণে প্রভাবশালী ঘের মালিকরা এলাকাবাসীকে আন্দোলনে উসকে দিচ্ছেন।'
এদিকে জোয়ার-আধার নির্মাণ প্রকল্পের বিরোধিতা করে বিল কপালিয়া রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক আবদুল কাদের গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁরা আন্দোলন এক সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেছেন। তিনি বলেন, 'জেলা প্রশাসককে আমরা ২ জুনের ঘটনায় দায়ের করা চারটি মামলা প্রত্যাহার, আটককৃতদের মুক্তি এবং টিআরএম বাতিল করে জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানের দাবি জানিয়েছি। তিনি আমাদের কথা শুনেছেন। পরে আমরা এক সপ্তাহের জন্য আন্দোলন কর্মসূচি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'
গত সোমবার জোয়ার-আধার প্রকল্পের প্রতিবাদে বিল কপালিয়া এলাকার অসংখ্য নারী-পুরুষ বিষ হাতে আত্মহনন কর্মসূচি পালন করে। তাদের মধ্যে তিনজন বিষ পানও করেন। এরপর সন্ধ্যায় যশোরের জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজুর রহমান বিল কপালিয়া এলাকাবাসী ও কপালিয়া বিল রক্ষা কমিটির নেতাদের সঙ্গে ওই বিলের পাশে বালিদাহ দাখিল মাদ্রাসা মাঠে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে সভা করেন। ওই সভায় স্থানীয় নেতারা এক সপ্তাহের জন্য আন্দোলন কর্মসূচি স্থগিত করার ঘোষণা দেন। জেলা প্রশাসক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এলাকাবাসীর সব দাবির কথা আমি শুনেছি। তাদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছি, এলাকাবাসীর মতামত নিয়েই জোয়ার-আধার করা হবে। আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথাও বলেছি।'
একই দাবিতে গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতি মনিরামপুর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে। এতে সমিতির মনিরামপুর শাখার আহ্বায়ক আবদুল কুদ্দুস লিখিত বক্তব্যে বলেন, 'হাজার হাজার গ্রামবাসীর নামে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার ও আটককৃতদের নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া না হলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।' এর আগে সমিতির নেতা-কর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল করেন।
ঘের মালিকদের ষড়যন্ত্র : পানি উন্নয়ন বোর্ডের মনিরামপুরের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, প্রভাবশালী ঘের মালিকরাই জোয়ার-আধার প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে দিচ্ছেন না। কপালিয়া বিলের ৪০ শতাংশ জমি সরকারের খাস ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি। ওই জমি দখল করে মাছ চাষ করা হচ্ছে। ৩০-৪০ জন ঘের মালিক ভূমিহীনদের ব্যবহার করে জোয়ার-আধারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলছেন। ঘের মালিকদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করা হয়েছে। প্রকল্পের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি জানান, প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে জোয়ার-আধারের কাজ বন্ধ থাকবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বিল কপালিয়া এলাকায় এক হাজার ৫০০ একর জমি রয়েছে। এর মধ্যে ৬০০ একর সরকারের খাস ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি। ঘের মালিকরা জমি লিজ নেওয়ার পাশাপাশি ওই খাসজমি দখল করে মাছ চাষ করছেন। জানা যায়, 'ভবদহ জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প' নামে ৭৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ২০০৫-০৬ অর্থবছরে গ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্পের ৫৮ কোটি টাকা এরই মধ্যে খরচ হয়ে গেছে। পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে বিল কপালিয়ায় জোয়ার-আধার প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, ভবদহ এলাকায় ২৭টি বিল রয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য এসব বিলে জোয়ার-আধার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে কপালিয়া বিলকেই জোয়ার-আধারের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। কপালিয়া বিলের পাশ দিয়ে প্রবাহিত মুক্তেশ্বরী ও শ্রীহরি নদীর জোয়ার-ভাটায় পলি পড়ে জোয়ার-আধারে বিল কপালিয়া উঁচু হবে। এতে জলাবদ্ধতা দূর হওয়ার পাশাপাশি বিলে ফসল ফলবে। জোয়ার-আধারে ফসল ও মাছের ক্ষতিপূরণ বাবদ জমির মালিককে সরকার বিঘাপ্রতি বছরে ১৬ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। এমনকি দুই বছরের টাকা অগ্রিম দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এর পরও এলাকাবাসী জোয়ার-আধার প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে দিচ্ছে না।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, জলাবদ্ধতা দূরীকরণে জোয়ার-আধারের বিকল্প নেই। কিন্তু ঘের মালিকরাই তা বাস্তবায়ন করতে দিচ্ছেন না। জমির ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে হয়রানির কারণে অনেকেই এর বিরোধিতা করছে।
এদিকে গত সোমবার আত্মাহুতি কর্মসূচির সময় বিষ পান করে অসুস্থ হয়ে পড়া এলাকার কৃষক মকছেদ সরদার, আমির আলী ও জিয়াউর রহমান বালিদাহ গ্রামের পল্লী চিকিৎসকের চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গেছেন।

No comments

Powered by Blogger.