দায়িত্বশীল সংসদই গণতন্ত্রের সুরক্ষা-গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা

গণমাধ্যম ও গণতন্ত্র বিশ্বের সব দেশেই পরিপূরক শক্তি। বাংলাদেশে সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা শুধু অনির্বাচিত শাসনামলে নয়, নির্বাচিত শাসনামলেও হুমকির মুখে পড়েছে। এখনো সেই বিপদ পুরোপুরি কেটে গেছে, বলা যাবে না। গণতন্ত্র যখন বিপদে পড়ে, তখন সংসদ থাকে না, সামরিক ফরমান দিয়ে এর বিলুপ্তি ঘটানো হয়।


কিন্তু আমাদের স্বৈরশাসকেরা জানেন, জনগণ বেশি দিন বাড়াবাড়ি মেনে নেয় না। গণতন্ত্র তাদের ধমনিতে, তাদের স্বপ্নে ও চিন্তায়। সংবিধানবহির্ভূত শক্তি মিডিয়ারও কণ্ঠরোধ করে। প্রেস অ্যাডভাইস পাঠায়। এসব সত্ত্বেও সাময়িক ধকল কাটিয়ে গণমাধ্যমই প্রথম বাকস্বাধীনতার নিশান উড়িয়ে স্বৈরশাসনের প্রতিবাদ জানায়। তাই বলা যায়, সাংবাদিকেরাই গণতন্ত্রের অগ্রদূত। তাঁরাই জাতীয় নেতা-নেত্রীদের বক্তব্য ও আশা-আকাঙ্ক্ষা জনগণের কাছে পৌঁছে দেন। এক-এগারোর পর জরুরি অবস্থাতেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।
আমাদের দেশের বাস্তবতায় এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, রাজনীতিকেরা রাজনীতি ও গণতন্ত্রের যত ক্ষতি করেছেন, সংবাদকর্মীরা কখনো তা করেননি। স্বাধীনতার আগে থেকেই এ দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা তুলে ধরেছেন তাঁরা। সুতরাং গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নস্যাৎ করার ঢালাও অভিযোগ কেবল দুঃখজনক নয়, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যমূলক। অনেকে বলার চেষ্টা করেছেন, সাংসদেরা আসলে ঢালাও অভিযোগ করেননি। কিন্তু এটা অস্বীকার করা যাবে না, সংসদে যেভাবে বিষয়টি এসেছে, সেটি দেশবাসীর কাছে অযৌক্তিক ও অসত্য উক্তি বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। সাংসদদের কোনো কোনো বক্তব্য বিদ্যমান আইন ও রেওয়াজের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। ২১ অক্টোবর প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে দেশের প্রথিতযশা সাংবাদিকেরা সংসদে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অসত্য বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করার কথা বলেছেন। সপ্তম সংসদে প্রয়াত স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে অনভিপ্রেত আক্রমণ এক্সপাঞ্জ করে অনুসরণীয় নজির রেখে গেছেন। ঢালাও অভিযোগ না এনে জরুরি অবস্থায় গণমাধ্যমের কী ভূমিকা ছিল, তা নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা হলে আমরা স্বাগত জানাব। একই সঙ্গে সংবাদপত্রের দায়বদ্ধতার বিষয়টিও আমরা বিস্মৃত হচ্ছি না। যেকোনো ভুলের জন্য তারও প্রচলিত আইনে জবাবদিহি করতে হবে।
প্রবীণ সাংবাদিক ও সাবেক সাংসদ এবিএম মূসা সংসদের আক্রমণের পর যে বৈপরীত্য তৈরি হয়, তা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে তথ্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদসহ বক্তারা কার্যত একই সুরে ওই সরস অভিমতই পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তাঁরা বলেন, গণমাধ্যমই শক্তিশালী করছে গণতন্ত্রকে। এক-এগারোর জরুরি অবস্থা থেকে উত্তরণে গণমাধ্যম যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তা-ও অস্বীকার করা যাবে না। ‘কালো টাকা এখন সবখানে, গণমাধ্যমও এর বাইরে নয়’—তথ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করার উপায় নেই। সে ক্ষেত্রে কালো টাকার অদৃশ্য হাত গণমাধ্যমের ওপর অশুভ প্রভাব ফেলছে, সেটিও সত্য। গণতন্ত্রকে টেকসই করতে হলে সংসদ ও গণমাধ্যমকে যেমন ঐক্যবদ্ধভাবে লড়তে হবে, তেমনি কালো টাকার দৌরাত্ম্যও রুখতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.