পদ্মা সেতু : হুইপ লিটনের ভাই নিক্সনকে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ-আবুল হোসেনসহ অনেককে ডাকা হচ্ছে! by মোশতাক আহমদ

দেশের বৃহত্তর নির্মাণ প্রকল্প পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে- বিশ্বব্যাংকের এমন অভিযোগের বিষয়ে নতুন করে তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরই অংশ হিসেবে গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় সংসদের সরকারদলীয় হুইপ নুর-এ-আলম চৌধুরী লিটনের বড় ভাই ব্যবসায়ী নিক্সন চৌধুরীকে দুদক কর্মকর্তারা


জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এর আগে গত বৃহস্পতিবার প্রয়াত রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ছেলে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
দুদক সূত্র জানায়, পদ্মা সেতুর অনিয়মের বিষয়ে সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক থেকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়। সরকারের মাধ্যমে প্রতিবেদনটি হাতে পেয়ে দুদক কর্মকর্তারা তৎপর হয়ে ওঠেন। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক সেতু বিভাগের সচিব ও বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াসহ আরো বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিশ্বব্যাংক আমাদের কিছু তথ্য দিয়েছে। তার ভিত্তিতে আমরা তদন্ত জোরদার করেছি।' এই তদন্তে 'যাদের' প্রয়োজন, তাদেরই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন ।
আবুল হোসেন যোগাযোগমন্ত্রী থাকার সময়ে কানাডা ও যুক্তরাজ্যের যৌথ অংশীদারির প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য পরামর্শক নিয়োগ করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, এ কম্পানিকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিষয়ে আবুল হাসান চৌধুরী ও নিক্সন চৌধুরীসহ অনেক 'ভিআইপি ব্যক্তি' সহযোগিতা করেন। আবুল হাসান চৌধুরী পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগ বিষয়ে সড়ক ভবনে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একাধিক মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন বলেও জানা যায়। একই অভিযোগ রয়েছে নিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধেও।
দুদক সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা গত বছর লাভালিনের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে কানাডা পুলিশের সহযোগিতা চান। কানাডার পুলিশ লাভালিনের অফিসে তল্লাশি চালিয়ে বেশ কিছু কাগজপত্র জব্দ করাসহ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক ইসমাইল ও রমেশ নামের দুজনকে আটক করে। আটক ইসমাইল বাংলাদেশের ব্যবসায়ী নিক্সন চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা কানাডার পুলিশকে জানান। দুদক সূত্র জানায়, ইসমাইলের সঙ্গে কী সম্পর্ক আছে বা ব্যবসায়িক কোনো সম্পর্ক আছে কি না সে বিষয়ে জানতেই নিক্সন চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক।
গতকাল দুদক কর্মকর্তারা নিক্সন চৌধুরীকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন বলে জানা গেছে। তবে দুদক কর্মকর্তারা তাঁকে কেন ডেকেছিলেন বা ঠিক কী বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, এসব নিয়ে সাংবাদিকদের কিছু জানাননি নিক্সন চৌধুরী।
দুদকের ডাকে গিয়ে কথা বলার সত্যতা কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ১৯৯৭-৯৮ সালে বিভিন্ন কাজে লবিস্ট (তদবিরকারী) নিয়োগে তাঁর যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল। সে কারণে পরামর্শ নিতে তাঁকে দুদকে ডাকা হয় বলে তিনি দাবি করেন।
জানা গেছে, দুদকের সিনিয়র উপপরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলী ও উপপরিচালক মির্জা জাহিদুল আলম গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত দুদক কার্যালয়ে নিক্সন চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেন। নিক্সন চৌধুরী দুদক কার্যালয় থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের এড়াতে একপ্রকার দৌড়ে গাড়িতে ওঠেন। তিনি পারিবারিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রিতা কনস্ট্রাকশনস ও মহাখালীতে একটি সিএনজি ফিলিং স্টেশনের দেখভাল করেন।
দুদক সূত্র জানায়, সেতু ভবন কর্তৃপক্ষের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ও কানাডীয় প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের বাংলাদেশের স্থানীয় প্রতিনিধি জিয়াউল হককেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তাঁদের ঠিকানায় সোমবার দুদক থেকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
জানা গেছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৩০০ কোটি টাকা। ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি মূল্যায়ন কমিটি পরামর্শক হিসেবে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের নাম সুপারিশ করেছিল। এর প্রথমটি ছিল এসএনসি-লাভালিন। অন্যগুলো হলো : যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান হালক্রো গ্রুপ, নিউজিল্যান্ডের একম অ্যান্ড এজেডএল, জাপানের ওরিয়েন্টাল কনসালট্যান্ট এবং যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসের জয়েন্ট ভেঞ্চার কম্পানি হাই পয়েন্ট রেলেন্ড।
দুদকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পদ্মা সেতুর প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগের দরপত্র-প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর আবুল হাসান চৌধুরী সেতু ভবনে সৈয়দ আবুল হোসেনসহ সেতু বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তা ও এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তাদের মধ্যে হওয়া একটি বৈঠকে মধ্যস্থতা করেন।
দুদকের কমিশনার সাহাবুদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, লাভালিনের লোকাল এজেন্ট জহির উদ্দিন সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসানের আত্মীয়। দুদকের কর্মকর্তারা অনুসন্ধানে জানতে পেরেছেন, সাবেক এ প্রতিমন্ত্রী তাঁর আত্মীয়ের পক্ষে কাজ পাইয়ে দিতে দু-দুবার রাজধানীর সড়ক ভবনে পদ্মা সেতু সম্পর্কিত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। তাই দুদক জানতে চেয়েছে, আবুল হাসান ওই সব বৈঠকে কেন গিয়েছিলেন এবং ওই সব বৈঠকে কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল।
দুদক সূত্র জানায়, দেশের সর্ববৃহৎ নির্মাণ প্রকল্প পদ্মা সেতুর অর্থ জোগানদাতা বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে গত বছরের ২১ অক্টোবর তাদের অর্থায়ন স্থগিত করে। সরকারের পক্ষ থেকে দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করা হলেও বিষয়টি খতিয়ে দেখতে দুদককে দায়িত্ব দেওয়া হয়। বিশ্বব্যাংকও দুদককে চিঠি পাঠায়।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির বিষয়ে অভিযোগ পাওয়ার পর তা অনুসন্ধানের জন্য সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। এ ক্ষেত্রে অনুসন্ধানকাজ দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। একটি পদ্মা সেতু নির্মাণে পরামর্শক নিয়োগ-প্রক্রিয়া ও অন্যটি ঠিকাদার নিয়োগ (মূল প্রকল্প) সংক্রান্ত।
পরামর্শক নিয়োগ-প্রক্রিয়া বিষয়ে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় দুদকের উপপরিচালক (তৎকালীন সহকারী পরিচালক) মির্জা জাহিদুল আলমকে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগে দুর্নীতির ঘটনা অনুসন্ধানের দায়িত্ব পান উপপরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলী। অনুসন্ধান শেষে উপপরিচালক শিবলী গত জানুয়ারি মাসে অভিযোগটি নথিভুক্ত করার সুপারিশ জানিয়ে কমিশনে প্রতিবেদন জমা দেন। সে অনুযায়ী অভিযোগটি নথিভুক্ত হয়। প্রথম দফা তদন্তের পর গত ২ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে দুদক জানিয়েছিল, মূল সেতু নির্মাণে প্রাক-যোগ্য প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে কোনো রকম দুর্নীতি হয়নি। তবে পরামর্শক নিয়োগে অনিয়ম নিয়ে দুদক অনুসন্ধান চালাবে বলে জানিয়েছিল। দুদকের ঠিকাদার নিয়োগে দুর্নীতি হয়নি মর্মে তদন্ত প্রতিবেদন বিশ্বব্যাংকের কাছেও প্রেরণ করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.